প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি #সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী #পর্ব_৪৫

1
592

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৪৫
,
সকাল সকাল রৌদ্রের মধ্যমা আঙুল ধরে সাদা স্কুল ড্রেসটা পরে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো জয়। সদর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যখনি গাড়িতে উঠতে যাবে তখনি জয় বায়না ধরলো আইসক্রিম খাওয়ার।

“এখন নয় তোদের স্কুলের সামনে থেকে কিনে দিবো। এখন দেরি হয়ে যাবে জলদি গাড়িতে গিয়ে বস।

” না না মেজো ভাইয়া তুমি এখনি কিনে দিবে। যদি না দেও তাহলে আমি এখানে বাবু হয়ে বসে পড়বো তখন তো আরো দেরি হয়ে যাবে তখন কি করবে?

জয়ের কথাশুনে রৌদ্র কমরে হাত রেখে জয় এর দিকে তাকালো৷ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে অগত্যা রাজি হয়ে গেলো। জয় কে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে নিজে আইসক্রিম আনতে গেলো। কিন্তু জয় তো নাছোড়বান্দা সেও যাবে। জয় এর পিছু পিছু সেও গেলো। রাস্তা পাড় হয়ে দোকান থেকে আইসক্রিম কিনে জয়ের হাতে দিতেই জয় খুলে খাওয়া শুরু করলো। রোদ্র তার মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে যখনি দিতে যাবে তখনি রোদ্রের পাশে আরেকটা হাত দেখতে পেলো। সেও একশো টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল।

“আইসক্রিম এর টাকাটা এখান থেকে রাখুন।

পরিচিত কন্ঠ পেয়ে রৌদ্র ঘাড় ঘুড়িয়ে পাশে তাকিয়ে জোসেফ কে দেখে অনেকটাই অবাক হয়ে গেলো। জোসেফ মুচকি হেসে বাকি টাকাটা নিয়ে পকেটে রেখে বলল।

” কিরে ওমন হ্যাঁ করে আছিস কেনো?

“তুই এখন এখানে?

রৌদ্র অবাক হয়ে কথাটা বলতেই জোসেফ হেসে ফেলল। জয়ের দিকে তাকিয়ে হাই দিয়ে পুনরায় রোদ্রের দিকে তাকালো।

“কেনো এখানে থাকলে কি কোনো সম্যসা? আরে হঠাৎ করে বাবা অসুস্থ হয়ে গেলো। তাই আমাকেও তড়িঘড়ি করে চলে আসতে হলো৷ এই কয়দিন এতো ব্যাস্ত ছিলাম যে তোর সাথে যোগাযোগ এর সময়ই পায়নি। আজকে এই দিকটায় একটা কাজ ছিলো এই জন্য আসছিলাম। আর দেখ তোর সাথে দেখাও হয়ে গেলো। তা তোর বাসা কি এখানেই?

” হ্যাঁ ওইতো আমার বাসা চল তোকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো৷

“কার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি তোর প্রিয় মানুষটার সাথে? আচ্ছা তুই কি দিয়ে তৈরি বলতো? চোখের সামনে তাকে দেখেও এতোটা শক্ত কীভাবে আছিস?

জোসেফ এর কথায় রৌদ্রের হাসি মুখটা কিছুক্ষণের জন্য মলিন হয়ে গেলো৷ কিন্তু পরক্ষণেই আবার একটা হাসি দিয়ে বলল।

” ওসব বাদদে চল তোকে সবার সাথে পরিচয় করায়ে দিই।

“নাহ আজকে নয় অন্যদিন। তবে তুই এখন আমার সাথে যাবি। না আমি কোনো কথা শুনবো নাহ।

” আরে কিন্তু এখন কীভাবে। আমিতো জয়কে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিলাম।

“একদিন স্কুলে না গেলে কিছু হবে নাহ। আর বন্ধু হই তোর আমি আমার জন্য একটাদিন বার করতে পারবি নাহ? এই তোর বন্ধুত্ব?

জোসেফ এর চতুর কথায় রৌদ্র দমে গেলো। মুচকি হেসে সায় জানিয়ে জোসেফ এর দিকে তাকালো। রৌদ্র কে কথাটা বলে জোসেফ জয় এর দিকে তাকালো। ততক্ষণে জয় এর আইসক্রিম খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। আর ওদের দিকে হা করে তাকিয়ে ওদের কথা শুনছে। জোসেফ জয় এর দিকে তাকিয়ে বলল।

” যাও আজকে তোমার ছুটি আজকে আর স্কুলে যাওয়া লাগবে নাহ৷ বাসায় যাও।

জয় খুবি তীক্ষ্ণ চোখে জোসেফ এর দিকে তাকিয়ে আছে৷ কেনো জানি ওর খুব চেনা চেনা লাগছে লোকটাকে। মনে হচ্ছে সামনে দাঁড়ালো লোকটাকে সে আগেও দেখেছে৷ কিন্তু কোথায়? ছোট্ট মাথায় একটু চাপ দিতেই মনে পড়ল হ্যাঁ অনেকদিন আগে এই লোকটিকে সে শশীর সাথে কথা বলতে দেখেছিলো৷ কিন্তু এই লোক মেজো ভাইয়াই বন্ধু হলো কীভাবে? কথাটা ভেবে যখনি রৌদ্রকে বলতে যাবে দেখলো জোসেফ ততক্ষণে রৌদ্রকে টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়েছে। রৌদ্র বার বার নিষেধ করা সত্বেও শুনলো নাহ৷ জয় বাইরে থেকে ডাকলেও ভিতরে শোনা যায়নি। গাড়িও ততক্ষণে স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। জয় আর কিছু না ভেবে গাড়ির পিছনের ডিকিতে উঠে বসল। যে করেই হোক মেজো ভাইয়াকে জানানো লাগবে যে এই লোকটাকে সে চেনে।

“ওই যে সামনের ওই কালো গাড়িটাই। ইমরান ভাইয়া আপনি আর একটু জোরে চালান।

শশীর কথাটা শুনতেই ইমরান গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিলো। গাড়িটা বেশ দূরে আছে। মাঝে আরো গাড়ি। একটু এদিক সেদিক হলেই গাড়িটা হারিয়ে যেতে পারে। পেটের বাম পাশটায় বেশ খানিকটা বেথ্যা করছে। তবে সেদিকে ওতোটা গুরুত্ব দিচ্ছে নাহ শশী৷ দাঁতে দাঁত চেপে সয্য করে নিচ্ছে। ইমরান গাড়ির গতি বাড়িয়ে বেশ খানিকটা কাছে নিয়ে আসলো। সামনের আয়নায় শশীকে একবার দেখে নিয়ে শশীর উদ্দেশ্য বলল।

” ম্যাম আপনার আসা মোটেও উচিত হয়নি। আমি এতোবার নিষেধ করলাম আপনি শুনলেন নাহ। এখন যদি কিছু হয়ে যায় আমি স্যারকে কি জবাব দেবো।

ইমরান এর কথা শুনে শশী সোজা হয়ে বসলো। বাম হাতে বেথ্যা করা জায়গাটায় চেপে ধরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল।

“এতো বেশি কথা বলেন কেনো ভাইয়া। আপনি গাড়িটার দিকে নজর রাখেন। আমি ঠিক আছি। গাড়িটাকে কিছুতেই আড়াল করা যাবে নাহ৷

কথাটা বলে শশী পুনরায় রোদ্রের নাম্বারে কল দিলো কিন্তু ফোন বরাবরের মতোই বন্ধ। এতোবার কল দেওয়ার পর বন্ধ পাওয়ায় রেগে হাতের ফোনটা নিচে আছাড় মারলো শশী। সাথে সাথে ফোনের স্কিনটা ফেঁটে লম্বা আঁড়াআঁড়িভাবে একটা দাগ পড়ে গেলো।
,,,,,,,,,,,,,

মাথাটা কালো কাপড়ে মোড়ানো। হাতদুটো মোটা দড়ি দিয়ে বেশ শক্ত ভাবে বেঁধে টানতে টানতে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওসমান কে। কপালের কোন থেকে তাড়া রক্ত গড়িয়ে পড়তে পড়তে শুকিয়ে গাড়ো খয়েরি আকার ধারণ করেছে। দুই দলের মধ্যে বেশ বড়সর একটা গুলাগুলি হয়েছে। বেশ কয়েকজন সৈনিক নিহত, আহত হয়েছে। আর সকালেই বেশ আঘাত পেয়েছে। তবে শেষ মেষ ওসমান কে ধরতে পেরেছে এটাই বড় কথা। সমুদ্রের পায়ে গুলি লেগেছে বিধায় হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। তবুও হেঁটে সামনের দিকে যাচ্ছে। জঙ্গল পাড় হলেই বর্ডারের কাছে ওদের হেড অফিসের সবাই আছে। যোগাযোগের কোনো মাধ্যম না থাকায় কাউকে ইনফরম করতে পারছে নাহ। দিনের আলো ফুঁটে গিয়েছে তবুও জঙ্গলের মধ্যে কেমন একটা গুমোট ভাব। ওসমান ও বেশ আঘাত পেয়েছে। সামনের সৈনিক দড়ি ধরে হেঁচকা টানতেই নিচে পড়ে গেলো। সমুদ্র চোখের ইশারায় ওসমান কে তুলতে বলল৷ অন্য একজন পিছন থেকে জামার কলার ধরে টেনে দাঁড় করায়ে দিলো। বেশ খানিক দূর যাওয়ার পর আচমকায় সমুদ্র থেমে গেলো। কেমন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দলনেতা কে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে সকলেই দাঁড়িয়ে পড়লো। পিছনে তাকিয়ে সমুদ্রের পায়ের দিকে সকলে আতংকিত চোখে তাকালো। বাম পায়ের নিচে যেনো সাক্ষাৎ মরণ। সমুদ্র কেমন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যে প্রথম থেকে সবাইকে সর্তক করছিলো এটার থেকে সাবধান থাকতে শেষে কিনা সেই বিপদে পড়লো। সামনে থেকে একজন নরম কন্ঠে বলল।

“স্যার এটা?

সমুদ্র শক্ত কাটকাট গলায় বলে উঠল।

” কিচ্ছু হয়নি তোমরা সামনে এগিয়ে যাও। ওকে সাবধানে স্যার এর হাতে তুলে দিবে। তারপর বাংলাদেশ আর্মি ওকে পাকিস্তান পুলিশের কাছে হস্তান্তর করবে। মনে রেখো এটা তোমাদের দায়িত্ব। আর হ্যাঁ আমার চিন্তা করো নাহ দেশ থেকে এমন জংজাল দূর করতে কিছু প্রাণের আহুতি দিতেই হয়।

“কিন্তু স্যার আপনি?

” বললাম তো আমার কিচ্ছু হয়নি তোমরা এগিয়ে যাও। তোমাদের দায়িত্ব পালন করো।

“ইয়েস স্যার।

সকলে সমুদ্র কে স্যালুট দিয়ে ওসমানকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। চোখে পানি টলটল করলেও উপরে সেটা প্রকাশ করলো নাহ। সমুদ্র ওদের দিকে তাকিয়ে একটা প্রাপ্তির হাসি দিয়ে ওদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলো। ওসমান কে নিয়ে সকলে সামনের দিকে চলে গেলো। শুধু দাঁড়িয়ে থাকলো এক সমুদ্র। কেননা ওখান থেকে একচুল নড়লেও মৃত্যু অবধারিত। নিস্তব্ধ এই ঘন জঙ্গলে পশুপাখি আর কিছু মৃত্যু দেহ ছাড়া কেউ নেই। এতোক্ষণে হয়ত কিছু ক্ষত বিক্ষত দেহ গুলো কারো খাবারে পরিনত হয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নিলো সমুদ্র। চোখটা বন্ধ করে মাথাটা নিচু করে নিলো৷ চোখের কোণে পানি জমেছে তবে এটা মৃত্যু ভয়ে নয়। কাউকে দেওয়া কথা না রাখতে পারার ভয়৷ কারো থেকে ক্ষমা না পাওয়ার ভয়। নিজেকে ভীষণ রকম অসহায় লাগছে। বীর সাহসী একজন সৈনিক ও নিজেকে অসহায় ভাবছে। হ্যাঁ আজকে সমুদ্র অসহায় ভীষণ রকম অসহায়। অপারগ সে, আশা ভরা চোখে সামনের দিকে তাকালো শুধু মাত্র একটা প্রাণের আশায়। কিন্তু না কেউ নেই সবটা শূন্য। চোখটা বন্ধ রেখেই বিরবির করে বলল।

” আমায় ক্ষমা করো নাহ শশী। আমি তোমায় দেওয়া কথা রাখতে পারলাম নাহ। কথা দিয়েছিলাম মৃত্যু কে হারিয়ে ঠিক তোমার কাছে ফিরে আসব। কিন্তু মৃত্যু কে হারানো যে বড়ই কঠিন৷ মৃত্যু এক অপ্রিয় সত্যি যেটা মেনে নিতেই হবে৷ অপেক্ষা করো নাহ৷ নিজেকে সামলে নিও।

কথাগুলো বলেই আস্তে করেই পা টা সরিয়ে নিলো সমুদ্র। বিকট শব্দে জঙ্গলটা যেনো কেঁপে উঠল। জঙ্গলের মাঝ থেকে সাদা কালো ধোঁয়ায় চারিদিকে ছেঁয়ে গেলো। সাথে বিদঘুটে গন্ধ।
,,,,,,,,,,,,

বিধস্ত অবস্থায় হসপিটালের চেয়ারে বসে আছে শশী। হাতের কনুই থেকে তাজা রক্ত বেঁয়ে পড়ছে। কপালের কোণে কাঁটা জায়গা থেকে রক্ত ঝড়তে ঝড়তে শুকিয়ে গেছে। ফোলা পেটটার মধ্যে থাকা ছোট্ট প্রাণটাও বোধহয় মায়ের বেথ্যা সয্য করতে না পেরে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে ফেলেছে। এতো এতো যন্ত্রণার মাঝেও শক্ত হয়ে নড়াচড়া বিহীন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে৷ যেনো কোনো বেথ্যায় তাকে কাবু করতে পারছে নাহ। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তেও যেনো তার কাছে অনুমতি চাইছে। ঠিক তখনি হসপিটালে লাগানো মাঝারি সাইজের টিভির মধ্যে চলতে থাকা খবরের চ্যালেনের মেয়েটা সমস্ত নিরবতা ভেঙে বলে উঠল।

“পাকিস্তান এর পলাতক টেরোরিস্ট ওসমান বাংলাদেশ বর্ডারের কাছ থেকে আর্মিদের কাছে ধরা পড়েছে। এতে অনেক সৈনিক নিহত এবং আহত হয়েছে। এইমাত্র পাওয়া খবরে জানা গেছে উচ্চ পদস্থ অফিসার এবং এই মিশনের লিডার সমুদ্র বোমা হামলায় নিহত হয়েছে। তার পুড়ে যাওয়া ক্ষত বিক্ষত বডি আর্মিরা উদ্ধার করেছে।

এইটুকুই কানে গেলো। মেয়েটা হয়ত আরো কিছু বলল তবে সেগুলোর কিছুই শশীর কানে গেলো নাহ। মাথার মধ্যে বন বন করে ঘুরছে। কানের মধ্যে কেমন শোঁ শোঁ আওয়াজ করছে। পেটের বেথ্যাটাও এবার সয্যের সীমানা পাড় করে ফেলল। তবে একটুও শব্দ করলো নাহ। ক্লান্ত চোখের পাতাটা ফেলতেই একফোঁটা পানি গড়িয়ে গাল বেঁয়ে নিচে পড়ল। উফ এতো যন্ত্রণা সয্য করতে যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। চোখটা বন্ধ করে বিরবির করে একটা ব্যাক্য আওড়াল শশী।

” আপনি আমায় কথা দিয়েছেন সমুদ্র। ক্ষমা করবো নাহ আপনাকে।

#চলবে?

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here