#মৃগতৃষ্ণিকা
#পর্ব:১০
আজ হেমন্তি ও সিরাজের বিয়ে,দুজনেই বেশ খুশি কতক্ষণে শেষ হবে অপেক্ষার প্রহর।দাওয়াত করা হয়েছে আত্মীয় স্বজনসহ সকল বন্ধুবান্ধবদেরও। তবে রফিকের অভাব যেন রয়েই গেছে। সকালেই রফিকের আম্মা এসে পৌছালো হেমন্তির বাড়ি।ছলছল চোখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো হেমন্তিকে বললো তোকে আমার ছেলের বউ বানাতে চেয়েছিলাম রে মা।কিন্তু দেখ কি কপাল আমার ছেলেটাই যে নেই আমার।কথাটা বলতে গিয়ে যেন তার জিভ আটকে আসছিলো তার পরমুহূর্তেই হেমন্তির থুতনিতে হাত দিয়ে মাথা উচু করিয়ে বলে উঠলেন তবে এখন আর কোনো চিন্তা নেই, তুই আমার আরেক ছেলের বউ হবি। আমার সিরাজের বউ।
হেমন্তি লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে মৃদু হাসলো।
সকলেই হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য তাড়া দিচ্ছিলো। হেমন্তি হলুদ রঙের শাড়ি পড়েছে চুলের খোঁপায় গাদা ফুলের ছড়াছড়ি, হাতে, গলায় ও কানে গাঁদা ফুল গয়না পড়েছে যেন মনে হচ্ছে এ যেন এক হলুদ পরী।
আয়নার নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হলো হেমন্তি এ কি সত্যিই সে নাকি অন্যকেউ।
সবার ডাক পড়তেই সে হুশে ফিরলো দরজা খুলে বের হতেই সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
লতিফা বেগম দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে কাজলের টিকা দিয়ে দিলো ঘাড়ের পেছনে, থু থু ও দিয়ে দিলো যাতে কারো নজর না লাগে।রূপা সেটা দেখে হাসতে শুরু হয়ে হেমন্তি রূপাকে কোলে নিয়ে চুমু একে দুলো কপালে রূপাও একটা চুমু দিয়ে বললো আমার মা বউ!!!!
হলুদ ছোঁয়ানো শুরু হলো হেমন্তির গায়ে, পাশেই মহিলারা গীত গাইতে শুরু করলো।
❝দাও গায়ে হলুদ,,,,,
দাও গায়ে হলুদ পায়ে আলতা হাতে মেহেন্দি
বিয়ের সাজে কন্যারে সাজাও জলদিই!!!!
যেন রূপ দেখে তার গলে যায় শাশুড়ী ইই ননদী ইইই।❞
গীত গাওয়ার মাঝেই আবির্ভাব ঘটলো সোফিয়ার। সোফিয়া কে দেখে হেমন্তির মুখে হাসি ফুটে উঠলো সোফিয়া এসেই হেমন্তির গালে হলুদ দিলো আশেপাশের সবাই চেয়ে আছে এই বিদেশিনীর দিকে।সাদা রঙের শাড়ি পড়ে এসেছে শুভ্র রঙে বেশ মানিয়েছে তাকে তবে কয়েকজন মধ্যবয়স্ক মহিলা কানাঘুষো করল এই বিদেশি মেয়ে কি বিধবা নাকি ধবধবে সাদা শাড়ি পইরা আইছে যে।
চোখ মুখে যেন তার বিষণ্নতার ছাপ, চাপা কষ্টে তার বুকের ভেতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
বিষাদ মাখা সুরে সোফিয়া বললো যাক! দেখিয়া ভালো লাগিলো সিরাজ আর তোমার অন্তত মিলন তো হইলো।ইস্ আমিও যদি পৃথিবীর নিয়ম ভাঙিয়া দিগন্ত কে পাইয়া যাইতাম???
হেমন্তি সোফিয়ার দুহাত শক্ত করে ধরে বললো আমি জানি অনেক কষ্ট তোমার মনে তবুও বলবো নিজেকে শক্ত রাখো সোফিয়া, ভাগ্য কে তো মেনে নিতে হবে তাইনা।সে মাথা নাড়িয়ে বললো আরে তুমি কেনো মন খারাপ করছো তোমার তো আজ খুশির দিন।
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতেই পাত্র পক্ষের বাড়ি থেকে বিয়ের জিনিসপত্র এলো। সেগুলো দেখতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
লতিফা বেগম মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে বললো আবার কবে তোর ছোয়া পাবো জানা নেই। মায়েদের যে মেয়েদের বাড়ি যেতে নেই নয়তো রোজ একবার করে তোকে দেখতে যেতাম।
– কি বলছো আম্মা। তুমি যাবে না তো কে যাবে শুনি? তুমি না গেলে আমিই চলে আসবো।।
দুচোখ ভরে মেয়েকে দেখে নিচ্ছে লতিফা বেগম যেন আর দেখাই পাবে না।চোখের পানিরা যেন থামছেই না খোলা চোখের কোণ ঘেঁসে অবিরত বয়েই চলেছে।
আজকের পত্রিকায় একবারও চোখ বুলানো হয়নি বাড়ির কারো। হেমন্তি তার আম্মাকে সামলে নিয়ে যেই পত্রিকা টা দেখতে যাবে অমনি ডাক পড়লো তার বিলেত ফেরত ফুপি মায়ের।সে আজ দেশে ফিরেছে ভাইজির বিয়ে বলে। হেমন্তিও পত্রিকা ফেলে ফুপি মায়ের কাছে গেলো দৌড়ে। দুজনে খোশগল্প সারতে সারতে আর পত্রিকার কথা মনেই নেই তার।
সন্ধ্যা শেষ হতে না হতেই সবাই রেডি হওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে হেমন্তিকে এক প্রকার জোর করেই তাকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই তাতে যোগ দিয়েছে সোফিয়াও।লাল টুকটুকে বেনারসি পড়িয়ে দিলো হেমন্তিকে এরপর একে একে গয়না পড়ানোও হলো। চোখে গাঢ়ো করে কাজল পড়ে নিলো হেমন্তি আয়নার সাহায্য ছাড়াই। ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক পড়েছে। কি অপরূপ সৌন্দর্য তার।
রাতের অন্ধকারে ছেয়ে গেছে পুরো বাড়ি তবে আনন্দ উল্লাসে ভরপুর। বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে বর আসার। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ করে বরপক্ষ এসে পৌছালো কনে পক্ষের বাড়ি। সিরাজ কেও আজ বেশ সুন্দর লাগছে। সিরাজের সাথে বরপক্ষ হিসেবে এসেছে দিগন্ত। সোফিয়া কনে পক্ষের হয়ে দাড়িয়ে আছে গেটে।দুজন দুজনকে দেখে কিছুটা থমকে গেছে অপলক চেয়ে আছে দুজনের তৃষ্ণার্ত চোখ জোড়া।
সকলের হই হুল্লোড় তাদের চেয়ে থাকার কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না।মনে মনে দিগন্ত বলে উঠল ইশ্! এভাবেই যদি অপলক তোমার নয়নের পানে চেয়ে থেকে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম মিস সোফিয়া। তবে এ জীবন নিয়ে আমার আর কোনো অভিযোগ থাকতো না।
বরপক্ষ কে বসানো হলো খাওয়ার টেবিলে।সিরাজ যেন ছটফট করছে হেমন্তিকে দেখার আশায়।আর কতো জনম অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে আমায়, বলতে পারো কেউ?
সিরাজের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।সে এবার কিছু টা লজ্জা পেয়ে নুইয়ে গেলো। সবাই বলে উঠল আর তো মাত্র কয়েক প্রহর অপেক্ষা করো মহাশয়।
হেমন্তি বাইরে সবার হাসি শুনতে পেয়ে বুঝেছে নিশ্চয়ই সিরাজ কোনো উল্টো পাল্টা কথা বলেছে।রূপাকে বলছিলো দেখেছিস কোনো লাগাম নেই তোর বাবার মুখে যা মুখে আসে তাই বলে।
রূপা হেসে হেঁসে বললো আচ্ছা মা বাবাকে আমি বকে দিবো কেমন।
সবার খাওয়ার পালা শেষ হলে হেমন্তিকে নিয়ে আসা হয় আসরে।বিয়ের আসরে হেমন্তি কে দেখে যেন কেউ চোখ ফেরাতেই পারছেনা। তবে বুঝুন সিরাজের কি অবস্থা। সিরাজ বুকে হাত দিয়ে ফিসফিস করে হেমন্তির কানে কানে বললো আমার হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে যাচ্ছে তোমার দর্শন পেয়ে। হেমন্তি মৃদু হেসে বললো চুপ করবি???
কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন তখন রাত বাজে প্রায় এগারো কি সাড়ে এগারোটা। হুট করেই কয়েকজন পুলিশ অফিসার এর আবির্ভাব ঘটলো বিয়ে বাড়িতে। সিরাজকে খুজতে এসেছে তারা।কেমন যেন একটা ভয় ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হলো বিয়ে বাড়িতে। সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে কেনো পুলিশ এলো বাড়িতে? পুলিশ অফিসার বললেন মি.সিরাজের সাথে আমাদের কিছু কথা রয়েছে তার সাথে একাকী সাক্ষাৎ কারের প্রয়োজন আছে।তাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।
সিরাজ হেমন্তি দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো তারা এসবের কিছুই বুঝতে পারছেনা। কি হচ্ছে এসব পুলিশ কেনো এলো?
সবাই পুলিশ অফিসারের সাথে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করছে আজ সিরাজের বিয়ে তাই থানায় না নিয়ে এ বাড়িতেই যাতে কথা বলে নেয়। পুলিশ অফিসার রাজি হলেন তিনি সিরাজকে নিয়ে একটা কক্ষে বসলেন। – মি.সিরাজ আপনি বেগম জুলেখা ও জনাব সুলায়মান এর একটা বায়োগ্রাফি তৈরি করেছেন। যাতে অনেক তথ্য দিয়েছেন তবে কোনো প্রমাণ ছাড়াই। সিরাজের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। তবুও সে অনেক কষ্টে মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করলো কিসের বায়োগ্র্যাফি??
আমি তো কোনো বায়োগ্রাফি পাবলিশ করিনি স্যার।
– এই দেখুন এখানে আপনার সিগনেচার রয়েছে। আপনিই এই বায়োগ্রাফির রচিয়তা। এটা পাবলিশ হয়েছে মাত্র দুদিন হলো এরই মাঝে প্রচন্ড ঝড় তুলেছে মানুষের মনে। পত্রিকায় দেখেননি??
– না স্যার আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা । আমি বেগম জুলেখা ও সুলায়মান এর বায়োগ্রাফি লিখেছিলাম কিন্তু পাবলিশ করিনি।
– আমরা প্রমাণ নিয়েই এসেছি।যাই হোক আপনার কাছে কি কোনো প্রমান আছে যে বাচ্চা রা চুরি হয়েছিলো তা জনাব সুলায়মান করেছে এবং তার বেগম সেই বাচ্চাদের কলিজা খাওয়ার মতো জঘন্যতম অপরাধ করেছিলো? নাকি নিছকই এটা আপনার কল্পনা, কেবলমাত্র মানুষের মনে ভয়ের সৃষ্টি করে নিজের লেখা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন রাজবাড়ী নিয়ে যা লিখবেন তাই গিলবে মানুষ মাঝে থেকে আপনি ও কোটিপতি হবেন।
– না স্যার আমি পাবলিশ করিনি।বিশ্বাস করুন।
পুলিশ অফিসার তার সামনে থাকা টেবিলে জোরে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে বললেন আপনি যদি পাবলিশ না ই করবেন তবে কেনো এটা লিখেছেন? বলুন? আপনার বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে আপনি এভাবে স্বীকার করার মতো পাত্র নন আপনাকে আমরা থানায় নিয়ে যেতে বাদ্ধ হচ্ছি।
বাইরে থেকে হেমন্তি অস্থির হয়ে আছে ভেতরে কি হচ্ছে জানার জন্য। বাইরে সবাই বলাবলি করছে জামাই নিশ্চয়ই কোনো বড় ধরনের অপরাধ করেছে নয়তো বা পুলিশ আসতো না।
কক্ষ এতক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেও হঠাৎ ধুপধাপ দুটো আওয়াজে হেমন্তির বুক কেঁপে উঠলো। কি হচ্ছে ভেতরে জানার জন্য অন্তর আত্মা সহ কেঁপে উঠেছে এবার আর সহ্য করতে পারছেনা হেমন্তি হুট করেই দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো বললো আমাকে ভেতরে আসতে দিন আমি জানতে চাই আপনারা কি করছেন।একজন পুলিশ গিয়ে দরজা খুলে দিলো অফিসার এর আদেশে। দরজা খুলতে না খুলতেই হেমন্তি হুড়মুড় করে কক্ষে প্রবেশ করলো সিরাজের কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম তার চোখ এড়ায়নি হেমন্তি তার চোখজোড়া বড় বড় করে তাকিয়ে পুলিশ অফিসার কে প্রশ্ন ছুড়ে মারলো – আপনি কেনো আমাদেরকে কিছু বলছেন না? কি করেছে সিরাজ? ফাঁসির আসামি কেও এত কড়াকড়ি ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়না। আপনারা কি ভেবেছেন কি যা ইচ্ছে তাই করবেন। বলুন ও কি করেছে?
সবাই হতবাক হয়ে চেয়ে আছে হেমন্তির দিকে।সাধারণত বউয়ের সাজে কোনো মেয়েরা এমন করে আচরণ করে না।
পুলিশ অফিসার বললেন আপনি স্থির হয়ে বসুন।মি.সিরাজ একটা বায়োগ্রাফি লিখেছেন সেটাতে তিনি যেসব তথ্য দিয়েছেন তা আইনবিরোধী। একজন সম্মানীয় ব্যক্তিকে নিয়ে এবং তার স্ত্রী কে নিয়ে এসব প্রচারণা কিভাবে করলেন তাও আবার এর কোনো প্রমাণও দিতে পারেননি। আমরা ওনাকে প্রমাণ দিতে বলছি গত দুইদিন হলো সুলায়মানের বায়োগ্রাফি প্রকাশ হয়েছে তার মাঝেই সারা পড়ে গেছে।আমরা এটা আপাতত বিক্রি করতে বারণ করেছি।
যেই চোখজোড়া দিয়ে এতক্ষণ অগ্নিশিখা বের হচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল সেই চোখজোড়া যেন শীতল হয়ে গেলো মুহুর্তেই।
সিরাজ হেমন্তি কে বোঝানোর চেষ্টা করে সে এটা প্রকাশ করেনি কিন্তু হেমন্তি বিশ্বাস -অবিশ্বাস করার মতো অবস্থাতে নেই।
পুলিশ অফিসার আবার বলা শুরু করলেন বায়োগ্রাফিটা আমি নিজেও পড়েছি সেখানে আপনাদের ভ্রমণেরও বর্ণনা রয়েছে। আপনাদেরকেও আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করবো একে একে তবে সেটা থানায়। আপনার কি মনে হয় এগুলো সত্যি?
হেমন্তি ভেজা কন্ঠে উত্তর দিলো না এমন কোনো ঘটনার সম্মুখীন আমরা হইনি।এগুলো তার কল্পনা হতে পারে।
তাহলে তো আর কোনো কথাই থাকে না মি. সিরাজকে আমাদের সাথে যেতে হবে।আপনারা বিয়েটা সেরে নিন আমরা ততক্ষণ অপেক্ষা করছি।
হেমন্তি চুপ করে রইলো চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে গালে এসে জমলো। হেমন্তি সহ সকলে কক্ষ থেকে বের হয়ে এলো হেমন্তি সকলের সামনে বলে উঠলো আমি এই বিয়েটা করছি না। উপস্থিত সকলে হতবাক হলো পরিবারের সবাই জিজ্ঞেস করলো কি এমন হয়েছে যে হেমন্তি বিয়ে করবে না।
সিরাজ অসহায়ের মতো চেয়ে আছে হেমন্তির দিকে। মনে মনে বলছে আমায় অবিশ্বাস করিস না হেমন্তি। আমি সত্যি সত্যিই এটা করিনি।
হেমন্তি সিরাজের দিকে চেয়ে বললো তুই যদি কাউকে খুন করার মতোও অপরাধ করতি তাও ক্ষমা করে দিতাম কিন্তু না তুই আমার আমিকেই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিস।আমাকে ভুল প্রমান করে দিলি?
সিরাজ মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। হেমন্তি বলে উঠল
– নারীদের জন্মই বুঝি হয় যন্ত্রণা ভোগ করার জন্য।
সিরাজ বললো- পুরুষ তার শখের নারীকে কখনোই পায় না তার প্রমাণ বোধহয় আমি নিজেও।
সিরাজকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো।সকলেই কিছুক্ষণ হট্টগোল করে যে যার বাড়িতে চলে গেলো।বরপক্ষও আশাহত হয়ে ফিরে গেলো।
বিয়ে বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এলো। শুনশান রাতের অন্ধকারে হেমন্তি যেন একা। কথা ছিলো সিরাজের বউ হয়ে তার বাড়িতে যাওয়া কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো।
লতিফা বেগম মেয়েকে বার বার জিজ্ঞেস করছে সিরাজ কি করেছে? কিন্তু হেমন্তি চুপ করে আছে।অসার হয়ে আছে তার সারা শরীর এক চুলও নড়ছে না।
ফুপি মা মুখ ভেঙচি দিয়ে বললেন এজন্যই বলেছিলাম এ ছেলেকে বিয়ে করতে না আমার বিলেতে বাস করা ছেলে তো ঢের ভালো সে কথা তোমরা গায়ে মাখলে না।দেখো এবার কি হয়??
থমথমে পরিবেশ এ হেমন্তির এক চিৎকার যেন ঝড়ের ন্যায় উদয় হলো হেমন্তির চিৎকারে কষ্টগুলো ছিটকে পড়ছে মাটিতে, আকাশে – বাতাসে।
হে আল্লাহ কেনো তুমি আমার ভাগ্যে৷ তারে লিখলে না, কেনো? যদি নিয়তিতে নাই থাকবে তবে উপক্রমণিকায় কেনো তাকে রাখলে???
সারা রাত হেমন্তি কেঁদেই চলেছে সকালের আলো চারদিকে ফুটতে না ফুতটেই সিরাজ এর আম্মা এ বাড়িতে এলেন ছেলের বিয়ে দেখতে নেই বলে সে রাতে আসেনি কিন্তু যখন সবার কাছে শুনলো তার ছেলেকে পুলিশ এ ধরে নিয়ে গেছে তখন থেকেই সে আসার জন্য ছটফট করছিলো।
হেমন্তি এখনও বিয়ের আসরে লাল বেনারসি পড়ে বধূ সেজে বসে আছে।সিরাজের আম্মা হেমন্তির হাত দুটো শক্ত করে ধরে বললেন- তুই আমার ছেলেকে আটকাতে পারলি না মা। আমি ওর মা আমি জানি আমার ছেলে কোনো অন্যায় করতে পারে না।তুই তো ওর বন্ধু, এতদিনে এই চিনলি ওকে?
– আমি জানিনা সে এই কাজটা করেছে কিনা তবে তার এ কাজ করার কথা মাথায় আনাটাও যে পাপ ছিলো।আমি আর এসব নিয়ে কথা বলতে চাইনা।
– তোকে আমার সাথে উকিলের কাছে যেতে হবে, আমার ছেলেকে একমাত্র তুই বাঁচাতে পারিস রে মা।
– হ্যা আমি থানায় যাবো তবে সিরাজ যদি অন্যায় করে থাকে তবে ও শাস্তি পাবে আর যদি না করে তবে পাবে না।
বেশ অনে্ক্ষণ কেটে যাওয়ার পর হেমন্তির বাবা মা সহ সিরাজের বাবা মা থানায় গেলো। পুলিশ সিরাজের সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না কাউকে। উকিলের কাছে যেতেই তিনি পুলিশ অফিসার এর সাথে কথা বললেন।
পুলিশ অফিসার জানালেন সিরাজ এর রচনা করা বায়োগ্রাফিটি যদি সত্যি হয় তবে মুক্তি পাবে এর জন্য সাক্ষির প্রয়োজন এবং উপযুক্ত প্রমান। উকিল সাহেব সমস্ত ঘটনা তদন্ত করে সিরাজের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলেন এটা সিরাজ লিখেছিলো তবে প্রকাশ করেনি।তবে এই সত্যি প্রমাণ করতে করতে অনেক সময় পার হয়ে যেতে পারে।মাসের পর মাস নয়তো বছরের পর বছর।তাই উকিল সাহেব হেমন্তিকে বললেন – মিস. হেমন্তি আপনি আর আপনার বন্ধুরা যদি সাক্ষী দেন সিরাজ সঠিক তথ্যই বায়োগ্রাফিতে লিখেছে তবে হয়তো সিরাজ মুক্তি পাবে আর যদি বলেন সিরাজের বায়োগ্রাফি মিথ্যা তবে সিরাজকে শাস্তি পেতে হবে। এবার ভেবে দেখুন আপনি কোনটা করবেন?
হেমন্তি যেন একটা ধাক্কা খেলো সে কোনদিকে যাবে এবার।নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছিলো।সিরাজের আম্মা ও বাবা হেমন্তির কাছে ভিক্ষা চাইছে তাদের ছেলের জীবন।তার একটা জবানবন্দি সব বদলে দিতে পারে।
হেমন্তি কিছুক্ষণের জন্য নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলো।হুট করেই নিজের আম্মাকে প্রশ্ন করে বসলো- আম্মা যদি বাবা আর আমার মাঝে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হয় তবে তুমি কাকে বেছে নিবে??
মেয়ের এমন প্রশ্নে লতিফা বেগম চমকে উঠল কিছুটা তার মেয়ে কখনোই এমন অযৌক্তিক প্রশ্ন করেনা।তবে যে ধকল যাচ্ছে তাতে এমন প্রশ্ন করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
হেমন্তি জোর করলো উত্তর দেওয়ার জন্য লতিফা বেগম মেয়েকে শান্ত করতে বললেন আমি যে দুজনকেই আমার জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসি।যদি আমার আর তোর মধ্যে কাউকে বেছে নিতে হয় তবে আমি তোকে বেছে নিবো।
হেমন্তি একটু হেসে নিয়ে বললো যাক আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি।
এবার হেমন্তি ঠিক একই প্রশ্ন করলেন সিরাজের আম্মাকে।
– কাকিমা আপনাকে যদি বলা হয় সিরাজ আর কাকা মশাই এর মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে তবে আপনি কাকে বেছে নিবেন?
তিনি ছেলের চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন সে ঘোরের মধ্যেই বলে উঠলেন – আমি আর আমার স্বামী দুজনেই আমাদের সিরাজকে বেছে নিবো।মা রে উকিল সাহেবের কথামতো তুই আদালতে এই সাক্ষীটাই দিস। আমার ছেলেকে ছাড়া রে মা এখন সব তোর হাতে।
এবারও হেমন্তি হাসলো।
সিরাজের সাথে দেখা করতে চাইলো হেমন্তি সারাদিন পার হওয়ার পর সন্ধ্যায় দেখা করার অনুমতি পেলো হেমন্তি।সময় মাত্র ১০ মিনিট।
হেমন্তি কে দেখা মাত্রই সিরাজ এর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো রাতের সেই অপরূপ মুগ্ধতাময় নারীকে আজ কতটা অসহায় লাগছে।হেমন্তির লেপ্টে যাওয়া কাজলও বলে দেয় কতটা আঘাত পেয়েছে সে নয়তো সিরাজকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই।
লাল বেনারসি শাড়ি পড়ে আজ আমার ঘরের বউ হওয়ার কথা ছিলো তোমার। আর ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখো আমরা এত কাছাকাছি থেকেও আজ দুজনে দুই প্রান্তে।
হেমন্তি মুখে মিথ্যা হাসি নিয়ে বলল-
আমায় যদি তোমার আর রূপার মাঝে একজনকে বেছে নিতে হয় তবে তোমার কি মনে হয় আমার কাকে বেছে নেওয়া উচিৎ?
ছলছল চোখে সিরাজ বলে উঠলো আমি চাই তুমি রূপাকে বেছে নাও।আমি প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ নিজের ভালো৷ মন্দ বুঝতে শিখেছে কিন্তু রূপা একটা বাচ্চা মেয়ে।ওর একজন অভিভাবক প্রয়োজন যার যোগ্য হেমন্তি।
হেমন্তি শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে নিজের কষ্ট টাকেও গিলে নিলো বললো- তুমি শব্দটা নাকি খুব আপন কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে অপ্রিয় শব্টা হলো তুমি। সবচেয়ে যে পর তাকেই বোধহয় তুমি বলে সম্বোধন করা হয়। যাই হোক আমাদের সময় শেষের দিকে আমি আসছি।
আগামী এক সপ্তাহ পর আদালতে উপস্থিত থাকতে বলা হলো সবাইকে। হেমন্তিও নিজের বক্তব্য ঠিক করে রেখেছে।
বাড়িতে এসেই গোসলের পানির সাথে চোখের পানি গুলো কে ও ঝড়িয়ে ফেললো।শক্ত আবরণে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা পায়ের গাড়ো রঙের আলতা পানি লেগে হালকা রঙে পরিবর্তিত হয়েছে।
দিনগুলো যেনো কাটছে বিষন্নতায়। চোখের নিচে কালি পড়েছে তার দুশ্চিন্তায়। আজ পত্রিকা খুলতেই যেন কপালে ভাজ পড়লো হেমন্তির।
❝গত সাত দিনে রাজবাড়ী গ্রামে দশজন শিশু নিখোঁজ। তাঁদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি ।❞
এমন এক শিরোনাম দেখে যেনো হেমন্তির কলিজা কেঁপে উঠলো চিৎকার করে রূপাকে ডাকতে লাগলো।রূপা দৌড়ে আসতেই বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগলো।অস্বাভাবিক আচরণে রূপা ঘাবড়ে গেলো।হেমন্তি অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল – বে বেগম জুলেখা ফিরে আ সে নি তো? না না উনি কি করে ফিরবে উনিতো মৃত।জীবিত সমাধি দেওয়া হয়েছে তাকে তবে এই মৃত্যুখেলা কে শুরু করলো???
চলবে,,,,,
#লেখা : মুন্নি ইসলাম