মৃগতৃষ্ণিকা #পর্ব : ১১

0
211

#মৃগতৃষ্ণিকা
#পর্ব : ১১

হেমন্তির দৃষ্টি স্থির। ভেতর ভেতর তার অস্থিরতা তবে বাইরে শক্ত আবরণ।সে যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তাকেই কিনা জীবন থেকে মুছে দিতে হবে!!
হেমন্তির দিকে সকলের দৃষ্টি সে কি বলবে সেটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সবাই।শক্ত আবরণে থাকা মানুষটার ভেতরে কি চলছে তা কেউ জানেনা সে নিজেও বুঝতে পারছেনা কি করবে অবশেষে সে আদালতে বলে উঠল সিরাজের ডকুমেন্টারিতে যা সে উল্লেখ করেছে তা কখনোই সম্ভব নয় এগুলো তার বানানো গল্প।আমরা কখনোই এই ঘটনার সম্মুখীন হইনি।রূপাকে জনাব সুলায়মান আমার হাতে তুলে দিয়েছেন তাই আমি তার দায়িত্ব পালন করছি। তার স্ত্রী কে জীবন্ত সমাধি দেওয়ার কারণ আমরা জানি না।
সব চাইতে বেশি অবাক হলো দিগন্ত। সে কখনোই ভাবতে পারেনি হেমন্তি এমন একটা সাক্ষী দিবে।সিরাজের জেল হতে পারে জেনেও সে অস্বীকার করলো??
হেমন্তির কাছাকাছি এগিয়ে এলো সিরাজের মা, হেমন্তি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে সিরাজের মা মুখে একটা তিক্ত হাসি নিয়ে বলল যা হয় ভালোর জন্য হয় ভাগ্যিস আমার ছেলের সাথে তোমার মত মেয়ের বিয়ে হয়নি!! হাহ্

হেমন্তি লিখিত ভাবে জমা দিলো সিরাজের ডকুমেন্টারি পুরোপুরি কল্পনাময় এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।
সিরাজের পাঁচ বছরের জেল হওয়ার কথা থাকলেও উকিল সাহেব হেমন্তির সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছিলেন সিরাজ এর শাস্তি হতে পারে তাই তিনি সিরাজের মানসিক সমস্যা ও ভুলে যাওয়া রোগের কথা উল্লেখ করেন। বলেন তার এই ভুলে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে তাকে কেউ ফাসানোর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে!অবশ্যই তাকে খুজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা হবে।

কোনোভাবে সিরাজকে সাময়িক ভাবে শাস্তির হাত থেকে বাঁচানো গেলো তবে জরিমানা করা হলো এক লক্ষ টাকা।সিরাজকে হাজিরাও দিতে হবে সময়মতো।

এতে সিরাজ ও তার পরিবারকে অনেকটা সমস্যায় পড়তে হয়।

সবাই অবাক হলো তখন যখন জরিমানা করা এক লক্ষ টাকা দিগন্ত দিতে চাইলো এমনকি উকিলের পারিশ্রমিকও।যতোই সে টাকার মালিক হোক না কেনো সে তো আর আমাদের অপমান করতে পারে না মনে মনে বললো সিরাজের বাবা। সিরাজও অবাক হলো সে কিছুতেই দিগন্তের দেওয়া টাকা নিবে না। চোখ গরম করে তাকালো দিগন্তের দিকে।দিগন্ত হুট করেই বললো এই সবকিছু আমার জন্যই হয়েছে তাই এটা আমার কর্তব্য।

সিরাজ কলার চেপে ধরে দিগন্ত রাগে তার শরীর কাঁপছে কটমট করে বললো বন্ধু হয়ে বিশ্বাস ঘাতকতা করলি তুই। তুই তোর ভালোবাসা পাসনি বলে আমাকেও পেতে দিলি না।এত জঘন্য তুই??

দিগন্ত কোনোমতে কলার ছাড়িয়ে বলল- বিশ্বাস কর আমি বুঝতে পারিনি পরিস্থিতি এমন হয়ে যাবে ভেবেছিলাম হেমন্তি তোকে বাঁচাতে সত্যিটা বলবে আর তুই হয়ে যাবি লাখপতি। জীবনভর সুখে কাটাবি বিশ্বাস কর সিরাজ আমি তোর খারাপ চাইনি।

– তোর তো অনেক টাকা, তুই কি পেরেছিস সুখী হতে??

দিগন্ত মাথা নিচু করে আছে সিরাজের কথায়।জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে বলল -“পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস”।

হেমন্তি সিরাজ দুজনে দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহুর্ত তবে হেমন্তি আর পারছেনা দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো নিজেকে মনে মনে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগলো তার। তবুও কিছু একটা বলতে যাবে তবে জিভ জড়িয়ে যাচ্ছিলো। বলতে গিয়েও আর বলা হলোনা।

সিরাজ মনে মনে বললো একটা বার আমায় বিশ্বাস করে দেখতি, এইটুকু বিশ্বাসও করতে পারলি না আমায়? আমার পাশে থেকে সত্যিটা তো উদ্ধার করতে পারতি?নাহ্! আসলে তোর আমার প্রতি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই।

❝তোমায় না পাওয়ার শোকে আমার মৃত্যু হোক তবুও তোমায় পেতে চাইবার৷ তীব্র আকুতি জানাবো না❞!!
-সিরাজ।

হেমন্তির চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে গালে এসে পড়লো কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলে উঠল – প্রিয় মানুষকে পাওয়ার মতো ভাগ্য নিয়ে সবাই যে জন্মায় না!!

__________

রাজবাড়ী গ্রামে আবারও শুরু হলো বাচ্চা চুরি হওয়ার প্রবণতা। দিন দিন যেন এই প্রবণতা প্রবলতর হচ্ছে। একের পর এক অশুভ ছায়া যেন রাজবাড়ীকে ঘিরেই রয়েছে। কিছুতেই যেন মুক্তি মিলছেনা বসবাসরত মানুষদের।
এদিকে পরি বানুর অবস্থা বেশ শোচনীয় কেমন যেন পাগলের মতো আচরণ করে সে। মাথার চুল টেনে টেনে ছিড়ে মাটিতে আচড় কাটে আবার একা একাই বকবক করে সে। মতি পরিবানুকে খুব যত্ন করে ঠিক ছোটবেলায় যেভাবে পরিবানু তাকে যত্ন করতো।পরিবানু মাটিতে আঁচড় কেটে কি যেন একটা অবয়ব তৈরি করে কিন্তু সেটা খুব অস্পষ্ট। অনেকেই ইতিমধ্যে তাকে দেখতে এসে এমন কান্ডের মুখোমুখি হয়েছে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারেনি।
জোছনাকে দেখলেই আরো বেশি আতঙ্কিত হয়ে যায় অস্বাভাবিক আচরণ করে তাই মতি জোছনা কে পরি বানুর কাছাকাছি আসতে নিষেধ করেছে।

দিন দিন যেন রাজবাড়ী গ্রামে বাচ্চা চুরি বেড়েই চলেছে এমনভাবে প্রতিদিন বাচ্চা চুরি হওয়ায় খবরটা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। হেমন্তি খবরের কাগজ হাতে নিলেই আকস্মিক ধাক্কা খায় তার মনে হতে থাকে জনাব সুলায়মান ও তার বেগম জুলেখার কথা কিন্তু তারা তো মা*রা গেছে তবে এখন এই বাচ্চাদের কারা নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?? মনে প্রশ্ন জাগে হেমন্তির।
রূপাকে লতিফা বেগমের কাছে রেখে রাজবাড়ী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় হেমন্তি। লতিফা বেগম জানেন যে হেমন্তি তার বন্ধুদের সাথে ঐতিহাসিক স্থানে যাবে।তবে রূপাকে রেখে যাওয়াতে লতিফা বেগমের মনে খটকা লাগলো কিন্তু মেয়েকে তিনি অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন তাই আর কোনো প্রশ্ন করেননি।
হেমন্তির কাছে মিথ্যের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না সত্যিটা বললে কখনোই যেতে দিতো না হেমন্তিকে। রূপাকে কোনোভাবেই রাজবাড়ী নিয়ে যাওয়া যাবে না।হেমন্তির মনে এক আকাশ সমপরিমাণ ভয় থাকা সত্বেও সে রাজবাড়ী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এতগুলো বাচ্চার প্রাণ এভাবে চলে যেতে দেওয়া যায় না।কে বা কারা এই কাজ করছে সেটা জানতেই হবে, এভাবে মায়েদের কোল থেকে তাদের শিশুদের আলাদা করার শাস্তি অপরাধীদের ভোগ করতেই হবে।
ভোর হতেই রূপাকে রেখে রাজবাড়ী যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলো হেমন্তি। এই প্রথম বার একা একা সে কোথাও যাচ্ছে মনের মধ্যে প্রচন্ড ভয় থাকলেও সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে।

রাজবাড়ীতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দুদিন সময় লেগে গেলো, বিকেলের স্নিগ্ধতা চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসম্ভব সুন্দর লাগছে গ্রামটাকে। তবে রাজবাড়ী পৌঁছাতেই তার ভেতরে এক অদৃশ্য ভয় যেকে বসেছে যেন এক্ষুনি কোনো অদৃশ্য ভয় তাকে পেয়ে বসেছে বিশাল গেটের সামনে যেতেই আবার পেছন ফিরে দৌড়াতে লাগলো দৌড়ে অনেকটা পথ চলে যাওয়ার পর হঠাৎ থমকে গেলো হেমন্তি।
না! না! এ আমি কি করছি আমি পালিয়ে যাচ্ছি??

মনকে প্রশ্ন করলো যদি রূপাকে তোর থেকে কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যায় তবে তুই কি করে বাঁচবি??
রূপার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই সমস্ত ভয়কে যেন জয় করে নেয় হেমন্তি। এক দু পা করে এগোতে লাগলো হেমন্তি ভেতরে প্রবেশ করতেই খেয়াল করে কেয়ার টেকার আব্দুলকে। আব্দুল এগিয়ে এলো বললো, কি চাই আপনার??
হেমন্তি বললো আমি রাজবাড়ীতে অবস্থান করতে চাইছি।
– কারো তো অনুমতি নাই থাকনের। আপনে কেমনে থাকবেন??
– আমি জনাব সুলায়মান এর মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছি।বাড়িটা দেখতে এসেছি, এখানে সব ঠিকঠাক আছে কি না।
– ওহ্। [ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল ]

মনে মনে আব্দুল ভীষণ ভয় পাচ্ছিলো সে তো রাতে রাজবাড়ীতে থাকে না এই কথা যদি হেমন্তি জানতে পারে তবে তো তার চাকরিটা থাকবে না। কি করবে সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। আব্দুল হুট করেই বলে উঠল – কয়দিন থাকবেন এইহানে??

হেমন্তি একটা ভেজা ঢোক গিলে বলল -শুনলাম রাজবাড়ী তে নাকি একের পর এক বাচ্চা চুরি হচ্ছে। আসলে এর আগেও তো একবার এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল রাজবাড়ী গ্রামকে। আমি এসেছি এই রহস্য উন্মোচন করতে এরজন্য প্রয়োজন আপনার সাহায্য।
চাচা আপনি কি আমায় করে বলতে পারবেন রাজবাড়ী তে কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তি আছে কী? যে বাচ্চা চুরি করতে পারে?
আব্দুল যেন একটু ভড়কে গেলো সে বললো না না মেডাম আমি এইসব জানি না। পুলিশি কারবারে আমি জড়াইতে চাই না তয় আপনেরে একটা কথা কই রাজবাড়ীতে অবস্থান করা ঠিক হইবো আমি একবার থাকছিলাম টানা তিনদিন জরে ভুগছি যে। আমি আসলে জীবনের মায়া ত্যাগ করতে চাই না তাই এইখানে থাকা লাগে কিন্তু সত্যি কথা কইতে রাজবাড়ী তে রাত্রিযাপন আমি করি না। একদিন থাকছিলাম মনে হইছিলো কোনো আত্মার বাস এই বাড়িতে ভয়ে আমি আর থাকিনাই। দয়া কইরা এই কথা কতৃপক্ষরে জানায়েন না, তাইলে আমারে না খাইয়া মরতে হইবো।

হেমন্তি লোকটার কথা শুনে আরও ভয় পেয়ে গেলো মনে হতে লাগলো সত্যি সত্যিই কোনো আত্মার বাস এখানে।কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার তার মনে হলো না না এটা কি করে সম্ভব? সত্যিই কি আত্মা বা ভূত বলতে কোনো কিছু আছে নাকি? আসলে এসব আমাদের মনের ভয়।কিন্তু এই এত বড় বাড়িটাতে একা থাকবো কি করে?
মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো হেমন্তির কড়া কন্ঠে বলে উঠল – দেখুন চাচা এতদিন থাকেন নি সে অন্য কথা তবে আজ আপনাকে থাকতে হবে কারণ আমি রাজবাড়ী তে অবস্থান করবো।আর যদি না থাকেন তবে আমি বাধ্য হবো এ কথা জানাতে।

আব্দুল ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলো তবে তার কাছে কোনো উপায় নেই চাকরি বাঁচাতে তাকে আজ রাতে রাজবাড়ীতেই অবস্থান করতে হবে। সে মাথা নিচু করে সম্মতি জানালো। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই পরিবেশ কেমন যেন নিস্তব্ধতা-বিদীর্ণ রূপ ধারণ করে নিলো। সব যেন অচেনা মনে হতে লাগলো হেমন্তি আসার পর একবার বেগম জুলেখার সমাধি তে চোখ আঁটকে গেছিলো তার ভয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলো সে সভাকক্ষ মেহমানশালা সব যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে অতীতের কথা।
তবে অন্দরমহলের দিকে আর পা বাড়ায় না হেমন্তি সে কাল সকালেই বের হবে খোঁজ নিতে তাই এখনই কক্ষে গিয়ে শুয়ে পড়লো। দুদিনের ধকলে তার চোখ বুজে আসছিল সে আর না ভেবে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
এদিকে আব্দুল চাচা রাত গাঢ় হতেই তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় হেমন্তি কে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেই সে তার বাড়িতে চলে গেলো।
রাত গভীর থেকে গভীর হতেই কারো পায়ের নুপুরের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় হেমন্তির।আধো আধো খোলা চোখে চারদিকে চোখ বুলায়। মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করে শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে সে বুঝতে পারে আওয়াজ টা অন্দরমহলের দিক থেকে আসছে।হেমন্তি আর না ভেবে নুপুরের ছন্দে ছন্দে চলতে শুরু করে বুকের ভেতর ধুপধাপ আওয়াজ করতে থাকে কোনো একটা অবয়ব লক্ষ্য করল হেমন্তি ঘুম ঘুম চোখ তার তাই ভুল দেখছে কি না তা যাচাই করতে চোখ ডলতে শুরু করে ভালোভাবে ঘুম সারিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই খেয়াল করে লাল শাড়ি পড়া কোনো কন্যা।ঠিক বধূ সাজে অন্দরমহলে প্রবেশ করলো হেমন্তিও পেছন পেছন ডাকতে শুরু করলো
– কে আপনি?
দাড়ান, দাড়া-ন বলছি।
আব্দুল চাচা কোথায় আপনি একি কোথায় গেলেন অন্দর মহলে কে?
আপনি না বললেন কেউ থাকেনা, তবে?

হেমন্তি এক দমে কথাগুলো বললো তবে কোনো সাড়াশব্দ পেলো না দৌড়াতে লাগলো লাল শাড়ি পরিহিত মেয়েটার পিছু পিছু তবে হুট করেই মশালের আলো নিভে গেলো হেমন্তিও থমকে গেলো, অন্ধকারে ছেয়ে গেছে রাজবাড়ীর অন্দরমহল!!!

[অনেকটা সময় পর গল্পের পর্ব দেওয়ার কারনে আমি দুঃখিত তবে অনেক ব্যস্ত থাকার কারনে দিতে দেরি হলো।চেষ্টা করবো সপ্তাহে দুটো করে পর্ব দেওয়ার।আপনাদের উৎসাহ আমার লেখার শক্তি তাই লাইক কমেন্ট ও শেয়ার করে পাশেই থাকবেন।ধন্যবাদ সবাইকে। ]

#লেখা: মুন্নি ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here