#চন্দ্রকলা
#লামিয়া_ইসলাম
#পর্ব_১৫
-এখানে কেনো আমাকে ডেকেছেন? আমি সাফোয়ান চৌধুরীকে ঘুমের ঔষুধ দিতে বাধ্য হয়েছি।
-বাধ্য হয়েছো মানে?তুমি তো ওই বাড়িতে বিয়েই করেছিলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। কিন্তু আজকাল দেখছি সাফোয়ান চৌধুরীর জন্য তোমার মনে বেশ প্রেম জেগে উঠেছে। তুমি কি তোমার লক্ষ্যের কথা ভুলে গেলে।
-না আমি ভুলিনি।আমি শুধু ওনাকে বেশি কষ্ট দিতে চাই। আমাদের প্রিয় মানুষ যখন আমাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে তাতে আমরা সবচেয়ে বেশি আঘাত পাই। আমিও সাফোয়ান চৌধুরীর বিশ্বাস অর্জন করে ওনাকে ধ্বংস করতে চাই। যেন উনি বুঝতে পারে প্রিয় মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে কেমন লাগে? আমি সেদিনই সাফোয়ান চৌধুরীকে শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে আগুন লেগে যাওয়ায় আমি আর কিছু করতে পারি নি। আর আমি এখন ওনাকে মারতেও চাই না। কেনো না আমার এখন শুধু ওনার মৃত্যু চাই না বরং সাথে সাথে আমি এত বছর ধরে যে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি সেই অধিকার ফিরে পেতে চাই। পুরো উজানপুরে আমি রাজত্ব করতে চাই। কারণ এ আমার অধিকার।
-হুম বুঝতে পেরেছি। সাবধানে থেকো। তোমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে কেউ যেন ভুলেও না জানতে পারে যে তোমার আসল পরিচয় কি?
-হ্যা আমি সাবধানেই আছি। আর আমাকে হুটহাট এভাবে ডাকবেন না। বাড়িতে দুইজন পুলিশ নিরাপত্তায় আছে। তাঁদের কারো সামনে পরে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে। আমি এখন আসি।
চন্দ্র পোড়া বাড়িটি থেকে বেরিয়ে গায়ের চাদরটি আরো ভালো করে শরীরে পেঁচিয়ে নিয়েছে। ধীরে ধীরে পাশেই নিজস্ব গতিতে বইতে থাকা চন্দ্রকলা নদীর পাড় ধরে চলতে থাকে। এক পর্যায়ে সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে উজানপুরের আকাশে ওঠা শুল্কপক্ষের চাঁদ দেখতে থাকে।
চন্দ্র দৃঢ়তার সাথে নিজে নিজেই বলে উঠে,
-আমি মিসেস চন্দ্র সাফোয়ান চৌধুরী। জমিদার সাফোয়ান চৌধুরীর স্ত্রী। গত তিন বছর ধরে আমি প্রতিশোধের নেশায় জ্বলছি। আমার বিয়ের সময় আমি লাল শাড়ি নয় বরং আমার স্বামীর কাফনের কাফন জড়িয়ে এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি। আমি শুধু সাফোয়ান চৌধুরীর ধ্বংস চাই। তার করা বিশ্বাসঘাতকতার যোগ্য জবাব তাকে দিতে চাই। রক্তের বদলে রক্ত জীবনের বিনিময়ে জীবন এটাই আমার উদ্দেশ্য।
আসমানি নামক মহিলাটির ঘুম হঠাৎ করে ভেঙে গেলো। সে উঠে গিয়ে তার ঘরের দরজা খুলে ধীরে শিরিন বেগমের ঘরের দিকে গেলো। শিরিন বেগম তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে ধীরে ধীরে নিজের শাড়ির আঁচলের খুট থেকে এক গোছা চাবি বের করে তার মধ্যে দিয়ে একটা চাবি দিয়ে শিরিন বেগমের ঘরের আলমারিটি খুললো। সেখান থেকে সে নীল রঙের বেশ পুরানো একটি শাড়ি নিয়ে ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। যাওয়ার সময় সে ইচ্ছে করেই আলমারি আর ঘরের দরজা খুলে রেখে গেলো।
চন্দ্র তড়িঘড়ি করে রুমে এসে দরজা বন্ধ করলো। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো সাফোয়ান এখনও গভীর ঘুমে নিবদ্ধ। সেও নিঃশব্দে ধীরে ধীরে গিয়ে সাফোয়ানের পাশে শুয়ে পড়লো।আসমানী বেগম রুমে এসে শিরিন বেগমের রুম থেকে আনা শাড়িটিকে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। তারপর শাড়িটিকে বুঁকের সাথে চেপে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলো।
ফজরের আজানের শব্দে শিরিন বেগমের ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলেই সে দেখতে পেলো তার রুমের আলমারি আর দরজা খোলা। কিন্তু তার স্পষ্ট মনে আছে সে দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়েছিলো। তাহলে আলমারিটি খুললো কে? সে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে আলমারির ভিতরে দেখতে লাগলো। সে দেখলো আলমারি থেকে কিছুই হারাই নি শুধু মাত্র একটা পুরানো আমলের নীল রঙের শাড়ী গায়েব। শাড়িটি খুঁজে না পেয়ে সে যেন আরো অস্থির হয়ে পড়লো। সে মনে মনে ভাবতে লাগলো তাহলে কি তার ধারণাই ঠিক।কিন্তু মৃত মানুষ কিভাবে ফিরে আসতে পারে?
আজ চন্দ্র প্রথমবার কলেজে যাবে। তাই সে তৈরী হচ্ছিলো। যদিও সাফোয়ান তাকে বলেছিলো যে কলেজ শাড়ী পরে যাওয়া লাগবে না। তারপর ও সে আজও শাড়ি পড়লো। হালকা আকাশি রঙের একটা তাঁতের শাড়ী পরে চুলে একটা লম্বা বেণী করে নিলো। সাফোয়ান ও আজকে চন্দ্রের সাথে কলেজে যাবে তাকে পৌঁছে দিতে। তাই চন্দ্র তৈরী হয়েছে কিনা তা দেখতে সে রুমে এসেছিলো। রুমে এসে সে চন্দ্রকে দেখে যেন আরেকবার নতুন করে প্রেমে পড়লো। তার কাছে মনে হলো তার রুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেন কোনো স্বর্গের অপ্সরী দাঁড়িয়ে আছে। সাফোয়ান রুমে ঢুকেই দরজা চাপিয়ে দিয়েপিছন থেকে গিয়ে চন্দ্রকে জড়িয়ে ধরলো। সাফোয়ানের এভাবে আকস্মিক ব্যবহারে চন্দ্র কিছুটা হতচকিয়ে গেলো। সে পিছনে ঘুরে দেখলো সাফোয়ান তাই দেখে এই সে সস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,
-ও আপনি। এভাবে হঠাৎ জড়িয়ে ধরায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। রুমের দরজা খোলা কে না কে এসেছে।
-এই উজানপুরে এমন করো সাহস নেয় যে কিনা সাফোয়ান চৌধুরীর বেডরুমে এসে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরতে পারে। এই উজানপুর পুরোটাই আমার। এখানে শুধুমাত্র সাফোয়ান চৌধুরীর রাজত্ব চলে। তুমি আমৃত্যু শুধু আমারই।
-আর আপনার মারা যাওয়ার পরে?
-তখনও আমারই থাকবে। এখন বলো তো আমাকে সেদিন রাতের পর থেকে তুমি আমাকে এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছ কেনো? তুমি কি লজ্জা পাচ্ছ?
-তা এতদিন পর আপনার আমার কথা মনে পরেছে? সেদিন রাতের পর থেকে তো আপনাকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। একদম সকালে বেরিয়ে যান আবার গভীর রাতে ফেরেন আপনি। রাতের খাবারটাও বাহির থেকে খেয়ে আসেন। আমার সাথে দু দণ্ড কথা বলার ও সময় নেই আপনার।
– আহারে আমার বউটা কি আমার উপর অভিমান হয়েছে। আচ্ছা সোনা যাও আজ থেকে আমি তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবো। আবার খুশিতো।
-হ্যা।
-আবার তুমি আমাকে একটা মাথা বলোতো এভাবে সকাল সকাল পরীর মত তৈরী হয়ে আমার মাথা কেনো খারাপ করছো?
-কয়দিন ধরে যে আমাকে সময় দেন না তার প্রতিশোধ নিচ্ছি।
-ওও। যাও আজ রাতে কড়ায় গন্ডায় সব হিসেব তোমাকে বুঝিয়ে দেবো। এবার চলো। তা না হলে দেরি হয়ে যাবে।
চন্দ্র তার শাশুড়িকে সালাম করে বাড়ি থেকে সাফোয়ানের সাথে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। কলেজে পৌঁছেই সাফোয়ান চন্দ্রকে বললো যে সে ক্লাস শেষে চন্দ্রর জন্য এখানে অপেক্ষা করবে।
গাড়িতে বসে সাফোয়ান চন্দ্রর জন্য অপেক্ষা করছিলো। হঠাৎ তার ফোনে ফোন আসলে সে রিসিভ করলেই,
-হ্যালো আপনি কি সাফোয়ান চৌধুরী।
-জি আমি সাফোয়ান চৌধুরী। কি দরকার বলুন?
-আমি থানা থেকে ইন্সপেক্টর আসাদ বলছি। একটু আগে চন্দ্রকলার তীরে একটি ছেলের লাশ ভেসে উঠেছে। উনার পকেটে থাকা আইডি কার্ড থেকে উনার নাম জানা গেছে বিপুল হাসান। আপনার বন্ধু যে আপনার বিয়েতে এসে নিখোঁজ হয়েছিলো তার সাথে উনার অনেক মিল পেয়েছি। যদিও উনার লাশটা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।আপনি তাড়াতাড়ি মর্গে এসে ওনার লাশটি শনাক্ত করুন।
-জি আমি এক ঘন্টার ভিতরেই আসছি।
সাফোয়ান ফোন কাটতেই দেখলো চন্দ্র কলেজ গেট থেকে বের হচ্ছে। চন্দ্র বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসলো। সে প্রথম নজরেই সাফোয়ানের অস্থিরতা খেয়াল করলো।
-আপনাকে এরকম অস্থির দেখাচ্ছে কেনো? আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?
-না। তোমাকে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে আমি একটু বের হবো।
-কোথায় যাবেন আপনি?
-একটু হাসপাতালে যাওয়া লাগবে।
-হঠাৎ হাসপাতালে কেনো?
– আমি বিষয়টা তোমাকে বলছি। কিন্তু তুমি বাড়ির কাউকে বিষয়টা জানিও না।
-ঠিক আছে। এখন বলুন কি হয়েছে?
-আমার কলেজ লাইফের বন্ধু বিপুল। আমার বিয়ের আগের দিন উজানপুরে আসে। আমাদের রিসিপশন এর পরের দিন ওর ঢাকায় ফেরার কথা ছিল কিন্তু আমাদের বিয়ের দিন রাতেই ও ঢাকার জন্য তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যায়। এত তাড়াতাড়ি কেনো চলে যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে ও বলে ওর নাকি অফিসে কাজ আছে। কিন্তু ঠিক তার দুই দিন পরেই ওর ফ্যামিলি আমাকে ফোন করে জানায় ও নাকি ঢাকা পৌঁছায়নি। আর তারপরেই আমি পুলিশের কাছে মিসিং রিপোর্ট লেখাই। আর একটু আগে পুলিশ চন্দ্রকলার তীরে একটি লাশ পেয়েছে। আর পুলিশের ধারণা করছে যে লাশ হয়তো ওরই। তাই লাশ শনাক্ত করার জন্য আমাকে মর্গে যেতে হবে। আমি এখনো ভাবতেই পারছি না নে এইসব কিভাবে হলো। সব কিছু ধীরে ধীরে আমার হাতের বাহিরে চলে যাচ্ছে।
-চিন্তা করবেন না সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
চলবে……
(প্রিয় পাঠকগণ সময়ের অভাবে ঠিকমতো গল্প পোস্ট করতে পারছি না। তার জন্য আমি খুবই দুঃখিত।)