#মৃগতৃষ্ণিকা-০৪
হেমন্তির জন্য একের পর এক সমন্ধ আসতে থাকে আর হেমন্তি একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে থাকে, সিরাজের একটা চাকরি হওয়ার আশায় সে দিন গুনতে থাকে।হেমন্তি চায় রূপাকে কাছে রাখতে আর সিরাজ হেমন্তিকে যেহেতু ভালোবাসে সে রূপাকেও কাছে রাখবে, হেমন্তির সকল চাওয়া- পাওয়াকে সে সম্মান করবে।
সিরাজ অনেক চেষ্টা করেও কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারছেনা আসলে এতো দ্রুত চাকরি পাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয় এরজন্য প্রয়োজন সময় এবং ধৈর্য যার কোনোটাই এখন সিরাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।সিরাজের কেবল একটাই ভাবনা সে কি করে হেমন্তিকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পাবে।
দিগন্তের আঁকা বেগম জুলেখার সেই স্কেচটার দাম এখন পাঁচ কোটি টাকা হয়েছে যা রিতীমত আকাশ ছোয়া দাম। একটা স্কেচের এত দাম এদেশে এর আগে কখনোই হয়নি, দিগন্তের নাম ডাক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।কয়েকদিনের মধ্যেই দিগন্তকে পুরষ্কৃত করা হলো, দিগন্তকে সরকারিভাবে আবেদন করা হয় সে যাতে সুলায়মান ও বেগম জুলেখার একটি স্কেচ করে দেয় এবং এর জন্য তাকে দেওয়া হবে দশ কোটি টাকা।এই স্কেচ একটি থাকবে রাজবাড়ীতে এবং অন্যটি থাকবে জাদুঘরে।
দিগন্তের ভাগ্য যেন এক ঝটকায় খুলে গেলো, সে এখন বিখ্যাত একজন আর্টিস্ট। অনেক বড় বড় জায়গায় তাকে নিমন্ত্রণ করা হয় তাকে তেমনি আজও এক নিমন্ত্রণ পড়েছে এক ইংরেজ কন্যার বিয়েতে, দিগন্ত সেখানে যেতেই সকলের ভিড় জমে যায় একে একে সকলেই অটোগ্রাফ চায় দিগন্ত সকলের মনই রক্ষা করে তবে হঠাৎ করেই সে কিছুসময়ের জন্য থমকে যায় তীব্র চেনা এক কন্ঠস্বর শুনে।চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে সেই মায়াবন বিহারিণীকে।
সে হাত পেতে বলছে আমাকেও একটা অটোগ্রাফ দিন, আমার হাতেই আপনার অটোগ্রাফ দিন।
দিগন্ত একটা ভেজা ঢোক গিলে করুন চোখে তাকিয়ে আছে সোফিয়ার দিকে, সোফিয়ার হাতে সে অটোগ্রাফ দিতে দিতে বলে উঠলো কেমন আছো?
সোফিয়া মৃদু হেসে বললো এখন ভালো আছি অনেকটা তোমার নাম যশ খ্যাতি দেখিয়া আমার ভীষণ ভালো লাগতেছে।আমি জানিতাম একদিন তুমি ঠিক সফল হইবে।
অটোগ্রাফ দেওয়া শেষ হলেও দিগন্ত সোফিয়ার হাত ধরে রেখেছে তার প্রেয়সীর স্পর্শে হৃদয় ব্যকুল হয়ে আছে। তবে সোফিয়া এবার তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো আমার যাইবার সময় হইয়া গিয়াছে, ভালো থেকো।
দিগন্তের চোখ টলমল করছে তবে এখন সে অনেকটা শক্ত তবুও যেন সোফিয়ার উপস্থিতিতে সে তার বল হারিয়েছে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে সোফিয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে অপলক দৌড়ে ছুটে সোফিয়ার কাছে যেতেই নিবে ঠিক তখনই দৃষ্টিতে আটকায় জিয়নকে। জিয়ন সোফিয়াকে নিয়ে এগোতে লাগলো দিগন্ত এবার ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সোফিয়া পেছন ফিরে আরেকবার তাকাতেই দিগন্তের হৃদয়ে যেন কিসের এক ঝড় তুললো, চোখের কোণে জমে থাকা জলেরা চোখে আর অবস্থান করতে পারছেনা তারা আপনা আপনি ঝড়ে চলেছে।
ভক্তের আনাগোনায় দিগন্ত তার হাত দিয়ে চোখ মুখ মুছে নিয়ে হাতে চুমু খেতে লাগলো।
বিয়ের বর ও কন্যার স্কেচ এঁকে দিতে অনুরোধ করা হলে দিগন্ত স্কেচ আঁকা শুরু করলো হুট করেই মনে পড়তে লাগলো সোফিয়ার আঁকা শেষ স্কেচটার কথা।স্কেচ আঁকতে আঁকতে সে তলিয়ে গেলো তাদের মধুময় স্মৃতিতে কিন্তু যখনই কঠিন বাস্তবটা মনে পড়লো ঠিক তখনই যেন সবকিছু ওলট পালট মনে হতে লাগলো।নিজেকে নিয়ে নিজে বারবার প্রশ্ন করতে লাগলো কেনো আমি আমার মায়াবীকে পেলাম না? কেন?
দিগন্ত বাড়িতে এসে টাকাগুলো ছুয়ে দেখতে লাগলো এখন সে কত টাকার মালিক কত ভক্ত তার কত নাম ডাক! ইশ! যদি আর কয়েকটা দিন আগে তোদেরকে পেতাম তবে হয়তো আমার মায়াবিনী আজ আমার কাছেই থাকতো।( আফসোস এর স্বরে বলতে লাগলো দিগন্ত)
সিরাজ দিগন্তের সাথে দেখা করতে যায় নিজের দুর্বলতার কথা দিগন্তকে বলে।দিগন্ত বলে দেখ আমাকে যতদূর বলেছিস রাজবাড়ীর এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি তোরা হয়েছিস আর এখন বেগম জুলেখার জীবন্ত সমাধি নিয়ে মানুষের মনে নানান জল্পনা কল্পনা ও কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে। দেখেছিস আমার স্কেচ টার কত কদর এখন। আমি যদি এই স্কেচ টা জুলেখার জীবিত অবস্থায় পেশ করতাম তবে হয়তো কোনোদিন এত নাম ডাক পেতাম না। তাই আমি বলি কি সিরাজ তুই রাজবাড়ীর একটা ডকুমেন্টারি বানা আর আমার বিশ্বাস এটাই হবে তোর বড় হওয়ার সবচেয়ে সহজলভ্য উপায়।
সিরাজ কিছুক্ষণ ভেবে বললো দেখ তোর নাম ডাক হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে তুই অনেক ভালো স্কেচ আঁকতে পারিস আর আমাকে তো জানিস ওতো গুছিয়ে লেখার মতো ক্ষমতা আমার নেই যে কেউ সেটা পড়ে মুগ্ধ হয়ে যাবে।
– আরে তুই পারবি, তুই আর হেমন্তি তো গিয়েছিলি সেখানে তুই যদিও না পারিস হেমন্তির সাহায্য নিতে পারিস।দুজনে মিলে ডকুমেন্টারি টা তৈরি করে ফেল দেখবি আর পেছনে ফিরে তাকাতেই হবে না।
দিগন্তের দেওয়া পরামর্শ সিরাজের খুব ভালো লাগে সে এবার ঠিক করে ডকুমেন্টারি টা তৈরি করেই ফেলবে।একটা গাঢ় লাল রঙের ডায়েরিতে সে লিখতে শুরু করে তবে এবার তার মনে হয় হেমন্তির সাথে কথা বলা দরকার যেহেতু হেমন্তির বারণ আছে সুলায়মানের কর্মকাণ্ডের কথা কাউকে জানাতে।
সিরাজ হেমন্তির সাথে কথা বলে- ডকুমেন্টারি বানাতে গেলে অবশ্যই এমন থিম লাগবে যাতে করে সবাই সেটা উপলব্ধি করতে পারে আর সকলের মনে দাগ কেটে যায়। আর জনাব সুলায়মান ও তার বেগমের কাহিনি তো আগের সব রেকর্ড ভেঙে দেবে। তুই দেখলি না দিগন্ত কি থেকে কি হয়ে গেলো শুধু মাত্র ও জুলেখার স্কেচ এঁকেছে বলে।
জুলেখার জীবন্ত সমাধির কারণে এখন ওদের নিয়ে যা ই বানানো হবে তাই তোলপাড় শুরু হবে।দেখবি আমরাও কোটিপতি হয়ে যাবো।আর সেটা ছাড় লাখপতি হলেই তো হলো অন্তত লাখপতি তো হতে পারবো।আর তোকেও আমার করে পেতে কোনো বাঁধাই থাকলো না আর, তাইনা?
হেমন্তি তার ভ্রু জোড়া কিছুটা কুঁচকে নিয়ে বলল তুই কি পাগল হয়ে গেছিস সিরাজ, জনাব সুলায়মানের শেষ ইচ্ছের কথা তোর মনে নেই? আর রূপার কথা একটা বার ভেবে দেখ ওর মনে কি ধরনের প্রভাব পড়বে। সুলায়মান ও বেগম জুলেখার কাহিনি লিখতে গেলে অনেক করুন সত্যকে তুলে ধরতে হবে আর আমি সেটা চাই না।
সিরাজ আর কথা বাড়ায় না সে জানে হেমন্তি কিছুতেই রাজি হবে না, সাহায্য করা তো দূরের কথা।
সিরাজ তার ডকুমেন্টারি তৈরি করার কাজে লেগে পড়ে তবে সে অনুভব করতে পারছিলো না এরজন্য প্রয়োজন রাজবাড়ী অবস্থান করা।পুরোপুরি ভাবে সবটা ফুটিয়ে তুলতে যেতে হবে রাজবাড়ী, সিরাজ আর কিছু না ভেবে দিগন্তকে বলে রওনা দিলো রাজবাড়ীর উদ্দেশ্যে, দিগন্তকে সাথে করে নিয়ে যেতে চাইলে সে জানায় তার কাজের অনেক চাপ সে এতদিনের সফর করতে পারবে না।
সিরাজ বাধ্য হয়ে একাই সেখানে যায়।
রাজবাড়ীটা আগের মতোই আছে শুধু মানুষজন গুলোই নেই।বেগম জুলেখার জীবন্ত সমাধি দেখতে এখনো মানুষ দূর দুরান্ত থেকে আসে। তবে রাতে কারো থাকার পারমিশন নেই, রাজবাড়ী দেখাশুনা করার জন্য একজন কেয়ার টেকার রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকারিভাবে।
যেহেতু সিরাজ ডকুমেন্টারি তৈরি করতে এখানে এসেছে তাই তার থাকার অনুমতি দেওয়া হয়।সিরাজ অবশ্য তেমন করে নাটকীয় ভঙ্গিতে না লিখতে পারলেও আজ বেশ ভালো করে লিখছে। রাজবাড়ীর প্রতিটা আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রহস্য সব একে একে উন্মোচন করছে সিরাজ তার লাল রঙা ডায়েরিটাতে।
অনেকক্ষণ লেখার পরে সে কিছুটা বিরতি নেয় এরপর আবার লেখা শুরু করে, সে লেখায় এতটাই মনোযোগী হয়ে পড়েছে যে আশেপাশের কোনো কিছুই তার খেয়ালে নেই।কখন যে দিনের আলো সরে গিয়ে রাতের অন্ধকার বিস্তার করেছে সে টেরই পায়নি। কেয়ার টেকারের ডাকে তার হুশ ফিরে কেয়ার টেকার আব্দুল জানায় রাতে সে রাজবাড়ীতে অবস্থান করেনা একদিন থেকেছিলো তবে সে দিন সে কোনো আত্মার অস্তিত্ব অনুভব করেছিলো ভয়ে তার জ্বর এসেছিলো তিনদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি।এরপর থেকে সে এই পর্যন্ত রাতে আর থাকেনি তবে কর্তৃপক্ষের কেউ সেটা জানেনা। আব্দুল সিরাজকে অনুরোধ করে যাতে সে এই কথা কাউকে না জানায়। সিরাজও সম্মতি জানায় কিন্তু মনে মনে তার একটু ভয় ভয় পায় এমনিতেই আব্দুলের বলা কথাগুলো তারওপর মনে পড়ে যায় রাজবাড়ীতে শেষ যে রাত থেকেছিলো সেদিন সেও অনুভব করেছিলো কারো উপস্থিতি।কালো বোরকা পরিহিত কোনো নারীর অবয়ব।
সিরাজ আব্দুলকে পেছন থেকে ডেকে বলে আপনি কি সেদিন রাতে কোনো কালো বোরকা পরিহিত নারীকে দেখেছিলেন।
আব্দুল সিরাজের কথায় ভেজা ঢোক গিলে কিছুটা সময় নিস্তব্ধতা পালন করে মাথা নাড়াল আর বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো- আপনি কি করে জানলেন বাবু?
সিরাজ বললো আরে আমি তো এমনি মজা করলাম দেখলেন আমার আন্দাজ কেমন সত্যি হয়ে যায়।
আব্দুল কিছু বুঝতে পারছেনা তবে রাত অনেক হওয়ার আগেই তাকে বাড়ি ফিরতে হবে সে আর দেরি না করে চলতে শুরু করলো।
সিরাজের মনে ভয়ের সৃষ্টি হলেও সে তোয়াক্কা না করে লেখায় মন দিলো এখন যেন তার লেখার মান আরও ভালো হচ্ছে। সে নিজের লেখা নিজে পড়েই বিশ্বাস করতে পারছেনা এটা তার লেখা।
মাঝরাতে হঠাৎ অন্দরমহল থেকে কান্নার শব্দ তার কানে ভেসে আসছে সিরাজ ভয়ে ভয়ে উঠে দাড়ায় কেন যেন তার ভীষণ ভয় হচ্ছে। পুরো রাজবাড়ীতে কেউ নেই তবে কাঁদছে কে, সিরাজ মৃদুপায়ে অন্দরমহলের দিকে যেতে শুরু করে কিন্তু সেখানে সে কাউকেই দেখতে পায় না। জনাব সুলায়মান ও বেগম জুলেখার কক্ষ তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে এমনকি এই রাজবাড়ীতে যতগুলো কক্ষে দামী জিনিসপত্র রয়েছে সেসবগুলো কক্ষই তালাবদ্ধ।
সিরাজ এবার থমকে দাঁড়ালো সুলায়মানের কক্ষের সামনে এখন আর কেউ কাঁদছে না সব নিশ্চুপ হয়ে আছে, সিরাজ ভাবে হয়তো এগুলো তার মনের ভুল সে চলে যেতে উদ্যত হলে আবারও কান্নার আওয়াজ পায় তবে এবার কোনো বাচ্চার কান্নার শব্দ আসতে থাকে।এরপর সিরাজ সেই কক্ষে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলে শুনতে পায় কেউ মিষ্টি কন্ঠে গান গেয়ে তার বাচ্চাকে থামানোর চেষ্টা করে। এমনকি বাচ্চার কান্না থেমেও যায়। সিরাজের এবার ভয় হতে শুরু করলো কিন্তু সে বুঝতে পারছেনা ভেতরে কে বা কারা আছে।
হঠাৎ করেই সিরাজ তার কাঁধে কারো স্পর্শ অনুভব করে এবার আঁতকে ওঠে সিরাজ, সে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতেই তার চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে যায়।একি! এতো কালো বোরকা পরিহিত কোনো মহিলা।
সিরাজ প্রশ্ন করে আপনি কে? কিন্তু তার কন্ঠস্বর কেবল তার কান পর্যন্তই পৌঁছাতে পেরেছে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে সে আর সহ্য করতে পারছেনা কাঁপতে কাঁপতে সে অস্থির হয়ে পড়ে হঠাৎ করেই সেই মহিলা তার নিকাবটা সরায় আর সিরাজ চিৎকার করে ওঠে কিন্তু সে নিজেকে আবিষ্কার করলো চেয়ার- টেবিলে যেখানে সে লেখালেখি করছে। লিখতে লিখতে কখন সে ঘুমের ঘোরে চলে গিয়েছে নিজেও জানে না তবে এমন একটা স্বপ্ন যেন তার ঘুম কেড়ে নিলো শত চেষ্টা করেও স্বপ্নের কথা সে ভুলতে পারছে না। পানি পিপাসা পেয়েছে খুব কিন্তু ভয়ে তার বেরোতে ইচ্ছে করছে না এদিকে পানি পান করতে না পারলেও যে তার ঘুম হবে না। সিরাজ এবার ভয়ে ভয়ে পানি খেতে বাইরে বেরোলো সিরাজ, পুরো বাড়িটাকে কেমন যেন ভুতুড়ে মনে হতে লাগলো সিরাজের সে পানি নিয়েই দৌড়ে তার কক্ষে চলে এলো এরপর হাঁপাতে হাঁপাতে পানি খেতে লাগলো। সিরাজ আবার লেখায় মন দিলো কিন্তু তার হাতও কাপছে।
অনেকটা সময় পর সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে,একটা স্বপ্ন দেখে ভয় পাওয়া নেহাত বোকামি ছাড়া আর কিছু না এটা সে নিজেকে বোঝাতে থাকে।
আজকের রাত টা যেন অনেক লম্বা সময় নিয়ে পড়ে আছে তার মনে হতে থাকে এই রাত বুঝি আর ফুরাবে না।
ভোরে কেয়ার টেকার আব্দুল বাড়িতে এসে কাজ করতে শুরু করলে দেখে সিরাজের কক্ষের দরজা বন্ধ। সে কিছুটা ভয় পায় সিরাজের জন্য তার মনে হতে থাকে কোনো ক্ষতি হলো না তো তার সে দরজা ধাক্কাতে থাকে।
ভোরের দিকেই সিরাজের চোখে একটু ঘুম লেগে এসেছিলো কিন্তু আব্দুলের ডাকে আর ঘুমানো হলো না।সিরাজ বিছানা ছেড়ে উঠে এসে দরজা খুলে বললো কি হয়েছে?
– না বাবু এমনি।আপনি ঠিক আছেন তো?
– হ্যা আমি ঠিক আছি।
সিরাজ তিন দিন এই রাজবাড়ী তে অবস্থান করে ডকুমেন্টারি তৈরি করে আজ চতুর্থ দিন। আরও দুদিন সময় লাগবে পুরোটা শেষ করতে।
বেগম জুলেখার ১৪৫টা বাচ্চার কলিজা খা*ওয়ার কথা সে ডায়েরিতে লিখতে যায় আর তখনই সে আবার অন্দরমহলের ভেতর থেকে আওয়াজ শুনতে পায়।ভাবতে থাকে হয়তো সে স্বপ্ন দেখছে কিন্তু না আজ সে বাস্তবেই শুনতে পাচ্ছে।প্রতিদিন এমন আওয়াজে সে বিরক্ত আজ সে দেখেই ছাড়বে কে আছে ভেতরে।
সুলায়মানের কক্ষের দরজার তালা ভাঙা সহজ কথা নয় সিরাজ অনেক চেষ্টা করেও সে তালা ভাঙতে পারছে না কিন্তু মানুষের জেদ একবার তার ঘাড়ে চেপে বসলে সেটা সে যে করেই হোক করেই ছাড়ে সিরাজও কক্ষের তালা ভেঙে ফেলে।ভেতরে ঢুকতেই দেখে এক মহিলা তার বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছে গান গেয়ে এই কন্ঠ যেন বেগম জুলেখার, এত সুমধুর কন্ঠ জুলেখা ছাড়া আর কারো হতে পারে না। সিরাজ সামনে যেতেই দেখে সেখানে কেউ আবার পেছনে ঘুরতেই দেখে কালো বোরকা পরে এক মহিলা দাড়িয়ে আছে সেখানেও সিরাজ এক মুহুর্তেই চলে যায় কিন্তু সে কারো অস্তিত্বই খুজে পায় না।
সারা কক্ষ জুড়ে সে চক্কর খেতে খেতে পাগলপ্রায় অবস্থা। এবার সিরাজ বসে পড়ে তার সাথে যা হচ্ছে তা কি সত্যি সত্যিই হচ্ছে নাকি এসব তার মনের ভুল।
সারা রাত পুরো কক্ষ জুড়ে সে আর অজানা এক অস্তিত্বের সাথে লড়াই করে গেছে কিন্তু কিছুতেই নাগাল পায় না সে। ডকুমেন্টারির একদম শেষ পর্যায়ে এসে থেমে গেলে চলবে না তার আজ রাতে পাতালঘরে ঢুকতে হবে আর সেটা পর্যবেক্ষণ করে ডায়েরি তে উল্লেখ করলেই তাকে ধনী হওয়া থেকে আর কেউ আটকাতে পারবে না। হেমন্তি কে পাওয়া থেকেও আর কেউ আটকাতে পারবে না। যা করার রাতের মধ্যেই করতে হবে। আমার আগে যদি কেউ জেনে যায় তবে আর রহস্য থাকলো কোথায়। সিরাজ রাজবাড়ীর একটা ম্যাপও তৈরি করে। শুধুমাত্র পাতালঘরের বর্ণনা দেওয়াই বাকি ডকুমেন্টারিতে।
আব্দুল এসে জানায় গ্রামের মানুষ নাকি বেগম জুলেখা ও জনাব সুলায়মান এর মৃত্যু কে অভিশাপ মনে করছে।এ গায়ের কোনো গর্ভবতী নারীই নাকি সুস্থ বাচ্চা জন্ম দিতে পারছে না সকলের বাচ্চাই মৃত হচ্ছে। প্রথম প্রথম স্বাভাবিক মনে হলেও এখন সবার মনে ভয়ের জন্ম দিয়েছে। অনেক গর্ভবতী নারীই গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আশে পাশের গ্রামগুলোতেও এই অভিশাপ নেমে এসেছে। সিরাজ কিছুটা চমকে যায় আব্দুলের কথা শুনে। মনে ভয়ের সৃষ্টি হলেও সে ভয় পেতে চায় না আজ রাতের মধ্যেই কাজ শেষ করে সে চলে যাবে রাজবাড়ী ছেড়ে। এমনিতেই হেমন্তির বারন আছে এই কাজে তারওপর যদি কোনোরকম ঝামেলায় জরাতে হয় তাহলে একুল ওকুল দুকুলই হারাতে হবে তাকে।
রাতের অপেক্ষায় সিরাজ প্রহর গুনতে থাকে।
হেমন্তির সাথে সিরাজের এক সপ্তাহ হলো কোনো যোগাযোগ নেই।হেমন্তি চিন্তায় পরে যায় সিরাজ আবার এসব ডকুমেন্টারি বানাতে চলে যায় নি তো। হেমন্তি সিরাজের কোনো খোঁজ না পেয়ে দিগন্তের কাছে গেলে সে জানায় এ ব্যাপারে দিগন্ত কিছু জানে না।আসলে দিগন্তকে সিরাজ বারণ করেছিলো কিছু জানাতে।
এদিকে কোর্ট থেকে হেমন্তির ঠিকানায় চিঠি আসে উকিলের সাথে দেখা করতে বলা হয় তাকে। যেহেতু সুলায়মান রূপার নামে সবকিছু লিখে দিয়ে গেছে সেহেতু রূপাকে তাদের প্রয়োজন।
হেমন্তি রূপাকে নিয়ে শহরে চলে যায় উকিলের সাথে দেখা করতে।
রাতের অন্ধকার চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তেই সিরাজ সুলায়মানের কক্ষে গিয়ে খুজতে লাগলো পাতালঘরের চাবি, কিন্তু কিছুতেই সেই চাবি খুঁজে পাচ্ছে না সিরাজ পুরো কক্ষ খুঁজে বেড়াচ্ছে কিন্তু কিছুতেই সেই চাবির খোঁজ পাচ্ছে না।
সিরাজ এবার রাগে গজগজ করতে থাকে সে লোহার একটা রড হাতে নিয়ে পাতালঘরের দিকে যেতে থাকে যেই রড দিয়ে বারি দিবে অমনি দেখতে পায় ঠকঠক আওয়াজ তুলছে পাতালঘর, এখনো আঘাত করেনি তার আগেই শব্দ শুরু হয়ে গেছে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে সিরাজের। সিরাজ পাতালঘরে হাত রাখতেই আপনা আপনি চাবি ছাড়াই এটা খুলে যায়।এটা দেখে সিরাজের চোখকে সে নিজেই বিশ্বাস করতে পারে না।
তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে পাতালঘরে তাকে পৌঁছাতে হবেই। সিরাজ আর না ভেবে পাতালঘরের দিকে পা বাড়ায় সিড়ি বেয়ে নামতে থাকে মৃদুপায়।
চলবে,,,,,
#লেখা : মুন্নি ইসলাম
[ ব্যস্ততার কারণে গল্প দিতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে তার জন্য দুঃখিত। আশা করি সবাই রেসপন্স করবেন রিচ অনেকটা কমে গেছে। ধন্যবাদ সবাইকে। ]