#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪২.
#ফারিয়াহ্_মমো .
শোকাহত বাড়ির মতো নিস্তব্ধ ছিলো দশটা নাগাদ। মাঝরাতের সেই ভয়াবহ ঘটনার পর ভোররাতে ঘুমাতে পারেনি কেউ। সকালের আলোটা গগনপটে ছড়িয়ে পরলে তখন যেনো ঘুম-ঘুম ভাব হলো, কিন্তু ঘুমকে তখন পাত্তা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিলো না কারোর। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতেই ফোনের বিপ্ আওয়াজে চমকে উঠলো আট মাথা, ফোনের উপর চোখ বুলাতেই সব ফেলে হুড়মুড়িয়ে উঠলো, একসঙ্গে নিজ-নিজ রুমের ওয়াশরুমে ছুটলো তারা। দ্রুত নিজেদের ফ্রেশ করে বাড়ির ঠিক বাগান সাইডটায় জড়ো হলো। সূর্যহীন আকাশটা শীতের আবরণে গুমিয়ে আছে, কুয়াশাচ্ছন্নে আবৃত হয়ে আছে চারপাশ। বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে ডানে বাঁক নিলো সবাই, যার-যার হুডির পকেটে সবারই হাত গোঁজা, মাথায় কেউ হুডি টেনেছে, কেউ পেচিয়েছে মাফলার। শিশির জমা ঘামের উপর পা ফেলে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে এক-এক করে জড়ো হলো তারা, মুখে কারোর রা নেই, নিশ্বাসের সাথে-সাথে নাক দিয়ে ধোয়ার মতো বেরুচ্ছে, দূর থেকে দেখলে মনেহয় নাক দিয়ে আগুনের রেশ ফুটছে। কনকনে শীতের সকালে দেয়ালহীন পাকাপোক্ত কটেজটার সামনে এলো সবাই, এটা মাহতিম নিজের জন্য বানিয়েছে। গোলকার কটেজটা সুউচ্চ হলেও চর্তুদিকে দেয়াল দেওয়া নেই, কটেজে ঢুকার জন্য একপাশে তিনটে সিড়ি দেওয়া আছে, কেউ সিড়ি দিয়ে শালীনভাবে উঠতে পারে, আবার কেউ ঘাস থেকে পা বাড়িয়ে এমনেতেও কটেজে ঢুকতে পারবে। মেয়েদল যেহেতু কমফোর্ট জোনে থাকতে ভালোবাসে, তাই নীতি-প্রীতি-ফারিন সিড়ি দিয়ে উঠলো, বাকিরা নিজেদের মতো পা উঁচিয়ে কটেজে ঢুকে পরলো। গোলাকার একটা মস্ত টেবিল বিছানো সেখানে, টেবিলের চারদিক জুড়ে বারোটার মতো চেয়ার সাজানো হয়েছে। ফাঁকা চেয়ারগুলোতে নিজেদের আসন অধিকার করে আসল জায়গায় দৃষ্টি দিলো সবাই। সেখানে তাকিয়ে প্রথম প্রশ্নটা শান্ত গলায় বললো তৌফ,
– মামু, এই সকাল-সকাল এই তলবে ডাকলা ক্যান? এক্সক্লুসিভ কিছু হইছে?
কথা বলার জন্য গলাটা একটু কেশে শীতের রুক্ষতা কাটালো সৌভিক। হাতদুটো টেবিলের উপর মুঠোবন্দি করে রাখতেই গম্ভীর সূচকে বললো,
– মাহতিম এবার গোপন কিছু করছে গাইজ। আমি ধরতে পারছিনা। কালরাতে যে রাগটা দেখালো, সেটা স্রেফ একপাক্ষিক জেদ ছিলো না। ওর আচরণগুলো আমার সেন্স অন্যদিকে ডিটেক্ট করছে। প্রথমত, ও কখনো চার মাসের ছুটিতে ঢাকা ফিরে না। দ্বিতীয়ত, অনামিকার ব্যাপারটায় ওভাবে রিয়েক্ট করে হুল্লোড় দেখাবে এটা আদতেও সম্ভব না। মেহনূরকে ক্ষতি করেনি জানি, এটা যে করবে না শিওর ছিলাম। তৃতীয়ত যেটা খটকা লেগেছে সেটা হলো ‘ তাড়াহুড়ো ‘। এই তাড়াহুড়োটা আগে কখনো ওর ভেতর দেখিনি, ও নেভির কোন্ পদের কর্মকর্তা এটা নতুন করে আর বললাম না। ওর মাইন্ড-ফিটনেস সবগুলোই এক্সিট্রিম লেভেলের ডিটারমাইন্ড, তার উপর ও যেই ফিল্ড থেকে বিলং করে সেখানে তিল পরিমাণ দয়া দেখানোর দীক্ষা শিখেনি। ও কেনো তাড়াহুড়োটা করছে বুঝতে পারছিস কেউ?
পালাক্রমে নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলো ওরা। সৌভিকের দৃষ্টি এখনো পূর্বের মতোই কঠোর। সিয়াম কথাটা আমলে নিয়ে এমনভাবে বললো যেনো কাকপক্ষি পযর্ন্ত কথাটা ওর শুনতে না পায়,
– ও কি কিছু নিয়ে ভয়ে আছে?
তৎক্ষণাৎ চকিত ভঙ্গিতে সিয়ামের দিকে তাকালো সবাই, এমন অবস্থা দেখে সিয়াম যেনো বিষম খেয়ে খুকখুক করে কেশে উঠলো। সৌভিকের দৃষ্টি শুধু কঠিনের মতো শক্ত হয়ে রইলো, গলার স্বর আগের চেয়েও গম্ভীর করে বললো,
– আমার মন বলছে, ও গোপন মিশনে জড়িয়ে আছে। ও চাচ্ছে আমরা যেনো আউট অফ ঢাকা হই। চট্টগ্রামে চলে গেলে ওর কোনো টেনশনই থাকবেনা। সেখানে কোনো প্রবলেম হলে যেকোনো সময় স্পেশাল ফোর্স এসে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে, কিন্তু ঢাকায় থাকলে সেই টিম আসতে-আসতে যা ঘটার সব ঘটে যাবে। ও যে কি নিয়ে টেনশন করছে সেটাই আমি রাত থেকে চিন্তা করছি। ধরতে পারিনি।
সৌভিকের কথায় নিজের বাক্য ঠেকিয়ে তেজী সুরে বললো প্রীতি,
– ভাইয়া যেটাই করুক তাই বলে কি ভাবীর সাথে ওরকম বিহেভ করবে? মেহনূর ভাবী যেমনই হোক, এখানে প্রত্যেকটা মেয়ের নিজস্ব গন্ডি আছে। কেউ খুব তাড়াতাড়ি অন্যের ইজি হয়ে যায়, কেউ বেশি টাইম লাগায়। কিন্তু ভাইয়ার আচরণটা আমার —
সৌভিক এমন কথায় দারুণ চটে গিয়ে বাঁজখাই গলায় বললো,
– আরে রাখ তোর আচরণ! একটা মানুষ যদি তোর সাথে ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করে, সেক্ষেত্রে তুই কি নখ কামড়ে বসে থাকবি? ভাবী কি বুঝেনা মাহতিমের ভেতরে কি চলে? ওর মুখের দিকে ঠিকমতো তাকালেও তো বুঝার কথা ও এখানে বিশ্রাম নিতে আসেনি। একটা মানুষের মধ্যে নূন্যতম সহ্য থাকে রে, আমি তো নিজেই ভাবীর ন্যাকামো দেখে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি, মাহতিমের মধ্যে কি হয় সেটা নাইবা বললাম।
সৌভিকের গরম মেজাজ দেখে আজ কেউই আগ বাড়িয়ে কথা বললো না। প্রীতিও নিজের কথায় বাধা পেয়ে বাকি কথাটুকু গিলে ফেললো। তৌফ এতে ক্ষান্ত রইলো না, তেড়ে এসে যুক্তি ছেড়ে গজগজ সুরে বললো,
– শা’লার মাথাই কাজ করতাছে না। এইসব প্যাঁচ যে ক্যামনে সামলামু, ক্যামনে যে ঠিক করমু, রাস্তাই তো চোখে দেখিনা। তোরা কিছু ভাবছোস কেউ?
তৌফকে শান্ত করে পাশ থেকে বললো সামিক,
– আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আছে। এক্জিকিউট করতে হেল্প লাগবে। আমার এখন মাহদিকে প্রয়োজন, আমি যেই টোপ ফেলতে যাচ্ছি, সেটা জায়গামতো নিশানা পেলেই সবকিছু ঠান্ডা হয়ে আসবে।
সামিকের চোখের ভাষাই যেনো দক্ষবুদ্ধির পরিকল্পনা বোঝাচ্ছে। সবাই কিছুক্ষণ মৌনতার সাথে নিরব থাকলো ঠিকই, পরক্ষণে সবার ঠোঁটে ফুটে উঠলো আত্মবিশ্বাসের চিন্তামুক্ত হাসি। নয়জন মাথা যখন দিনশেষে একত্র হয়, তখন হাজার বিপদের ভেতরেও সুরাহা যেনো অন্ধকার চিঁড়ে বেরিয়ে আসে। মনের সকল ভয়-ডর-শঙ্কা এমনভাবেই নিঃশেষ করে দেয় যেনো আশার আলোতে বলিয়ান হয়ে উঠে তাদের স্বতন্ত্র প্রাণ।
.
শাওয়ারের সিলভার নবটা বাঁদিকে ঘুরাতেই ফোঁটায়-ফোঁটায় বর্ষণ শুরু হলো। নবটা মোচড়ে স্পিড খানিকটা বাড়িয়ে দিতেই এবার তুমুল আকারে বর্ষণ শুরু হলো। কৃত্রিম বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তুষারকণার মতো ঠান্ডা, ভোর-সকালে বরফের মতো কনকনে ঠান্ডা পানিতে গা ভেজাচ্ছে মাহতিম আনসারী। শীত-গ্রীষ্ম কোনোটাই তার নিয়মমাফিক রুটিনকে ছেদ করতে পারেনা, টানা চারটা বছর যাবৎ নিজেকে কঠিন নিয়মে আবদ্ধ করার ফল এটা। শার্টের বোতামগুলো ডানহাতে খুলতে লাগলো মাহতিম, মুখটা শাওয়ার দিকে উঁচু করে রাখা। প্রতিটি ঠান্ডাতুল্য বিন্দু তার দেহের ভাঁজে-ভাঁজে মিশে গিয়ে সিক্ত করতে মত্ত। ঠান্ডা পানি যেনো তার চোখদুটোর দেখা পেয়ে আনন্দে উল্লাসিত, ঠোঁটদুটো যেনো ঠান্ডার সংস্পর্শ পেলে সাথে-সাথে রক্তিম হয়ে উঠে। বাঁহাতে মোটা ব্যান্ডেজ থাকা সত্ত্বেও তোয়াক্কা করেনা মাহতিম, একটানে সেখান দিয়ে শার্ট খুলে আনে সে। কাটা জায়গাটা আবার যেনো চনমনিয়ে বিষিয়ে উঠলো, ব্যথায় শুধু বন্ধ চোখদুটো যেনো খিঁচুনি দিয়ে ফের স্বাভাবিক হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ থাকার পরও মনের আন্দাজ মোতাবেক শার্টটাকে ছুঁড়ে মারলো, ওমনেই জবজবা ভেজা শার্টটা ‘ ছলাৎ ‘ শব্দ করে ভরা বালতিতে গিয়ে পরলো। দেয়ালে ডানহাতে ফেলে মাথাটা নিচু করলো মাহতিম, হাতসহ সমস্ত দেহ যেনো চিনচিন করে ব্যথা করছে, মাথাটাও ভীষণ টনটন করছে, চোখ খুলে তাকাতে গেলে ভারী ব্যথা এখন। এটা নির্ঘাত গতরাতের ফলাফল, যার দরুন এখন বেখাপ্পা কায়দায় ফাঁসতে হলো। আজকের মধ্যেই সবাইকে কক্সবাজার পাঠাতে হবে, সবাইকে এখান থেকে নিরবে সরিয়ে ফেললে তবেই চিন্তামুক্ত হওয়া সম্ভব। ছুটি নেয়নি, চায়নি, কোনোটাই করেনি মাহতিম। এখানে আসার পেছনে পূর্বঘটনার অপারেশনটা কঠিনভাবে জড়িত। নেভির স্পেশাল ফোর্সের তত্ত্বাবধানে প্রায় দুই বছর আগে যেই ‘ অপারেশন ঝিলতলা ‘ নামের অভিযান হয়েছিলো, সেই ঘটনার চূড়ান্ত পর্ব এবার নিজ হাতে সাজাবে মাহতিম।
রাজধানীর মতো জনবহুল শহরে লুকিয়ে-লুকিয়ে অ’স্ত্র আনাগোনার ব্যবসা করছিলো একদল গোপন সংগঠন। ভ’য়াবহ, বিধ্বং’সী, আক্রম’ণাত্মক অ’স্ত্রগুলো তারা বিপুল টাকার বিনিময়ে দেশের যেকোনো প্রান্তে কিছু অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে তুলে দিচ্ছিলো, সরকার ও জনগণের অগোচরে চলছিলো বিশাল বড় কারসাজি। কিছু অ’স্ত্র বিশেষ সুপারিশের ভিত্তিতে সামরিক বাহিনীর জন্য আনা হতো, কিছু অ’স্ত্র এমনও ছিলো যা দেশে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নি’ষিদ্ধ, সেসব ভয়াবহ নিষিদ্ধ অ’স্ত্রগুলো নির্দ্বিধায় সকলের চোখে ধূলো দিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছিলো। ওসব বিপদজ্জনক অ’স্ত্রের ব্যাপারে যদি একটা মানুষ তিল পরিমাণ ধারণা পেতো, তাহলে তার পায়ের তলায় মাটি খসে যেতে সময় নিতো না। এমনই একটা সংঘবদ্ধ দলকে ধরার পেছনে সামরিক বাহিনীর বিশেষ দল লেগেছিলো। প্রত্যেকটা দেশেই মূলত ‘ নেভাল ফোর্স ‘ নামে স্পেশাল ফোর্স রেডি তৈরি করা আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতের ‘ মারকোস ‘, আমেরিকার ‘ সিল টিম ৬ ‘, পাকিস্তানের ‘ এসএসজিএন ( SSGN ) টিম ইত্যাদি। যারা মূলত নেভাল ফোর্স বেস্ড স্পেশাল ফোর্স। তেমনি বাংলাদেশের জন্য আমাদেরও সফল ফোর্স রয়েছে, নাম ‘ সোয়াডস ‘ (SWADS)। যারা আমেরিকার ঘাঁটি থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসছে সেই বহু শতক আগে থেকে। তবে এর শুরুটা ২০০৮ সালের দিকে চট্টগ্রামে হলেও আনুষ্ঠানিক জন্ম ২০০৯ সালের দিকে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হওয়া সোয়াডস সদস্যদের প্রশিক্ষনটা কোনো সাধারণ ধাঁচের প্রশিক্ষণ নয়। উক্ত প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ ইন্সট্রাক্টদের আগমন ঘটে, যারা মূলত আমেরিকা-কোরিয়া-তুরস্ক থেকে এসে থাকে। তাদের চরম কঠোর-কাঠিন্য-শক্ত স্বভাবের জন্য তারা ‘ দ্যা ব্রুট ‘ বলেও পরিচিত, একজন সোয়াডস ক্যান্ডিডেটকে সফল সোল্ডার ( Soldier ) হিসেবে রূপান্তর করার জন্য এই ব্রুট ব্যক্তিদের বিশেষ অবদান উল্লেখ্যযোগ্য। বলে রাখা প্রয়োজন, প্রশিক্ষকরা কোনোপ্রকার নমনীয়তা, কোমলতা, দয়া দেখান না। তারা নির্মমতা এবং ত্রুটির ব্যাপারে অতি মাত্রায় হিংস্র। মূলত সকলেই সোয়াডস হবার সুযোগ পায় না, ঝরে পরার সম্ভবনা প্রায় ৯৮%। ‘ সোয়াডস ‘ এর অন্যান্য স্বতন্ত্র ইউনিট সম্পর্কিত তথ্যসমূহ ‘ হাইলি ক্লাসিফাইড ‘ বিধায় তাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ জানা অসম্ভব। তবে এটুকু নিশ্চিত এই দল জল-স্থল-আকাশ পথে চলার জন্য সদা প্রস্তুত, সদা তৈরি। এবার ভেলকি দেখানোর আখেরী পর্ব চলে এসেছে।
স্বচ্ছ আয়নার সামনে দাঁড়ালো মাহতিম। চুল থেকে টুপ-টুপ করে পানি পরছে, ডানহাতটা দিয়ে ব্যাকব্রাশ করে চুলগুলো পেছনে ঠেলে নিলো। শেভটা ঠিকঠাক মতো হয়েছে কিনা সেটাও গাল ঘুরিয়ে দেখে ফেললো। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ফাস্ট-এইডের খোলা বাক্স থেকে একটানে গজ কাপড়টা বের করলো, ক্ষতের মুখে তুলা চেপে সাদা ব্যান্ডেজের কাপড় দিয়ে বাঁহাতটা পেঁচাতে লাগলো। হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের উপর ফোন বেজে উঠলে স্ক্রিনে দৃষ্টি দিলো সে, ‘ HANNAN SHEKH ‘ ! ওমনেই মুখের স্বাভাবিক আঁচটা বদলে গিয়ে চিন্তার আদলে ছেয়ে গেল তার, মাহতিম ফোনটা বন্ধ ধরলো না। ফোনটা বেহালভাবে বাজতে-বাজতে একইভাবে আপনা-আপনি কেটে গেলো। টানা তিনবার কেটে যাওয়ার পর যখন আর কোনো কল আসলো না, তখন তাড়াতাড়ি নিজের ড্রেসিং সম্পণ্ণ করে ফোনটা হাতে তুললো মাহতিম। একসেকেন্ডও দেরি না করে কল বসালো জায়গামতো। সাতসকালে এমন একটি অচেনা নাম্বারের কল পেয়ে অপর প্রান্তের লোক বেশ বিরক্ত নিয়ে কল রিসিভ করলো, তার চেয়েও দ্বিগুন বিরক্তি মিশিয়ে বললো,
– হ্যালো, কে?
মাহতিম বিরক্তির ধাঁচটা পুরোপুরি ধরতে পারলেও সময় নষ্ট না করে মোদ্দাকথায় আসলো,
– আরাফাত সাহেব, নেভি ফোর্স থেকে মাহতিম আনসারী বলছি। এই মূহুর্তে আমার এলাকায় নেটওয়ার্ক জ্যাম করা চাই। টানা দুটো ঘন্টার জন্য সব স্থগিত। কল ড্রপ করার সাথে-সাথে কাজটা যেনো শুরু দেখি। এই এরিয়ায় যদি একটা কল আসতে দেখি, কিছুক্ষণ পর ইমেইল একাউন্টে নিজের রাস্টিগেট লেটার দেখতে পাবেন।
কল কাটার শব্দ হতেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চমকে উঠলেন ভদ্রলোক। এখনো আশ্চর্যের ঘোরটা তিনি কাটাতে পারেননি। পরিচয় শোনার পর ‘ বস্ বা স্যার ‘ বলে সম্বোধন করে মাফ চাইবেন, সেই সুযোগটাও এই নৌ-কর্মকর্তা দিলো না। কান থেকে ফোন নামিয়ে উক্ত সেল নাম্বারে তাকালেন তিনি, সত্যিই কি মাহতিম আনসারী কল দিয়েছে? তিনি কতো শত পুলিশকে তুড়ি বাজিয়ে ঢপ মেরে দিলেন, অথচ এই কন্ঠের কাছে এতো ঘাবড়ে গেলেন কি করে? কাছের কথা মনে পরতেই দ্রুত তিনি হন্য হয়ে ছুটলেন, এখুনি অনেকগুলো কল করতে হবে। একটু দেরি হলেই তার চাকরি নট, একেবারেই সাসপেন্ড!
.
চিন্তিত হান্নান শেখ কপালে রীতিমতো ঘাম ছেড়ে পায়চারি করছেন। হাতদুটো পিছমোড়া করে আবদ্ধ রেখে একবার এমুখো, আরেকবার ওমুখো করে ছুটছেন। বাড়িতে সবাই ঘুম শেষে নিজ-নিজ কাজে লিপ্ত, শানাজ একটু আগে কলেজের দিকে বেরুলো, সুরাইয়া-সাবা ঘরের কাজ দেখছে। সাবা উঠোনে বসে কাঁচা মরিচের বোটা আলাদা করতেই দাদার রুমের দরজা গলে ভেতরে তাকিয়ে আছে। দাদাকে খুবই চিন্তাগ্রস্থ দেখাচ্ছে এখন, কি নিয়ে চিন্তায় মগ্ন সেটা জানার জন্য খচখচানি হচ্ছে সাবার। সাবা কাজের ফাঁকে-ফাঁকে বারবার সেদিকে দেখছে, ব্যাপারটা সুরাইয়ার দৃষ্টিতে আঁটকা পরলে সাবার মাথায় চাট্টি মেরে বলে,
– ওখানে কি? কি দেখিস ওখানে? ভাতার দেখিস?
সাবা মুখটা বিকৃত করে সুরাইয়ার দিকে তাকালো, সেও পালটা প্রতি’শোধ হিসেবে সুরাইয়ার দিকে মরিচ ছুঁড়ে বললো,
– মুখ সামলে কথা বল্! আমি ওখানে দাদাভাইকে দেখছি। তোর মতো খাচ্চ’র ভাবিস নাকি?
সুরাইয়া এবার ফুঁসে উঠে বললো,
– খবরদার আমাকে ‘ খা’চ্চর ‘ ডাকবিনা সাবা!
সাবা আরো রাগ দেখিয়ে আঙ্গুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলো,
– তুই আমাকে নাম ধরে ডাকবি না! তোর মায়ের মতো ফাতরামি করলে দাদাভাইয়ের কাছে বিচার লাগাবো! চুপচাপ মরিচ কুট্। অন্যদিকে চোখ দিলে এক্কেরে কষিয়ে মা’রবো।
সাবার হুঙ্কারে চুপটি মা’রলেও রাগে দপদপ করছিলো সুরাইয়া। উঠোন থেকে চেঁচানির আওয়াজ পেয়ে এবার হান্নান শেখ নিজেই ছুটে এলেন, আক্রোশে ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন,
– তোমাদের ঝগড়া কি কোনোদিন থামবে ভাই? প্রতিদিনই তোমরা বোনেরা-বোনেরা লড়াই করো, আমার বুড়ো শরীরটা এসব দেখলে কি টিকবে?
হান্নান শেখের কড়া গলায় দু’বোন খামোশ হয়ে মাথা নিচু করলো। সাবা অপরাধীর মতো মুখ করে আরো খিঁচিয়ে গেলো, সুরাইয়ার অবশ্য গায়েও লাগলো না। সাবা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে অধোমুখে বললো,
– দাদু, আজ আমি ভুল করিনি। এই সুরাইয়া আমাকে ইচ্ছা করে রাগায়। দাদু, আপনি কি কোনো ব্যাপারে চিন্তিত?
টনক নড়লো হান্নান শেখের, তিনি নিজের চিন্তান্বিত চেহারার উপর স্বাভাবিক চেহারার মুখোশ লাগিয়ে চাপা হাসিতে বললেন,
– না না, কিসের চিন্তা দাদু? ওই আমার ছোট দাদুভাইয়ের কথা একটু খুব মনে পরছিলো। কতোদিন ওকে একটু দেখিনা। সবসময় তো চোখের সামনে থাকতো, মনে একটা জোর পেতাম। দূরে থাকে তো, কথাও হয়না।
মুখে উদাসী ছাপ ফেলে মলিন করে হাসলেন হান্নান শেখ। তাঁর চলে যাওয়ার দিকে নির্যুত্তর ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো সাবা, অন্যদিকে সুরাইয়া দাদার দিকে মুখ ভেঙচি করে তীব্র আপোষ বুঝালো। হান্নান শেখ পুনরায় মলিনতার ছাপ উবে দিয়ে রাগান্বিত মুখায়বে ফিরে এলেন, কলটা ধরলো না, আবার মেহনূরের নতুন ফোনটাও বন্ধ। এখন সবার ফোনই ‘ নট রিচেব্যাল ‘ বলছে। কি চালাকি হচ্ছে ওখানে? ও কি টের পেয়ে গুটি সরালো নাকি? গায়ের রক্ত যেনো টগটগ করে মাথায় উঠে গেলো, তিনি দ্রুত বিছানার তোশক উঠিয়ে গোপন ফোনটা বের করলেন। এবার এটার ব্যবহারের সময় এসে পরেছে।
.
সূর্যের অবস্থানটা আকাশের মধ্যখানে ঠিক মাথার উপর। ভূমিতে সোনালি আলোটা বেশ প্রখর হচ্ছে, ঘড়িতে ঘন্টার কাটাটা বারোর দিকে, মিনিটের কাটাটা সদ্য পনেরোর ঘরটা ছুঁয়েছে। বাড়ির সিড়ির কাছে একসারিতে তিনটা গাড়ি থামানো। প্রথমে ভোলভো কোম্পানির আভিজাত্যপূর্ণ গাড়িটা আয়েশী স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনে দশ সিটের পারিবারিক মাইক্রোবাসটা, তার পেছনে দাম্ভিকের চেহারা নিয়ে থেমে আছে জিপটা। রজনী আজ শাড়ি পালটে হলুদ থ্রিপিসের বেশে সেজেছে, স্পা করা চুলগুলো ছেড়ে সানগ্লাসটা মাথায় সেঁটে রেখেছে। অনামিকার পড়নে হাতাহীন কালো কূর্তি, ভেতরের মেয়েলি পোশাকের স্বচ্ছ চিকন স্ট্রিপদুটো দু’কাধের উপর দৃশ্যমান। রজনী নিজেই নিজের গাড়ি ড্রাইভ করবে বলে মারজাকে সে জোর করে পাশে বসিয়ে নিলো, অনামিকার সুপ্ত ইচ্ছাটা জিপের ড্রাইভিং সিটের পাশে বসার ছিলো, কিন্তু রজনী সে ইচ্ছাতে পানি ছুঁড়ে চোখ রাঙানি দিয়ে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে নিলো। মাইক্রোটাকে বিদায় দিয়ে রজনীর ভোলভো গাড়িটা সবার আগে ছুটলো। তৌফের সাথে ট্যূরের রাস্তা নিয়ে কথা বলতে-বলতে আসছিলো মাহতিম, এদিকে মাইক্রোটা আস্তে-আস্তে পূরণ হয়ে শেষ। হুট করে কল আসলে বাধ্য হয়ে কল রিসিভ করতে কোণায় চলে যায় মাহতিম, ততক্ষণে নীতির হাত ধরে নিচে নেমে আসে মেহনূর। গাঢ় নীল রঙের শাড়িটা আজ ভিন্ন কায়দায় পরিয়ে দিয়েছে নীতি, শাড়ির সাথে হুবহু কালার মিল করে মখমলের ছোট হাতার ব্লাউজ। নীল জামদানী শাড়িটাকে লেহেঙ্গার মতো পরিয়ে দিয়েছে। অনেকটা লেহেঙ্গার ওড়না যেমন ঘুরিয়ে এনে বুকের সামনে দিয়ে আঁচলের মতো পিছনে ছেড়ে দেয়, ঠিক সেই স্টাইলে যেনো শাড়ির বেশভূষা। চুলগুলো সব পেছনে টেনে বেশ মোটা এবং লম্বা একটা বেণী ঝুলিয়ে দিয়েছে, মাথার অগ্রভাগে ছোট-ছোট চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে দিয়েছে। নীতি ইচ্ছে করে সাজায়নি মেহনূরকে। যে মেয়েটা আকাশের সমস্ত নীলকে একীভূত করে নিজের গায়ে জড়িয়ে ফেলেছে, তার দেহে আলগা রঙের কৃত্রিম সাজটা একদম বেমানানই লাগবে। সিড়ি দিয়ে নামতে-নামতে এই ফাঁকে আরেকবার ব্লাউজটা নিচের দিকে টান মারলো, তবুও ব্লাউজটা পেটের চিলতেখানি ফাঁকটা ঘুচালো না। নীতির হাত ছেড়ে পিছু-পিছু আসতেই হঠাৎ বাঁদিকের কোণায় চোখ পরলো মেহনূরের, সাদা শার্টের টানটান পিঠটা আড়চোখে দেখতে পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। আজ কেনো শার্টের হাতাদুটো গুটায়নি? বাঁহাতটা কি প্রচণ্ড ব্যথা? সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই অন্যমনষ্ক মেহনূর শাড়িতে হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে পরলো, ওমনেই হাতের নীলগাছী চুড়িগুলো রিনঝিন করে উঠলো। নীতি সদর দরজার কাছে এসে পাশের সু’শেল্ফ থেকে দুজনের জুতা বের করতে নিলে পেছন থেকে বাধা দিলো মেহনূর,
– আমার জুতা নিতে হবেনা আপু, আমি নেই। আমি নেই। আপনি গাড়িতে উঠুন।
কথা মতো, দ্বিতীয় গাড়িটাও ‘ সরাৎ ‘ করে মেইন গেট দিয়ে ছুটে গেলো। জানালা দিয়ে গাড়ি যাওয়ার দৃশ্য দেখে চোখ বন্ধ করে চিন্তার ভারী নিঃশ্বাসটা ছাড়লো মাহতিম। কলে কথা বলতে-বলতে দরজার কাছে আসতেই দেখলো তার সু’জোড়া রেডি। কাজটা নীতির ভেবে এক পশলা হাসি দিয়ে কালো সু’য়ের খাপে পা ঢুকিয়ে দিলো। ফিতা বাঁধার জন্য নিচে ঝুঁকতে নিলে তখনই সরু ফিতাগুলো আয়ত্তে নিয়ে ফেললো এক খন্ড নীল রাজ্যের উষ্ণতা। মাহতিম অনুভব করলো, তার হাত-পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে। তার হাতে থাকা ফোনটা কান থেকে নির্লিপ্তে নেমে যাচ্ছে, কলের ওপাশ থেকে অনবরত বলেই যাচ্ছে,
– হ্যালো স্যার? স্যার, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? আনসারী স্যার, আপনি কি…..
– চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
#নোটবার্তা : আমার টাইপের ভুলগুলো ক্ষমার চোখে দেখবেন। আমি রিচেক দিতে পারিনি, দুঃখিত 💔