#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশ সংখ্যা ০১.
আবহাত্তয়ার পৈশাচিক চিৎকারে বারবার দালান শুদ্ধো কেঁপে উঠছে। কানে হাত চাপা দেওয়ার মতো বিকট শব্দ হচ্ছে। একটু পরপর হুঙ্কার দিচ্ছে জোরালেভাবে, তীব্র সুরে, ভয়ঙ্কর কাঁপুনিতে। প্রকৃতির এমন বিধ্বংসী রূপ দেখে মারজার মনটা কেনো যেনো কু ডেকে উঠলো। তিনি কোনোভাবেই শান্ত থাকতে পারলেন না, এরই মধ্যে ছুটে এসেছে মেহনূর। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতির জন্য শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে, দৌঁড়ে আসাতে সামান্য হাঁপাচ্ছে সে। বিছানায় জবুথবু হয়ে বসেছিলো মারজা, দরজায় হাঁপাতে থাকা মেহনূরের ক্লান্ত মুখ দেখে মায়াসূচকে হাসি দিলেন। মাথাটা একটুখানি ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে দুলিয়ে ভেতরে আসার ইশারা দিলেন, মেহনূর ঠোঁট প্রসার করে হাসি দিতেই ধীরপায়ে বিছানার কাছে এগিয়ে গেলো। মারজা মুগ্ধ হয়ে তার বউমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আপাদমস্তক পুলকিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখলেন। মেহনূরের একটা হাত টেনে নিয়ে তার পাশে বসালেন মারজা। শ্বাশুড়ির সৌহে কিছুক্ষণ কাটানোর জন্য মেহনূর পা তুলে মারজার মতোই বিছানায় আসন করে বসলো। মারজার চোখের দিকে তাকাতেই তাঁকে প্রচণ্ড বিমর্ষ এবং বিষণ্ণ দেখালো, কেনো এই বিষণ্ণতা সেটা বুঝার জন্য গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহনূর। অবচেতন মন কেনো জানি বলছে, কিছু তো অঘটন ঘটতে যাচ্ছে। সেটার ফল যে কোনোভাবে সুমিষ্ট, শুভ হবে না সেটা পুরোপুরি নিশ্চিত। মারজা শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন,
– তোকে অসময়ে বিরক্ত করছি মা। একা থাকি তো, কথা বলার মানুষ না পেলে খারাপ লাগে। তুই কিছু মনে করিসনি তো? রাগ করেছিস?
দ্রুত শ্বাশুড়িকে বিচিত্র চিন্তা থেকে ইস্তফা দেওয়ার জন্য তাঁর হাতদুটো ধরলো মেহনূর। রেশমী চুড়ির রিনরিন শব্দটা মৃদ্যুতালে হতেই মারজার হাতদুটো মেহনূরের মুঠোয় ভরসা পেলো। মেহনূর সদাসর্বদার মতোই নিচু গলায় শান্তভঙ্গিতে বললো,
– আমাকে এসব বলে কষ্ট দিবেন না মা। আপনার উপর কেনো রাগ করবো? আমারই ভুল হয়েছে। আপনি যে একা আছেন সেটা ভুলে গিয়ে উনার রুমে বসে ছিলাম। আমাকে মাফ করুন।
মারজা সঙ্গে-সঙ্গে জিভ কেটে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালেন। একটা হাত মুক্ত করে মেহনূরের দিকে মারের ভঙ্গিতে শূন্যে উঠালেন। খানিকটা রাগ দেখিয়ে বললেন,
– খালি ‘ মাফ করুন, মাফ করুন ‘ বলতে থাকিস। ভুল হলেও বলিস ‘ মাফ করুন ‘, নাহলেও বলিস ‘ মাফ করুন ‘। বাবামশাইকে এ ব্যাপারে বিচার লাগাবো? কানটা মুচড়ে দেবো?
এমন প্রসঙ্গ শোনার পর মেহনূরের জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো তাহলে হো-হো করে রুম কাঁপিয়ে হেসে দিতো, হাসতে-হাসতে লুটোপুটি খেতেও কার্পণ্য করতো না। কিন্তু এসবের কিছুই না করে মেহনূর কিয়দংশ পরিমাণে হেসে দিয়ে আবারও নিচু গলায় বললো,
– দাদাভাইকে বলতে না হবে মা। আমি খেয়াল রাখবো।
মারজা তবুও আদুরে ভঙ্গির রাগটা কায়েম রাখলেন, চোখের উপরে থাকা ভ্রুঁদুটো কুঁচকে রেখেই গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু রীতিমতো তিনি ব্যর্থ। মেহনূর ফের হেসে দেওয়ার চিন্তা করতেই আকস্মিকভাবে এমন অবস্থা হলো সে আর হাসতে পারলো না। ওইসময় দারুণ শব্দ করে রূহ কাঁপিয়ে প্রচণ্ড হুঙ্কারে বাজ পরলো। মেহনূর অকস্মাৎ এমন শব্দ শুনে এতোটাই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে যায়, সে দিশেহারা পথিকের মতো ভয় পেয়ে মারজার দেহটায় তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পরলো। মারজার কাধে থুতনি রেখে চোখদুটো খিঁচুনি দিয়ে বন্ধ করলো। আর কোনো হুঁশজ্ঞান নেই মেহনূরের, ভয়ের চোটে শুধু মারজাকে কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরে আছে। পিঠে হাতের স্পর্শ লাগিয়ে শান্ত হতে বললেন মারজা। ‘ কিচ্ছু হয়নি, এটুকু শব্দে কেউ ভয় পায়? ‘ বলেই তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। ভয়ের মাত্রাটা একটু কেটে গেলে বুক ধড়ফড় করা অবস্থায় চোখ খুললো মেহনূর, মারজাকে ছেড়ে দিতে-দিতেই জানালার বাইরে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– এমন ঝড়ো অবস্থা দেখলে ভয় পাই মা। এমন অবস্থা দেখলে শুধু সমুদ্রের উত্থাল-পাত্থাল অবস্থার কথা মনে হয়। দাদাভাই সমুদ্র দেখতে গিয়ে যেই ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন এখনো সেই গল্প তিনি শুনান। গা ছমছম করে উঠে ওই গল্প শুনলে। আমি এমন দিনে একা থাকতে পারিনা। সবসময় বুবু বা মা আমার কাছে থাকতো।
মেহনূরের উদ্বিগ্ন দৃষ্টি লক্ষ্য করে মারজাও জানালার বাইরে দৃষ্টি দিলেন। আকাশের ফেঁটে যাওয়া দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে হালকা স্বরে বললেন,
– সমুদ্রের কথা যদি জানতে চাস, সেটা তোর স্বামী এলেই শুনে নিস। এসব ব্যাপারে ও-ই ভালো খবর দিতে পারবে।
ইঙ্গিতটা মাহতিমের দিকে নির্দেশ করলে মারজার দিকে চকিত ভঙ্গিতে তাকালো মেহনূর। মারজা তখনও আকাশের দিকে মন ভোলানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মেহনূর বিষয়টা পরিষ্কার ভাবে বোঝার জন্য কৌতুহল গলায় প্রশ্ন করলো,
– আমি আপনার কথা বুঝিনি মা। ঝড়ের সাথে উনার কি সম্পর্ক?
মারজা একই অবস্থাতে স্থির রইলেন, জানালা থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে হাসিসূচকে বললেন,
– ঝড়ের কাছে হার মানলে সাক্ষাৎ মৃতুর দর্শন। একটু যদি এদিক-সেদিক করে তাহলে মনে কর্ মাহতিম আর ফিরবে না। তবে এখনো এই কাজে আছে কিনা জানিনা। মাহতিম সবসময় বলে, প্রাকৃতিক দূর্যোগ যতোটা সহজে মোকাবিলা করা যায়, মানুষের ধূর্ত চাল মোকাবিলা ততটাই কঠিন। প্রকৃতির হালচাল দ্রুত ধরা যায়, মানুষেরটা ধরা যায় না।
মারজা হুট করে চাপা ব্যথার মতো শ্বাস ছাড়লেন। জানালার বাইরে দৃষ্টিলব্ধ চোখদুটো চট করে বন্ধ করলেন। মেহনূর আনমনে আকাশের দিকে তাকালো। বড় বড় চোখদুটো অজানা ব্যথায় কাতর হয়ে আছে। পুরো মুখটাই স্বহাস্য রূপ পালটে মলিন অবস্থা ধারণ করেছে। বুকের ভেতরটা টাইফুনের মতো হুলস্থুল করছে, অসহ্য অপরাধে মুষড়ে আসছে সরল-কোমল মনটা। মাহতিম তো ওর জন্যই গাড়ি ঘুরিয়ে এসেছিলো। হাতে সময় নেই জেনেও সে বিদায় জানাতে দেরি করেনি। মাহদির ছোট্ট একটা কল শুনেই মেহনূরকে বিদায় জানাতে ছুটে আসে মাহতিম। সেই মানুষটা মেহনূরের কঠিন-কঠিন কথা শুনে নিশ্চয়ই অভিমান করেছে, রেগে গেছে। ক্ষোভে হয়তো মনের মধ্যেই বিক্ষোভ করে বেড়াচ্ছে, সে প্রকাশ করছে না কিছুই। হঠাৎ ভাবনার রাজ্যে ছেদন করে হাসি দিয়ে বললেন মারজা,
– আগে এই বাড়িটা এমন খাঁ খাঁ করতো না। বাপ-বেটা দুজন মিলে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। দুটো মানুষ দুশো মানুষের সমান হৈ-হুল্লোড় করতো। ওর বাবা ছুটি কাটাতে এলেই মাহতিম আর স্থির থাকতে পারতো না, সোজা বাবার কাধে চড়ে ফূর্তি করতো। আমাকে কতোভাবে যে জ্বালিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই রে মা। একবার কলেজে থাকাকালীন কি করেছে শোন। মাহতিম তখন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফে পড়তো। বাসা থেকে ওর কলেজ দূর বলে ওর বাবা কর্তৃপক্ষকে বলে-টলে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। ঈদের ছুটি পেয়ে ও বাড়িতে আসে, এসেই বাপের সাথে এক সপ্তাহ বন্দুকের টিপ শিখলো। ওইযে শিখলো, মনে কর্ আমাকে ছাড়েনা। আপেল,পেয়ারা, তরমুজ যেটাই পায় সেটাই আমার মাথায় রেখে টার্গেট করে। আমিতো ভয়ে শেষ! এদিকে ওর বাপও কম ইতর ছিলো না। আগেরদিন রাতে কি নিয়ে যেনো মন খারাপ করেছিলাম সেটার শোধ তুলতে গিয়ে মাহতিমকে আরো লেলিয়ে দেয়। এইযে আমি বুঝাচ্ছি, ‘ থাম বাবা, আমি মরে যাবো, তোর নিশানা ভুল হলেই আমাকে আর পাবি না। ‘ এদিকে কে শোনে কার কথা? বদমাইশটা সত্যি-সত্যিই আমার দিকে ওর বাবার বন্দুক তাক করলো, ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে নিশান ঠিক করলো। আমিও আজীবনের জন্য তওবা করে একনিশ্বাসে ‘ লা ইলাহা ইলাল্লাহু, আল্লাহ মাফ করো। ‘ বলে ফেললাম। এরপর বিশ্বাস কর্, আমার কলিজাটা স্বাভাবিক হতে প্রায় আধা ঘন্টা লেগেছে, এমন ভয়ঙ্কর শব্দ! বাড়ির সবক’টা চাকর কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে খিঁচে আছে। আরেকটু যদি অস্থির হতাম তাহলে হার্ট এ্যাটাক করে সেদিনই ম’রতাম। এরপর থেকে ওর বাবার মুখে একটা কথা খুব গর্ব করে বলতে শুনতাম। তার ছেলে নাকি তার সাথে ভালোই পাল্লা দিতে পারে। পুরো ট্রেনিং সেন্টারে নাকি ওর মতো চতুর বন্দুকবাজ কেউ ছিলো না। মাথার খুলি নাকি এমনভাবেই উড়াতে পারতো, বাস্তবে নাকি সেটাও এক বীভৎস দৃশ্য। সেটা হাতে গুণে দশের মধ্যে একজন করতে পারে। এখনো ওর টিপ নিয়ে ওর বাবার কলিগরা প্রশংসা করে। আজ যদি ওর বাবা বেঁচে থাকতো, তাহলে হয়তো জানতে পারতো আজ সেই হাসিখুশি ছেলেটা খুব উচ্চপদে চলে গেছে। সে দেখেও যেতে পারেনি মেহনূর, আমার জীবনে এটা সবচেয়ে বড় আফসোস। যেই ছেলেকে উনি কাছেপিঠে মানুষ করলেন, ছেলে আজ বাপকেও ছাড়িয়ে গেছে, অথচ বাপ তার একবিন্দু দেখতে পারলোনা। জানিস….
মারজার কথা আর শুনতে পেলো না মেহনূর। জানালার দিকে মুখ করে ক্রমাগত বলেই যাচ্ছিলেন মারজা, তিনি আর বউয়ের দিকে খেয়াল দিতে পারলেন না। ঠোঁটদুটো ফাঁক করে নিশ্বাস ছাড়ছিলো মেহনূর, ওই অবস্থাতেই চোখদুটো বন্ধ করে মাথা নিচু করলো। মাহতিমের কথা শুনলে এখন প্রচণ্ড অস্থির লাগে, মন আনচান হয়, মানসিক অবস্থা প্রকটরূপে বেচইন হয়ে উঠে। কোলে রাখা হাতটা আচঁলের কাপড়টুকু কঠিনভাবে খামচে ধরলো, ওমনেই কয়েক মিনিটের মধ্যে একটার-পর-একটা স্মৃতির পৃষ্ঠা উলটাতে লাগলো মেহনূর। কালো শার্টপ্যান্ট পরা সাহেবী বেশভূষার লোক, যার মেজাজটা অস্বাভাবিক খারাপ ছিলো, বাড়িতে অতিথি হিসেবে পরিবার নিয়ে ঢুকলো, সবাই তাদের নিয়ে ব্যস্ত হলো, সুরাইয়া তাকে নিয়ে কুমতলব ঠাওরাতে লাগলো, গোসল শেষে পেটের কাছে কুচিগুলো ঠিক করছিলো মেহনূর, আয়নায় তাকাতেই কোনো পুরুষের সামনে ওমন অপ্রত্যাশিত দর্শন, ভয়ে-আতঙ্কে জ্বরে ভুগে সে, পরদিন সকালে দাদাভাইয়ের লাইব্রেরীতে আবারও লোমহর্ষক ভঙ্গিতে সাক্ষাৎ হয়, শেল্ফের সাথে ধাক্কা খেয়ে কোমরে সূচালো তারকাটা বিদ্ধ হয়। গাঢ় করে ক্ষত হয় জায়গাটা, গলগল করে রক্ত পরতে থাকে। সেই কাটা জায়গায় ওই মানুষটার প্রথম স্পর্শ টের পায় মেহনূর। সুদেহী মানুষটা নিজের বাহুদ্বয়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো কোলে তুলে, একদিন রাতে কিসের শোধবোধ করার জন্য তার হাতটা টেনে গাঢ় করে চুমু খায়। জঙ্গলে ছ্যাঙ্গাজাতীয় কীট থেকে রক্ষা, শেফালী মেজোমার অত্যাচার থেকে বাঁচানো, সুরাইয়াকে ঠান্ডা মস্তিষ্কে মোকাবিলা করা, সবই যেনো তার অনন্য ঘটনার অংশ। মেহনূর চোখ বন্ধ করেই রাখলো, পাঁচ আঙ্গুলের ফাঁকে-ফাঁকে কোলে থাকা আচঁলটা আরো দলা পাকাতে থাকলো, স্মৃতির পৃষ্ঠা যতো সামনের দিকে উলটাচ্ছে বুকের ভেতরটা অশান্ত ঝড়ের মতো ধড়াস-ধড়াস করে উঠছে। ভাগ্য যেনো টেনে-হিঁচড়ে বারবার তার সামনে দাঁড় করাতে ব্যস্ত। তরুণের কাছ থেকে ধাওয়া খেয়ে আবারও সেই মানুষটার মুখোমুখি! ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত-ভঙ্গুর দেহটা আবারও তার বলপূর্ণ হাতদুটোর মাঝে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। কেনো এই স্বস্তি, কেনো এমন শঙ্কাহীন, মন যেনো এসবের উত্তর বানাতে ত্রস্ত। এবার রেসোর্টের নিরব পরিবেশে শুধু মুখোমুখি নয়, অদৃশ্য কোনো বন্ধন যেনো সংষর্ষ লাগাতে ব্যস্ত। সেই পড়ন্ত বিকেলটা সন্ধ্যার সাজে পসরা সাজিয়েছিলো, আবারও কালো পোশাকে তার আর্কষণীয় ব্যক্তিত্বটা চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। রোমন্থন করা মূহুর্তগুলো তার ঠোঁটের হাসি দিয়ে সিক্ত করছিলো তখন, গিটারের তারে আঙ্গুলের অগ্রভাগ সুরের মূর্ছনায় ডুবে ছিলো সন্ধ্যাটা। বাতাসে তালে-তালে কোমল ধ্বনি উঠেছিলো, ‘ তাকে অল্প কাছে ডাকছি, আর আগলে-আগলে রাখছি, অল্পেই হারাচ্ছি আবার। ‘ তার চোখের হাসি-হাসি দৃষ্টি জুড়ে শুধু মেহনূর ছিলো, ঠোঁটের প্রাণখোলা হাসিটা তার সান্নিধ্য পেয়ে আশেপাশের কোনো বাধ মানেনি। গিটারের তারে আঙ্গুল কাটলেও মেহনূরের উপর থেকে দৃষ্টি সরায়নি। সেই রাতে যখন জঘন্য ঘটনা…. আর ভাবতে পারলো না মেহনূর। বন্ধ চোখের দু’কোল থেকে তরল ফোঁটা গড়াতে লাগলো, খামচে ধরা হাতের উপর টপটপ করে পরতে থাকলো, মারজার দিকে দৃষ্টি তুলে ভেজা কন্ঠে বলতে ইচ্ছে করলো,
– মা আমার খারাপ লাগছে। আমার খুব খারাপ লাগছে।
ইচ্ছাটা কাগজের মোয়ার মতো গুটিয়ে গেলো। মারজাকে একটুও মুখ ফুটে বলতে পারলো না। মারজা তখনও অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে অতীতে দিনগুলো বলেই যাচ্ছেন, মেহনূরের দিকে অজান্তেই বেখেয়ালী হয়ে গেছেন। মেহনূর তাড়াতাড়ি চোখের সিক্ততা ঢাকার জন্য মাথা আরো নিচু করলো, দলা পাকানো আচঁলটা চোখে তুলে দ্রুতগতিতে চোখজোড়ার অবস্থা শুষ্ক করলো। আকাশের কারসাজি যেনো থামার ইচ্ছাতে ছিলো না, হুঙ্কারে দ্বিগ্বিদিক ফেটে পরছিলো তখন। এমনই সময় খবর এলো বাড়িতে অতিথি এসেছে। কে এসেছে সেটা জানার জন্য মারজা প্রশ্ন ছুড়লে, তড়িৎগতিতে উত্তর পায় রজনী ভাবীর ভাতিজি। চাপা আক্রোশে মারজার স্বাচ্ছন্দ্য মুখটা আকাশের মতোই কালো হয়ে যায়, হাসিটা কোথায় মিলিয়ে যায় সেটা খোঁজা মুশকিল। মারজার দেহটা বিছানা থেকে নামাতে ইচ্ছে করছিলো না, তবুও মনের উপর বেহিসেব ভর জুগিয়ে স্বাগত জানাতে নামলেন । মেহনূরকে কি উত্তর দিবেন এটা নিয়ে আপাতত মাথাব্যথা নেই। মেহনূর অন্যান্য মেয়েদের মতো পরিস্থিতির মারপ্যাঁচ ধরতে পারবেনা। একদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি মেহনূরকে পরিচয় করানোর জন্য সেদিকে নিয়ে গেলেন। মেহনূরও আগত মেহমানের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে শ্বাশুড়ির সাথেই পা বাড়ালো। প্রশস্ত ড্রয়িংরুমের আভিজাত্য সোফার দিকে দৃষ্টি আঁটকালো মেহনূরের, শ্বাশুড়ির পিছু-পিছু পা বাড়িয়ে এগুতে থাকলে ‘ ভাতিজি ‘ বলা মেয়েটার উপর আশ্চর্য হয়ে তাকালো। মেয়েটার পড়নে এ কি ধরনের পোশাক? শার্ট রঙের টপ পরেছে মেয়েটা। টপসের কাধদুটো নেই, হাতদুটোও খালি। বুক থেকে পেট পযর্ন্ত ঢাকা ওইটুকু পোশাক কি করে শালীন পোশাক হতে পারে? টপের উপর পাতলা ফিনফিন ধরনের কটি পরেছে। ওই কটি পোশাকটা পরা যা, না পরাও তা। কালো রঙের জিন্স পরা, দামী ব্রান্ডের হিল বুট দেখা যাচ্ছে। পায়ের উপর পা তুলে বাঁ পা-টা ক্রমাগত নাচাচ্ছে। মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে ফোন টেপা বাদ দিয়ে মুখ তুলে তাকালো। মারজার দিকে চোখ পরতেই দ্রুত উঠে দাঁড়ালো, অনেকটা আমোদিত ভাবসাব দেখিয়ে মারজার সাথে কুশল বিনিময় করলো। মারজা এবার পরিচয় করাতে মেয়েটার হাত ধরে মেহনূরের মুখোমুখি করালো। মেহনূর সহজ চাহনিতে মেয়েটার দিকে তাকালেও মেয়েটার চাহনিতে বিষভরা ক্রোধ ছিলো। মেহনূরের দিকে তাকিয়ে মারজা প্রস্তুত গলায় বললেন,
– মেহনূর এই দ্যাখ, ও হচ্ছে রজনী ভাবীর একমাত্র ভাতিজি। আগে তো আমাদের বাসাতেই থাকতো, এখন অবশ্য বিদেশ থাকে। ওর বাবা খুব ভালো মানুষ, একদিন উনার সাথেও দেখা করাবো।
মারজার পরিচয় পর্ব শেষ হতেই মেয়েটা নিজ উদ্যোগে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত এগিয়ে দিলো, কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললো,
– কেমন আছো মেহনূর? আমি অনামিকা। ছোট করে অনা ডাকলেই হবে। তুমিতো দেখছি আমায় জুনিয়র। নেভার মাইন্ড, কিসে পড়াশোনা করছো এবার?
মেহনূর ছোট্ট একটা ঢোক গিলে ডানহাতটা বাড়িয়ে বললো,
– মাধ্যমিক।
অবাকে হা করে তাকালো অনামিকা। মেহনূরের হাতটা আর হ্যান্ডেশেকের জন্য ধরলো না। আশ্চর্য মুখভঙ্গি নিয়ে চট করে মারজার দিকে তাকালো, বিষ্ময়াভূত দৃষ্টি দিয়ে তাকাতেই মেহনূরের দিকে তর্জনী তাক করে বললো,
– ওকে বিয়ে করেছে? সত্যি? আমি কি কানে ঠিক শুনছি মারু আন্টি?
মারজা এমন প্রশ্ন শুনে বিপাকে পরলেন। অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে একবার অনামিকার দিকে তাকালেন, আরেকবার থতমত দৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তাকালেন। মেহনূর ইতিমধ্যে তার দিকে প্রশ্নসূচকে তাকিয়ে আছে। মারজা চটজলদি পরিস্থিতিটা অনুকূল করার জন্য প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললেন,
– মাহতিমের ব্যক্তিগত পছন্দের উপর আমি কখনো বাধা দেইনি। তাছাড়া ও আমার দূর সম্পর্কীয় ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের নাতনী। এবার যখন ওদের বাড়িতে দীর্ঘদিনের ছুটিতে গেলাম, তখন ওকে ভালো লাগে। তাই ওদের দুছনকে সেখানেই বিয়ে করিয়ে দেই।
অনামিকা উত্তর শুনে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে আঙ্গুল নামিয়ে নিলো। মারজা সামনে না থাকলে আসলেই মেহনূরকে কঠিন কিছু বলে ফেলতো! মিথ্যা অভিনয় চলমান রেখে দুজনের সাথেই ভালো ব্যবহার করলো অনামিকা। এর মধ্যে মারজার গুরুত্বপূর্ণ কল আসলে মারজা সেদিকে ছুটে যায়, সুযোগ বুঝে মেহনূরের কাছে ফলের জুস খাওয়ার বায়না করে সে। মেহনূর অতিথি আপ্যয়নের জন্য রান্নাঘরের দিকে যেতে থাকলে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে অনামিকা। চোখদুটো দুষ্কর্ম করার জন্য যেনো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। জিন্সের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করে, কিছু একটা টাইপ করতেই কানে ঠেকালো আধা-খাওয়া আপেলের ছোট্ট ছাপবিশিষ্ট দামী ফোন। কলের বিপরীতে কথা শুরু করতেই ঠোঁটের হাসিটুকু পালটে গিয়ে ক্রুদ্ধ আভা ফুটলো। গলায় তেজ মিশিয়ে চাপাসুরে বললো,
– গেঁয়ো মেয়ে এটা। এটাকে টাইট দেওয়া আহামরি কিছু না। আমি জানিনা রজনী ফুপি কেনো এটাকে আরামে থাকতে দিচ্ছে। সে কি আমার প্রতিটা ম্যাটার ভুলে গেছে? উহু, আমিতো চুপ করে থাকার জন্য এখানে আসিনি। কক্ষনোই না। এই মেয়ের চামড়ায় যদি এসিড ঘঁষে দিতে হয়, তাও আমি করবো। আমার চামড়ার কথা কিন্তু ভুলিনি। যেই দাগ আমার শরীরে বসিয়েছিলো আমি এর চেয়ে তিনগুণ ডাবল চিহ্ন করে ছাড়বো। মাহতিমের দেওয়া প্রত্যেকটা পেইন আমি হিসেব করে রেখেছি, এখন শুধু দাবার গুটির মতো চাল দিতে থাকবো। আমি মেহনূরকে ছাড়বো না।
.
বিলাসবহুল কোয়ার্টারের সামনে বিশেষ গাড়িটা থামলো। গাড়িটার পেছনে আরো তিনটি সিকিউরিটি গাড়ি থেমেছে। সিকিউরিটি গাড়ি থেকে আর্মিদের বেশভূষার দু’দল বেরিয়ে এলো, বিশেষ গাড়িটার কাছে দাঁড়াতেই গাড়ির ড্রাইভার সিটের দরজাটা ভেতর থেকে খুললো। ড্রাইভার লোকটা বেরিয়ে পেছনের সিটের দরজা খুলতেই সিকিউরিটি দল থেকে ক’জন সদস্য কোয়ার্টারের প্রবেশপথে এগিয়ে গেলো। সেখানেও একইভাবে কিছু নিরাপত্তাকর্মী পাহারা দিচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের হাতে লম্বা-লম্বা বন্দুক। সিকিউরিটি টিমের সদস্যরা তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,
– উনি ভেতরে আছেন? আপনারা খবর পাঠান ল্যাফটেন্যান্ট জাফর হাবিব এসেছেন।
সিকিউরিটি টিমের একজন উত্তর দিলো,
– জ্বী আছেন। আপনারা ভেতরে যেতে পারেন। আপনাদের আসার ব্যাপারে আগেই আমাদের কাছে ইনর্ফম করা হয়েছে।
প্রত্যুত্তরে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়ালো, অপেক্ষা না করে জাফর হাবিব তার দলবল নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করলেন। উনার পিছু গোটা সিকিউরিটি টিম আসতে থাকলে উনি হাতের ইশারায় একজনকে সামনে আসতে বললেন। পিছন থেকে একজন সেই ইশারা পেয়ে চট করে জাফর হাবিবের ডানপাশে এসে হাঁটতে লাগলো। জাফর হাবিব যথেষ্ট রসিকপ্রিয় মানুষ, মাঝে-মাঝে কথা বলার সঙ্গী হিসেবে মাইনুদ্দীনকে পছন্দ করে। লিফটে ঢুকে থার্ড নাম্বারে ক্লিক করতেই মাইনুদ্দীনের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,
– বুঝলে মাইনু, লাইফে আজীবন লেগে থাকতে হয়। লাইফ যে কোন্ পথে টান মারবে কেউ আন্দাজও করতে পারবেনা। এই ডিপার্টমেন্টে কখনো পা দিয়েছো?
মাইনুদ্দীন একটু ইতস্তত করতে লাগলো। হাতে যদি বন্দুক না থাকতো তাহলে মাথাটা একটু চুলকে নিতো। তবুও ইতস্তত গলায় সে বললো,
– না, স্যার।
লিফট উপরে উঠতে-উঠতেই জাফর হাবিব প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বললেন,
– না জানার তো কথা না। নৌবাহিনীর বিশেষ সদস্যরা এখানে থাকছে। এই ডিপার্টমেন্টে অবশ্য তোমাকে নিয়ে আসিনি।
ছোট্ট একটা শব্দ করে সিলভারের দু’দ্বার দুদিকে সরে গেলো, ওমনেই চোখের সামনে কাঙ্ক্ষিত ফ্লোর দেখতে পেলেন জাফর হাবিব। লিফট থেকে বেরিয়ে স্মৃতির পাতা নাড়াতে-নাড়াতে আসল ফ্ল্যাটের কাছে চলে এলেন তিনি। সিকিউরিটি টিমকে বাইরে থাকতে বলে দিলেন তখন। হালকা অফ হোয়াইট দরজাটা নতুনের মতো চকচক করছে, বন্ধ দরজার এক জায়গায় কালো ক্যাপিটাল লেটারে লিখা, ‘ M. ANSARI ‘ . জাফর হাবিব হাত উঠিয়ে ডানদিকে থাকা কলিংবেলটার বোতামে তর্জনী চাপ দিলেন, সাথে-সাথেই বেলের শব্দ হয়ে থেমে গেলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গোলগাল নব্ এবং কিছু সিকিউরিটি সিস্টেম সম্পণ্ণ হয়ে দরজা খুললো, পাশে থাকা মাইনুউদ্দীন আশ্চর্যভাবে এসব কীর্তিকাণ্ড দেখছে। তখনই ভেতর থেকে কাটকাট গলার আওয়াজ এলো,
– কাম ইন। আনসারী হেয়ার।
– চলমান .
#FABIYAH_MOMO
#নোটবার্তা : প্রত্যেকটা পাঠককে মনের সুগভীর স্থান থেকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাই। আপনাদের প্রত্যেকের অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়ে আমি আনন্দিত। আজ ছোটোখাটো প্রতিক্রিয়া এবং মন্তব্য পেতে চাই, সবার জন্য দুয়া রইলো। ❤