#নিশীভাতি
#৩৫তম_পর্ব
“আমি ফাইজান ইকবাল, হুমায়রার হাসবেন্ড”
হুমায়রার হাসবেন্ড কথাটা যেনো একটু বেশি জোর দিয়েই বললো। হুমায়রা কিছু সময় নিষ্পলক চেয়ে রইলো ফাইজানের দিকে। ফাইজানের আজ এখানে আসার কথা নয়। ব্যস্ততার দাপটে যে খেতে ভুলে যায়, সেই মানুষটি সব ফেলে তাকে নিতে আসবে– এটা আকাশকুসুম চিন্তা। তাই বেশি আমলে আনলো না হুমায়রা। অন্যদিকে মৃণালের মুখবিবরের রঙ্গ পালটে গেলো। স্ফুর্তি পালটে গেলো মুহূর্তেই। ক্ষুদ্র ভ্রান্ত হৃদয় নড়ে উঠলো। আনমনে আওড়ালো,
“হাসবেন্ড?”
ফাইজান তার হাসি বর্ধিত করে বললো,
“হ্যা, জানতে না?”
মৃণাল উত্তর দিলো না। তার সংকচিত, ভ্রান্ত, অপ্রতিভ মুখখানা বহু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলো যেনো ফাইজানকে। ফাইজান স্বাভাবিক গলায় বললো,
“হুমায়রা আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন, আমি স্যারের সাথে দেখা করে আসছি। ভিজে গেছেন তো দেখছি। কাদেরকে বলবেন যেনো হিটার অন করে দেয়”
বলেই হুমায়রার হাতে ছাতিটা ধরিয়ে দিলো। হুমায়রা দ্বিতীয়বার প্রশ্নের সুযোগ পেলো না। ফলে সে গাড়ির কাছে চলে গেলো। হুমায়রা চলে যেতেই ফাইজানের মুখশ্রী বদলে গেলো। চোয়াল শক্ত হলো, দৃষ্টির প্রখরতা বাড়লো। স্থুল স্বরে শুধালো,
“চিঠিটা কি তুমি লিখেছো?”
কন্ঠের ধারে কিছুটা নড়ে চড়ে উঠলো মৃণাল। হাতড়ালো উত্তর কিন্তু পেলো না। নিরাস হলো নিজের কাপুরুষতায়। মানুষটিকে সে চিনে পত্রিকায় বহুবার তাকে দেখেছে। ক্ষমতাবান তো বটেই তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার প্রভাবই অন্যরকম। ক্ষণ সময়ের জন্য তার কাছে সামনে থাকা মানুষটিকে বাঘের চেয়েও ভয়ংকর মনে হলো আর নিজেকে ভীত ভেড়া। মৃণাল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ তোলার সাহস হচ্ছে না কেনো যেনো। সেই ত্রাস আরোও বাড়লো যখন ফাইজান শীতল স্বরে বললো,
“বয়স কম, না জেনে ভুল করাটা অস্বাভাবিক নয়। তোমাকে দেখে লজিক্যাল আর ম্যাচিউর মনে হচ্ছে। আশাকরি বিবাহিত জানার পরও এই আবেগের তাড়নায় দ্বিতীয়বার ভুল করবে না। তাই এবারের মতো ব্যাপারটিকে আমি ছেড়ে দিচ্ছি। তবে মাথায় রেখো, আমি মানুষটি মোটেই দানবীর বা ক্ষমাশীল নই। দ্বিতীয়বার আমার স্ত্রীকে নিয়ে অসংগত চিন্তা করলে আমি ছেড়ে দিবো না”
মৃণালের শিরদাঁড়া বেয়ে হিমপ্রবাহ নেমে গেলো যেনো। মৃণাল কথা বললো না। ফাইজানের ঠোঁটে হাসি উন্মোচিত হলো। ভীত মৃণালকে দেখে কেনো যেনো উত্তেজিত হৃদয় শান্ত হলো। ছেলেটি বোকা নয়। সে বুঝতে পেরেছে তার ভুল। ফাইজান দাঁড়ালো না। তার স্ত্রী অপেক্ষা করছে গাড়িতে। তাই পা বাড়ালো গাড়ির দিকে।
***
হিটারের কারণে গাড়ির উষ্ণতা অনেক বেশি। গা গরম হয়ে গিয়েছে বেশ। হুমায়রা মৃদু স্বরে বললো,
“কাদের ভাই হিটার বন্ধ করে দিন”
ঠিক সেই সময় ই দরজা খুলে প্রবেশ করলো ফাইজান। বেশ ভিজে গেছে সে। অহেতুক ছাতাটা হুমায়রাকে দিলো সে। ফাইজান ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
“প্রয়োজন নেই। আমার ঠান্ডা লাগছে”
কাদের হিটার বন্ধ করলো না। আবার নীরবতা বিস্তার করলো দুজনের মাঝে। কাদের গাড়ি স্টার্ট দিলো। হুমায়রার চোখ তখন বাহিরের দিকে। আজ সূর্য ঘাপটি মেরে আসে কৃষ্ণ মেঘের আড়ালে। তাপমাত্রা কমে নি, কিন্তু শীত হাড় কাঁপাচ্ছে। এর মাঝেও জীবিকার জন্য শত মানুষ বেড়িয়েছে। তাদের বিরাম নেই। ভাইজানের কথা মনে পড়লো। মানুষটির ঠান্ডার বাতিক আছে। প্রতি শীতে একবার জ্বর হবেই। গতকাল কথা হয় নি। আজ বাসায় যেয়েই ফোন করবে। এর মাঝেই ভারিক্কি স্বর কানে এলো,
“কয়েকদিনে শহুরে ছেলেমেয়েদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন বেশ। ভালো লাগলো দেখে”
“সে আমার বন্ধু নয়। একটা অংকের উত্তর চেয়েছিলো। সেজন্যই ক্ষণিকের কথা। এবাদে আর কিছুই নয়। আমার কোনো বন্ধু নেই। আর শহুরে ছেলেমেয়েদের সাথে মানিয়ে নেবার ক্ষমতাও আমার নেই”
নির্মল স্বীকারোক্তি হুমায়রার। ফাইজান ভ্রু গুটালো। নিরেট মুখে বিস্ময়ের ছাপ। অবাক স্বরে শুধালো,
“আপনার ধারণা আমি আপনাকে সন্দেহ করছি?”
হুমায়রা একমুহূর্ত চুপ করে ধীর কন্ঠে উত্তর দিলো,
“না, আমি নিজের কাছে পরিষ্কার থাকছি”
হুমায়রার উত্তরে চমকালো ফাইজান। মেয়েটি তাকে প্রতিবার অবাক করে। তাকে চমকে দেবার সুযোগ ছাড়ে না। তার স্বাভাবিক কাজও তাকে বিস্মিত করে। আজও তাই হলো। সেই সাথে তার পোড়া ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো। দূরত্ব গোছালো সে। হাত বর্ধিত করে আলতো করে হুমায়রার মাথায় হাত রাখলো। মৃদু ভাবে বুলাতে বুলাতে বললো,
“ভালো মেয়ে। আমার বউ অনেক বুদ্ধিমতী”
ফাইজানের প্রগাঢ় নয়ন, বিমুগ্ধ হাসি ঘায়েল করলো হুমায়রাকে। নিরেট মানুষটির এমন বিচিত্র আচরণে হৃদয় কম্পিত হলো। প্রশ্রয়ের সামান্য উক্তি ক্ষুদ্র হৃদয়ের উত্তেজনার সৃষ্টি করলো। জোড়ালো হলো স্পন্দন। দৃষ্টিতে লজ্জা ভর করলো। নির্নিমেষ অসংযত চাহনী লজ্জাবতীকে দেখলো ক্ষণসময়। হৃদয়ে উদিত হলো এক নিষিদ্ধ ইচ্ছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সংবরণ করলো। নিজের সংযম হারানোর সময় নয় এটা। মৃণালের স্পর্ধায় নিজের সম্পর্কেও কিছুটা জানতে পারলো ফাইজান। তার নিরেট হৃদয়ের অগোচরেই মেয়েটি তার জায়গা করে নিয়েছে। তার আত্মিক চাহিদার খোরাক সে। তাই শুধু শারিরীক চাহিদার তকমাটি লাগাতে চায় না এই সম্পর্কে। সেও হুমায়রার হৃদয় ছুতে চায়। সেও হুমায়রার হৃদয়ের খোরাক হতে চায়। চিন্তাগুলো মস্তিষ্কে ছুটতেই আনমনে হাসলো ফাইজান। বিকারহীন, গম্ভীর, নিরেট ফাইজান ইকবাল কিনা ক্ষুদ্র কিশোরীর প্রতি দূর্বল হয়েছে। মানুষ জানলে আর রক্ষে থাকবে না। তবুও তার পরোয়া নেই। নিলীন চোখ দেখছে হুমায়রাকে। তার লালিমায় থিতিয়ে যেতেও দ্বিধা নেই।
****
উৎসবের মহল। শীতের মাঝেও আমেজের কমতি নেই। হলুদের সন্ধ্যা ঝাঁকঝমক। প্রতি সাজসজ্জায় অনন্য স্ফূর্তি। আতিয়া খাতুন নিজ হাতে পিঠে বানিয়ে এনেছেন। রসে ডুবানো পুলি। পাত্রের সামনে তা দেওয়া হয়েছে। লিমনের মা আশপাশ দেখলো। সতর্ক স্বরে শুধালো,
“বউ আয় নাই চাচী?”
“না ছুটি পায় নাই”
লিমনের মার মুখ বদলালো সাথে সাথে। বিদ্রুপ টেনে বললো,
“সে কি চাচী, এতো ব্যাস্ত তোমার বউ? নাকি শহুরে মাইয়্যা গেরামের মানুষের বাড়ি আইবো না”
কথার ধরণ মোটেই ভালো লাগলো না যেনো আতিয়া খাতুনের। কিন্তু ভালোক্ষণে ঝগড়া করা ঠিক নয়। ইলহার উপর কিঞ্চিত রাগ হলো৷ কিন্তু নিজেকে সংযত রেখে বললো,
“হ্যা তো আর তোমার আমার মতো বাড়ি বইয়ে থাহে না রজিনা। বউ আমার ডাক্তার। মাসে মাইন্যে পায়৷ তাই ওর ছুটিছটা বুইঝাই আইতে হয়”
লিমনের মার মুখটা ভোঁতা হলো। আতয়া খাতুন বেশিক্ষণ থাকলেন না। কারণ বউদের কথা তার সহ্য হবে না। এদের সব কথায় ইলহা থাকে। সুতরাং এখানে থাকার মানে হয় না।
****
রাশাদের নাক জমে এসেছে। ঠান্ডা বাড়ার সাথে সাথে শরীরটা কাবু হয়ে যাচ্ছে। পরিশ্রমও কম যাচ্ছে না। প্রতিদিন চারঘন্টার জার্নি, উপরন্তু দোকানের চাপ বেড়েছে। ফলে শরীরটা মিয়ে যাচ্ছে। তবুও নিজ দায়িত্ব ভুলে না রাশাদ। যথা সময়ে রওনা দিলো ইলহাকে আনতে। আজ কুহেলিকার গাঢ়ত্ব বেশি। দু মিটারের মাঝেও কিছু দেখার জো নেই। কুয়াশার মাঝে দৃষ্টি খাবি খাচ্ছে, তবুও মোটরসাইকেল চালাচ্ছে সে। নাক বন্ধ থাকায় মাথা ব্যাথা করছে, ভার ভার লাগছে চোখজোড়া। জ্বলছে প্রচুর। খুলে রাখা দায় হয়েছে। তখন ই ঘটলো বিপদ….
চলবে
(ভালো লাগলে রেসপন্স করবেন। আপনাদের রেসপন্স আমাকে ভালো লিখতে সহায়তা করে)
মুশফিকা রহমান মৈথি
আগের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=396949246047575&id=100071975089266&mibextid=Nif5oz