তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ৩১.

0
481

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

৩১.
দিহানের রুমের দক্ষিণ পাশ জুড়ে বিশাল এক খোলা বারান্দা রয়েছে। বারান্দা থেকে দিনের আলো রুমটাকে সর্বদা উজ্জ্বল করে রাখে। বারান্দার থাই খোলা। রেহানা খুলে রেখে গেছে। দু একখন্ড কোমল রোদ এসে পড়েছে বিছানায়। নরম রোদ শরীরে লাগায় বেশ আরাম অনুভব হচ্ছিলো দিহানের। কিন্তু এই আরামকে হারাম করে দিয়েছে অন্তির একটা ফোন কল। দিহান ভেবে পায়না মেয়ে মানুষ এত অশান্ত হয় কিভাবে। মেয়েরা হচ্ছে এক মুঠো কাদার দলার মতো। যেমন ভাবে রূপ দেওয়া হবে তেমন ভাবেই থাকবে সারাজীবন। কিন্তু এই মেয়ে হচ্ছে সকল কিছু ছাপিয়ে এক ভিন্ন জাতের। কোনো কিছুতে পরোয়া নেই তার। হুট করে তার বিপি কখনো হাই করে ফেলে কখনো বা ডাউন। এক দন্ড শান্তি নেই কোথাও। চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়েছে দিহানের। না জানি কোথায় কি অঘটন ঘটাচ্ছে তাকে নিয়ে! কলটাও রিসিভ করছে না। চিন্তিত ভঙিতে দিহান কল করলো নুহাশকে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে নুহাশ কল রিসিভ করলে না। এমনটা সচরাচর হয় না। সচরাচর বলতে কখনই হয় না। দিহানের কুঁচকানো কপাল আরো খানিক কুঁচকে এলো। অন্তির খোঁজ নেওয়ার শেষ মাধ্যম হিসেবে দিহান পারুকে কল করলো। দু বার রিং হওয়ার পর পারু কল ধরলো। দিহানকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না। তার পূর্বেই পারু বলতে শুরু করলো,

‘আপা ঘুম ভাঙার পর থেইকেই কেমন অদ্ভুত আচরণ করতাছিল বুঝলেন ভাই? মনেহয় মনে রংটং লাগছে। বয়সটাতো বোঝেন। খালা….’

দিহান পারুকে কথা শেষ করতে দিলো না। মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বললো,

‘ও কোথায় এখন?’

কথার মাঝে বাঁধা দেওয়ায় পারু কিছুটা বিরক্ত। ভালো অংকের টাকা দেয় দেখে এসব পারু সহ্য করে নেয়, নয়তো এসব মানুষের ধার ধারে না পারু। মুখের কথা গিলে ফেলে পারু জবাব দেয়,

‘ঘন্টাখানেক আগে বাইরে গেছে। কোতায় তা এই পারু জানে না। সেই খবর রাখার কতা আমার ছিলো না। পারুর কাজ পারু ঠিকঠাক করছে। পারু একবার যে কাজ হাতে….’

দিহান খট করে কল কেটে দিলো। প্রয়োজনের সময় কোনো কিছুই ঠিক থাকে না। এই মুহূর্তে অন্তি কোথায় আছে জানাটা দরকার ছিলো। দিহান ছোট করে শ্বাস ফেলে। বিয়ের পর এই মেয়েকে চব্বিশ ঘন্টা সে ঘরে আটকে রাখবে। নয়তো যে কোনো মুহূর্তে সে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে।
______________

মিণু সুপারির ছোলা ছুলছে মেঝেতে বসে। রেহানা বারবার তাকে মেঝেতে বসতে মানা করেছে। এই ঠান্ডায় মেঝেতে বসে থেকে ঠান্ডা বাঁধিয়ে পরে দিন রাত কাশতে থাকবে। এজন্য রেহানা তাকে বারবার বলেছে,

‘মিনু সোফায় বসে তোর যা কাজ করার কর। মেঝেতে যেন বসতে না দেখি।’

কিন্তু সে কথা তার মনে থাকে না। মেঝেতেই বসে পরে। তখন কিছু বললে মুখখানা আঁধার করে বলবে,

‘সোফায় বসার অভ্যাস নাই তো তাই বারবার ভুল হয়।’

রেহানাও তাই তাকে কিছু বলা ছেড়ে দিছে। আর যাই হোক প্রতিবেলায় মিনুকে সোফায় বসতে বলা তার পক্ষে সম্ভব না।

কলিং বেল বাজছে। রেহানা রান্নাঘরে স্যুপ রান্নার জন্য চিকেন ছোট ছোট পিস করছে। সে রান্নাঘর থেকেই গলা উঁচু করে মিনুকে ডাকে।

‘দরজা খোল। দেখ কে এলো।’

মিনুর কোনো শব্দ পাওয়া গেলো না। রেহানা নিজেই হাত ধুয়ে বের হয়ে এলো। দরজা খুলতেই হাসি উজ্জ্বল মুখের একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। দু হাত ভর্তি তার বিভিন্ন ফল। তাকে দেখতেই মিষ্টি হেসে সালাম দিলো। হঠাৎ তার বাড়িতে একটা মেয়ের আগমনে রেহানা খানিকটা বিস্মিত হয়। রেহানা তাকে ভেতরে আসতে না বললেও অন্তি টুপ করে ঘরে ঢুকে পড়ে যেন এটা তার বাড়ি। ততক্ষণে মিনুও এসে দাঁড়িয়েছে কাছে। অন্তি ফলের ব্যাগ দুটো মিনুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেশ স্বাভাবিক ভাবে রেহানাকে বলে,

‘মা দিহান কি খেয়েছে?’

এত চমক হজম করতে না পেরে রেহানা বোবা বনে গেলো যেন। কে এই মেয়ে? কোথা থেকে এলো এসব প্রশ্ন ভাবার সময়টুকু ও পেলো না সে। সম্মোহিতর মতো মাথা নেড়ে না জানালো। অন্তি মুচকি হেসে গলার ওড়না সুন্দর করে কোমরে পেঁচিয়ে বললো,

‘রান্নাঘরটা কোন দিকে?’

মিনু হাতেল ইশারায় রান্নাঘর দেখিয়ে দিলো। অন্তি মিষ্টি করে হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিকে চলে গেলো। তার পিছু পিছু রেহানাও যেয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ালো।

‘মা এই মাংস দিয়ে কি হবে?’

‘স্যুপের ভেতর দেওয়া হবে।’

‘স্যুপটা আমি রান্না করি?’

‘পারবে?’

‘খুউউব পারবো। আপনি শুধু বলে বলে দিবেন কখন কি করতে হবে।’

রেহানা হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলে। মেয়েটার চঞ্চলতা তার ভালো লেগেছে। চেনা নেই জানা নেই এমন একটা মেয়ে তাকে মা মা বলে ডেকে চলছে এই ব্যাপারটাও তার ভালো লাগছে। তবে মেয়েটার সাহস তাকে অবাক করেছে খুব। এই যে এসেই মা ডাকা শুরু করেছে কয়টা মেয়ে পারে এমন সাহস করতে?

‘তোমার নামটা তো বললে না মা।’

অন্তি জিভ কাটে। আলতো হেসে বলে,

‘ইসস! একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আমি রূপন্তি নওয়াজ খান। বাবা সাহেদ নওয়াজ খান। আমি এবার দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠবো।’

রেহানা বেশ উচ্ছ্বসিত গলায় বলে,

‘তাহলেতো তুমি বেশ ছোট!’

হঠাৎ করেই অন্তি মুখটা বাংলার পাঁচ বানিয়ে ফেলে। এমন পরিবর্তনে রেহানাও কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। সে তো এমন কোনো কথা বলেনি যার জন্য মেয়েটার মুখে এমন আঁধার নামবে!

‘আপনার বাউন্ডুল ছেলেটা আমাকে ছোট ছোট করে মাসের পর মাস ঘুরিয়েছে জানেন মা? আপনিতো জানেন না। জানলে অবশ্যই আমাকে ছোট বলতেন না। আমি দেখতে ছোট হলেও আমার মন অনেক বড়।’

রেহানার মুখ থেকেও যেন মেঘ কেটে যায়। হাসি হাসি মুখে বলে,

‘তোমার সাথে আমার বাউন্ডুল ছেলেটার সম্পর্ক কি মা?’

অন্তি বেশ প্রফুল্ল চিত্তে জবাব দেয়,

‘আমি তার অফিসিয়াল প্রেমিকা। বিয়েটা হলেই বউ উপাধি পেয়ে যাব। আমাকে আপনার পুত্রবধূ হিসেবে কেমন লেগেছে মা?’

রেহানা হতবাক হয়ে অন্তির দিকে তাকিয়ে আছে। এইযে একের পর এক কথার চমক দিয়ে চলেছে মেয়েটা এতে যেন মেয়েটার মুখভাবের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। কত সহজ স্বাভাবিক ভাবে প্রতিটা জবাব দিচ্ছে। যেন রেহানার সাথে তার বহুদিনের পরিচয়। রেহানা একটু কেশে কথা ঘুরিয়ে নিতে চায়। ছেলেকে না জানিয়ে বউ পাকাপোক্ত করে ফেলাটা অন্যায় হবে। রেহানা একটা বাটি এনে অন্তির সামনে রাখে।

‘মা তুমি এবার এপাশ হয়ে দাঁড়াও। আমি স্যুপটা ঢেলে দিচ্ছি। অনেক গরম, তুমি এটা পারবে না।’
________________

অন্তিকে দিহানের রুম দেখিয়ে দিয়ে সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল মিনু। সে কিছুতেই দিহানের রুমে একটা মেয়েকে একা রেখে যেতে পারবে না। এই মেয়ের যে রূপ দেখেছে সে তাতে এই মেয়ের পক্ষে দিহানকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপার না। মিনু থাকতে মির্জা পরিবারে এতবড় ঘটনা সে ঘটতে দিবে না। কিছুতেই না‌। তাছাড়া নিচে যেয়ে এ ব্যাপারে রেহানাকে তার আপডেট দিতে হবে।

দিহান বিছানায় আধবসা হয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে। তার স্বভাবসুলভ ভ্রুদুটো সামান্য কুঁচকে আছে। দাঁত দিয়ে নিন্মাংশের ওষ্ঠদ্বয় কামড়ে ধরে আছে। যেন কোনো কিছু নিয়ে খুব ভাবনায় বিভোর সে। অন্তি আগাগোড়া দিহানকে পর্যবেক্ষণ করে খুব নিরবে স্যুপের ট্রেটা তার পাশের টেবিলে নামিয়ে রাখলো। দিহান রুমে কারো উপস্থিতি টের পেয়েছে। তবে তার রুমে এ সময়ে রেহানা ছাড়া অন্য কারো আসার কথা না। মিনু কখনোই তার রুমে আসে না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সে ধরে নিয়েছে রেহানা এসেছে। দিহান ল্যাপটপে নজর রেখেই বললো,

‘এক গ্লাস পানি দাও তো মা।’

অন্তি কোনো বাক্য ব্যায় না করেই পানি এগিয়ে দিলো। দিহানের কানের নিকট মুখ এগিয়ে ফিসফিস করে বললো,

‘পানিটা মা নয় বউ দিয়েছে। কল মি বউ।’

দিহান মাত্রই গালে পানি নিয়েছিলো। পানিটা তার গলা দিয়ে প্রবেশ করার সুযোগ পেলো না। তার পূর্বেই তীব্র গতিতে ছিটকে পড়লো। কাশি উঠে গেছে তার। অন্তি তৎক্ষণাৎ দ্রুত গতিতে দিহানের পিঠে চাপড় দিতে দিতে বলতে লাগলো,

‘এত কেয়ারলেস কেন? সামান্য পানিটাও ঠিক ভাবে খেতে পারেননা দেখছি।’

দিহানের চোখ মুখের অবস্থা করুণ। যেন তার ভেতর সত্তা বলতে চাইছে,’নিজের কেয়ার নিতে পারছি কোই? তোমার চমক আমার এই প্রাণ আর নিতে পারছে না। ক্ষমা দাও এবার।’

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here