প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি #সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী #পর্ব_৪৪ ,

0
318

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৪৪
,
সমুদ্রের যাওয়ার দুইদিন পেরিয়ে গেছে। এই দুইদিনে একটা বারও কোনো রকম যোগাযোগ হয়নি। মূলত ওখানে যাওয়ার পর থেকেই সব যোগাযোগ যেনো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সকাল থেকে বেশ করেকবার বমি হয়েছে। এই অবস্থায় এমন বমি খাবারে অনিয়ম করলে মা এবং বাচ্চা দুজন এরই ক্ষতি। জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে শশী। সমুদ্র যাওয়ার পরদিন থেকেই ওদের বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথমে ওতোটা খেয়াল না করলেও এই দুইদিন বেশ চোখে পড়ছে। শশী ভাবলো হয়ত সমুদ্র ওদের পাহাড়ার জন্য কাউকে রেখে গেছে এই জন্য বেশী মাথা ঘামালো নাহ। পেটের নিচের দিকটাই বেশ বেথ্যা করছে। এই জন্য নরম বালিশটা রেখে তাতে ভর দিয়ে বসে আছে। এবার একটু কম লাগছে। হাতের ফোনটায় চোখ বুলিয়ে পুনরায় সমুদ্রের নাম্বারে কল দিলো। প্রতিবারের মতো এবারেও বন্ধ আসছে। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ও যদি ভেঙে পড়ে তাহলে বাচ্চাটার ও ক্ষতি হবে সাথে শাহানারা কেউ সামলানো যাবে নাহ। চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ শরীর টা যেনো বিছানার সাথে মিলিয়ে গিয়েছে। শশীর ভাবনার মাঝেই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হল। শশী ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার ওপাশে থাকা লোকটাকে ভিতরে আসতে বলতেই রোদ্র হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে ভিতরে আসলো। রোদ্রের হাতে খাবারের প্লেট দেখতেই শশী নাক সিটকে বলল।

“রোদ্র ভাইয়া প্লিজ এটা নিয়ে চলে যান। আমি খাবো নাহ৷ এসবের গন্ধ নাকে লাগলেই কেমন বমি পাচ্ছে।

শশীর কথায় রোদ্র গেলো নাহ। বরং মুচকি হেসে প্লেটটা টেবিলে রেখে শশীর থেকে বেশ দুরত্ব নিয়ে বসে বলল।

” না না এমন করলে তো চলবে নাহ। দেখো তুমি এটা ভেবো নাহ যে আমি তোমাকে খাওয়াতে এসেছি। আমিতো আমাদের ওই যে কী বলে যেনো হ্যাঁ বংশের বাতি। আমিতো আমাদের বংশের বাতির জন্য খাবারটা এনেছি। এখন তুমি যদি না খাও তাহলে তারও খাওয়া হবে নাহ। আর আমি থাকতে এমনটা কখনোই হতে দেবো নাহ।

কথাটা বলে রোদ্র হাসি মুখে শশীর দিকে তাকালো। শশী করুণ চোখে রোদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো এমন তাকানোই রোদ্রের একটু মায়া হয় আর ওকেও খাবারটা খেতে না হয়। শশীর এভাবে তাকানো দেখে রোদ্র শশীকে বোঝানোর স্বরে বলল।

“দেখো শশী তুমিতো সবটাই বুঝতেছো তারপরেও এমন করলে চলবে? এখানে তুৃমি খাচ্ছো নাহ৷ ওদিকে মাও খাচ্ছে নাহ৷ আমি একা কয়দিকটা সামলাবো বলো? আবার তোমাদের এমন বিষণ্ণ দেখে জয়টাও মনমরা হয়ে বসে আছে। লুকিয়ে লুকিয়ে কান্নাও করছে৷ হয়েছে তো একদম ভাইয়ার মতো কাউকে কিছু বলবে নাহ৷ একা একা কষ্ট পাবে।

রোদ্রের থেকে জয়ের কথাটা শুনতেই শশীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এই কয়দিনের জয়ের কথাটা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলো। সমুদ্র ওকে যে দায়িত্ব দিয়ে গেছে সেটার কিছুই পালন করতে পারছে নাহ। না জানি ছোট ছেলেটা কোথায় গিয়ে বসে আছে। মাও অসুস্থ ওকে তো আমি ছাড়া দেখার ও কেউ নেই। আর সেই আমি কিনা। এসব ভেবে শশী তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতে গেলে রোদ্র থামিয়ে দিয়ে বলল।

” একি এভাবে কোথায় যাচ্ছো?

“জয়ের কাছে। ও খেয়েছে কিনা তাওতো জানি নাহ৷ বড় ভুল হয়ে গেলো। আপনি প্লিজ সরে যান ভাইয়া আমি গিয়ে দেখি ও কোথায় আছে।

” কোথাও যেতে হবে নাহ তোমায়। আগে খাবারটা শেষ করো৷ আর আমি জয়কে খাইয়ে দিয়েছি ও ওর ঘরে ঘুমিয়ে আছে। তুৃমি এখন কথা না বলে খেয়ে নাও তো।

শশীও আর কথা বাড়ালো নাহ। চুপচাপ হাতটা ধুয়ে টেবিলের উপর থেকে প্লেটটা নিয়ে খাওয়া শুরু করলো৷ রোদ্র অপলকভাবে শশীর দিকে তাকিয়ে আছে। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে আসতেই মাথা ঝাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের মনে বিরবির করে বলল।

“না না এভাবে ওর দিকে তাকানো অন্যায়। কোনো অনুভূতি নেই আমার মনে ওর জন্য৷ আমি শুধু ভাইয়ার দেওয়া দায়িত্ব পালন করছি আর কিছু নাহ।

কথাগুলো বলতেই ভিতর থেকে অন্য একটা সত্তা যেনো বলে উঠল। সত্যি কি তাই? কোনো অনুভূতি নেই? এটাও সম্ভব?
,,,,,,,,,,,

পরপর দুটোরাত না ঘুমানোর দরুন চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। পেশী বহুল লম্বা চওড়া শরীরে জংলী ছাপার পোশাকটা বেশ আঁটোসাটো হয়ে চেপে গাঁয়ের সাথে মিশে আছে। ছোপ ছোপ কাঁদায় মোড়ানো পুরো শরীর। নিচু হয়ে নিঃশব্দে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। শুকনো পাতার উপর পা পড়তেই মড়মড় শব্দে নিস্তব্ধতা ভেঙে আওয়াজ করে উঠতেই পিছনে ঘুরে আঙুলের সাহায্যে চুপ থাকতে বলল। রাত তখন কত সেটাও জানা নেই ঘন জঙ্গলের গাছ পাতার ফাঁক গলে চাঁদের আলো মাটিতে স্পর্শ করতে অক্ষম। দলনেতার পিছনে পিছনে সর্তক চোখে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে সৈনিকেরা। চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে সমুদ্র পিছনে ফিরে চোখের ইশারায় মাটির দিকে তাকিয়ে যথেষ্ট নিচু স্বরে বলল।

” এটার থেকে সাবধান।

কথাটা বলে মাটিতে পুঁতে রাখা জিনিটা এড়িয়ে সামনের দিকে গেলো। কারো জানা নেই আরো কোথায় কোথায় এগুলো রাখা আছে। সামনের অন্ধকার ভেদ করে আগুনের ফুলকি দেখা যাচ্ছে সমুদ্র হাতের ইশারায় সবাইকে থামতে বলল। সবাই থেমে যেতেই পিছন থেকে কাঁপা স্বরে কেউ ডেকে উঠল।

“স্যার।

সমুদ্র পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখলো তাদের মাঝে একজন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো নড়াচড়া নেই। সমুদ্র ভ্রু কুঁচকে নিচের দিকে তাকাতেই সর্তক কন্ঠে বলে উঠল।

“নড়ো নাহ। একদম নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকো।

কথাটা বলতে দেরি কিন্তু ছেলেটি সেটা শোনতে দেরি করলো নাহ। ভয়ে সমুদ্রের কথা না শুনেই পা উঠিয়ে পিছাতে গেলেই বিকট শব্দে আগুন জ্বলে উঠল। ছেলেটির পাশে যারা ছিলো তারাও ছিটকে কিছুটা দূরে পড়ে গেলো। সমুদ্র সেদিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনের দিকে ফিরলো। সামনের তাবু গেরে ওসমান তার ঘাটি বসিয়েছিলো। সেখান থেকে বেশ গোরগোল আসছে। সমুদ্র পুনরায় পিছনে ফিরে বলে উঠল।

” ওহ শিট। সবাই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ো ফাস্ট। হাতে সময় খুবি কম, গো।

কথা অনুযায়ী সবাই যার যার মতো নিজের জায়গা প্রস্হান করলো। কিন্তু সেখানে পড়ে রইলো দুটো পুড়ে যাওয়া সৈনিক এর নিথর প্রাণহীন দেহ।
,,,,,,,,,,,,

ডয়িং রুমের সোফায় মননরা হয়ে বসে আছে শশী। সারাদিন রুমের মধ্যে থাকতে থাকতে কেমন দমবন্ধ লাগছে। শাহানারা নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। বাড়িতে আপাতত কেউ নেই। জয় রোদ্রের সাথে বাইরে গিয়েছে। একা একা ভালো লাগছে নাহ। তাই জন্য শশী ঘরের সদর দরজা খুলে বাইরে গেলো। হাঁটাচলা করতে খুব বেশিই কষ্ট হয়। তবুও একটু আধটু না হাঁটলে পা ফুলে যায়। যদিও সমুদ্র বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলো। কিন্তু ওতো বেশিদূর যাবে নাহ। বাড়ি আঙ্গিনায় একটু হাঁটবে গেটের বাইরে যাবে নাহ। ঘর থেকে বেরিয়ে তিনটা সিঁড়ি পাড় করে বাইরে আসলো শশী। সামনে তাকিয়ে দেখে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দারোয়ান ঝিমুচ্ছে। শশীর আসার শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকাতেই সেই ঝিমুনি ভাবটা কেটে গিয়ে সটান করে দাঁড়িয়ে রইলো। শশী সেদিক থেকে নিজের চোখ সরিয়ে বাড়ির পিছন দিকটায় গেলো। প্রাচীরটা বেশ উঁচু করে দেওয়া যার দরুন বাইরের কিছু দেখা যাচ্ছে নাহ। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে শশী পুনরায় সামনের গেটের দিকটায় গেলো। রেলিং এর ফাঁক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকালো। হ্যাঁ ওইতো সেই কালো গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। সমুদ্র যাওয়ার পর থেকে গাড়িটা এখানে দাঁড়ানো । কিছু একটা মনে হতেই শশী গেটের কাছে চলে গেলো। শশীকে দেখে দারোয়ান নম্র ভাবে জিগাস করলো।

“ম্যাম কিছু লাগবে?

” না কিছু নাহ।

কেনো জানি নিজের সন্দেহের কথাটা দারোয়ানকে বলল নাহ। খানিকক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকে যখন ফিরে আসতে যাবে তখনি চোখে কিছু একটা পড়লো। সেই কালো গাড়িটার ডিকি খুলে সেটার মধ্যে প্রবেশ করছে জয়। নিজেকে ডিকির মধ্যে সেট করা হতেই আস্তে করে সেটা বন্ধ করে দিলো। শশী বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে কোথাও রোদ্র নেই। কিন্তু জয়তো রোদ্রের সাথেই ছিলো তাহলে রোদ্র কোথায় গেলো। আর জয়ই বা কেনো গাড়িতে উঠে গেলো। অস্থির হয়ে শশী গেট দিয়ে বের হতে গেলে দারোয়ান আটকে দিলো।

“ম্যাম আপনি কোথায় যাচ্ছেন? বড় স্যার কড়া ভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন আপনাকে যেনো বাইরে যেতে না দিই।

” আরে তুমি দেখোনি জয়। ওই গাড়িতে জয় আছে তুমি যাও আর ওকে বের করো ওখান থেকে।

শশীর কথায় দারোয়ান আশে পাশে দেখলো ততক্ষণে শশী বেশ করেক বার রোদ্রকে ফোন দিয়েছে কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ফোনটা রিসিভ করেনি। শশী উপায় না পেয়ে ইমরান কে কল দিলো। ইমরান আসছি বলে কলটা কেটে দিলো৷ শশী দারোয়ানকে পুনরায় তাড়া দিতেই দারোয়ান গাড়িটার দিকে গেলো। কিন্তু ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। শশী দ্রুত পা চালিয়ে গেটের বাইরে এসে রাস্তায় দাঁড়ালো। এর মধ্যেই শরীর ঘেমে একাকার। এইটুকু আসতেই হাঁপিয়ে গেছে। গাড়িটা এখন আর দেখা যাচ্ছে নাহ বেশ খানিকটা দূর চলে গেছে। দারোয়ান হাঁপাতে হাঁপাতে শশীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল।

“ম্যাম একটুর জন্য গাড়িটা ধরতে পারিনি। আপনি প্লিজ বাসার মধ্যে যান।

কিন্তু শশী কোনো কথা শুনলো নাহ। বার-বার রোদ্রের নাম্বারে ডায়াল করছে। এতোক্ষণ ফোন গেলেও এবার বন্ধ আসছে৷ শশী অস্হির হয়ে এদিক ওদিক দেখছে। কিছুক্ষণ পর ওর সামনে ইমরান গাড়ি নিয়ে এসে থামালো। ইমরান গাড়ি থেকে নামতে গেলে শশী ওকে থাকিয়ে দিয়ে বলল।

” আপনি নামবেন নাহ ইমরান ভাইয়া জলদি গাড়ি স্টার্ট করুন। ওই গাড়িটা এদিকে গিয়েছে। এতোক্ষণে হয়ত অনেকটা দূর চলে গিয়েছে৷ প্লিজ আপনি গাড়িটার পিছু করুন।

কথাটা বলে শশী গাড়িতে উঠে বসলো। ইমরান পিছনে তাকিয়ে শশীর দিকে তাকিয়ে বলল।

“কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন। আপনি বাসায় যান আমি দেখছি।

” আমিতো বললাম আমি যাবো আপনি গাড়ি স্টার্ট করুন ইমরান ভাইয়া।

“কিন্তু ম্যাম। স্যার?

” সেটা আমি বুঝে নেবো আপনাকে যেটা বললাম সেটা করুন এটা আমার আদেশ। প্লিজ জলদি গাড়ি স্টার্ট দিন নয়ত আমরা ওই গাড়িটা আর ধরতে পারবো নাহ।

শশীর গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে ইমরান আর না করতে পারলো নাহ। চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সামনের দিকে গেলো। শশী বারবার রোদ্রের নাম্বারে কল দিচ্ছে কিন্তু বারবারই বন্ধ আসছে। শশীর মাথায় একটা কথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। গাড়িটা কার? গাড়িতে কে এমন ছিলো যার জন্য জয় এভাবে নিজে থেকে গাড়িতে উঠে বসল। যদি চেনা কেউই থাকবে তাহলে ও ডিকিতে লুকালো কেনো? আর রোদ্রই বা কোথায়? ওনার ফোন কেনো বন্ধ?

#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here