#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩০
#আদওয়া_ইবশার
অশান্ত মস্তিষ্ককে কোনোমতে শান্ত করে এক ঘন্টার পরীক্ষা শেষে হল থেকে বেরিয়েছে দৃষ্টি। আদালতে কি হয়েছে ভাবনা, চিন্তায় বুকের ভিতরটা অবিরাম কাঁপছে। রাস্তায় শিক্ষার্থী সহ অভিভাবকদের উপচে পরা ভীড়। ভয়ার্ত চোখে আশেপাশে তাকিয়ে পরিচিত কোনো মুখ খুজতে ব্যস্ত দৃষ্টি। মিনিট দুইয়েক পাড় হতেই দেখতে পায় ব্যস্ত ভঙ্গিতে রাকিব এগিয়ে আসছে তার দিকে। দ্রুত পা চালিয়ে দৃষ্টি নিজেও এগিয়ে যায় সেদিকে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রথমেই জানতে চায়,
“কি হয়েছে কোর্টে? ওনার জামিন হয়েছে তো?”
দৃষ্টির প্রশ্ন রাকিবের কানে গেল কি না কে জানে! প্রশ্ন দুটো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাকিব ভাঙা স্বরে বলে,
“ভাই হাসপাতালে। জ্ঞান নাই। অবস্থা খুব একটা ভালো না। তাড়াতাড়ি আসেন।”
বলতে বলতেই রাকিবের চোখে জমে থাকা অশ্রুজল টুপটাপ ঝরে পরে কার্নিশ বেয়ে। অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে থাকে দৃষ্টি। এতোক্ষনের বুকের ভিতরের অস্থিরতাটা এবার যেন শ্বাস রোধ করে নেয়। মনে হয় পৃথিবীতে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের বড্ড অভাব। হাঁসফাঁস করে দৃষ্টি। পাগলের মতো হাটু গেড়ে বসে পরে সেখানেই। সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে বেজে ওঠে বিধ্বস্ত এক কিশোরীর আর্তনাদ। বুকে জমে থাকা কষ্ট গুলো একে একে বেরিয়ে আসে প্রতিটা চিৎকারের সাথে। ছোট্ট হৃদয়ে কষ্টের বোঝাটা হয়তো একটু বেশিই হয়ে গেছিলো। সেই ভার সহ্য করতে না পেরে জনসম্মুখেই হিতাহিত জ্ঞান ভুলে দুঃখ বিলাসে মেতে উঠেছে। মাঝ রাস্তায় এক কিশোরী মেয়ের বুক ফাঁটা আর্তনাদে জনগণ বিমূঢ়। অবাক নেত্রে শুধু তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে বিধ্বস্ত দৃষ্টিকে। রাকিব বুঝতে পারে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে খুব বড় এক ভুল করে বসেছে। এখন এই ভঙ্গুর হৃদয়ের মানবীকে কিভাবে সামলাবে সে? ইতিমধ্যে দৃষ্টিকে ঘিরে জটলা বেঁধে গেছে। কেউ কেউ এগিয়ে এসে জানতে চাইছে, কি হয়েছে? আবার কেউ কেউ দূর থেকেই মায়া মায়া দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে দুঃখবিলাসিনীকে। কয়েকজন মহিলার সহযোগীতায় একটা সিএনজি ঠিক করে দৃষ্টিকে তুলতে সক্ষম হয় রাকিব। হাসপাতালে যাবার পুরোটা সময় চিৎকার করে কেঁদে গেছে দৃষ্টি। অস্পষ্ট স্বরে কি যেন বারবার বলেছে। বুঝতে পারেনি রাকিব। বিষাদের প্রলেপ ঘেরা মুখটা দেখে কি যে মায়া হয় রাকিবের! এতোদিন এই মেয়েটাকে দেখলেই তার রাগ হতো। ইচ্ছে হতো পায়ে পা মিলিয়ে ঝগড়া করার। তবে আজ খুব করে চাইছে কোনো এক জাদুবলে ঘুচে যাক বিষাদিনীর সমস্ত বিষাদ।
হাসপাতালের সামনে সিএনজি থামতেই পাগলের মতো ছুটে যায় দৃষ্টি। জ্ঞানশূণ্য হয়ে যেদিকে দুচোখ যাচ্ছে সেদিকেই ছুটছে। রাকিব কোনোমতে সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত বেগে এসে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েই দৃষ্টির একটা হাত শক্ত করে ধরে নেয়। বলে,
“এমন পাগলামি করবেন না। মানুষ খারাপ বলছে।আমার সাথে আসুন। ভাই চতুর্থ ফ্লোরে। এখানে না।”
রুদ্ধশ্বাসে রাকিবের সাথে লিফটের ভিতর দাঁড়িয়ে যায় দৃষ্টি। এতোক্ষন যাবৎ এক সুরে চিৎকার করে কান্নার ফলে নেতিয়ে গেছে। গলা চিরে এখন আর চিৎকারের শব্দ আসছেনা। তবে ফোঁপানোর শব্দটা রয়ে গেছে। লিফট চতুর্থ ফ্লোরে থামতেই দুজন সমান গতিতে কয়েক লাফে আইসিইউ এর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চারিদিকে নজর ঘুরিয়ে দৃষ্টি দেখে নেয় শক্ত খোলসে আবৃত প্রতিটা পুরুষের চোখে আজ অশ্রু। মেহেদী, জাবির, শান্ত সহ আরও কিছু পরিচিত-অপরিচিত মুখ দাঁড়িয়ে। পাশেই চেয়ারে শরীর ছেড়ে বসে আজীজ শিকদার। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে নিঃশব্দে। আজীজ শিকদারের দেখা পেয়ে দৃষ্টি যেন এবার একটু ভরসা খোঁজে পায়। ছুটে গিয়ে জানতে চায়,
“বাবা!ওনি কোথায়? কি হয়েছে ওনার? আমি দেখব। একটাবার দেখব শুধু।”
কান্নায় এইটুকু সময়েই গলা বসে গেছে দৃষ্টির। কন্ঠস্বর কেমন রুক্ষ শুনাচ্ছে। কোনো জবাব দেয়না আজীজ শিকদার। কতক্ষণ জবাবের আশায় তাকিয়ে থেকে ধৈর্য্যহারা হয়ে মেহেদীর কাছে ছুটে যায় দৃষ্টি। অনুরোধের স্বরে বলে,
“ভাইয়া! আপনিও চুপ করে থাকবেন না প্লিজ। বলুন ওনি কোথায়? আমি শুধু একবার দেখব। আমার নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে আর টেনশন দিবেন না। নিতে পারছিনা আমি আর এসব। মরে যাব। একদম মরে যাব।”
কথা গুলো বলতে বলতেই নিস্তেজ হয়ে ঢলে পরে দৃষ্টি। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসে সমস্ত কিছু। মেঝেতে লুটিয়ে পরার আগেই ধরে নেয় মেহেদী। তড়িৎ দুজন নার্স ডেকে ধরাধরি করে একটা কেবিনে নিয়ে যায়। ডাক্তার দেখে জানায় অত্যন্ত দুর্বল শরীর। স্ট্রেস বেশি হয়ে গেছিল। এতো ধকল সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে। মাঝ সাগরে ডুবতে গিয়েও যেন ডুবছেনা কেউ। কেমন একটা দম বন্ধকর পরিস্থিতি। যেদিকেই তাকায় সেদিকেই যেন বিপদ। একটু একটু করে ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গছে প্রত্যেকের। ক্ষীণ হচ্ছে আশার আলো। রক্তিম-দৃষ্টির গল্পের শেষ পরিণতি কি এটাই? হঠাৎ আসা এই ঝড়েই কি নিঃশেষ হবে তাদের অসমাপ্ত গল্প। দুচোখ জুড়ে হাজার স্বপ্ন বুক ভরা আশা নিয়ে ছন্নছাড়া রক্তিমকে ভালোবেসেছিল যে মেয়েটা, সৃষ্টিকর্তা কি তার ভাগ্যে বিয়ে পরবর্তী দিন গুলোতে এক বিন্দু সুখ রাখেনি? এ কেমন নিষ্ঠুর বিচার তার?
বুক চিরে হতাশার নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে মেহেদীর। দুহাতে মুখ ঢেকে কতক্ষণ চুপ থেকে অন্যদের উদ্দেশ্যে বলে,
“রক্তিমের কথা আপাতত বাড়িতে যেন আর কেউ না জানে। দুজনকে সামলাতেই জান বেরিয়ে যাচ্ছে। বাকীদের সামলানোর ধৈর্য্য আমার আর নেই।”
দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে আসে আইসিইউ থেকে। উদগ্রীব হয়ে ছুটে যায় সকলেই। ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে ডাক্তারকে। অধৈর্য হয়ে মেহেদী জানতে চায়,
“কি অবস্থা ওর? ভালো আছে তো! জ্ঞান ফিরেছে? রিপোর্ট কি এসেছে?”
আস্তেধিরে মুখ থেকে সার্জিক্যাল মাস্ক খুলে প্রতিটা উৎসুক মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে ডাক্তার। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে জানায়,
“সিচুয়েশন ক্রিটিক্যাল। স্ট্রোক হয়েছে। ডান পাশ প্যারালাইজড।আর ঘন্টা খানেক অবজারবেশনে রাখব। এরপর কেবিনে শিফট করব।”
হঠাৎ যেন প্রতিটা মানুষের মাথায় মস্ত বড় আকাশটা ভেঙ্গে পরেছে। শরীর ছেড়ে দেয় প্রত্যেকে। দুহাতে মুখ ঢেকে চোখের জল ছেড়ে দেয় মেহেদী। অশান্ত মন গুলো শান্ত হবার বদলে নতুন করে চোরাঝড়ের সম্মুখিন হয়ে আরও অশান্ত রূপ নিয়েছে। নিভু নিভু জ্বলা আশার প্রদিপটা ঝুপ করেই নিভে গেছে।এটুকুই কি বাকী ছিল? একটা মানুষের জীবনে আর কতভাবে দুর্দশা দিবেন সৃষ্টিকর্তা? একের পর এক আঘাতে মৃতপ্রায় জীবনটা এমন নির্জীবের মতো পরে থাকার থেকে না হয় মরেই যেতো। মৃত্যু অন্তত রেহাই দিত এই অভিশপ্ত জীবন থেকে। কিন্তু হায়! মৃত্যও যেন রক্তিমকে উপহাস করছে। সেও দেখতে চাচ্ছে একটা মানুষ এক জীবনে ঠিক কতটা দুঃখ সইতে পারে।
মুখ থেকে হাত সরিয়ে পাগলের মতো মাথার চুল খামচে ধরে মেহেদী। শরীর কাঁপিয়ে হাটু মুড়ে নিঃশ্বের কান্নায় ভেঙ্গে পরে। হাতের উল্টো পিঠে সিক্ত চোখ মুছে এগিয়ে আসে জাবির। এক হাত মেহেদীর কাধে রেখে ধরা গলায় বলে,
“ভাই! আপনি এভাবে ভেঙ্গে পরলে আমরা কি করব? রক্তিম ভাইয়ের পর তো আপনিই আমাদের একমাত্র ভরসা। আর ভাবি! ভালোবাসার কাঙ্গাল ঐ মেয়েটাকে কে সামলাবে? আপনার কাধে যে এখন অনেক বড় দায়িত্ব। একজন ভাই হয়ে ভাবির পাশে ছায়ার মতো থাকতে হবে। ভাইকে সঠিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ্য করে তুলতে হবে। আমরা ভাইকে খুব বেশিদিন বিছানায় পরে থাকতে দেখতে পারবনা। সবাই মিলে খুব তাড়াতাড়ি ভাইকে সুস্থ্য করে তুলব। আমাদের এতো গুলো মানুষের মনের জোর মিথ্যে হতে পারেনা। ভাই সুস্থ্য হবে। আবার আগের মতো পুরো সাভার জোরে রাজ করে বেড়াবে।”
ক্ষনকাল পর নিজেকে শান্ত করে ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়ায় মেহেদী। শীতল চোখে তাকায় নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা আজীজ শিকদারের দিকে। নিস্তেজ ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
“এটাই তো চেয়েছিলেন আপনি তাইনা! এবার শান্তি পেয়েছেন তো? মনের জ্বালা মিটেছে? নিজের সন্তানকে তিলে তিলে নিজ হাতে মেরেছেন। দেহের মৃত্যু না দিয়ে মনের মৃত্যু দিয়েছেন। এক কুলাঙ্গারের জন্য এক স্বপ্নবাজ ছেলের স্বপ্ন গুলো গলা টিপে হত্যা করেছেন। এখন তো আপনার খুশির অন্ত থাকবেনা। আর কোনো লুকোচুরির ও প্রয়োজন পরবেনা। আদরের কলিজার টুকরা চরিত্রহীন ছেলে আর পুত্রবধূ নিয়ে নিশ্চিন্তে নিজ গৃহে শান্তিতে থাকতে পারবেন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন এখনো এখানে? যান না! দ্রুত যান। রক্তিম নামের গলার কাটা আজ নিথর দেহে পরে আছে হাসপাতালের বেডে। এই খুশিতে পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা অতিব জরুরি।”
কথা গুলো শোনা মাত্রই অত্যাধিক রাগে কিড়মিড়িয়ে সর্বসম্মুখে আজীজ শিকদার থাপ্পড় বসিয়ে মেহেদীর গালে। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলে,
“একদম চুপ! বেয়াদব! একজন বাবাকে বিচার করার ক্ষমতা কবে হয়েছে তোমার? সংগ্রাম যেমন আমার সন্তান তেমন রক্তিম ও আমার সন্তান। বরং সংগ্রামের থেকেও রক্তিমের প্রতি আমার টান একটু হলেও বেশি। কারণ সে আমার বড় সন্তান। তার জন্যই আমি প্রথম বাবা হবার অনুভূতি চিনেছি। প্রথম বাবা ডাক শুনেছি ওর মুখ থেকে। সবাই শুধু একপাক্ষিক ভাবে ওর দিকটাই দেখছো। কারণ ওর দুঃখ গুলো দৃশ্যমান। আর আমার! আমি তো বাবা। বাবাদের কোনো দুঃখ,কষ্ট প্রকাশ করতে নেই। আজ কেউ আমাকে বুঝবেনা। আমার ছেলেও না। বুঝবে সেদিন। যেদিন নিজেরা বাবা হবে। একজন বাবা ছাড়া কখনও অন্য কেউ একজন বাবার দুঃখ বুঝতে পারেনা। সব কিছু ছাপিয়ে আজ সত্যিই আমি অপরাধি। সন্তানদের ভালো করতে গিয়ে, একটা শান্তিপূর্ণ, সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে গিয়ে আজ আমি একজন আদর্শ বাবা থেকে নিকৃষ্ট বাবাতে পরিণত হয়েছি।”
নিরব কান্নার সাক্ষী বহন করছে আজীজ শিকদারের রক্তিম, ফোলা দুটো চোখ। কাঁপছে পুরো শরীর। জোর গলায় এতো গুলো কথা বলায় হাঁপিয়ে গেছে। বুকে চাপ অনুভব হচ্ছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। কিছুই বলতে পারেনা আর। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ধপ করে বসে পরে চেয়ারে। দুহাতে মুখ ঢেকে ছোট বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কেঁদে ওঠে। ভালো করতে গিয়ে ছোট্ট একটা ভুলের কারণে আজ এতো গুলো মানুষের জীবন বিপন্ন। যে ছেলের আঙুল ধরে টুকটুক করে হাঁটা শিখিয়েছিল ছোট্ট কালে। আজ সেই ছেলে পঙ্গুত্ব বরণ করে বিছানায় নিথর হয়ে পরে আছে। শুধুমাত্র নিজের ভুলের কারণে। একটা সময় যে ছেলের গোপন কথার সিন্ধুক ছিল, আজ সেই ছেলের দুঃখের সিন্ধুক হয়ে গেল। তালাবদ্ধ সিন্ধুক খুলে ছেলেকে ভাসিয়ে দিল দুঃখের সাগরে। বাবা-ছেলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বদলে নিঃশেষ করে দিল একেবারে। বাবা হয়ে নিজে হেঁটে বেড়াবে, আর ছেলে পরে থাকবে বিছানায়! কিভাবে সহ্য করতে এই দৃশ্য? ছেলের অচল দেহ দেখার আগে আল্লাহ মৃত্যু দিক এই পাপি বাবাকে। উঠিয়ে নিক পৃথিবী থেকে বাবা নামক ঘৃন্য মানুষটাকে।
****
রক্তিমকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।আপাতত কড়া ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ার ফলে ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছে একদম চিন্তামুক্ত রাখতে হবে। দ্বিতীয়বার কোনো কিছু নিয়ে হাইপার হলে ধুকধুক নিঃশ্বাসটাও হয়তো চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আবার এমনও হতে পারে হৃৎপিন্ডটা সচল থাকলেও ডান সাইডের পাশাপাশি পুরো শরীরটাই অকেজো হয়ে যেতে পারে। বিপদ এখনো উত পেতে আছে। যত সাবধানতা অবলম্বন করা যায় ততই ভালো। আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করার সময় দূর থেকে একবার রক্তিমের নিথর দেহটা দেখার সুযোগ হয়েছে একবার। ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে দ্বিতীয়বার কেবিনে গিয়ে দেখার সাহস কেউ করেনি।
রক্তিমকে কেবিনে শিফট করার কতক্ষণ পরই দৃষ্টির জ্ঞান ফিরে। পিটপিট দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখে মাথার উপর সাদা ছাঁদ। আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করতেই মনে পরে যায় একে একে সমস্ত ঘটনা। সাথে সাথে ধরফরিয়ে ওঠে বসে। তখনই বা-হাতে ব্যথা অনুভব হয়। চোখ কুঁচকে হাতের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় ক্যানুলায় স্যালাইন চলছে। দাঁত চেপে এক টানে ক্যানুলা খুলে ওঠে বসে। ক্যানুলায় বেকায়দায় টান লাগায় গলগলিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই দৃষ্টির। দৌড়ে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন নার্স আটকে দেয় তাকে। বলে ওঠে,
“ম্যাম প্লিজ এভাবে ছুটবেন না। আপনার শরীর দুর্বল। আবারও মাথা ঘুরিয়ে পরে যেতে পারেন।”
দৃষ্টি শুনেনা কারো কথা। দুর্বল শরীরেই কিভাবে যেন শক্তি এসে ভর করে। এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেয় নিজেদের। ছুটে গিয়ে থামে মেহেদীর সামনে। হাপিয়ে যাওয়া স্বরে বলে,
“কোথায় ওনি?”
ফ্যালফ্যাল নয়নে দৃষ্টির মুখের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে মেহেদী। কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ দুটো বন্ধ করে কি যেন ভাবে। পরোক্ষনে চোখ খুলে দৃষ্টির হাত দুটো স্ব-স্নেহে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম সুরে বলে,
“দৃষ্টি! বোন তুমি তো অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে তাইনা? আমি ভাই হয়ে তোমার কাছে একটা আবদার রাখি! আমার আবদারটা ফেলে দিওনা প্লিজ। নিজেকে শক্ত করো। একমাত্র তুমি ছাড়া ঐ অভাগাটার আর কেউ নেই। তোমাকেই সবটা সামলাতে হবে। আমি জানি তুমি পারবে। তুমিতো রক্তিমকে ভালোবাসো। এখন তুমিও যদি এমন ভেঙ্গে পরো অসুস্থ হয়ে যাও তবে রক্তিমকে কে দেখবে? বোন প্লিজ! শক্ত করো নিজেকে।”
একদম শান্ত দৃষ্টি।শীতল চোখে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে থমকে যাওয়া কন্ঠে জানতে চায়,
“বেঁচে আছো তো!”
আৎকে ওঠে মেহেদী। তড়িৎ মাথা ঝাকিয়ে বলে,
“কিসব আজেবাজে ভাবছো! এমন কিছুই হয়নি। স্ট্রোক হয়েছে। এখন ভালো আছে। ডাক্তার বলেছে আর কোনো টেনশন নেই। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে তো। তাই ঘুমাচ্ছে। তুমি যাও। দেখে আসো। তবে ডেকো না। নিজে থেকে উঠলে তখনই কথা বলো।”
হঠাৎ দৃষ্টির এমন অস্বভাবিক শান্ত কন্ঠের এমন ভয়াবহ একটা কথায় মেহেদী বাকিটুকু বলার সাহস পায়না। কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের থেকে অনুমতি নিয়ে দৃষ্টিকে দেখার সুযোগ করে দেয়। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বুকটা মুচড়ে ওঠে দৃষ্টির। বলিষ্ঠ সুদেহী শরীরটা বিছানার সাথে মিশে আছে। দাড়ি ভর্তি মুখটা কেমন ফ্যাকাশে! ধূসর ঠোঁট দুটো কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। বুকের ভিতরের অশান্ত ঝড়টা আবারও টের পায় দৃষ্টি। উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকায়। শরীরটা আবারও দুর্বল হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন শ্বাস নেয়। অপলক তাকিয়ে থাকে ফ্যাকাশে মুখটার দিকে। বুকের ভিতর কান্না আটকে রাখা দায় হয়ে পরছে। সব ভেঙ্গেচূরে তোলপাড় হচ্ছে। কিছুতেই পারছেনা নিজেকে সামলাতে। মুখে ওড়না গুজে ব্যর্থ হয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। অশান্ত মন সৃষ্টিকর্তাকে শুধু বলে, হে আল্লাহ! ধৈর্য্য দাও আমাকে। বাড়িয়ে দাও সহ্যক্ষমতা।
চলবে……
(আপনাদের আবদার রাখতে গিয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে লিখে ফেললাম। রক্তিমের এমন দশা কিন্তু আমি করিনি। সব দোষ আজীজ কাকুর। বকার হলে তাকে বকেন। আমাকে কিছু বইলেন না প্লিজ!)