#নিশীভাতি
#৩৯তম_পর্ব
“হ জামাই বাপ, তোমার থেইক্যা একটা সাহায্য চাইছিলাম। কাওরে কইয়ো না। এমন কি হুমায়রারেও না”
কাওছারের পানে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ফাইজান। তার মুখভাব খুব শান্ত। কাওছার মানুষটির প্রবৃত্তি তার অজানা নয়। অত্যন্ত ধূর্ত এবং লোভী মানুষ। সে ভয় পায়, কিন্তু শুধু তার থেকে ক্ষমতাবান পার্থিব মানুষদের। সে ক্ষমতাকে ভয় পায়। এমন মানুষদের অতীব অপছন্দ ফাইজানের। লোভী মানুষদের ভরসা করা যায় না। কিন্তু তাদের লোভকে কাজে লাগানো যায়। তাই কাওছারের মতো লোকদের খুব কাছে রাখে সে৷ দাবার সৈন্যের মতো এগিয়ে দেয়। মা’রা গেলে তো গেলোই, আর ভাগ্য ভালো হলে শেষ অবধি রাজাকেও গিলতে পারে। মৃদু হাসলো সে। নরম গলায় বললো,
“বলুন আব্বা, কিভাবে সাহায্য করবো?”
ফাইজানের প্রশ্রয় পেয়ে দাতকপাটি বের করে হাসলো সে। আলজিহ্বাটুকুও দেখা যাচ্ছে। খুব ই কুৎসিত হাসি। ভাগ্যিস হুমায়রা এই পুরুষের মতো নয়। এক রত্তিও মিল নেই তাদের মাঝে। না বললে কেউ হয়তো বাবা-মেয়ে পরিচয়টাও বিশ্বাস করবে না। ভাগ্যিস। কাওছার এবার সহজ হলো। গদগদ স্বরে বললো,
“তুমি তো আমার জামাই, জামাই থেইক্যা গোপন করনের মানে নাই। আমাদের বাজারের কালাম মিস্ত্রী, ওর পোলাডায় এবার পাশ দেছে ইন্টার। ভালা ছাত্র। কিন্তু বাপে গরিব, তাই পড়ানোর খরচ নাই। ছেলে চাকরি খোঁজতেছে, সরকারি চাকরি। আমারে খুব ধরলো। আসলে গেরামে তো সবার জানা, তুমি হুমাইরারে কত্ত ভালাবাসো৷ না জামাই, তুমি পারবা নাকি! একটু ঢুকাইয়্যা দিতে। হেতি টেহা পয়সা সাধিলো আমারে। আমি কইছি, টেহা লাগতো না। জামাই আমার বড় নেতা। ও চাইলেই ঢুকাতি পারবে। জামাই তুমি পারবা না চাকরিখান দেতে?”
“আপনি কি তার থেকে টাকাটা নিয়ে নিয়েছেন?”
ফাইজানের প্রশ্নে চমকে গেলো কাওছার। থতমত খেলো রীতিমতো। সাথে সাথেই অস্বীকার করে বললো,
“না না, আমি টেহা নেই নাই। ও সাধিলো। কিন্তু আমি নেই নাই। হত্য কইতাছি জামাই। খোদার কসম”
ফাইজানের হাসলো। তার দৃঢ় বিশ্বাস কাওছার টাকা নিয়ে নিয়েছে। কাওছারের মতো মানুষের মাঝে মানবতা শব্দটি কখনোই থাকে না। লোভ এবং মানবতা দুটি শব্দ সর্বদা একে অপরের বিরোধিতা করে। যেখানে লোভের বাস সেখানে মানবতা স্থান পায় না। তাই কাওছারের মনে স্বল্প পরিচিত কোনো মানুষের জন্য এতোটা দরদ থাকবে, তা অবিশ্বাস্য। ফাইজান স্মিত হেসে বললো,
“ভালো করেছেন আব্বা। আমি সামান্য এম.পি। আমার এত্তো ক্ষমতা নেই। ক্ষুদ্র মানুষ আমি। ভোট হলে দেখা যাবে আমার গদি চলে গেছে। তখন আরেক বিপদ”
ফাইজানের কথায় রক্তশুণ্য হলো কাওছারের মুখ। তার মুখ যেনো দর্পন। ফাইজানের চোখে মুখে সন্তুষ্টি ছলকে উঠলো। কাওছার আমতা আমতা করে বললো,
“কিচ্ছু করতে পারবা না বাপ?”
“পারবো কতটুকু বুঝতে পারছি না, তবে এবার ভোটে জিতলে সুপারিশ পত্র লিখে দিবো। এতোটুকু করতেই পারবো।”
কাওছারের মুখের বর্ণ এখনো পাংশুটে। চিন্তা, ভয় সবকিছুই পরিলক্ষিত হলো। সে কালামের থেকে টাকা নিয়েছে। তাও গুনে গুনে দেড় লাখ টাকা। চেয়েছিলো ফাইজানকে দিয়ে কার্য হাসিল করাবে। ফাইজান নিশ্চয়ই এই ছোট একটা চাকরির জন্য এই সামান্য টাকা নিবে না। যার এতো আছে, তার ক্ষুধা লাখ দুয়েকে মিটবেও না। সামনে ভোটও আছে, সেজন্য টাকাটা সে নিজের সৎ ইমেজ রক্ষার্থেও নিবে না। অন্তত শ্বশুরের অনুরোধের পর তো নয় ই। সেই ফাঁকে লাভবান হবে কাওছার। নেতার শ্বশুর হওয়ার একটু তো ফয়দা তোলাই যায়। পিতা এবং পুত্রের সততার জন্য ফাইজানের কাজ থেকে টাকা চাইতে পারে না কাওছার। এইটুকু সাহায্য চাইতে তো ক্ষতি নেই। কেউ শুধালেই বলবে, জামাই এর থেকে সামান্য সুপারিশের অনুরোধ করেছি। কালাম কাউকে জানাবেও না। সব পরিকল্পনা একেবারে ভন্ডুল হয়ে গেলো। ফাইজানের কথায় একেবারেই চুপসে গেলো সে। ফাইজানের বেশ পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। কাওছারের মানুষদের এমন নাকানিচুবানি খাওয়াতে তার ভালো লাগে। সে অপেক্ষা করলো না। গাড়িতে উঠে পড়লো। কাওছার ভেবে কুল-কিনারাহীণ হয়ে পড়লো। চাকরি টা না হলে কালাম টাকাটা ফেরত চাইবে। কিন্তু টাকা ফেরত কি করে দিবে সে!
*****
ভাইজানের উপর বেশ অভিমান হলো হুমায়রার। যে মানুষটির জন্য ছুটে আসা সেই মানুষটি এখনো বাড়ি ফিরে নি। রাত ঘন হচ্ছে। শীতের প্রকোপ যেন আজ মাত্রাতিরিক্ত বেশি। বৃষ্টির জন্যই বোধ হয়। আতিয়া খাতুন মাছ কাটছেন। চুলোতে কষছে মাংস। ইলহা আঁচ কমিয়ে দিলো খানিকটা। এখন কাঠের চুলা চালাতে পারে সে। হুমায়রা বসে আছে রান্নাঘরের চৌকাঠে। ভাবীর উদ্দেশ্যে বলল,
“তুমি ভাইজানকে যেতে দিতে কেনো?”
ইলহা মৃদু হাসলো। উত্তরটা আতিয়া খাতুন ই দিলেন,
“না গেলে কি পয়সা আইবো নি বুবু? ভালাই হইছে গেছে। জামাই আইছে, ঘরে কিচ্ছু নাই আপ্প্যায়নের”
“উনি তো বাজার করেছেন। ওগুলো দিয়েই চালিয়ে দাও না দাদী”
“তুই কি পাগল নি? এডি তো দিমুই, আর কিছু দিতে হইবো না”
“উনি কি রাক্ষশ নাকি? আর দেখবে মামা বাড়ি থেকেই খাবার খেয়ে আসবেন”
“খায়ে আসুক। তাও আমগোর রান্না করতি হবে। জামাই এর আদরের ব্যাপার আছে না?”
“এজন্য আমার ভাইজানকে অসুস্থ শরীরে দোকানে যেতে হবে তাই তো?”
আতিয়া খাতুন বিরক্ত হলেন। কড়া স্বরে বললেন,
“হুনো বুবু, এতো ভাইজান, ভাইজান কইরো না। এহন তুমি ওই বাড়ির বউ। তোমারও মনে রাহা লাগবো যেনো ওই বাড়ির অসম্মান না হয়”
হুমায়রা বিস্মিত স্বরে বললো,
“তোমরা অদ্ভুত কথা বলতো দাদী, আড়াই-তিন মাসে আমি আমার বাড়ি ভুলে ওবাড়ির বউ হয়ে গেলাম? আর আমার ভাইজান যে আমাকে আঠারোটা বছর বটগাছের মতো ছায়া দিলো তার বেলায় ঠেঙ্গা? তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিবো”
“আমি কি হেইডা কইছি নি?”
“বলো নি, কিন্তু সেটাই তো অর্থ দাঁড়াচ্ছে। আমার কথা হলো, যে আমাকে বিয়ে করেছে আমার ঘর দেখে বিয়ে করেছে। যদি আমার ঘরে পানতা ভাত আর মরিচ ভাজা না খেতে পারে, তাহলে কিসের জামাই সে। এই তোমরাই জামাই নামক সম্পর্কটাকে পদবী বানিয়েছো। জামাই হয় নি, দেশের হনু হয়েছে”
ইলহা মুখটিপে হাসলো। দাদী শ্বাশুড়িকে একমাত্র তার ননদ ই শান্ত করতে পারে। আতিয়া খাতুন তর্কে পরাজিত হলেন। মাছটা কেঁটেই উঠে গেলেন। মিনমিন করে বললেন,
“তোমার লগে কথা কইয়ে লাভ নাই। মেলা বোঝো”
আতিয়া খাতুন যেতেই হুমায়রা ভাবীর উদ্দেশ্যে বলল,
“আমাদের এখানে কষ্ট হচ্ছে না তো ভাবী?”
” উহু, শুধু তোমাকে খুব মিস করছিলাম”
“দাদীর সাথে কথা হলেই তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছি। শুনেছি তুমি চাকরি পেয়েছো?”
“হ্যা। সবটার কৃতিত্ব তোমার ভাইজানের।”
“তাহলে জিতেছো বলো?”
“তা আর বলতে?”
বলেই দুজন একসাথে হেসে দিলো। কলপাড় থেকে আতিয়া খাতুন চিল্লিয়ে বললেন,
“না হাইসা মাংসের দিকে খেয়াল দাও। বুবু, পালংশাকটা বাইছ্যে দাও”
“আচ্ছা দাদী”
বলেই পালংশাকটা হাতে নিলো হুমায়রা। ইলহা হাসতে হাসতে বললো,
“আমার কথা তো শুনলে, তোমার কথা বলো”
“আমার আবার কি কথা?”
“এইযে, নেতাসাহেব আর তোমার গল্প? কি অবস্থা সেখানে?”
হুমায়রা মৃদু হাসলো৷ ধীর স্বরে বললো,
“আমাদের গল্পটা চলছে, মন্থরগতিতে কিন্তু চলছে”
“এখনো কি নেতাসাহেবকে অপছন্দ করো, নাকি একটু একটু করে পছন্দে তালিকা উত্তীর্ণ হচ্ছে?”
ইলহার প্রশ্নে ক্ষণ চুপ রইলো হুমায়রা। ইলহা উত্তরের প্রতীক্ষা করলো৷ হুমায়রা নিজের অন্তরকে টলালো। খুঁজলো উত্তর। সে কি এখনো তাকে অপছন্দ করে? মানুষটিকে অপছন্দের কি কোনো কারণ আছে আদোপি! তন্ময় স্বরে বললো,
“আমি তাকে বুঝতে পারি না, তবে এতোটুকু সত্য আমি তাকে অপছন্দও করি না”
ইলহার চোখে মুখে প্রশান্তি ছড়ালো। মাংসের হাড়ি থেকে একটি কষানো মাংস পিরিচে তুলে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“খেয়ে দেখো তো সেদ্ধ হয়েছে কি না?”
হুমায়রা খেলো। ইলহার রান্নার হাত ভালো। অতীব সুস্বাদু হয়েছে তরকারীটা। বেশি তেল মসলা নেই, কিন্তু স্বাদটা খুব দারুণ। দাদীর রান্না থেকে অনেক ব্যাতিক্রম। হুমায়রা বললো,
“সেদ্ধ হয়েছে, আর অনেক মজাও হয়েছে”
“থ্যাংক ইউ। ভাগ্যিস দাদী নেই, নয়তো বলতো তেল হয় নি”
“দাদীর সাথে তোমার বনছে না, তাই না ভাবী?”
ইলহা মলিন হাসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,
“সত্যি কি জানো, আমরা অনেক আলাদা। আমাদের চিন্তা, ভাবনা– সব আলাদা। আমি কখনো বলবো না সে ভুল৷ তবে তার সাথে আমার মত আপাতত মিলছে না। হয়তো আমি তার নাতীর যোগ্য নই”
কথাটা শেষে ম্লান হাসিটা বিস্তৃত হলো। কোথাও যেনো আক্ষেপ লক্ষিত হলো। হুমায়রা বুঝলো কিছুটা। মেয়েটির বয়স কম কিন্তু পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভালো। পুইশাকের বাটিটা ইলহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আমি বলবো না সয়ে নাও, তবে বলবো একটু মানিয়ে নিও। জানি খুব বাজে শোনায়, কিন্তু আমার আর ভাইজানের দাদা-দাদী ছাড়া কেউ নেই। আমি কখনো মায়ের ভালোবাসা পাই নি। কিন্তু দাদী আমাকে আগলেছে। তার ভালোবাসাতে কমতি নেই। শুধু সে মানুষটি বড্ড সেকেলে। পৌঢ় চিন্তা। তবে সে খারাপ নয় কিন্তু। তার সাথে তোমার সমীকরণ গোলমেলে হলে যাতাকলে পিষবে আমার ভাইজান। সেটা আমি চাইবো না।”
“জানি, তাই তো এক কান দিয়ে শুনি, আরেক কান থেকে বের করি”
আবারোও দুজন হেসে উঠলো। আবার আতিয়া খাতুন চেঁচালেন,
“এই দুই ফুড়ির দেখি কাম নাই, এই রাত্রবেলা খালি হাসে। হাসি বন্ধ”
*****
দেলওয়ার সাহেবের চোখে মুখে কুন্ঠা। ফাইজানের অতর্কিত আগমণ তার পরিকল্পনাতীত ছিলো। খেয়ে কেবল ধুম্রপানে মগ্ন৷ ছিলেন তখনই আগমণ ঘটলো ফাইজানের। সে সরাসরি দেলওয়ার সাহেবের ঘরে প্রবেশ করলো। তামাকের সরু নলটা সাথে সাথে নামিয়ে নিলেন দেলওয়ার সাহেব। নড়েচড়ে উঠলেন,
“তুমি?”
ফাইজান তার সামনের চেয়ারটিতে বসলো। নম্রস্বরে বললো,
“না-জানিয়ে আসার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী মামা। বিরক্ত করলাম নাকি! ”
“না না, বলে আসলে তোমার মামী রান্না করতেন। খেয়ে যাবা? বলি ভাত বসাতে?”
“সেটার প্রয়োজন নেই মামা। আমার শ্বশুরবাড়িতে রান্না হচ্ছে”
“ওখানেই থাকবে?”
“জ্বী, রাশাদ সাহেবের অসুস্থতার খবর পেয়ে আপনার বউ মা অস্থির হয়েছিলো। তাই আসা”
“ও”
দেলওয়ার সাহেব পুনরায় নলে টান দিলেন। ফাইজান তখন ই শান্ত স্বরে বললো,
“কেতাব চৌধুরী কত টাকা দিলো?”
কথাটা শুনতেই কেশে উঠলো দেলওয়ার। সে প্রস্তুত ছিলো না এই প্রশ্নের জন্য। নলটা পড়ে গেলো হাত থেকে। নিজেকে সামলাতে সময় নিলো। অপ্রস্তুত গলায় বললো,
“উনি আসছিলেন আর কি”
“জানি, দেওয়ালেরও কান আছে মামা”
“তুমি কি এটা জানার জন্য এখানে এসেছো?”
“নাহ! আমি তোমার কাছে ভাগ্নে হিসেবে আবদার করতে এসেছি। আবদারটা তোমার জানা নিশ্চয়ই”
দেলওয়ার সাহেব মৌন রইলেন। শুধু তাকিয়ে রইলেন সামনের নিরেট, গম্ভীর, তীক্ষ্ণ মানুষটির দিকে। ফাইজান শানিত স্বরে বললো,
“ঘাটের ওপারে মার কিছু জমি আছে, শুনেছি একটা মিল করার সাধ আপনার। বড় বড় মানুষের সাথে কথাও হচ্ছে। শুধু জমির পার্মিশন পাচ্ছেন না। কারণ এখানের সব উর্বর ধানের জমি। মার ওই জমিটা বাঞ্জার। পড়ে আছে অনেক বছর। হাইওয়ে রোড পাবে সামনে। মিলের জন্য পার্ফেক্ট। জমিটা পেলে ভালো লাগবে না মামা?”
“টাকাটা কি করবো?”
“রেখে দিন। বলবেন ক্যাম্পেইনে খরচ হয়েছে। সবাইকে কিনেছেন”
“যদি না জিতে!”
“টাকা খেয়ে কাজ করে নি। আপনার তো দোষ নেই। তাই না?”
দেলওয়ার সাহেব চুপ রইলেন। ফাইজান উঠে দাঁড়ালো। পোড়া ঠোঁটের কোনায় হাসি এঁকে বললো,
“আপনার আন্ডারে ১৫ টা কেন্দ্র। আমি একটাতেও হারতে চাই না। আসি তাহলে। গাড়িটা রেখে যাচ্ছি”
যেতে যেতেও থেমে গেলো ফাইজান। দেলওয়ারের বিবর্ণ মুখপানে চেয়ে বললো,
“শফি হত্যার কেসটা এখনো অমীমাংসিত। আপনি অনেক বুদ্ধিমান মানুষ। আশা করছি চাইবেন না আপনার ছেলে খুনের দায়ে জেলে পচুক”
দেলওয়ারের চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো। ফাইজানের ঠোঁটে দূর্বোধ্য হাসি। এই মানুষটি কতটা ভয়ংকর সেই নিয়ে রত্তিটুকু অবিশ্বাস নেই দেলওয়ালের। ছেলের কুকর্ম নিপুনভাবে লুকালেও ফাইজানের নজরে ঠিক পড়ে গেছে। দেলওয়ারের চোয়াল শক্ত হলো৷ মনে মনে বললো,
“তুই ও মরবি, বাপের থেকে কঠিনভাবে মরবি”
******
সদর থেকে বের হতেই আমানের মুখোমুখি হলো ফাইজান। হাতে মদের বোতল, টলমলে চলন। চোখজোড়া উদ্দেশ্যহীন। তাকে দেখতেই আমান কপাল কুচকালো। চেনার চেষ্টা করলো। নেশায় বুদ দৃষ্টিতে সবটাই ঝাপসাই লাগছে। ফাইজান তাকে দেখে ঠোঁট বিস্তার করে হাসলো। মৃদু স্বরে শুধালো,
“ভালো আছো?”
আমান এবার চিনতে পারলো। সাথে সাথে দৃষ্টি বদলালো। বিশ্রী গন্ধ আসছে তার সাথে। সে বিরক্ত গলায় বললো,
“হ্যা, ভালো”
“এতো নেশা করো না আমান। নেশা তোমাকে ডুবিয়ে দিবে”
“তোমার থেকে তো উপদেশ চাই নাই”
“কিন্তু বড় হিসেবে উপদেশ দেওয়া দায়িত্ব আমার। দেখো না, যাকে ভালোবাসতে তার জন্য একটা সাংঘাতিক কাজ করলে। অথচ এই নেশার জন্য তাকে হারালে। তোমার জীবনটা পড়ে আছে। তাই উপদেশ দিচ্ছি”
বলেই পা বাড়াতেই আমাল টলমলে স্বরে বললো
“হুমায়রা তোমারে ভালোবাসে না”
ফাইজানের হাসি মিলিয়ে গেলো। চোয়াল শক্ত হলো। ক্ষণসময় বাদে তাচ্ছিল্যভরে বললো,
“তবুও সে আমার স্ত্রী”
বলেই বেড়িয়ে গেলো সে। আমান সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। কি লাভ হলো এতো ভালোবেসে। মেয়েটা কখনো বুঝতেই চাইলো না।
*******
খাওয়া দাওয়ার পর হুমায়রার ঘরে এসে বসলো ফাইজান। এই প্রথম স্ত্রীর ঘরে সে প্রবেশ করেছে। খুব সিমসাম ছোট একটি ঘর। কোনো আহামরি কিছুই নেই। বালিশটা খুব পুরোনো। দাদী নতুন ধোয়া চাঁদর বিছিয়ে দিয়েছেন। ফাইজান নিপুন ভাবে দেখছে সব। হুমায়রা এখনো আসে নি। সে এখনো গল্প করছে ভাবীর সাথে। ফাইজান ভালো করে খেতে পারে নি। এতো ব্যাঞ্জন দেখেই কিছুটা বিব্রত হলো সে। উপরন্তু রাশাদ ঠিক তার বিপরীতে বসে ছিলো। ফাইজানের কোনোকালেই রাশাদকে পছন্দ নয়। কারণ রাশাদ যে তাকে অপছন্দ করে ব্যাপারটি বেশ প্রকাশ্য। আজও সেটাই হলো। পুরোটা সময় সে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলো। ফাইজানের বদহজম হচ্ছিলো। তাই ভালো করে খায় নি সে। এখনো একটু অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু ঘুমও আসছে না। কারণ হুমায়রা নেই। মেয়েটি কি আসবে না! কতসময় প্রতীক্ষিত রাখবে। আর না পেরে সে ডাক দিলো,
“হুমায়রা একটু পানি দিবেন?”
ওপাশ থেকে রাশাদের কন্ঠ কানে এলো,
“কল চেপে খান”
ফাইজান হতাশ হল। এদিকে আতিয়া খাতুন চিমটি কাটলেন নাতীকে৷ রাশাদ বিস্মিত স্বরে শুধালো,
“কি?”
“এমনে কিডা কয় জামাইরে। আর বুবু ঘরে যাও। তোমার বর ডাকে”
“আমার বোন কি তার কাজের মেয়ে? এসেছে কতদিন পর। গল্প করছে করুক না”
“তুই বুঝবি না”
বলেই ধমকালো আতিয়া খাতুন। হুমায়রাও মাথা নেড়ে পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে নিজ ঘরে গেলো। ইলহা ভেবে পায় না, যে মানুষটি এতো বুঝদার, বোনের ক্ষেত্রেই এমন ছেলেমানুষটি কেন হয়।
হুমায়রা ঘরে ডুকতেই হাত টেনে ধরলো ফাইজান। ফাইজানের এমন কাজে চমকে গেলো সে। বিস্মিত, বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ফাইজানের দিকে। ফাইজান নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
“আপনি তো ভারী দায়িত্বহীন হুমায়রা”
“জ্বী?”
“নিজের মানুষদের পেয়েই আমাকে ভুলে গেলেন? এটা কি ঠিক হলো?”
“ভুললাম কোথায়?”
হুমায়রার সরল প্রশ্নে ফাইজান কিছুটা চিন্তিত ভাব নিয়ে বললো,
“এই যে আমি পানি বাদে তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছিলাম, আপনি তো পাত্তাই দিচ্ছিলেন না”
“পানি তো নিয়ে এসেছি। নিন”
“আর আপনার তৃষ্ণাটা? সেটা কিভাবে মিটবে?”……….
চলবে
(গতকাল ব্যস্ত থাকায় দুটো পর্বের সমান একটি পর্ব দিলাম। গল্পটা নিরামিষ হচ্ছে অথবা ধামাকা পর্ব দিচ্ছি না বলে অনেক পাঠকের দাবি। তাদের জন্য বলছি, গল্পটা আমি যেভাবে সাজিয়েছি, সেভাবে হয়তো আপনার কাছে নিরামিষ লাগতেই পারে। কিন্তু গল্প সেভাবেই চলবে যেভাবে আমার পরিকল্পনা। তাই হতাশ হলে আমি দুঃখিত, কিন্তু অপারগ। ভালো লাগলে সাথে থাকবেন। )
মুশফিকা রহমান মৈথি
৩৮তম পর্ব
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/953982396323533/?mibextid=Nif5oz