#নিশীভাতি
#৩৭তম_পর্ব
ফাইজান কিছুসময় নিস্তব্ধ চেয়ে রইলো হুমায়রার দিকে। শান্ত চোখে দেখলো নিজের বউকে। এজন্য হয়তো বলে অসমবয়সী বিয়েতে চিন্তাধারা মেলাটা কঠিন। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি কি মাকে জড়িয়ে ঘুমাই? আপনি আর মা এক?”
আকস্মিক প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না কিশোরী। ফলে একরাশ কুন্ঠা তাকে ঘিরে ধরলো। সফেদ গালে জমলো অকৃত্রিম লজ্জা। দৃষ্টি নত হলো। কন্ঠে মিয়ে গেলো। ওড়নার ত্রিকোন হাতের ভেতর দলিত হলো। মানুষটি নিতান্তই নির্লজ্জ তাতে সন্দেহ নেই। নয়তো এমন বেফাক প্রশ্ন করত না। এই নত দৃষ্টিটা কিছুসময় নিপুন ভাবে অবলোকন করলো ফাইজান। হাতে থাকা ফাইলটা রেখে দিলো বিছানায়। হুমায়রা তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা হাতটি বাড়িয়ে তার নরম হাতটা ধরলো ফাইজান। দুরত্ব ঘুচিয়ে নিলো মুহূর্তেই। বসালো তার উরুর উপর। হুমায়রার দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাঢ় হলো। নিঃশ্বাস ঘন হলো। ফাইজান তার কোমড় চেপে ধরলো। আরেকটু কাছে টানলো তাকে। থুতনি ঠেকালো হুমায়রার কাঁধে। প্রগাঢ় স্বরে বললো,
“আমার আপনাকে চাই, আপনার কমতি যে কেউ পূরণ করতে পারবে না হুমায়রা”
হুমায়রা চোখ তুলে দৃষ্টি ফেরালো। খাদের ন্যায় গভীর চোখজোড়ার দিকে একপলক চাইলো। হৃদয়টা কেঁপে উঠলো। আনমনেই শুধালো,
“ভা..ভালোবাসেন?”
হুট করেই প্রশ্নটি করলো হুমায়রা। একরাশ জড়তা, দ্বিধা প্রকাশ পেলো তার প্রশ্নে। প্রশ্নটা করাটা অযৌক্তিক। তবুও বোকার মতো প্রশ্নটা করলো। গ্রামের বড় বু-ভাবীরা বলতো, “ভালোবাসলেই স্বামী এমন পা’গ’লের মতো আচারণ করে। কাঁধছাড়া করতে চায় না। আঁঠার মতো চিপকায় থাকে।”
ফাইজানের আচারণও কেমন পা’গ’ল পা’গ’ল। যা তার চরিত্রের সাথে একেবারেই যায় না। তার মতো গম্ভীর মানুষ কেনোই বা হুমায়রাকে ভালোবাসবে! হুমায়রার মনে পড়লো বিয়ের রাতের কথা, ফাইজানের দ্বিধাহীন উক্তি,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি না, হুমায়রা”
কথাটা স্মরণ হতেই হুমায়রার হৃদয় বসে গেলো। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো সাথে সাথেই। ফাইজান নিঃশব্দে হাসলো। তার চোখ স্থির কিশোরী বধুর দিকে। আলতো হাতে খোপা থেকে খুলে আসা অবাধ্য চুলগুলোকে কানের পেছনে গুজলো। খুব নরম স্বরে বললো,
“কি মনে হয়?”
অতিরিক্ত আশা কখনোই হুমায়রা করে না। সমীকরণহীন সম্পর্কে ভালোবাসা থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। এই সম্পর্কগুলোতে শুধু দায়িত্ববোধ থাকে, মাঝে মাঝে দায়িত্ববোধ থেকে বন্ধুত্বের জন্ম হয়। কিন্তু ভালোবাসা শব্দটি উহ্য থাকে। তাই চট করে উত্তর দিতে পারলো না হুমায়রা। ফাইজান এখনো উত্তরের অপেক্ষায় তার পানে চেয়ে আছে। ক্ষণসময় বাদে খুব নিচু স্বরে বললো,
“আপনার মতিগতি আমার বোঝার বাহিরে”
“আমি তো এতোটা জটিল নই হুমায়রা”
“পা’গল কখনো বলে না, সে পাগল। তেমন আপনিও জানেন না আপনি জটিল। কিন্তু আপনি জটিল”
এবার সশব্দেই হেসে উঠলো ফাইজান। কপাল ঠেকালো হুমায়রার কাঁধে। তার শরীর কাঁপছে। হুমায়রা অবাক হলো। এমন তো কোনো হাসির কথা বলে নি সে৷ তাহলে হাসছে কেনো লোকটি। ফাইজান এবার মুখ তুললো। হুমায়রাকে আরোও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বললো,
“আপনাকে কিভাবে যেতে দেই বলুন! আপনি ছাড়া আমি হাসবো কি করে! ঘুমাবো কি করে! জানি স্বার্থপর, কিন্তু আপনার নিস্তার নেই হুমায়রা। আমার আপনাকেই চাই, মৃত্যুর আগ অবধি, প্রতিক্ষণ, প্রতি মুহূর্ত। যদি এটাকে আপনাদের ভাষায় ভালোবাসা বলে তবে তাই সই”
হুমায়রা চোখ তুললো না। মস্তিষ্ককোষগুলো কাজ করছে না। মানুষটির অকপট উত্তর হৃদয়ে অদ্ভুত আলোড়ণ তৈরি করলো। শিরদাঁড়া বেয়ে উষ্ণ স্রোত বয়ে গেলো যেনো। হৃদস্পন্দন বাড়লো ক্রমশ। সেই সাথে চোখে জমলো অশ্রু। কেনো! নিজেও জানে না। ক্ষণসময় বাদে নিচু স্বরে শুধালো,
“আমি বাড়ি যাবো না তাহলে?”
“যাবেন, আমার সাথে যাবেন”
*****
শীতের অস্থিমজ্জা কাঁপানো বিকেলটা খুব আলসেমীতে কাটলো না ফরিদের জন্য। পোস্টারিং এর কাজে কোনো কমতি নেই। ভোটের জন্য সম্পূর্ণরুপেই তৈরি তারা। যদিও একটু চিন্তা হচ্ছে, কারণ তার বিপরীতে কেতাব চৌধুরীও দাঁড়িয়েছে। যদিও সে মনোনয়ন পায় নি পার্টি থেকে, তাই স্বতন্ত্র সে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটি নিয়ে একটু চিন্তিত ফরিদ। স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের দুটো ছেলে নাদিম এবং আফসানের ভেতরের গ্যাঞ্জামটি সীমা ছাড়িয়ে। যদিও ফাইজান নাদিমের সাথে কথা বলেছে। কিন্তু তাতেও কাজ হয় নি। আফসানের ছেলেগুলো আবার মারামারি করেছে। ভয় হচ্ছে এই ফাটলের সুবিধা না কেতাব চৌধুরী নেয়। ভোটটা গেলেই শান্তি এরপর এদের একরুমে আটকে পে’টা’নো যাবে। এখন থানা পুলিশের ঝামেলা ভালো লাগছে না। এরমাঝেই ফাইজান বললো,
“আমি দু রাত এক দিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। আমার সম্বন্ধী অসুস্থ”
ফরিদ বিস্ফারিত নয়নে চাইলো ফাইজানের দিকে। হতভম্ব স্বরে শুধালো,
“কি?”
“তোমার কানে কি সমস্যা ফরিদ ভাই? আজকাল সবকথাই রিপিট করতে হচ্ছে”
“তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে তাও রাশাদ সাহেব অসুস্থ তাই? এটা আমার বিশ্বাস করতে হবে?”
“প্রয়োজন তো নেই। বিশ্বাস অবিশ্বাসে কি যায় আসে। তুমি এই ছত্রিশ ঘন্টা সামলে নিও। এতোটুকুই”
“ক্ষেপেছো। এখন তোমার নড়া মানেই একটা বিপদ। এমনেই নাদিম আর আফসান তোমার ভয়ে সামলে চলছে। আবার উচ্ছনে যাবে”
ফাইজান অনঢ় স্বরে বললো,
“কিন্তু হুমায়রা যেতে চাইছেন”
“আমি পৌছে দিচ্ছি”
“তোমার যাওয়ার হলে তো আমিই তোমাকে পাঠাতাম। এখানটা সামলাতে বলতাম না”
ফাইজানের মতিগতি বিচিত্র। ফরিদের চিন্তা বাড়লো। জোর দিয়ে বলল,
“ফাইজান, কেতাব চৌধুরীর মতলব ভালো নয়। তুমি এই সময়ে…”
“ফরিদ ভাই”
ফাইজানের মাত্রাতিরিক্ত শীতল স্বরে চুপ করে গেলো ফরিদ। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখনো আবদ্ধ ফরিদের পানে। স্বরে তীব্র কাঠিন্য,
“আমি মেপে কাজ করি, এতো বছরে নিশ্চয়ই জানো। আমি যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভেবেচিন্তেই নিয়েছি। তাই নয় কি!”
ফাইজানের দৃষ্টি কোনো প্রাণনাশকের চেয়ে কম নয়। ফরিদ থেমে গেলো না তবুও। মিনমিনিয়ে বললো,
“আমি তো শুধু সতর্ক করছিলাম”
“তুমি অহেতুক চিন্তা করছো, একটা প্রবাদ আছে “মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত”— প্রবাদটি হয়তো কেতাব চৌধুরীর জন্যই বানানো। তাই তুমি চিন্তা করো না। তুমি কি জানো সে মামাবাড়ী গিয়েছিলো?”
বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো চমকালো ফরিদ। ফাইজানের ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। দেলওয়ার সাহেবের সাথে কেতাব চৌধুরী গিয়েছিলো ব্যাপারটি হজম হলো না। ফাইজান এবার গা এলিয়ে দিলো। তার মাঝে খুব একটা হেলদোল দেখা গেলো না। ফরিদ বিস্মিত স্বরে বললো,
“তাহলে তো তোমার গ্রামে যাওয়া উচিত”
“হ্যা, সেজন্যই বলছি আমি না মেপে কাজ করি না”
ফরিদ আর কথা বাড়ালো না। ফাইজানের দূরদর্শীতার আবার প্রমাণ পেলো। কেতাব চৌধুরী কেনো এতো বড় ঝুকি নিলো হিসেবে মিলছে না। এবার বুড়োটা যদি ক্ষান্ত হয়।
****
শীতের নির্মম থাবায় ভোরের মোরগটাও আজ ঝিমুচ্ছে। আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে গ্রামের মসজিদের থেকে। ইলহার চোখ খুললো খুব কষ্টে। মোটা সোয়েটারটাও হার মানছে শীতের কাছে। তবুও উঠতে হবে। আড়মোড়া ভেঙ্গেই পাশে চাইলো। মানুষটি ঘুমাচ্ছে। কপালে হাত দিলো ইলহা। গা হালকা গরম। জ্বরটা নেই মনে হয়। গত তিন দিন যাবৎ রাশাদের জ্বর। শুধু জ্বর নয়। একেবারে পারদের স্থানাঙ্ক ১০৪। এন্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। তবুও কমছে না। ঔষধের ডোজ বাড়াতে হবে এখন। আঙ্গুলের ফোলাটা কমে এসেছে যদিও। এই তিনদিন হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছে ইলহা। কারণ সে না থাকলে এই জেদি মানুষ দোকানে ছুটবে। মানুষটি খুব দূর্বল হয়ে গেছে। কিছুই খেতে চাচ্ছে না। রুচি নেই। অসুখ সমস্যা নয়। সমস্যা দারিদ্র। হাতে টাকা ফুরিয়ে এসেছে। বেতনটা এখনো একাউন্টে আসে নি। প্রতিদিন মোবাইলে একবার চোখ ঘুরায় ইলহা। যদিও রাশাদের ভাষ্য।
“আমি এমনিতেই সেরে যাবো ঔষধের প্রয়োজন নেই”
এই নিয়ে আরেকদফা তর্কযুদ্ধ হয়েছে ইলহার সাথে। এই চার-পাঁচ দিনে তাদের মাঝে ঝগড়াই হয়েছে। এখন ইলহা বুঝতে পারলো, কেনো বলা হয়,
“অভাব আসলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়”
দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে নিলো ইলহা। নামায আদায় করে রাশাদকে একবার স্পঞ্জ করলো। এরপর গেলো রান্নাঘরে। আতিয়া খাতুনের সাথে দেখা হলো সেখানে। আতিয়া খাতুন রুটির খাম বানাচ্ছেন। খোলা চুলগুলো খোঁপায় বেধে উনুন জ্বালালো ইলহা। আতিয়া খাতুন তার সাথে কয়েকদিন যাবৎ কথা বলেন না। এড়িয়ে যান। ব্যাপারটি নজর এড়ায় নি ইলহার। কিন্তু ব্যাপারটি খুব একটা ভাবায় না তাকে। আপাতত রাশাদের সুস্থতা বেশি জরুরি। এরমাঝেই আতিয়া খাতুন বলে উঠলেন,
“রাশাদের শলীলডা কেমন? জ্বর কমছে নি?”
“এখন একটু কম। ঘুমাচ্ছে”
“পোলাডা অমানুষে মতো খাটে। অসুখ তো বাধবোই। এখন কেউ যদি যত্ন না নেয় তাইলে অসুখের কি দোষ”
আতিয়া খাতুনের কথাটা ইলহার উদ্দেশ্যে সেটায় সন্দেহ নেই। কিন্তু ইলহা চুপ রইলো। কারণ এখানে তর্ক করলেই তর্ক বাধবে। ইলহা তাড়াতাড়ি হাত চালালো। আলু কাটলো দ্রুত। আতিয়া খাতুন তার ট্রানজেস্টার চালিয়েই গেলেন। মোট কথা রাশাদের অসুস্থতা ইলহার চাকরির জন্য। নাস্তা বানানো শেষে ইলহা বললো,
“দাদী, আমি উনার খাবার নিয়ে যাচ্ছি”
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। অন্যসময় হলে হয়তো চাকরিটা ছেড়ে দিত। কিন্তু এই কদিনে তার মনে হলো চাকরিটা তার দরকার। নিজের জন্য নয়, রাশাদের পাশে দাঁড়াতেই চাকরিটা দরকার। মানুষটার উপর অমানবিক বোঝ, সেটা কমানো স্ত্রী হিসেবে তার কর্তব্য। ঘরে এসে দেখলো রাশাদ তৈরি হচ্ছে। অবাক স্বরে শুধালো,
“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
“দোকানে। মিঠুটা কি করছে জানি না”
“আপনার জ্বর, আপনি এখন দোকানে যাবেন?”
“জ্বর নেই। পরীক্ষা করে দেখুন”
রাশাদের কথায় রাগ উঠলো ইলহার। প্লেটটা টেবিলে রেখে ক্ষিপ্ত স্বরে বললো,
“কোথাও যাচ্ছেন না আপনি। এখন নাস্তা করে, ঔষধ খেয়ে রেস্ট করবেন”
“ক্ষমা করবেন আপনার কথাটা মানতে পারছি না। কারণ আমার শুয়ে বসে কাটানোর পরিস্থিতি নেই। দোকানের বিক্রি নেই দুদিন”
“আপনি গেলে বিক্রি হয়ে যাবে?”
“আজব! জেদ করছেন কেনো ইলহা?”
“আমি জেদ করছি? সত্যি? আর আপনি যা করছেন সেটা কি?”
রাশাদ কিছুসময় চুপ করে রইলো। শীতল চোখে তাকালো ইলহার ক্ষিপ্র মুখবিবরের দিকে। মেয়েটি খুব জেদ করছে, যা অসুস্থ শরীরে ভালো লাগছে না। রাশাদ বিরক্ত স্বরে বললো,
“ঝগড়া করতে ভালো লাগছে না ইলহা। অবুঝকে বোঝানো যায়, কিন্তু যে বুঝেও বুঝে না তাকে আমি বুঝাতে পারবো না”
ইলহা কথা বাড়ালো না। কিছু সময় মৌণ রইলো। না চাইতেও চোখ জ্বলছে। তবুও নিজেকে সংযত রেখে বললো,
“যা খুশি করুন। আমার কথার যখন দাম নেই, বলেও লাভ নেই”
বলেই বেরিয়ে গেলো মেয়েটি। রাশাদ কয়েকবার পিছু ডাকলো কিন্তু শুনলো না মেয়েটি। রাশাদের ক্লান্ত লাগছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। ভিন্ন ট্রেনের যাত্রীদের একত্রে যাত্রাটা খুব একটা সুখময় হবে বলে মনে হচ্ছে না……
চলবে
(ভালো লাগলে রেসপন্স করবেন। আপনাদের রেসপন্স আমাকে ভালো লিখতে সহায়তা করে)
মুশফিকা রহমান মৈথি
আগের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=399857972423369&id=100071975089266&mibextid=Nif5oz