মৃগতৃষ্ণিকা #পর্ব:০৭

0
166

#মৃগতৃষ্ণিকা

#পর্ব:০৭

মতি জোছনাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে আছে কবিরাজের দেওয়া বড়ি সেবন করালেও জোছনার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না বরং দিনদিন আরও অবনতি হচ্ছে।
জোছনার পেটে প্রতিদিন কালো হাতের ছাপ ভেসে উঠছে, পরিবানু অনেক কটুবাক্য শুনিয়েছে জোছনাকে তার শখের জন্যই আজ এ দিন দেখতে হচ্ছে বলেছে। জোছনা কেবল কেঁদেই চলেছে, আল্লাহর কাছে কেবলমাত্র তার অনাগত সন্তানের জন্য মঙ্গল কামনা করছে।দোয়া করে চলেছে অবিরত।
মতিও বেশ অপরাধবোধে ভুগছে তার মনে হচ্ছে তারজন্যই আজ জোছনাকে এত কষ্ট পেতে হচ্ছে।

প্রতিদিন রাতেই জোছনা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে কিন্তু জেগে যাওয়ার পর তার আর সেটা মনে থাকে না।
শুধুই আবছা আবছা কিছু দৃশ্যপট মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে থাকে।

পরিবানু কিছুদিন হলো লক্ষ্য করছে জোছনার আচরণ বদলে গেছে কেমন যেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সবসময়।পেটের মধ্যে হাত বুলাতে থাকে একা একা কথা বলতে থাকে।
পরিবানুর মনে হতে থাকে নিশ্চয়ই কোনো খারাপ বাতাস লেগেছে মেয়েটার আর এমনিতেই গ্রামে মহামারির উপদ্রব।
সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিতে থাকে কোনো এক ফকির বাবার কাছে জোছনাকে নিয়ে যাবে।কিন্তু বাড়ির বাইরেও তো যাওয়া যাবে না তাই বাড়িতেই ফকির বাবাকে আনতে হবে তবে মতিকে জানানো যাবে না হয়তো ও বাঁধা দিতে পারে।

পরিবানু এক ফকির বাবার খোঁজ নেয় তিনি নাকি অনেক মানুষকে সাহায্য করেছেন তবে তিনি কারও বাড়িতে যান না বরং তার কাছেই রোগীকে নিয়ে আসতে হয়। পরিবানু অনেক আকুতি মিনতি করে অবশেষে ফকির বাবাকে রাজি করালো অবশেষে ফকির বাবা রাজি হলেন এবং মঙ্গলবার যাবেন বলে আস্বস্ত করেন পরিবানুকে।পরিবানু খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লেন অবশেষে সে একটা উপায় বের করতে পেরেছে।
আজ মঙ্গলবার পরিবানু বাহানা করে মতিকে তার ভাইয়ের বাড়িতে পাঠায় বলে সে তার একটা দরকারি জিনিস সে বাড়িতে রেখে এসেছে যা তার আজকেই দরকার মতিও রাজি হয় এত করে বলছে যখন তখন হয়তো দরকারী।
মতি পরিবানুকে বলে যায় সে যাতে জোছনাকে দেখে রাখে।
আছরের পরেই আগমন ঘটলো ফকির বাবার তিনি দক্ষিণমুখী একটা ঘর চাইলেন যেখানে সে বসবেন।জোছনার থাকার ঘরটা দক্ষিণমুখী হওয়ার সে ঘরেই বসলেন তিনি।
কিছুক্ষণ পরে জোছনা কে ডাকা হলো পরিবানু জোছনাকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখে পুরো ঘরে ফকির বাবা নানা জিনিসপত্র দিয়ে অন্যরকম করে তুলেছেন। মাঝখানে লাল সুতো দিয়ে তিনকোনা আকারের একটি স্থান তৈরি করে যার ভেতরে জোছনাকে বসতে বলে।
জোছনা ভয়ে কাঁপতে থাকে পরিবানু চোখ রাঙিয়ে কর্কশ গলায় বলে বাবা যা কয় শুনো যাও গিয়া বসো।
জোছনা ভয়ে ভয়ে ত্রিকোণটির ভেতর এ গিয়ে বসলো ফকির বাবা জোছনাকে তার পেটের কাপড়টা সরাতে বলে সে দেখতে চায় কেমন ছাপ বসেছে সেখানে।
কথাটা শুনেই জোছনা বড় চোখ করে তাকায় অসহায়ের মতো পেছন ফিরে তাকায় পরিবানুর দিকে পরিবানু বললেন সরাও কাপড়খান!!
জোছনা ভেজা ঢোক গিলে আশে পাশে চোখ বুলায় মতিকে সে মনে মনে খুঁজে বেরুচ্ছে সে থাকলে হয়তো কখনোই অন্য পুরুষের সামনে তার অসম্মান হতে দিতো না। মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলতে লাগলো জোছনা।
পরিবানু রাগে গজগজ করতে লাগলো বললো যদি বাচ্চা বাঁচাইতে চাস তাইলে কাপড় খান সরা কইতাছি।
অলক্ষুণে মাইয়া কোনানকার, এই আকাম করনের সময় মনে ছিলো না।
জোছনা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না বলে পরিবানু জোর করে পেটের কাপড় সরিয়ে ফকিরকে দেখায়।
ফকির বাবা আৎকে ওঠে বলেন এ তো কোনো অশরীরীর হাতের ছাপ!!
হটাৎ করেই চোখ বন্ধ করে কি যেন পড়তে থাকে বিরবির করে আর জোছনা অস্থির হতে শুরু করে কাঁপতে থাকে থরথর করে।
সারা ঘরে দমকা হাওয়া বইতে থাকে দরজা সহ ঘরের সকল জালানাই বন্ধ তবুও কোথা থেকে যেন এ বাতাস চলে আসছে। তিনকোণায় থাকায় তিনটা কাচের জার পরে ভেঙে গেলো।ফকির বাবা পরিবানুকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন। সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
বাইরে অন্ধকার নেমে এলো বলে আজকের সন্ধায় যেন ভারী বাতাস, প্রকৃতিও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।

ভেতরে সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে জোছনা আতরা-কাতরা করছে সে যেন আর তার মধ্যে নেই কোনো এক অশরীরী তার ভেতরে বাসা বেঁধেছে বলে মনে হচ্ছে। ফকির বাবা এবার তার হাতে থাকা সাদা রঙ জোছনার কপালে ছুঁইয়ে দিতেই জোছনা উত্তেজিত হয়ে পড়লো ভরাট কন্ঠে বলে উঠল – চলে যা বলছি নয়তো ভালে হবে না বলে দিলাম।
ফকির বাবা হাসতে শুরু করলো বললো – আমি না তুই যাবি বুঝলি!!
কথাটা বলেই একটা কাচের জার থেকে পবিত্র পানি জোছনার গায়ে ছিটিয়ে দিতে লাগলেন জোছনা ছটফট করতে লাগলো তবে আশ্চর্যের বিষয় ও হাসছে উচ্চস্বরে হাসছে।
-তোর কোনো তন্ত্র মন্ত্র আমাকে থামাতে পারবে না শুধু মাত্র শরীরকেই কষ্ট দিবে। হা হা হা

– তুই কে?

– আমি জুলেখা!!!

ফকির বাবা যেন এবার হকচকিয়ে গেলেন সম্মানের স্বরে বললেন – বেগম জুলেখা!!

– হ্যাঁ। আমিই বেগম জুলেখা তোর ছেলের তো দুটো বাচ্চা রয়েছে তোর খুব আদরের তাই না??

ফকির বাবা কিছুটা ভড়কে গেলেন শুকনো ঢোক গিলে বলল হ্যা।কিন্তু আপনি এই অবলা নারীর শরীরে কেন বাসা বেঁধেছেন??

– সে উত্তর আমি তোকে দিতে বাধ্য নইই।

ফকির বাবা যেন পথভ্রষ্ট হতে চললেন কিন্তু না কোনোমতে সে নিজেকে সামলে আরও পবিত্র পানি ছেটাতে লাগলো জোছনার গায়ে কিন্তু তার হাসির শব্দ আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
তিনটের মধ্যে যেকোনো একটা ইচ্ছে আমি তোর পূরণ করতে পারবো।১.জোছনার শরীর থেকে আমি চলে যাবো।
২.আমি ওর পেটের বাচ্চাটাকে বাচিয়ে রাখবো।
৩.আমি তোর নাতিদেরকে মা*রবো না।
বল কোনটা চাই তোর??

ফকির বাবা ঘাবড়ে গেলেন তিনটাই মারাত্মক। কোনো একটা বেছে নিলে যে বাকি দুটেতে আরও বিপদ।
কি উত্তর দিবে ভেবেই পাচ্ছে না সে।
ওনার এই নাজেহাল অবস্থা জুলেখাকে বেশ আনন্দ দিচ্ছে।
ফকির বাবা জানেন যে জুলেখাকে জীবন্ত সমাধি দেওয়া হয়েছে তাই তার কৌতুহল থেকে জিজ্ঞেস করলেন – জনাব সুলায়মান কেনো আপনাকে জীবন্ত সমাধি দিয়েছে?
জুলেখা রাগান্বিত স্বরে বললো তোকে যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বল। আমি প্রশ্ন করা একদম পছন্দ করিনা।

– আমি যদি তিনটে ইচ্ছেই চাই তবে?

– তবে তাই হবে।শুধুমাত্র আমার একটি ইচ্ছে পূরন করতে হবে।

-কী ইচ্ছে আপনার?

– জোছনার বাচ্চাটাকে আমায় দিতে হবে। আমি আমার সন্তান হিসেবে ওকে চাই।আমার পেটে বাচ্চা থাকা অবস্থাতেই আমার মৃত্যু হয়েছিল আমার খুব ইচ্ছে ছিলো আমি মা হবো।

– এটা কি করে সম্ভব?? আপনি তো মৃত আর আপনি এই সন্তান মানুষ করবেন কি করে?

– আমি মৃত বলেই ওকে আমার চাই আমার একটা শরীরের ভীষণ প্রয়োজন।

– ওহ্। তাই বলুন আপনার প্রয়োজন কেবল শরীর।

– হ্যা তা-ই। আমার আপন বলতে কেউ নেই আমার একজন আপন মানুষ চাই যে কিনা আমার সমস্ত কথা শুনবে। আমার ইচ্ছে পূরন করবে।

এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।আপনি ওর শরীর ছেড়ে চলে যান বলছি।নয়তো ভালো হবে না বলে দিলাম।

হা হা হা! তবে তুই বাড়ি যা গিয়ে দেখ কি হচ্ছে সেখানে।

– আমি জানি সেখানে কিছুই হচ্ছে না শুধুমাত্র আমাকে ভয় দেখাতেই এগুলো বলা হচ্ছে। নে দেখ তোর কি হাল করি আমি।
এই বলেই ফকির বাবা তার কাছে থাকা আরেকটি কাচের জার থেকে লাল রঙ বের করে জোছনার কপালে ছেয়ায় সাথে সাথেই জোছনা কাতরাতে থাকে চোখ মুখ ওলট-পালট হয় মুখ দিয়ে কেবল গোঙানির শব্দ বের হতে থাকে অবশেষে জ্ঞান হারায় সে।

ঘরে নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ রূপ নিয়েছে। ফকির বাবা পরিবানুকে ডেকে বলল জোছনাকে চৌকিতে শুইয়ে দিতে আর ওর জ্ঞান ফিরলে এই পবিত্র পানি খাইয়ে দিতে এমনকি অবস্থা বেগতিক দেখলে ছিটিয়েও দিতে পারে।
পরিবানু জিজ্ঞেস করলেন- কি হইলো বাবা সারছে তো??
– নাহ্। অনেক বড় বিপদের কবলে পড়েছেন আপনারা। এখানে কাজ হবে না আমার কাছে আগামী মঙ্গলবার নিয়ে যাবেন আমি সেখানে আবার ওর চিকিৎসা করবো।

পরিবানু অস্থির হয়ে পড়লেন কোনোমতে জোছনাকে চোকিতে শুইয়ে দিলেন তার সাহায্য নিয়ে।

জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত পরিবানু জোছনার কাছেই বসে রইলো।
__________________
সিরাজ মাস শেষে আজ বেতন পেয়েছে।বারো হাজার টাকা সে গুনেছে বারো বারেরও বেশি তার চোখমুখে হাসির ঝলকানি ফুটে উঠেছে। জীবনের প্রথম সে রোজগার করেছে, প্রথমেই মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনে নিলো এরপর হেমন্তির জন্য একটা লাল পাড়ের শাড়ি কিনলো।রূপার জন্য ও জামা কিনে নিলো পছন্দমতো।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে প্রফুল্ল সজীব প্রাণের মানব।

হেমন্তি কে দেখার জন্য প্রাণ তার ছটফট করছে সিরাজের কতদিন হয় তার সাথে দেখা হয় না।

হেমন্তির হাতে এসে পৌছাল সিরাজের দেওয়া চিঠিখানা ঠোঁটের কোণে খুশির আভা ফুটে উঠলো তার। তড়িঘড়ি করে খাম থেকে চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করলো ঘরের দরজার সামনেই

প্রিয় হেমন্তি,
– আমাকে এভাবে গড়ে তোলার জন্য তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ হেমন্তি।তুই আমার পাশে না থাকলে হয়তো আমি কখনোই সফল হতে পারতাম না। আমি জানি তুইও আমার মতো অনেক খুশি হয়েছিস চাকরির কথা শুনে কিন্তু জানিস তোকে না দেখতে পেয়ে আমার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে কখন যে তোকে দেখতে পাবো!! হেমন্তি আমি চাকরিটা পেয়ে গেছি এবার আর তোকে আর আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না তোর হাতে চিঠিটা যেতে যেতে হয়তো আমার হাতে বেতনটাও এসে পড়বে।
তোর জন্য লাল পাড়ের একটা শাড়ি দেখেছি আমার প্রথম বেতনটা পেয়েই সেটা কিনবো তুই পড়ে আমার সামনে এলে আমি হয়তো জ্ঞান হারাতে পারি এই শোন এই ভয়ে আবার না পড়িস না কিন্তু? আমি জ্ঞান হারালেও জান হারাবো না!!
কিছুদিন হলো বুকে প্রচন্ড ব্যথা হয় তোকে না দেখার তৃষ্ণায় আমার শরীর খারাপ হতে শুরু করেছে একে একে হয়তো আমি অকেজো হয়ে পড়বো তাই আমাকে আর অসুস্থ না বানাতে চাইলে আগামী দুই তারিখ বিলের পাড়ে থাকিস। পড়ন্ত বিকেলে তুই আর আমি একসাথে আকাশ দেখবো সূর্যাস্ত শেষে চাঁদের আলোয় তোকে মুগ্ধ হয়ে দেখবো।

চলবে,,,,,

#লেখা:মুন্নি ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here