#নিশীভাতি
#৩২তম_পর্ব
“দেইখো চাচী, বউ আনসো তো মেলা শিক্ষিত, উপর থেকে শহুরে মাইয়্যা। রাশাইদ্দা আমাদের সাধারণ পাশ, গেরামের পোলা। সংসার টিকলি হয়”
লিমনের মার কথাটা আতিয়া খাতুনের মস্তিষ্কেও যেনো জেকে বসলো। যতই হোক, ঘরপোড়া গরু; সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়। ইলহাও যে জুবাইদার মতো কিছু করবে না কি ভরসা। ইলহার চাকরি করা কিংবা আরোও পড়াশোনার ব্যাপারটিতে তিনি খুব একটা প্রসন্ন ছিলেন না। মেয়ে মানুষের এতো পড়াশোনার কি কাজ এই কথাটা মাথায় আসে না তার। তার একটি ভ্রান্ত ধারণা লেখাপড়া শিখলে নেয়ে মানুষ অভদ্র হয়। উচ্ছন্নে যায়। কিন্তু নাতীর সিদ্ধান্তের উপর কথা বলেন নি তিনি। স্বামী যদি আপত্তি না করেন তবে তার আপত্তি বেমানান। কিন্তু সবসময়ই মনে কিছু একটা খটাখট লেগেই আছে। ফলে লিমনের মার কথাটা মনমস্তিষ্ককে নাড়িয়ে দিলো। আতিয়া খাতুন মৌন রইলেন। লিমনের মা আরোও কিছুসময় বসলো। এদিক ওদিকের কথা বললো। কিন্তু বেশিরভাগ কথাই ছিলো ইলহাকেন্দ্রিক। আতিয়া খাতুনের একটা সময় বিরক্তি ধরলো। একটা সময় বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“বউ, তোমার দাওয়াত দেওন শেষ নাকি আরোও বইবা? আমার রান্না আছে”
“আহারে চাচী, কই নাতবউ আনছো। আরাম করবা, ঘুরবা, ফিরবা! নাহ এখনো হেসেল-ই টানতি হচ্ছে তোমার।”
“মোর হেসেল মুই টানুম, তোমার কি বউ! তুমি নিজের ছেলের বউরে হেসেল দিয়ে দাওগা যাও। আমার সংসারে কথা কইয়ো না”
লিমনের মা টের পেলো আতিয়া খাতুনের বিরক্তি। তাই আর কথা বাড়ালো না। বললো,
“থাক চাচী রাইগো না। বউরে লইয়ে আইসো কিন্তু। হক্কলের লগে পরিচয় হবে। সবাই তো আর দেহে নি বউ। এই চোটে সবাই দেখবোও রাশাইদ্দার বউ কেমন”
আতিয়া খাতুন উত্তর দিলো না। তার মস্তিষ্কে এখন চলছে অন্য চিন্তা। ইলহার চাকরীর ব্যাপারে নাতীকে কি বলাটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছেন না। পৌঢ় চিন্তার মানুষটি নবীনদের উন্নত চিন্তার সাথে পেরে উঠছেন না। অন্যদিকে নাতীর জন্যও চিন্তা হচ্ছে। ভঙ্গুর এই পরিবারটায় শুধু নিজেকে বিসর্জন দিয়ে গেছে রাশাদ। এখন নতুন জনের জন্যও তার সর্বাধিক বাজি রাখছে, এই বাজিতে হেরে গেলে হয়তো ভালোবাসায় সিক্ত হৃদয়টা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। এটুকু তো বুঝতে বাকি নেই রাশাদ তার স্ত্রীকে মনপ্রাণ উজার করে ভালোবাসে।
****
হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে আজ লোকে লোকে গিজগিজ করছে। রোগীর আর্তনাদ এবং বেদনাতুর চিৎকারের মাঝে পিষছে ইলহা৷ তবুও নিজেকে অশান্ত করে নি৷ মস্তিষ্ক স্থির রেখে একের পর এক রোগীকে চিকিৎসা করছে। এরমাঝেই একজন গর্ভবতী মহিলা এলেন। তার লেবারপেইন উঠেছে। নয়মাস চলছে। কিন্তু ডিউডেটের আগেই লেবারপেইন উঠায় তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। মহিলাটি অসম্ভব মোটা। এমন রোগীর সাধারণত চিকিৎসা করতে চায় না বেসরকারি হাসপাতাল গুলো৷ কারণ এদিক থেকে ওদিক হলেই দোষ বর্তায় ডাক্তারের উপর। তখন ভাঙচুর, কেসকাচারী— উপর থেকে এখনকার অঅত্যাধুনিক সোশ্যাল মিডিয়া তো আছেন। দু মিনিট সময় নেয় না তারা পোস্ট করতে। আর তার চেয়ে কম সময়েই সেটা পৌছে যায় দেশের আনাচে কানাচে। নতুন বেসরকারি হাসপাতাল, তাই তাদের কিছু পলিসি আছে। তারা ঝুঁকিগ্রহণ করতে চায় না। ফলে বলা আছে, এমন রোগী আসলেই বলতে হবে,
“সদরে নিয়ে যান”
মহিলাটির অবস্থা শোচনীয়। পানি ভেঙ্গেছে। সেই সাথে রক্তও পড়ছে। এখনই সিজারিয়ান না করা হলে হয়তো বাচ্চা বা মা কাউকেই বাঁচানো সম্ভব হবে না। ইলহা তাকে একটা ঔষধ দিয়েছে যেনো ব্লিডিংটা থামে। ইমার্জেন্সির নার্সটা বললো,
“ম্যাডাম, সদরে নিয়ে যেতে বলেন৷ এডমিট করলে রাশেদা ম্যাডাম চিল্লাইবো”
ইলহা বিপাকে পড়লো। তার ডাক্তার সত্তা মোটেই রোগীটিকে ফিরিয়ে দিতে চাইছে না। মোটা, ঝুঁকিপূর্ণ বলে কি সে চিকিৎসা পাবে না। এখান থেকে সদরে নিতেও একঘন্টা। এই সময়ে তো মহিলা মারাও যেতে পারে। কিন্তু তার চাকরি নতুন। এদিক থেকে ওদিক হলে সেটা তৎক্ষনাৎ চলে যেতে পারে৷ ফলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ইলহা বললো,
“দেখুন, উনার অবস্থা ভালো নয়। আপনি সদরে নয়ে যান উনাকে”
মহিলাটির স্বামী সাথে সাথেই তার কাছে হাতজোড় করলো। কাতর কণ্ঠে বললো,
“ম্যাডাম, কেমন রক্ত পড়তাছে! কেমনে নিমু আমি! ওরে এখন সদরে নিতেও মেলা সময় লাগবো৷ আপনি এমনে ফিরায়ে দিয়েন না ম্যাডাম। আমার বউডা মইর্যা যাইবো। আমার ও বাদে কেউ নাই”
লোকটির আকুল অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে মানবতায় বাধলো ইলহার। ফলে সে নার্সকে বললো,
“উনাকে এডমিট করো। রাশেদা ম্যাডাম আছে কি না দেখো। নাহলে পিহু ম্যাডামকে ডাকো। কিন্তু উনাকে এই মুহূর্তেই ওটিতে নাও”
“ম্যাডাম, কিছু হইলে চাকরি থাকবো না”
“জানি। কিন্তু মনে রাখো আমরা এখানে শুধু টাকা কামাই করতে আসি নি”
কঠিন স্বরে উত্তর দিলো ইলহা। ফলে নার্সও কথা বলার সুযোগ পেলো না। মহিলাটিকে নিয়ে যাওয়া হলো ওটিতে। গাইনি চিকিৎসক রাশেদা আলমকে ইমার্জেন্সি কল করে আনাতো হলো। উনি রোগীর প্রোফাইল দেখেই চটলেন। কিন্তু এখন ধমকানোর সময় নেই। ফলে তিনি ওটিতে আগে গেলেন। অপারেশনের একপর্যায়ে অবস্থা খুব খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। মহিলাটির এটা প্রথম সন্তান কিন্তু তার আগ থেকেই ডায়াবেটিস, হাই প্রেসার এবং অতিরিক্ত মেদ। ফলে অপারেশনের মাঝে তার প্রেসার কমাতে হয়েছে। তিনবার ব্রেক নিতে হয়েছে এক অপারেশনে। অবশেষে পাঁচঘন্টা পর অপারেশন শেষ হলো। ঘেমে নেয়ে একাকার রাশেদা আলম। মাকে পোস্ট অপারেটিভ রুমে পাঠানো হয়েছে। মেয়ে বাচ্চা হয়েছে ফলে তাকে পরিষ্কার করে তার পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহর কৃপায় দুজন ই সুস্থ ছিলো। কিন্তু রাশেদা আলমের মেজাজ কতটা তিরিক্ষি সেটা হাসপাতালের সবাই জানে ফলে অপারেশন শেষ হতেই তিনি ঝাঁঝালো স্বরে শুধালেন,
“এই রোগী কে ভর্তি করেছে? কে ওটিতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে? সে সামনে আসো।”
প্রথমে কেউ কথা না বললেও শেষমেশ ইলহার নাম সামনে এলো। ফলে তিনি ইলহাকে দাঁড় করিয়ে কঠিন স্বরে শুধালেন,
“কি ভেবে তুমি এই মাতব্বরি করেছো? তুমি দেখো নি রোগীর প্রোফাইল? যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারতো। অপারেশন থিয়েটারে সে মারা যেতে পারতো। তখন দায়ভার কি তুমি নিতে? নিজেকে কি ভেবেছো তুমি? হ্যা? উত্তর দাও।”
ইলহা নতমস্তক চুপ করে রইলো। রাশেদার মেজাজ আরোও খারাপ হলো। ফলে তিনি লাগাম ছাড়লেন কথার,
“নতুন নতুন ডাক্তার হলে ভাবছে মহৎ কাজ করেছে ফেলেছে! উচিত ছিলো এটার উপর ওটি ছেড়ে দেওয়া। তারপর রোগী মরলে যখন রোগীর সাথে লোকগুলোর প্যাদানী খেতো তখন বুঝতো এখানে শুধু সেজেগুজে আসাটা কাজ নয়। যতসব গার্বেজ মানুষজনকে কাজ দেয়। ভর্তি করার সময় প্রোফাইল চেক কর নি নাকি? নাকি না পড়েই রোগী ভর্তি করেছো? আসলে জানো তো রোগী দেখা?”
এবার ইলহা আর মৌন থাকতে পারলো না। ধীর স্বরে বললো,
“পলিসি আমার পড়া, কিন্তু মানবতার কাছে মাঝে মাঝে পলিসিও হার মানে। আমি জানি উনার হেলথ প্রোফাইল। কিন্তু আমি যদি তাকে ফিরিয়ে দিতাম তার সার্ভাইভাল রেট কমে যেতো। শুধু নিজের গায়ে দোষ নিবো না বলে কাউকে মৃত্যুর মুখে জেনেবুঝে ঠেলে দেওয়াটা আমার ঐমুহূর্তে সঠিক মনে হয় নি”
ইলহার কথায় কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়লো রাশেদার। কঠিন স্বরে বললেন,
“বাস্তবতার রুপ এখনো দেখা হয় নি বলে মানবতা বড় লাগছে। আজ চাকরিটা চলে যেতো তাহলে মানবতা জানালা দিয়ে পালাতো”
“শুধু চাকরি হারানোর ভয়ে দুটোপ্রাণকে মরতে দেওয়াটা কি অন্যায় নয়? আমরা তো এখানে চিকিৎসা দিতেই এসেছি।”
ইলহার উত্তরে অপ্রসন্নতা বাড়লো রাশেদার। ফলে আরোও অকথ্য ভাষায় গালি দিলেন তিনি। এবার আর তর্ক করলো না ইলহা। কারণ চাকরি যাবার ওয়ার্নিংও দেওয়া হলো দুবার৷ যতই হোক এই চাকরিটা সে হারাতে চায় না। কারণ রোগীদের মাঝে ক্লান্ত হতেই আনন্দ খুঁজে পায় সে। উপরন্তু এই সাদা কোটটি এখন শুধু তার একার স্বপ্ন নয়। আরেকটি মানুষও তার পেছনে ঘাম ঝড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই খরশান ঠান্ডার মাঝেও সে দুঘন্টা বাইক চালিয়ে তাকে নিতে আসে। সেই মানুষটি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে এই চাকরিটা হারালে। ফলে মাথা নিচু করেই রাশেদা আলমের ধমক সইলো। সে প্রস্তুত ছিলো তার আগাম দিনগুলো ভালো যাবে না মোটেই।
******
কোচিং শেষ হতে আজ একটু দেরি হলো। হুমায়রা একা একা অপেক্ষা করছে গাড়ির জন্য। এই কদিনে তার কোনো বন্ধু হয় নি। কারণ নিতান্ত গ্রামের মেয়ে বিধায় শহরের চালচলনে সে মানিয়ে উঠতে পারছে না। তার কথাবার্তা ততটা স্মার্ট নয়। গ্রাম্য টান থেকেই যায়। ফলে তার সাথে মেয়েরা কথা বললেই শুধু হাসে। ব্যাপারটি বুঝতে সময় লাগলো না হুমায়রার। তাই সেও যেচে কারোর সাথে কথা বলে না। পড়তে এসেছে এটুকুই তার উদ্দেশ্য। আজ গাড়ি একটু বেশি দেরি করছে৷ হাত জমে আসছে ঠান্ডায়। হুমায়রা এখানকার পথঘাট চিনেও না। ফলে একা একা যেতেও পারছে না। এমন সময় একটি ছেলে তার পাশে দাঁড়ালো। বিনা ভনীতায় একটি বই এগিয়ে বললো,
“স্যার তোমাকে বইটা দিতে বলেছে। এখানে সব দাগানো আছে”
ছেলেটির কথায় চমকে উঠলো হুমায়রা। বিস্মিত, হতবাক নয়নে চাইলো সে। ছেলেটি তার কোচিং এ পড়ে। খুব ভালো ছাত্রদের একজন। স্যার প্রায়ই তার প্রশংসা করে। ছেলেটির নাম মৃণাল। হুমায়রা স্মিত স্বরে বললো,
“ধন্যবাদ”
“ইটস ওকে। বাসায় যেয়ে ৭৮ নম্বর পৃষ্ঠাটা খুলো। ওখানে একটি কঠিন প্রশ্ন আছে। প্রশ্নটির উত্তর আমার চাই”……..
চলবে
(ভালো লাগলে রেসপন্স করবেন। দ্বিতীয় পর্ব রাতে আসবে)
মুশফিকা রহমান মৈথি
আগের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=393431813065985&id=100071975089266&mibextid=Nif5oz