নিশীভাতি #৩৮তম_পর্ব

0
722

#নিশীভাতি
#৩৮তম_পর্ব

রাশাদ কয়েকবার পিছু ডাকলো কিন্তু শুনলো না মেয়েটি। রাশাদের ক্লান্ত লাগছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। ভিন্ন ট্রেনের যাত্রীদের একত্রে যাত্রাটা খুব একটা সুখময় হবে বলে মনে হচ্ছে না। রাশাদ ইলহার চিন্তাগুলো যে বুঝতে পারছে না সেটা ঠিক নয়। ইলহা মনোস্থিতি সে খুব ভালো করেই বুঝছে। অসুস্থতার প্রতিটা ক্ষণে তার জন্য অব্যক্ত চিন্তার রেখা যে মেয়েটির আদলে স্পষ্ট ছিলো তা খুব ভালো করে অনুভব করেছে সে। কিন্তু ইলহার এটাও বুঝতে হবে রাশাদের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই পাঁচজনের সংসারে আয়ক্ষম ব্যাক্তি শুধু সে। প্রতিটি মানুষের চাহিদার বস্তাটা তাকেই বইতে হয়। শীত আসার পর পর ই দোকানের বেঁচাকেনা কমে গেছে। এই মাসে মিঠুর বেতন দিয়ে কতটাকাই বা আসবে। ওদিকে দাদার ঔষধ, দাদীর ঔষধ, কাওছারের দেনা। এই তিনদিন বিছানায় পড়ে থাকায় খাবার দাবারেরও ঠিক নেই। মুদির দোকানে বাকি পড়েছে। তার দয়ালু মনের জন্য আলু আর ভাতের উপর দিন কাটছে। রাশাদের ঔষধও সব বাকিতে আনা। মোটরসাইকেলটা ঠিক না হলে শহরে যাওয়া হচ্ছে না। সেখানে তিন হাজার টাকার ফর্দ দিয়েছে। সব মিলিয়ে আর শুয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। অন্তত দোকানে গেলে যদি উপায় বের হয়। কিন্তু মেয়েটি বুঝতে চায় না। তার একটা কথা, “সুস্থতা সবার আগে”। রাশাদ মনে মনে তাচ্ছিল্য করে আর বলে,
“নিন্মমধ্যবিত্তের শরীর বলে কিছু নেই। যতদিন চলবে ততদিনই রেহাই। এরপর একেবারে কবরে”

রাশাদ চায় না ইলহা তার কষ্টের উপার্জন সবটুকু না বুঝে খরচ করে ফেলুক। তার একটা ভবিষ্যৎ আছে। রাশাদ চায় তার উপার্জন সে সঞ্চয় করুক নিজের জন্য। এমন দিন আসতেই পারে যখন রাশাদের পক্ষে তার প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। শুনেছে ভবিষ্যৎ পড়াশোনার খরচ অনেক। সেটা যদি সে পূরণ না করতে পারে! রাশাদ চায় না তার দারিদ্র ইলহার ভবিষ্যতের পথে কাঁটা হোক। কিন্তু মেয়েটি বুঝে না। ক্ষণসময় রাশাদ অপেক্ষা করলো। তারপর পা বাড়ালো পেছনে পুকুর পাড়ে। অভিমানিনীর আজকাল প্রিয় জায়গা সেটা।

পুকুরের পানি শুকিয়ে এসেছে। কাঁচা সিড়িগুলো দেখা যায়। বর্ষার শেষের দিকে কানায় কানায় ভরা থাকে এই পুকুর। এখন এমন মৃতপ্রায় স্রোতস্বিনী। পেছনে বিশাল বাশঝাড়। শীত বিধায় কাটা হচ্ছে না। তাই স্বগৌরবে বেড়ে নুয়ে এসেছে তা। পাশে অনাদরে বেড়ে উঠেছে রক্তজবা গাছ। গাছে ফুল নেই একটাও। যাও হয় পেছনের বাচ্চাগুলো ছিড়ে ফেলে। বরই গাছটাও নুয়ে পড়েছে লাল বরই এ। ডালটা একেবারেই পুকুরের উপর। তাই কেউ পারে না। পারতে গেলেই ডাল ভেঙ্গে পুকুরে। আর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় একেবারেই নিচে। পেঁকে, পঁচে তাই পুকুরেই পড়ে যায়। বরই গাছটার পাশেই বসে আছে ইলহা। এটা তার হিডেন স্পট। মন খারাপ করলেই সে এখানে এসে বসে। ছুটির দিনে এখানে বসে বিকালের মিঠে রোদ পোহাতে তার দারুন লাগে। ছোটবেলা থেকেই নিজের সাথেই বন্ধুত্ব করে বড় হয়েছে ইলহা। তার তেমন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলো না। তার বন্ধু ছিলো নির্জীব একাকিত্ব, ঘরের নির্জন বারান্দা আর বই। এখানে বারান্দা নেই, তবে এই নির্জীব, জনমানবহীন পুকুরটা তার অতি পছন্দ। হুমায়রা থাকতে এখানে বসে চা খেতো। কিন্তু এখন একাই এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে সে। দূরে বাশঝাড়ে একটা কাক কর্কশ গলায় ডাকছে নিরলস ভাবে। ইলহার তাতে আপত্তি নেই। সে উদাসীন চোখে মৃত পুকুরটির দিকে তাকিয়ে আছে। নাতীসাহেবের সাথে সরল সম্পর্কটা ক্রমশ জটিল হচ্ছে। ইলহার ভালো লাগছে না তা। মানুষটি এতো বেপরোয়া কেনো! সে কি একটু ভরসা করতে পারছে না ইলহাকে। ইলহা তার সহধর্মিণী। তাহলে কেনো দায়িত্বগুলো ভাগ করে দিচ্ছে না রাশেদ। এর মাঝেই পদধ্বনি কানে এলো। ইলহা অনড় বসে রইলো। ফলে গাঢ় স্বরে রাশাদ শুধালো,
“আমার ঔষধগুলো দিবেন না?”

ইলহা না শোনার ভান করলো। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রাশাদ পুনরায় একই প্রশ্ন শুধালো। এবার শান্ত স্বরে সে উত্তর দিলো,
“ঔষধের কি দরকার? আপনি তো সুস্থ!”
“নিজের জন্য চাইছি না। আমার একটা বউ রয়েছে। তার জন্য খেতে হয়৷ আবার জ্বর আসলে আর রক্ষে নেই”

পাশে বসতে বসতে নরম স্বরে উত্তর দিলো রাশাদ। ইলহা চোখ কুচকে তাকালো। অবাক স্বরে শুধালো,
“আমি কে? কে বলেছে আমার জন্য কিছু করতে? যখন আমার কথাই শোনা হয় না”

তীব্র রোষ প্রকাশ পেলো ইলহার কথায়। রাশাদ হাসলো স্মিত। ইলহার অবিন্যস্ত এলোমেলো চুলগুলো সন্তর্পণে কানে গুজে দিলো। মৃদু স্বরে বললো,
“আপনি কে সেই উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই”
“আছে, অবশ্যই আছে”
“আপনি আমার স্ত্রী”
“স্ত্রীর দায়িত্ব কি?”

এবার চুপ করে গেলো রাশাদ। উত্তর দিলো না। ইলহা উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে রইলো। অবশেষে নিজেই বললো,
“স্ত্রীর দায়িত্ব শুধু স্বামীর জন্য রান্না করা আর তার মনোরঞ্জনের খোরাক হওয়া নয়। একই বিছানায় শুলেই স্ত্রীর কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না নাতীসাহেব। আমি আমার আত্মা সপেছি আপনাকে। আমিও চাই আপনিও আপনার চিন্তা, দায়িত্বগুলো আমার সাথে ভাগ করে নিন। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা একটা দুচাকার সাইকেলের মতো। আপনি একাই ছুটলেন আর আমি বসে রইলাম আমাদের সাইকেল কখনোই গন্তব্যে পৌছাতে পারবে না। আমি শুধু আপনার সাথে থাকতে চাই না, আপনার সাথে কদম মিলিয়ে চলতেও চাই। আপনার ভরসা হতে চাই। নাকি আমার সেই যোগ্যতা নেই”

ইলহার টলমলে চোখের দিকে নয়নাভিরাম চোখে চেয়ে রয়েছে রাশাদ। স্মিত হেসে বললো,
“বুঝলাম। কিন্তু কি জানেন, একা একা ভার নিতে নিতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি চাই না এই কুৎসিত চিন্তাগুলো আপনাকে দাবড়ে বেড়াক। যতটা সরল মনে হয় জীবনটা এতোটা সরল নয়। আমি আপনাকে এজন্য বাধা দিচ্ছি না যে আপনি অযোগ্য। এজন্য বাধা দিচ্ছি যেনো আপনার দমবন্ধ না হয়। আপনি একটা ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছেন, সেখানে আপনি অভাব শব্দটি কখনো অনুধাবন করেন নি। আমি করেছি। আমি চাই না আমার ঘরে আপনার কখনো অভাববোধ হোক”
“এতোটা স্বার্থপর আমি নই নাতীসাহেব”
“জানি”
“তবুও?”
“হ্যা, তবুও আমি বলবো আপনার উপার্জনটি স্বযত্নে রাখুন। আমি তো বেঁচে আছি। যেদিন ক্লান্ত হয়ে যাবো, আমার সবটুকু নিংড়ে যদি শূণ্য হাতে ফিরি, তখন নাহয় আপনি সামলে নিবেন”

হার মানলো ইলহা। আর কথা বাড়ালো না। মানুষটি তা জেদে অনড়। অহেতুক এই ব্যাপারগুলোতে নিজের সম্পর্কটাকে তিক্ত করার মানে নেই। বরং সে সেদিনের জন্য প্রস্তুত হোক, যেদিন রাশাদ নিজ থেকে তার উপর নির্ভর করবে। ইলহা স্মিত হাসলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“চলুন, ঔষধ বুঝিয়ে দেই”

*******

দিপ্তীমান অপরাহ্নের রঙ্গ মিলিয়ে গেছে কৃষ্ণ মেঘের নিষ্ঠুর পদচারণে। আজ বৃষ্টি হচ্ছে। শীতের সময় বৃষ্টি খুব অনিয়ম ব্যাপার। এবছরের শীতটা এই অনিয়ম ঘন ঘন করছে। গাড়ির এসির তাপমাত্রা সাতাশে দেওয়া। মৃদুবেগে গাড়ি চলছে। স্টেয়ারিং এ হাত ফাইজানের। কিন্তু ঘন ঘন দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে তন্দ্রাচ্ছন্ন মায়ামুখে। দীর্ঘনেত্রপল্লবে নিজের হৃদয় আটকে আছে যেন। কতটা নিশ্চিন্তে মানুষ এমন বেপরোয়াভাবে ঘুমাতে পারে! গাড়ি চালানোর মিনিট দশেকের মাঝেই মায়াবতী ঘুমিয়ে গেছে। মাথা হেলে গেছে কাঁচের জানালায়। অস্বস্তি হচ্ছে না! ফাইজানের ইচ্ছে হলো মেয়েটিকে একটু ঠিক করে দিতে। পাছে ঘুম ভেঙ্গে যায়! তখন চিত্তশীতল করা মুখের দিকে বুভুক্ষের মতো চেয়ে থাকা যাবে না। তাই সেই চিন্তাকে বিসর্জন দিলো সে। মেয়েটি সজাগ থাকলে সর্বদা এমন তাকানো যায় না। কারণ তার অস্বস্তি হয়। লজ্জায় মিশে যায় সে। চোখ তুলে না। ফাইজান বুঝে তবুও মাঝে মাঝে বেহায়া দৃষ্টি সরায় না। হুটহাট অধর ছোয়ায় নরম গালে। মেয়েটি বাঁধা দেয় না। ফাইজানের মনে হয় এটা যথেষ্ট নয়। সে আরোও লোভী হতে চায়। সম্পূর্ণ রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার আধিপত্য চায় সে। ফলে নিজেকে বাধ্য হয়ে সংযত রাখে সে। ফাইজানের ইচ্ছে, হুমায়রা নিজ থেকে তার কাছে ধরা দিবে। নিজেকে সমর্পণ করবে নিজেকে। ইচ্ছেটা কবে পূরণ হবে জানা নেই। তবে খুব দেরি হয়তো হবে না৷ গাড়ি থামলো হুমায়রার বাড়ির কাঁচা রাস্তার সামনে। রাস্তাটি খুব চওড়া নয়। গাড়ি ডুকবে না। তাই এখানেই থামতে হলো। ফাইজান হুমায়রাকে ডাকলো না। বরং স্টেয়ারিং হেলান দিয়ে বসলো। তার দৃষ্টি আবদ্ধ হুমায়রার দিকে। তৃষ্ণার্ত নয়ন তৃপ্তি মেটাচ্ছে বর্ষাস্নাত সন্ধ্যায় ঘুমন্ত রুপবতীকে দেখে।

হুমায়রার ঘুম ভাঙ্গলো অনেক দেরিতে। ঝাপসা নয়ন মেলে তাকাতেই ভেজা কাঁচের ওপারে ছোট্ট টিমটিমে জ্বলন্ত হারিকেন চোখে পড়লো। তাদের বাহিরের বারান্দায় এটা সন্ধ্যে হলেই দাদী জ্বালায়। বাড়ি চলে এসেছে তারা! পাশে তাকাতেই দৃশ্যতঃ হলো ঘুমন্ত নিরেট যুবকের শান্ত মুখবিরত। স্টেয়ারিং এ হাতের উপর ভর করেই ঘুমাচ্ছে সে। এক রাশ জড়তা নিয়ে হুমায়রা তাকে ডাকার জন্য হাত বাড়াতেই সাথে সাথেই হাতটা চিলের মতো খপ করে ধরে ফেললো সে। চোখ খুলে স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“ঘুমন্ত মানুষের ইজ্জত হরণ ঠিক নয়”

হুমায়রা স্তব্ধ হয়ে গেলো ফাইজানের কথায়৷ গালে জমলো রক্ত। সাথে সাথেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করলো হুমায়রা,
“আমি শুধু আপনাকে ডাকতে গিয়েছিলাম”

মৃদু হাসলো ফাইজান। মেয়েটিকে এমন দ্বিধাদ্বন্দে খাবি খেতে দেখতে মন্দ লাগে না তার৷ কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে বললো,
“আপনার বাসা চলে এসেছে, এখন একটু সংযত রাখুন। বাড়ি গেলে আমাকে সপে দিবো”

হুমায়রাকে কথা বলার সুযোগ দিলো না ফাইজান। গাড়ি থেকে দ্রুত গতিতে নেমে পড়লো। হুমায়রা বেশ ভ্রান্ত হলো। সে তো কেমন তাকে ডাকছিলো। মানুষটি এমন নষ্ট চিন্তা কেনো করে!

******

শ্বশুরবাড়ির জন্য প্রাণখুলে বাজার করে এনেছে ফাইজান। একেই না বলেই আকস্মিক আগমনে আতিয়া খাতুন বেশ অপ্রস্তুত হলেন। উপরন্তু এতো বাজার। কোথায় রাখবে এতো কিছু। প্রায় পাঁচ রকমের মাছ, মাংস, ফল, মিষ্টি– কিছুর কমতি নেই যেনো। শামসু মিঞা লজ্জামিশ্রিত স্বরে বললেন,
“এতো বাজারের কি দরকার ছিলো জামাই? ফাও খরচা?”
“কি কন আব্বা, আলু খাতি খাতি ফেডে চর পড়ে গেছে, কত দিন মাছ খাই না”

কাওছারের বেফাশ কথায় জামাইয়ের সামনে মাথা কাটা গেলো শামসু মিঞার। আতিয়া খাতুন চোখ গরম করতেই থেমে গেলো কাওছার। তার চোখে মুখের লোভ দৃষ্টি এড়ালো না ফাইজানের। সে নম্র স্বরে বললো,
“এটা তো আমার দায়িত্ব। আমার দাদা দাদী নেই। তাদের সেবার করার সুযোগ আল্লাহ আমাকে দেয় নি। আপনাদের সেবা করতে পারার সুযোগ দিয়েছেন। তাই আমার কাছ থেকে এটা কেড়ে নিবেন না”

ফাইজান সব সময় ই দাদা দাদীকে খুব শ্রদ্ধা করে। যা বরাবর ই ভালো লাগে হুমায়রার। কিন্তু সংকা তো ভাইজানকে নিয়ে। এই বাজারটি মোটেই ভালোভাবে নিবে না সে। সবসময় ই ফাইজান আর ভাইজান মুখোমুখি হলেই গ্যাঞ্জাম বাধে। এবার না বাঁধলেই হয়।

*****

ফাইজান হুমায়রাকে রেখে বেরিয়ে গেলো। গাড়িটা মামা বাড়ি রেখে আসতে হবে। সেই সাথে মামার সাথে কথাও বলার আছে। গাড়িতে উঠতে নিলেই তাকে পিছু ডাকলো কাওছার। সকলের দৃষ্টির অগোচরে সে ফাইজানের পিছু নিয়েছিলো। ডাক শুনেই ফাইজান দাঁড়ালো। বিস্মিত স্বরে শুধালো,
“আব্বা, কিছু বলবেন?”
“হ জামাই বাপ, তোমার থেইক্যা একটা সাহায্য চাইছিলাম। কাওরে কইয়ো না। এমন কি হুমায়রারেও না।……

চলবে

(ভালো লাগলে রেসপন্স করবেন। আপনাদের রেসপন্স আমাকে ভালো লিখতে সহায়তা করে)

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here