#চন্দ্রকলা
#লামিয়া_ইসলাম
#পর্ব_১৪ (প্রথমাংশ)
চন্দ্র তার হাতে থাকা কারুকার্য করা ছুরিটা নিয়ে সাফোয়ানের গলায় ঠেকালো। যেই না সে ছুরিটা দিয়ে তার গলায় পোচ দিতে যাবে হঠাৎই তার নাকের কাছে একটা পোড়া গন্ধের আবেশ পেলো। ঠিক তার পর পরই সে বাড়ির কাজের লোক ফুলির চিৎকার শুনতে পেলো। ফুলির চিৎকার শুনতে পেয়েই চন্দ্র তাড়াতাড়ি ছুরিটা সাফোয়ানের গলা থেকে সরিয়ে নিজের শাড়ির আঁচলের তলায় লুকালো।ইতিমধ্যেই ফুলির চিৎকারের শব্দ পেয়ে সাফোয়ানের ঘুম কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে। তাই সে হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠেই চন্দ্রকে সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ভড়কে গেলো। কিন্তু সে চন্দ্রকে কিছু না বলেই তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে বের হয়ে গেলো। চন্দ্রও ছুরিটা আলমারির ভিতরে বক্সের মধ্যে তার পিছু পিছু বের হয়ে গেলো। তারা বাড়ির দোতলার উত্তর পাশের ঘর থেকে দেখলো ধোয়া বের হচ্ছে। তাই তারা ওই রুমের সামনে দৌড়ে গিয়ে দেখলো রুমের ভিতর থেকে ধোয়া আসছে আর ফুলি রুমের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে।
-ফুলি এই রুম থেকে এত ধোয়া আসছে কেন?
-জানি না ভাইজান। আমার ঘরে গরম লাগে দেইখা আমি বারান্দায় মাদুর পাইতা ঘুমাইছিলাম। পোড়া পোড়া গন্ধে ঘুম ভাঙলেই দেখি রুম থেইক্কা ধোয়া বের হইতাছে।
-আমার মনে হয় ভিতরে আগুন লেগেছে। এক বালতি পানি নিয়ে আয়।
ফুলি দৌড়ে পানি আনতে ছুটলো। বাড়ির বাকি সদস্যরাও ইতিমধ্যে ওই ঘরের সামনে এসে জড়ো হয়েছে।
এই ঘরটি আগে জমিদার বাড়ির অর্থ সংরক্ষণের কোষাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখানে আগের মত এত অর্থ সঞ্চিত না হলেও বাড়ির মেয়ে বৌদের গহনা, জমির কাগজপত্র সহ প্রায় মূল্যবান জিনিসই এই ঘরের সিন্ধুকে রাখা হয় পাশাপাশি সাফোয়ান তার ব্যাবসায়িক বিভিন্ন কাজকর্মও এখানে বসে সমাধা করে। সেই হিসেবে বলতে গেলে এটা এ বাড়ির সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কক্ষ।
ফুলি পানি নিয়ে আসতেই সাফোয়ান আর সাহেদ মিলে পানির বালতিটি নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। ভিতরে গিয়ে তারা দেখলো সাফোয়ানের বসার চেয়ারটিতে আগুন লেগেছে। তারা অনেক চেষ্টার পর আগুন নেভাতে সক্ষম হলো। এই চেয়ারটির বয়স ১০০ বছরেরও বেশি।
উত্তরাধিকার সূত্রে যে জমিদার হয় এই চেয়ারটিতে বসার অধিকার কেবল সেই পায়। তারা কোনোভাবে ভেবেই পেলো না যে কিভাবে এইখানে আগুন লাগতে পারে। সব কিছুই যেন তাঁদের কাছে ধোঁয়াশা লাগছে।সাব ইন্সপেক্টর আরিফও এতক্ষন যাবৎ বিষয়টি খেয়াল করেছে। সেও কোনোমতে সমাধান করতে পারলো না যে আগুনটি কিভাবে লাগলো। একরাশ ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে যে যার রুমে আবার ফিরে গেলো।
-স্যার আপনার সাথে আমি কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই
-জি বলুন।
-স্যার ইন্সপেক্টর সাহেব আমাকে কালকে রাতের আগুন লাগার ব্যাপারে তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছে। আপনি যদি একটু আমাকে এই ব্যাপারে একটু সাহায্য করতেন।
-জি জি বলুন আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
-স্যার কালকে যে ঘরে আগুন লেগেছে ওই ঘরের চাবি কার কার কাছে রয়েছে।
-ওই ঘরের তালার তিন সেট চাবি রয়েছে। কারণ তালাটা খুবই পুরানো আমলের । তাই ওই তালার চাবি এখন আর কেউ বানাতে পারে না।
-ওই ঘরের চাবি গুলো কার কার কাছে থাকে?
-এক সেট আমার কাছে, আরেক সেট আমার মায়ের কাছে আর এক সেট…
-আরেক সেট কার কাছে থাকে?
-আর এক সেট অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।
-কবে হারিয়েছে?
-প্রায় ১৫-২০ বছর আগে।
-কালকে তো আপনি প্রথমে ঐখানে গিয়েছিলেন। ঘরের তালা কি খোলা ছিল?
-হ্যা। ঘরের তালা খোলা ছিল।
-আপনার কি মনে হয় যে আগুন লাগিয়েছে সে কি আপনার বা আপনার মায়ের ঘর থেকে চাবি চুরি করেই ওই ঘরটা খুলেছে।
-না। সেটা সম্ভব না। কারণ কালকে আমি আর আমার মা দুইজনের রুমের দরজাই ভিতর থেকে বন্ধ ছিল তাই এটা সম্ভব না।
– আপনাদের দুইজনের চাবি গুলো আমার কাছে দেবেন। আমি ল্যাব টেস্টের জন্য পাঠাবো। কিছুদিনের জন্য অন্য তালা ব্যবহার করুন। আর ওই ঘরটাও আমি একটু ঘুরে দেখতে চাই। আর একটা কথা কোনো জিনিস কি চুরি হয়েছে ওই ঘর থেকে?
-না কোনো কিছুই চুরি হয়নি।
সাফোয়ানের সাথে কথা বলা শেষ করেই আরিফ জমিদার বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলো। কিছু দূর এসে সে ফোন বের করে ইন্সপেক্টর আসাদকে কল দিলো।
-কি হলো আরিফ কিছু জানতে পারলে জমিদার সাহেবের থেকে?
-জি স্যার।
আরিফ একে একে সাফোয়ানের বলা যাৰ কথাগুলো আসাদ কে বললো।
-এ তো মহা সমস্যা। কিছু চুরিও হয়নি। শুধু চেয়ার পুড়িয়েছে। চাবি কারো কাছে নেই আবার এই টাইপের চাবি নাকি কেউ এখন বানায় ও না। আবার নাকি ঘরের দরজাও খোলা ছিল। তাহলে কে করলো আর কেনই বা করলো? তাড়াতাড়ি এইসবের সমাধান করো। আমার মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে। এই কেসটা শেষ হলে আমি একটা লম্বা ছুটি নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে যাবো।
-স্যার আমাকেও সাথে করে নিয়ে যাইয়েন।
-সেটা সময় হলে দেখা যাবে।এখন তোমার নেক্সট প্ল্যান কি?
-স্যার আমি ঘরের দুই সেট চাবি আর চেয়ার পোড়া ছাইগুলোর নমুনা ল্যাব টেস্ট করতে পাঠাবো। আগুনটা কিভাবে লাগলো টা সম্পর্কে জানা দরকার।
-ঠিক আছে। সাবধানে থেকো।
আরিফ জমিদার বাড়িতে ফিরে এসেই দোতলার ঘরটিতে ছুটলো। সে ধীরে ধীরে পুরো ঘরটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। সে দেখতে পেলো ঘরের ওপর পাশে একটি জানালা আছে। যেটা সম্পূর্ণ চেয়ারটির সম্মুখে। সে প্রথমে ভাবলো জানালা থেকে হয়তো কেউ এই কান্ডটি ঘটিয়েছে। কিন্তু সে চিন্তা করলো যদি জানালা দিয়েই আগুন লাগায় তাহলে দরজা খোলার দরকার কি ছিল? পুরো ঘরে সে কিছুই খুঁজে পায় না। সে চেয়ার থেকে ছাইয়ের কিছু অংশ প্যাকেট করে নেয়। কিন্তু যখনি সে বের হতে নেবে রুম থেকে তখনি তার নজর একটি মেঝেতে পরে। মেঝেতে সে একটি আংটি দেখতে পায়। আংটি টা দেখতে খুবই পুরোনো মনে হচ্ছিলো। সে মনে করে হয়তো এই বাড়ির কারো হবে। তাই সে আংটি টাও উঠিয়ে নেয়।
হঠাৎ করে কারো চেঁচামেচিতে রিমার ঘুম ভাঙলো। হঠাৎ করে তার মনে পড়লো যে কাল রাতে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে আশে পাশে তাকিয়ে তার স্বামীকে খুজলো। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলো না। তার বদলে দেখতে পেলো তার স্বামীর প্রথম স্ত্রীকে। যে তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
-কিগো তুমি কি কিছু শিখা আহো নাই বাপের বাড়ি থেইক্কা?শশুর ঘরে আইয়াও এত দেরি পর্যন্ত ঘুমাই থাহো।
-একটু ক্লান্ত লাগছিলো বুবু। টের পাই নাই।
-হইছে হইছে আর বাহানা দেওয়া লাগবো না। এই শাড়িটা ধরো। গোসল কইরা চুলার কাছে আহো।
-ঠিক আছে বুবু।
লোকমান মিয়ার প্রথম স্ত্রী গটগট করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। রিমা তাকে দেয়া শাড়িটাকে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। সে দেখলো শাড়ির আঁচলে হলুদের দাগ লেগে আছে। সে বুঝতে পারলো শাড়িটি অন্য কারো ব্যবহার করা। তার প্রতি করা এসব ব্যবহার দেখে তার সকল আশা যেন ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যেতে লাগলো।
অসামানিকে দিয়ে চন্দ্র তার বাগানের জন্য জমিতে বীজ লাগাচ্ছে। হঠাৎই করেই তার নজর গেলো আসমানীর হাতে। সে দেখলো বেশ খানিকটা পোড়া দাগ। সে হতচকিয়ে বললো,
-চাচী আপনার হাতে কি হয়েছে? এত পোড়া দাগ বলে মনে হচ্ছে। আর বেশ পুরোনো দাগ হবে।
-আরেহ মালকিন কি আর বলবো।অনেক বছর আগের কথা এক দুর্ঘটনায় এসব হয়েছে। এইসব ক্ষত এখন পুরোনো হয়ে গেছে।সময়ের সাথে সাথে শরীরের ক্ষত তো মিলিয়ে যায় কিন্তু হৃদয়ের ক্ষত তো আরো বেদনাদায়ক হয়।
চলবে….
গ্রুপ লিংক :https://facebook.com/groups/3532259070436906/