#নিশীভাতি
#৩১তম_পর্ব
“ফুচকা খাবেন?আজ আমার ছুটি। চাইলে আপনাকে দিনটা দিতে পারি ”
ফাইজানের দিকে নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে রইলো হুমায়রা। ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে তার এইরুপটা ঠিক বোধগন্য হলো না। অবশ্য ফাইজানকে সে কখনোই বুঝে উঠে না। প্রতিবার একটি সূত্র মেপে আগাতে যায়, কিন্তু কিছুদূর এগিয়েই অনুভব হয় এই পথে আগাবার যো নেই। সামনে প্রাচীর টানা। আবার হতাশ হয়ে অন্য পথ ধরে হুমায়রা। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই ঘোলাটে মানুষটিকে সে বুঝতেই চাইবে না। কিন্তু আজকে কাঠিন্যের খোলশ টেনে ছিড়ে এমন হাস্যোজ্জ্বল রুপটিকে একেবারেই মেনে পারছে না ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক। হুমায়রার হতভম্ব দৃষ্টিকে অবলোকন করলো মানুষটি। একটু এগিয়ে চোখে চোখ রেখে কৌতুহলী স্বরে বললো,
“ফুচকা ভালো লাগে না?”
হঠাৎ প্রশ্নে স্বম্বিৎ ফিরলো। ঘোর কাটলো। হুমায়রা মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো,
“লাগে”
“তাহলে ফুচকা খেতে যাচ্ছি আমরা”
জড়তাহীন বক্তব্য তার। পোঁড়া ঠোঁটের কোনে শিহরিত হাসি। তার হুকুমে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। ফাইজানের দৃষ্টি বাহিরের দিকে। অথচ অষ্টাদশী নিজের ঘোলাটে বরটিকে দেখছে। মানুষটিকে তার ভালো লাগে না। একেবারেই ভালো লাগে না, তবে মন্দের তালিকাতেও সে ফেলতে পারে না। কেনো ফেলতে পারে না, কারণটি হয়তো এই ব্যক্তিটি। তার ব্যাক্তিত্বটাই এমন, পছন্দ না করলেও অপছন্দ করা যায় না।
অদ্ভুত ভাবে হুমায়রাকে ফাইজান সত্যি ই ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে গেলো। ফুচকাওয়ালা নেতা সাহেবকে দেখে খুশিতে গদগদ। পারলে সোনার পাটি বিছিয়ে দেয়। আনুগত্যের বিন্দুকণা তার প্রতিটি কথায় ছলকাচ্ছে। হুমায়রা বুঝলো, দোকানীকে এই ফুচকার দোকানটি কোনো এক অনুদানের সাপেক্ষে করে দেওয়া হয়েছে। এবং এতে ফাইজানের হাত অনেক বেশি। ফুচকাওয়ালার ছোট্ট একটি দোকান। তার ভেতরে প্লাস্টিকের বেশ কটা চেয়ার। সবই গিজগিজ করছে কাস্টোমারে। কলেজগেটের অপোজিটে বলেই হয়তো এতো ভিড়। কলেজ ড্রেস পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের হৈ-হল্লা। ফাইজান বসতে চাইলো না। শুধু নরম স্বরে বললো,
“চাচা, আমি বসবো না। শুধু বউমাকে দেখাতে এনেছি”
দোকানী আরোও আহ্লাদের আটখানা হলেন। তার অকৃত্রিম প্রসন্নতা বুঝতে কষ্ট হলো না হুমায়রার। সে হুমায়রার জন্য ফুচকা পার্সেল করে দিলেন। ফাইজান টাকা দিতে চাইলেও সে নিলো না। কৃতজ্ঞ স্বরে বললো,
“তুমি আমারে জীবিকার ব্যবস্থা করে দিছো বাপ, তোমার থেকে টাকা নিবো?”
ফাইজান জোর করতে চাইলেও সে নিলেন না। হুমায়রা নির্বাক চোখে দেখলো। মানুষটিকে কঠিন, গম্ভীর, অনুভূতিহীন মনে হলেও মানুষের কাছে তার ব্যক্তিত্বটা ভিন্ন। তার কথার ভঙ্গি তখন আলাদা, গাম্ভীর্যটুকু যেনো কোথাও মিলিয়ে যায়। এমনটা আগেও দেখেছে সে। মিঠু কিংবা গ্রামের প্রতিটি মানুষের কাছেই ফাইজান মানেই জনগনের নেতা, দানবীর, যে জনগনের দুঃখ বুঝে। সে তাদের সাথে ততটাই কোমল। ইস্পাতের মতো কঠিন মানুষটি তখন স্বচ্ছ জলের মতো। হুমায়রা সালাম দিলো। প্রবীন মন খুলে দোয়া করলো। এই দোয়ায় কৃপনতা ছিলো না। বৃদ্ধ গদগদ স্বরে বললে,
“আরেকদিন আইসো মা, এক্কেরে ফার্স্ট ক্লাস চটপটি খাওয়ামু”
হুমায়রা মৃদু হাসলো৷ তারপর গাড়িতে উঠলো। ফুচকার প্যাকেটগুলো খোলা হলো না। ভাবলো বাড়ি গিয়ে শ্বাশুড়ির সাথে খাবে। মহিলা এসব জিনিস খাওয়ার ওস্তাদ। কে বলবে সে একজন পঞ্চাশোর্ধ মানুষ। ভেতরটা এখনো যেনো কিশোরী। কিন্তু গাড়ির গন্তব্য যেনো বাড়ি নয়। হুমায়রা অবাক স্বরে শুধালো,
“বাড়ি যাচ্ছি না?”
“না”
গম্ভীর ছোট উত্তর। হুমায়রা শুধালো না কিছু। সে জানে উত্তর পাবে না। মানুষটি হেয়ালী ভালোবাসে। তাই পৌছালেই জানা যাবে কোথায় যাচ্ছে। গাড়ি থামলো একটি নিরিবিলি জায়গায়। আশপাশটা সবুজের মাতামাতিতে ব্যস্ত। সরল বাতাসে হিম ছোঁয়া। মাটির রাস্তা। ফাইজান নেমেই দরজা খুললো। ভারী স্বরে বললো,
“নামুন, চলে এসেছি”
“এটা কোথায়?”
“আমার প্রিয় একটি জায়গায়”
*****
নিরিবিলি জায়গা। সামনে যতটা চোখ যায় শুধু সবুজ ক্ষেত। কিসের ক্ষেত জানা নেই। হয়তো সরষের। পুকুরের পাড়ে বসে আছে হুমায়রা। হিমবাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে কানের লতি। ঠান্ডা লাগছে। গাছগাছালির মাঝে একটি ছোট্ট বাড়ি। সেই বাড়ির সাথে লাগোয়া পুকুরপাড়। ঘর থেকে বের হতেই ঘাট। এটা ফাইজানের দাদুর। এখানে এখন কেউ থাকে না। একটা কেয়ারটেকার থাকে। তাকেও ফোন করে আনতে হয়। এমন একটি জায়গা ফাইজানের প্রিয় হবে ব্যাপারটা মানতে পারছে না হুমায়রা। হঠাৎ অনুভব হলো কেউ তার কোলে কেউ মাথা রেখেছে। চিন্তার দুনিয়াকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে তাকে বর্তমানে টেনে আনলো ফাইজান। আকস্মিক ঘটনায় কিছুটা চমকে গেলো হুমায়রা। মানুষটি মাথাটি রেখেই বললো,
“মাথা ব্যাথা করছে। একটু মাথাটা টিপে দিন”
ক্ষণসময় স্তব্ধ রইলো হুমায়রা। তারপর নরম আঙ্গুল গুলো ছুঁলো শ্যাম কপাল। অনুভূতিটা বিচিত্র। হুমায়রার মনে হলো হৃদয়টা এখন ই থেমে যাবে। সে জড়োসড়ো হয়ে গেলো। তাকে স্বাভাবিক করতেই নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো ফাইজান,
“জায়গাটি পছন্দ হয়েছে?”
“হু”
“একটা সময় এখানে প্রায় ই আসা হত, এখন হয় না। মাঝে মাঝে আসি। তাও আমি একা। মা আসতে চায় না। সামনের জমিগুলো দেখছেন, আমাদের জমি। সব বর্গা দেওয়া। বছরে একবার ধান দেয়, একবার মাছ। এবার নাকি ফলন হয় নি। বিশ্বাস হয় নি আমার। মায়ের জন্য অবশ্য কিছু বলিও নি।”
ফাইজান কথা বলছে। এতোগুলো কথা সে খুব কম ই তার সাথে বলেছে। ব্যাপারটি খুব অদ্ভুত। কিন্তু হুমায়রার মন্দ লাগছে না। হুমায়রা নিঃশব্দে তার চুলে বিলি কাটছে। ফাইজান এবার চোখ খুলে তাকালো হুমায়রার চোখে। মৃদু স্বরে শুধালো,
“জিজ্ঞেস করবেন না আমি আপনাকে এখানে কেনো এনেছি?”
হুমায়রা স্মিত স্বরে শুধালো,
“কেনো?”
“কারণ আজকের দিনটা আমি আপনার সাথে কাটাতে চাই একাকীত্বে। তাই আমার পছন্দের জায়গায় আনা”
“আপনাকে প্রকৃতিপ্রেমিক বলে মনে হয় না”
“হবার কথাও নয়, কারণ আমি প্রকৃতিপ্রেমিক নই। আমার আষাঢ়িয়া বৃষ্টিতে জলকেলী করতে ভালো লাগে না, না আবার পৌষের সকালে সরষে ক্ষেতে চোখ সেকতে ভালো লাগে। অগ্রহায়ণের কাশফুলের শুভ্রতাও আমার মাঝে ভাবান্তর ঘটায় না, না শরতের পেঁজোতুলোর মতো মেঘের আনাগোনা ভালো লাগে। এগুলো আমার কাছে নিছক নকটামি বই কিছুই নয়। সাহিত্যপ্রেমীদের কিছু বানোয়াট উপমা”
“তবে যে বললেন, এটা আপনার প্রিয় জায়গা?”
হুমায়রার অবাক প্রশ্নে ফাইজান মুচকি হাসলো। মানুষটি কি জানে তার হাসিটা কতটা ভয়ংকর। হয়তো কঠিন মানুষগুলোর হাসি এতোটাই স্বচ্ছ হয়। হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়। ফাইজান নরম স্বরে বললো,
“এখানে আমি একাকীত্বে শ্বাস নিতে পারি। কেউ আমাকে বিরক্ত করে না। না অতীত আমাকে দাবড়ে বেড়ায়, না বর্তমান আমাকে নাড়ায় আর না ভবিষ্যত আমাকে ভাবায়”
“আপনার কথাগুলো খুব কঠিন লাগে আমার কাছে”
“তাই নাকি? কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার জানেন আমার আপনার কাছে কথা বলতে ভালো লাগছে। কারণ আমার হাজারটা চিন্তা করতে হচ্ছে না, মেপে কথা বলতে হচ্ছে না, মেকিপনা দেখাতে হচ্ছে না। জানেন ই তো নেতাদের কতশত মুখোশ পড়তে হয়”
কোথাও যেনো মলিনতার আভাস পেলো হুমায়রা। ফাইজান চোখ বুজে আছে। হুমায়রার হাত তার চুলের ভেতরে মৃদু গতিতে আনাগোনায় ব্যস্ত। কিছুসময় চুপ রইলো সে। নিস্তব্ধতায় আলিঙ্গন করলো পরিবেশ। পাখিদের কলরব কানে আসছে। মাছরাঙ্গাটা মাছ খাবার নেশায় উঁকি ঝুকি দিচ্ছে। ঠিক তেমন ই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে হুমায়রার হৃদয়। চাঁপা কিছু প্রশ্নরা উত্তর খুঁজছে।
“হাফসার মৃত্যুতে আপনার কিছু যায় আসে না, সেটাও একটি মুখোশ ছিলো। তাই না? গ্লানি হোক বা ভালোবাসা; তার মৃত্যু পাঁচ বছর পরও আপনাকে একই ভাবে তাড়িয়ে বেড়ায়। আপনাকে পোঁড়ায়, প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবুও সবার কাছে আপনি অনুভূতিহীন, স্বার্থপর পুরুষ। কেনো এই অভিনয়?”
কিন্তু প্রশ্নটা করার বোধ হয় এখন সঠিক সময় নয়। ফাইজান চোখ বুজে রয়েছে। খানিকক্ষণ বাদে সে ঘুরে জড়িয়ে ধরলো নরম, ছোট্ট কোমড়খানি। মিশে রইলো নিবিড়ভাবে। পোড়া ঠোঁটের কোনে অকৃত্রিম মৃদু হাসি। মনে মনে আওড়ালো,
“আপনি শুধু আমার ঘুমের মাধ্যম-ই নন, ভালোথাকারও ঔষধ”
*****
চাকরিটা অবশেষে পেয়েই গেলো ইলহা। হাসপাতালটি বাড়ি থেকে দুঘন্টা দূরে। জুনিয়র মেডিকেল অফিসার হিসেবে চাকরি পেয়েছে সে। তার কাজ ইমার্জেন্সিতে। আটঘন্টার ডিউটি। ঘর থেকে বের হতে হয় কাক ভোরে। আসার সময় লোকাল বাসে করে আসে। তবুও ভালো লাগছে। কারণ আবার নিজের ভালোবাসার স্থানগুলো খুঁজে পাচ্ছে সে। রাশাদ নিজে তাকে দিয়ে আসে। তাকে হাসপাতালে নামিয়ে দুঘন্টা জার্নি করে এসে দোকান খুলে। দেরিতে দোকান খোলায় দুপুরেও বাড়ি আসে না। আসে একেবারে ইলহাকে নিয়ে। ক্লান্ত শরীরেই বউটিকে আনতে যায়। কিন্তু সেই ক্লান্তি মিলিয়ে যায় যখন ইলহার ক্লান্ত অথচ প্রাণবন্ত মুখখানি দেখে। মোটরসাইকেলের পথটুকু খুব ভালো লাগছে রাশাদের। বউ তাকে শক্ত করে ধরে কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয়। সব ক্লান্তি যেনো শুষে নেয় তখন প্রেয়সীর সেই স্পর্শ। কিন্তু সুখের সময়ের নজর দেবার মানুষের যেনো অভাব নেই। পাশের বাড়ির চাচী এসেছিলেন ছেলের বিয়ের দাওয়াত দিতে। রসিয়ে রসিয়ে কথা বলতে বলতে একটা সময় বলেই বসলেন,
“দেইখো চাচী, বউ আনসো তো মেলা শিক্ষিত, উপর থেকে শহুরে মাইয়্যা। রাশাইদ্দা আমাদের সাধারণ পাশ, গেরামের পোলা। সংসার টিকলি হয়”
কথাটা আতিয়া খাতুনের মস্তিষ্কেও যেনো জেকে বসলো। যতই হোক, ঘরপোড়া গরু; সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়। ইলহাও যে জুবাইদার মতো কিছু করবে না কি ভরসা……
চলবে
(ভালো লাগলে রেসপন্স করবেন। পেজের রিচ অনেক ডাউন)
মুশফিকা রহমান মৈথি