#নিশীভাতি
#৩৬তম_পর্ব
কুয়াশার মাঝে দৃষ্টি খাবি খাচ্ছে, তবুও মোটরসাইকেল চালাচ্ছে রাশাদ। নাক বন্ধ থাকায় মাথা ব্যাথা করছে, ভার ভার লাগছে চোখজোড়া। জ্বলছে প্রচুর। খুলে রাখা দায় হয়েছে। তখন ই ঘটলো বিপদ। সামনে থেকে আকস্মিকভাবে একটা টেম্পু চলে আসায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লো রাশাদ। ব্রেক চাপলেও কাজ হলো না, ফলে বামে ঘুরালো মোটরসাইকেল। আকস্মিক এই সিদ্ধান্তে টাল সামলাতে না পেরে মোটরসাইকেল উলটে পড়লো। রাশাদ ছিটকে পড়লো একটু দূরে বালির উপর। এদিকটায় আলো নেই। রোডলাইটটা বেশ দূরে। রাশাদ অনুভব করলো তার সারা শরীর সম্ভব ব্যাথা করছে। দৃষ্টি ক্ষীন হলো। কিছু সময় ওভাবেই পড়ে রইলো সে। মোবাইলটা কর্কশ ধ্বনিতে বাজছে। কিন্তু ধরলো না। সময় পাড় হলো। হাতটা ভেজা লাগছে। উষ্ণ অনুভূতি। আঙ্গুল দুটো নাড়াতে পারছে না। অসহনীয় ব্যাথা করছে। পিঠ, পাঁজরের ব্যাথাটুকু সহ্যক্ষমতার মধ্যে থাকায় উঠে দাঁড়ালো সে। মোটরসাইকেলটার অবস্থা ভালো নেই। খুব কষ্টে তা দাঁড় করালো রাশাদ। স্টার্ট নিচ্ছে না। কুয়াশায় ঘেরা আকাশটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফোনটা বারে বারে বেজে থেমে যাচ্ছে। ওপাশের মানুষটি বেশ অধৈর্য্য বুঝা যাচ্ছে। শীতের রাত বলে বোধ হয় কুকুরও এসে মারালো না। কেউ ম*রে পড়ে থাকলেও হয়তো জানতো না। ভাগ্য নেহাৎ ভালো। তাইতো শুধু আঙ্গুল নাড়াতে পারছে না। আরোও খারাপ কিছু হতে পারতো। রাশাদ “আস্তাগফিরুল্লাহ” পড়লো। সাথে সাথে শুকরিয়া আদায় করলো, প্রাণে বেঁচে গেছে। কিন্তু মাসের অন্তিমে বাড়তি খরচ হিসেবে এই নষ্ট মোটরসাইকেলটা খুব পীড়া দিবে সেটা বুঝতে বাকি নেই। ফোন এখনো অক্লান্ত বেজেই যাচ্ছে। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ইলহার নামটা ভেসে উঠলো। ফোনটা ধরলো রাশাদ। ওপাশ থেকে অধৈর্য স্বর ভেসে উঠলো,
“আপনি কোথায়? ফোন ধরছিলেন না যে?”
রাশাদ খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“আসছি, একটু অপেক্ষা করুন”
রাশাদের স্বর শুনেই ওপাশ থেকে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আপনি ঠিক আছেন তো? কিছু হয়েছে? আপনার স্বর এমন লাগছে কেনো?”
রাশাদ নিঃশব্দে হাসলো। মেয়েটির কন্ঠে ঠিকরে পড়ছে চিন্তা। মেয়েটি কি বুঝতে পারলো রাশাদের কষ্ট হচ্ছে! মেয়েটি কিভাবে যেনো বুঝে ফেলে। এই রহস্যটি এখনো অজানা। রাশাদ লুকাতে চাইলেও পারে না। আজও হয়তো বুঝতে পেরেছে। রাশাদ তবুও বললো,
“ক্লান্ত লাগছে তাই”
“তাহলে আমি একা চলে আসি?”
“খবরদার না, আমি আসছি”
শক্ত কন্ঠে উত্তর দিলো রাশাদ। সে জানে ইলহা আসতে পারবে। কিন্তু তবুও তাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। দুঘন্টার রাস্তা, পুরোটা সময় অহেতুক চিন্তা করতে হবে। ইলহাকে আর কথা বলার সুযোগ দিলো না রাশাদ। ফোন রেখে দিলো। ইলহার বুকটা খচখচ করছে। মানুষটির স্বর কেমন যেনো শুনালো। এই কদিনের সংসারে এটুকু বুঝতে বাকি নেই, রাশাদ মানুষটি খুব জেদী, একগুঁয়ে। তার মনের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করতে পছন্দ করে না সে। এই যে প্রতিদিন ইলহাকে সে নিতে আসে, দিয়ে যায় ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ তো বটেই সেই সাথে ক্লান্তিকর। তবুও মানুষটি কথা বুঝতে চায় না। তার এক ভাষ্য,
“আমি বেঁচে আছি এখনো। সুতরাং আপনার একা একা যাতায়াত করার প্রয়োজন নেই। পথটা ভালো নয়। আমার চিন্তা হবে”
হ্যা, পথটা ভালো নয়। হাইওয়ে থেকে যেতে হয়। পথে তিনবার যান বদলাতে হয়। বাস থেকে নেমে টেম্পু, টেম্পু থেকে বাজারে নেমে ভ্যান। রাত হলে যান চললেও বাসে ডাকাতির আতঙ্ক থাকে। আশপাশটায় জনবসতি একেবারেই শূন্য। তাই রাশাদের অখন্ডিত নির্দেশ৷ ইলহা একা একা যাওয়া আসা করবেন না। কিন্তু মানুষটির যে কষ্ট হচ্ছে সেটা তো অস্বীকার করার নয়। ইলহা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, ব্যাপারটা নিয়ে আরোও একবার কথা বলবে সে।
একঘন্টা বাদে হাসপাতালের গেটে আসলো রাশাদ৷ মোটরসাইকেলের অবস্থা খুব করুন। বডিটা টিকে গেছে এইটাই বেশি। সাবফ্রেম, ব্রেক লিভার, উইন্ডস্ক্রিন, ব্রেক প্যাডেল সব কিছুতেই ঝামেলা হয়েছে। মিঠুকে ফোন করায় সে ছুটে আসলো একটা গ্যারেজের ছেলেকে নিয়ে। দুশো টাকা ধরিয়ে বলল,
“দেখ কি করতে পারিস”
মিঠু ছেলেটা বুদ্ধিমান। সে একটা ব্যবস্থা করতে পারবে এতে কোনো দ্বিধা নেই। রাশাদ শার্টটা বদলে নিলো। এই শার্টটায় রক্ত-ধুলোবালি মাখামাখি হয়ে একাকার অবস্থা। মিঠু নিন্মোষ্ঠ কামড়াচ্ছে। কিছু বলতে চাইছে সে। রাশাদ শার্টটের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো,
“কি বলবি বল”
“ডাক্তার দেহালি হতো না?”
“কখনো কি দেখিয়েছি?”
“না”
“তাহলে?”
“কয়ে লাভ নাই, আপনে হুনবেন না। হুমায়রা আফা থাকলে দেখতেন কি করে”
“খবরদার ওকে জানাস না। বোনটা আমার পাগলি আছে”
মিঠু আর কিছু বললো না। রাশাদ একটা টেম্পুতে উঠে রওনা দিলো। অবশেষে পৌছালো সে গন্তব্যে। রিসিপশনে অপেক্ষা করছিলো ইলহা। রাশাদকে দেখেই এগিয়ে আসলো। রাশাদ ক্লান্ত স্বরে শুধালো,
“বেশি দেরি হয়ে গেছে?”
“না…”
কিছু বলতে গেলেও থেমে গেলো ইলহা। তার চোখ গেলো রাশাদের ক্ষতবিক্ষত হাতের দিকে। রক্তটুকু পানি দিয়ে ধুয়ে নিয়েছে। তবুও চোখ থেকে এড়ালো না ক্ষতটা। আঙ্গুলের নখ উলটে গেছে, তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলি ফুলে গেছে। কপালে ভাঁজ পড়লো ইলহার৷ তীক্ষ্ণ হলো স্বর,
“এটা কি করে হলো?”
“ছোট একটা দূর্ঘটনা হয়েছে। আমার কিছু হয় নি। বাইকটার উপর দিয়েই গেছে। আজ বাসে যেতে হবে। এখন রওনা না দিলে বাস পাওয়া যাবে না”
ইলহার মুখবিবর শক্ত হলো। কিছুসময় চুপ রইলো। রাশাদ আবার তাগিদা দিলেই সে শীতল স্বরে বললো,
“আগে আমরা চেকাপ করবো৷ তারপর যাবো”
রাশাদ সাথে সাথেই বললো,
“প্রয়োজন নেই”
“সেটা চেকাপ না করে তো বলা যাচ্ছে না”
রাশাদের মুখখানা মিয়ে গেলো। পকেটে দুশো টাকাই ছিলো। তাও মিঠুকে দিয়ে দিয়েছে। এখন টাকা একেবারেই নেই। চেকাপ করালেই এক্সরে করাবে। ডাক্তারের খরচ আলাদা৷ রাশাদ রাজী হলো না। তর্কের সাপেক্ষে বললো,
“প্যারাসিটামল খেলে ঠিক হয়ে যাবে”
“মায়ের কাছে মাসির গল্প দিবেন না, আমার এমন অবহেলা পছন্দ নয়। আর ভুলে যাচ্ছেন কেনো, আপনার স্ত্রী এই হাসপাতালের ডাক্তার”
ইলহার শান্ত মুখখানা হুট করেই রুদ্ররুপ নিলো। রাশাদের কথা শুনলো না। জোর করে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলো। চেকাপ হলো। হাতে ফ্রাকচার হয় নি। তবে বেশ চোট লেগেছে। পাঁজরের দিকটা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সেই সাথে জ্বর। সেই অনুযায়ী ঔষধ দেওয়া হলো। ইলহা নিজের বেতন থেকে ব্যাপারটা এডজাস্ট করে নিলো। ব্যাপারটি মোটেই ভালো লাগলো না রাশাদের। কিন্তু ইলহার রুদ্ররুপের সামনে তার যুক্তি টিকলো না। ইলহা ভাষ্য খুব সহজ,
“যা আপনার তা আমার, তাহলে যা আমার তা আপনার নয় কেন?”
রাশাদের যুক্তি সেখানেই বুদ হলো। অবশেষে শেষ বাসটি পেলো তারা। হাসপাতাল থেকেই রাশাদ চুপ করে রইলো। ইলহা কথা বললেও সে উত্তর দিলো না। শুধু হ্যা, হা তে উত্তর দিলো। বাসভাড়াটাও ইলহাই দিলো। বাসায় এসে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলো। খাবার সময়টাতেও রাশাদ কথা বললো না। মৌন রইলো। দূর্ঘটনার কথা শুনে আতিয়া খাতুন বেশ উত্তেজিত হলেন। ইলহা আশ্বস্ত করলো ব্যাপারটা খুব জটিল নয়। রাশাদ খুব তাড়াতাড়ি খেয়েই নিজ ঘরে চলে গেলো। সব খাবার গুছিয়ে ইলহা এলো বেশ সময় পর। ঘরে এসে নিজের ব্যাগ রাখতে রাখতে শুধালো,
“ঔষধ খেয়েছেন?”
“না”
“অদ্ভুত মানুষ আপনি”
বলেই ঔষধ গুলো খুলে তাকে দিতে দিতে শুধালো,
“আপনার জ্বর ছিলো, তবুও এতো অবহেলা কেনো করেন বলুন তো! কি প্রয়োজন ছিলো আজ আমাকে নিতে যাওয়া। আমি তো একা একাই আসতে পারতাম”
“হু”
“কি হয়েছে বলুন তো? তখন দেখছি শুধু হু হু করছেন”
এবার চুপটি ভাঙ্গলো রাশাদ। বিরক্ত স্বরে বললো,
“এতো বাড়াবাড়ির দরকার ছিলো না। দেখলেন তো কিছুই হয় নি। মাঝখান থেকে আপনার বেতন কাটা গেলো”
“অদ্ভুত! আপনার একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে আর বলছেন আমি বাড়াবাড়ি করছি। যদি ফ্রাকচার হতো! আপনার এতো বেপরোয়া হওয়াটাই বাড়াবাড়ি”
“এতোদিন তো এভাবেই বেঁচে আছি তাই না?”
“এখন থাকবেন না। আমার এমন অবহেলা করা মোটেই পছন্দ নয়”
“আমার পকেটে এতোটা টাকা থাকে না যে পরোয়া হবার বিলাসীতা করবো”
রাশাদের স্বরটা ভিন্ন ঠেকলো ইলহার কাছে। বিস্মিত স্বরে শুধালো,
“আমি তো পেমেন্ট করে দিয়েছি। সমস্যাটা কোথায়”
“সমস্যাটা অহেতুক খরচে ইলহা। আপনি বেতন পাবেন বা কত, সেখান থেকে আজ আগ থেকেই টাকাটা কেটে গেলো। আপনি ভুলে কেনো যান আপনি আপনার বাবার বাসায় নেই। ইচ্ছে হলো খরচ করে ফেললাম তা নয়”
“আমি তো অহেতুক খরচ করি নি নাতীসাহেব। আপনার জন্য খরচ আমার কাছে মোটেই অহেতুক নয়”
“কিন্তু আমার কাছে তো অহেতুক লাগছে”
“আচ্ছা আমার ইনকামের টাকাতেই কি আপনার আপত্তি?”
রাশাদের কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়লো। কথার উত্তাপ বাড়লো। রাশাদ বিস্মিত স্বরে শুধালো,
“কি?”
“সেটাই তো এখন মনে হচ্ছে। নাহলে কেনো এতো আপত্তি আপনার? সত্যি বলতে আপনার মাঝেও যে মেল ইগো রয়েছে জানা ছিলো না”
ইলহার কথায় বিষন্নতার ছাপ। সে কথা বাড়ালো না। জামা পাল্টেই শুয়ে পড়লো। রাশাদ তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। অভিমান হলো কিঞ্চিত। মেয়েটি বুঝতেই পারলো তার আপত্তিটা কোথায়। এই একটা মাস কতটা কষ্ট করেছে মেয়েটা। অথচ বেতন পাবার পূর্বেই টাকাটা ভেঙ্গে ফেললো। টাকাটা থাকলে তার ভবিষ্যতে কাজে লাগলো। কিন্তু মেয়েটা বুঝলোই না। রাত গাঢ় হলো, সেই সাথে বাড়লো দীর্ঘশ্বাস।
****
আতিয়া খাতুনের কথা হলো হুমায়রার। মনটা মোটেই ভালো নয়। রাশাদের শরীরটা ভালো নয়। দুদিন ধরে বেশ জ্বর। কমছে না। আতিয়া খাতুন বেশ অভিযোগ করলেন। রাশাদ আজকাল একটু বেশি পরিশ্রম করছিলো। ভাইজানকে চিনে হুমায়রা। এখনো নিশ্চয়ই দোকানে যাবার তাল তুলছে। খুব বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ফাইজান রাজি হবে কি না জানা নেই। শ্বাশুড়িকে জানালে সে সাথে সাথেই বললেন,
“তুমি একবার ঘুরে আসো হুমায়রা। মন ভালো হবে”
কিন্তু ঝামেলা বাধালো ফাইজান। সে এক কথায় সবাইকে থামিয়ে দিলো,
“আমার সময় নেই। আগামী সপ্তাহে আমার ভোট আমি নড়তে পারবো না”
“আপনার যেতে হবে না। ফরিদ ভাই আমাকে নিয়ে যাবে”
“”আপনার ভাইজানের কাছে সবাই আছে, যদি আপনি তাও যান তবুও খুব একটা সমস্যা হবে না। কিন্তু আমার কাছে কে আছেন বলুন?”
“কেনো আম্মা?”
অবাক স্বরে উত্তর দিলো হুমায়রা। ফাইজান কিছুসময় তার দিকে তাকিয়ে রইলো। শান্ত চোখে দেখলো নিজের বউকে। এজন্য হয়তো বলে অসমবয়সী বিয়েতে চিন্তাধারা মেলাটা কঠিন। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি কি মাকে জড়িয়ে ঘুমাই? আপনি আর মা এক?”…….
চলবে
(ভালো লাগলে রেসপন্স করবেন। আপনাদের রেসপন্স আমাকে ভালো লিখতে সহায়তা করে)
মুশফিকা রহমান মৈথি
আগের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=397509732658193&id=100071975089266&mibextid=Nif5oz