মৃগতৃষ্ণিকা #পর্ব:১৩

0
166

#মৃগতৃষ্ণিকা
#পর্ব:১৩

আব্দুল চোখ দুটো বড় বড় করে ঘাড় বাঁকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলা শুরু করলো – ম্যাডাম পদ্মপুকুরে লাশ ভাইসা ওঠা, বাচ্চা চুরি হওয়া থেকে শুরু কইরা বেগম জুলেখার জীবিত সমাধি সবকিছুই রহস্য। এরপর শুরু হইলো রাজবাড়ী গ্রামের গর্ভবতী মহিলাগো গর্ভধারণের আগেই বাচ্চা মা*রা যাওয়ার মহামারি। এরপর আবার বাচ্চা গো একে একে উধাও হইয়া যাওয়ার ঘটনা।

হেমন্তি অধীর আগ্রহের স্বরে বলে উঠল – চাচা! বেগম জুলেখার জীবন্ত সমাধি দেওয়ার পর পরই গর্ভবতী মহিলাদের বাচ্চা পেটেই মা*রা যাওয়া শুরু হলো। তাই না?

আব্দুল মাথা নেড়ে সায় দিলো।আর বলল পেটেই মারা যায় নয়তো সদ্য ভূমিষ্ট হয়ে মা-রা যায়।

হেমন্তি আবার বলল – আর তার পরপরই আবার বাচ্চাদের উধাও হয়ে যাওয়া শুরু হলো।

আব্দুল বলল জ্বি ম্যাডাম।

হেমন্তি বললো চাচা আমি মনে হয় কোনো এই রহস্যের উন্মোচন করতে পারবো। তবে আমার আপনার সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজন। করবেন আমায় সাহায্য??

আব্দুল থতমত খেয়ে বলল ম্যাডাম আমি এইসবে জড়াইতে চাইনা আরকি। মাফ করবেন।

– বাচ্চা গুলোকে তাদের মায়ের বুকে ফিরিয়ে দিতে না পারলে যে মনে শান্তি পাবো না। তাছাড়া এর পরে তো আপনার সন্তানের পালাও হতে পারে।

আব্দুল উচ্চস্বরে বলে উঠল – চুপ করেন। আমি এসব পারবো না। আমার সন্তানেরা এখন যথেষ্ট বড় হইছে তাদের হারানোর কোনো ভয় নাই।

হেমন্তি মুখ বাঁকিয়ে রাগে গজগজ করে বলে উঠলো -তবে তাই হোক।আমি আপনার নামে কমপ্লেন করবো কর্তৃপক্ষের নিকট। আপনি কেয়ার টেকার হিসেবে যথেষ্ট দায়িত্ব পালন করেন না এমনকি রাতেও রাজবাড়ীতে থাকেন না। অনেক দামী দামী সম্পদ এখনও এখানে রয়েছে যা চুরি হওয়ার সম্ভাবনা ও রয়েছে। আপনার চাকরি তো যাবে যাবেই সাথে সাথে জরিমানাও করা হবে।
বলুন কোনটা চান??

আব্দুল মাথা নিচু করে মিনমিন করে অনুরোধের সুরে বলে উঠল – ম্যা-ডা-ম! আমার চাকরি টা না থাকলে যে অনেক বড় ক্ষতি হইয়া যাইবো। আ আ আমি থাকমু আপনের সাথে চিন্তা কইরেন না। পুরো রাজবাড়ী গ্রামে কোথায় কি হইতাছে না হইতাছে সব খবর দিমু।

হেমন্তি মৃদু হেসে বললো ধন্যবাদ।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই আব্দুলকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো হেমন্তি। সারা গ্রাম ঘুরতে লাগলো কিন্তু কোথাও তেমন কোনো রহস্য জনক ঘটনা তাদের চোখে পড়লো না। হেমন্তি হাঁপিয়ে উঠেছে হাটতে হাটতে তবে তার বেশ ভালোই লাগছে গ্রামটা ঘুরে দেখতে।

আব্দুল বলে উঠল – আর হাটতে হইবো না ম্যাডাম চলেন রাজবাড়ী ফিরা যাই।

হেমন্তি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল – সেকি চাচা এখনই চলে যাবো?

– হ ম্যাডাম চলেন।

– আচ্ছা একবারও তো আপনার বাড়িতে যাওয়ার কথা বললেন না।

বিস্ময় নিয়ে আব্দুল বলে উঠলো – সত্যি যাইবেন ম্যাডাম!! আমার বউ বড্ড খুশি হয় মেহমান বাসায় গেলে।

হেমন্তি আব্দুল এর চোখেমুখে খুশির আভা দেখতে পেয়ে বললো – আরে আমি তো এমনিতেই বলেছিলাম। তবে আপনার খুশি দেখে যেতে ইচ্ছে করছে। চলেন তবে যাওয়া যাক।

বাঙালির আবেগ হলো মেহমানদারি। তারা মেহমান বেশ পছন্দ করে কি করবে না করবে ভেবেই পায় না।

হেমন্তি কে নিয়ে আব্দুল চাচা বাড়িতে যেতেই কিছুটা অবাক হলো এমন ভরসন্ধ্যায় কখনোই তার বউ বাড়ির বাইরে যায় না তবে আজ কোথায় গেলো?
আব্দুল চিৎকার করে ডাকতে লাগল – বউ ও বউ কই গেলা?
আব্দুল এর বড় ছেলে এসে বলল – আব্বা কি হইছে? এত হাঁকডাক কিসের?
আম্মা তো মতির বাড়ি গেছে, পরিবানু নাকি আবার পাগলামি শুরু করছে তাই দেখতে গেছে।

আব্দুল আফসোস এর স্বরে বলল- পরিবানুর হঠাৎ কি যে হইলো বুঝে আসেনা।এই মতি বিয়া করার পর থেকে পরিবানুর জীবনডা তছনছ হইয়া গেলো।কি পরিবানু কি হইয়া গেলো!

আব্দুল হেমন্তিকে বেতের মোড়া এগিয়ে দিতে দিতে বললো – আপনে থাকেন ম্যাডাম আমি ডাইকা দিতাছি।
হেমন্তি বলে উঠল – আরে চাচা থাক থাক ডাকতে হবে না। চলেন তো আমরাই বরং সেখানে যাই।

আব্দুল ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে বলল আরে ম্যাডাম সেইখানে গিয়া কি করবেন।রহস্যের গন্ধ পাইছেন নাকি?
হেমন্তি মৃদু হেসে বললো – জানি না তবে কেনো যেন মন টানছে।

– তাইলে চলেন এই তো আরেকটা বাড়ির পরেই পরি বানুর বাড়ি।

যেতে যেতে আব্দুল পরিবানু আর মতির জীবনের গল্প শোনায়।হেমন্তিও বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনতে লাগলো।

আরও কিছু বলতে যাবে তবে পরি বানুর বাড়ি অবধি পৌঁছে যাওয়াতে আর বলা হলো না। পরিবানুর চিৎকারে থেমে গেলো আব্দুল। জোরে জোরে পা চালিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো পরিবানুর উৎপাত। আশেপাশের সকলেই তাকে দেখতে এসেছে। পুরো বাড়ি ভর্তি মানুষের সমাগম।

সে যেন কিছুতেই থামছে না।মতি তাকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করলেও পারছে না একসময় সে হাঁপিয়ে ওঠে।

আব্দুল ভীড়ের মাঝে তার বউয়ের দেখা পেয়ে টেনে নিয়ে এসেছে হট্টগোল এর বাইরে, হেমন্তির সাথে দেখা করানোর জন্য।
হেমন্তি কে দেখে আব্দুল এর বউ বড্ড খুশি হয়েছে তবে এখন সে তা প্রকাশ করার মতো অবস্থায় নেই।

পরিবানুকে শান্ত করার জন্য তার মন ছটফট করছে তাড়াহুড়ো করে বলল- আমি আপনেরে দেখে খুব খুশি হইছি তয় এখন সময় দিতে পারতাছি না। পরিবানুরে শান্ত করন লাগবো মতি একা পারতেছে না। আমারে সে ছোট বোনের মতো স্নেহ করতো আমিও তারে বড় বোন মানতাম। এমন দুর্দিনে তার পাশে থাকতে না পারলে যে….
তার কথা শেষ হবার আগেই হেমন্তি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল- চাচি কোনো সমস্যা নেই। অন্য একদিন না হয় আপনার সাথে গল্প করা যাবে। আপনি এখন যান তাকে সামলান।
সে মুখে একটা মলিন হাসি দিয়ে হেমন্তির মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বলল – বেশ তবে।আসবেন কিন্তু!!
সে আর দেরি না করে পরিবানুকে শান্ত করতে ছুট লাগালো।
হেমন্তি আব্দুল কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল – আচ্ছা চাচা এই যে আপনি বললেন মতি ও তার বউয়ের কথা।তা মতির বউ কোনটা?
আব্দুল মুখটাকে মলিন করে বলল- এইখানে নাই ম্যাডাম।
– কেনো? এত মানুষ এখানে ভীড় জমিয়েছে তাকে দেখতে কিন্তু তার নাতবউ নেই। ব্যাপারটা কেমন যেন দৃষ্টিকটু লাগছে।

– আরে ম্যাডাম আপনাকে তো বলাই হয়নাই। মতির বউটাকে দেখলেই তো পরিবানু আরো উত্তেজিত হইয়া পড়ে একদম সহ্য করতে পারে না।তাই মতি ওর বউরে পরিবানুর কাছাকাছি আসতে নিষেধ করছে।

– কেনো উত্তেজিত হয়ে যায় চাচা?

– সেটাতো জানি না ম্যাডাম।
তবে আমার বউ আন্দাজ করছে যে মতির বউয়ের জ্বীনে নাকি ধরেছে পরিবানুকে। ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলল আব্দুল।

অস্পষ্ট স্বরে হেমন্তির মুখ থেকে বেরিয়ে এলো – জ্বীন!!!

আব্দুল আবার ফিসফিস করে বলল- হ ম্যাডাম জ্বীন।পরিবানুরে জ্বীনেই ধরছে আর তাও আবার নাতবউ এর জ্বীনে। তাইতো দেখেন না অন্য কাউরে ভয় পায় না শুধুমাত্র ওই মতির বউরেই ভয় পায়। সকলেই জানে এই কথা কিন্তু কয় না।
কি জানি আঁকে মাটিতে কিন্তু কেউই বুঝে না কি আঁকে।

হেমন্তি একটা ভেজা ঢোক গিলে বলল আমাকে একটু তার কাছাকাছি নিয়ে চলুন। দেখি না কি আঁকে।

আব্দুল ভীড় সামলে নিয়ে পরিবানুর কাছাকাছি নিয়ে গেলো হেমন্তি কে।

গ্রামে সন্ধ্যার পরপরই মানুষ জন তেমন একটা বের হয় না অথচ আজ কত সমাগম। রাত যেন তার নিজের নিয়মে বেড়েই চলেছে তবে সেদিকে কারো কোনো খেয়াল নেই সবাই পরিবানুর পাগলামো দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

পরিবানু মাটিতে আঁচড় কেটে কি যেন একটা অবয়ব তৈরি করে আবার সেটা দেখেই সে ভয় পেতে শুরু করে হাত -পা আছড়ে আবার মুছে ফেলে দাগ গুলো।অবয়বটা মিলিয়ে যায় আবার শান্ত হয় আবার শুরু করে প্রথম থেকে। এভাবেই তার দিনগুলো কাটছে তবে আজ যেন সে একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।

পরিবানু মাটিতে আঁচড় কেটে একটা অবয়ব তৈরি করার চেষ্টা করছে হেমন্তি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেদিকে। পরিবানুর আকা শেষ এবার তার নিজেরই ভয় পাওয়ার কথা কিন্তু হলো তার উল্টো, পরিবানু চিৎকার করার আগেই হেমন্তি চিৎকার করে উঠলো।

পরিবানু এবার ভয় পাওয়ার আগে নিজেই হকচকিয়ে গেলো। তার চোখেমুখে হাসির ঝলকানি দেখা যাচ্ছে আস্তে আস্তে সে হেমন্তির দিকে এগোতে লাগলো শোরগোল হওয়া পুরো পরিবেশটা থমথমে রূপ ধারণ করলো হেমন্তির চিৎকারে।
জোছনা এবার তার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো কারণ এই চিৎকার পরিবানুর নয়। কে এমন করে চিৎকার করলো কিন্তু হুট করেই জোছনার মনে পড়লো মতির দেওয়া নিষেধাজ্ঞার কথা সে আর এগোলো না। দরজার সামনে দাড়িয়ে পরিস্থিতি দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু এত মানুষের ভীড়ে সে তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
সে অসহায়ের মতো চেয়ে আছে।
হেমন্তির ভয়ার্ত চেহারা ও অস্বাভাবিক আচরণ দেখে আব্দুল যেন ঘাবড়ে গেলো।
আশেপাশের মানুষজন বলাবলি করতে লাগলো- এই জন্যই একরঙা মাইয়া মাইনষের এইসব জ্বীনভুতে ধরাগো কাছাকাছি আইতে নাই। মাইয়াটার এখন কি হইবো!!
পরিবানু যত এগোচ্ছে হেমন্তির দিকে হেমন্তি তত পেছোতে লাগলো আঙুল দিয়ে ইশারা করে কি যেনো দেখাতে চাইছে সবাইকে কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারছেনা।
আব্দুল পরি বানু কে থামতে বলে হেমন্তির কাছাকাছি যেতে বাঁধা দেয় কিন্তু পরিবানুকে থামাতে যাচ্ছে না এদিকে হেমন্তি পেছোতে পেছোতে ধাক্কা খায় একটা গাছের সাথে ধপ করে পড়ে যায় উঠোনে। কোথা থেকে যেনো সুবাস আসছিলো হেমন্তি ঘ্রানে মুগ্ধ হতে চেয়েও হতে পারে না এটা সেই সুবাস যা সে রাজবাড়ী তে গতকাল রাতেও পেয়েছিলো।হেমন্তি ভয়ে কুঁকড়ে যায় ঘাম ভরা মুখটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মোছার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু কিছুতেই সে শান্ত হতে পারছে না।

আব্দুল উচ্চস্বরে বলল- ম্যা-ডা-ম কি হইছে আপনার?

হেমন্তি কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না তার জিভ আটকে আসছিলো।ডান হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে পরিবানুর আঁকা সেই অবয়ব টার দিকে তাক করলো।হেমন্তির আঙুলকে লক্ষ্য করে সবাই সেই অবয়বটার দিকে দৃষ্টি দিলো।

চলবে,,,,,

#লেখা: মুন্নি ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here