#মৃগতৃষ্ণিকা
#পর্বঃ০৯
মতিকে জোছনা ছেড়ে দিতেই ছিটকে গিয়ে পড়লো মাটিতে। গলা দিয়ে যেন কোনো স্বর বের হচ্ছিল না, মতির চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছাপ সে যেন তার জোছনাকে চিনতেই পারছেনা।তারচেয়ে বড় কথা হলো মতিকে সে পরপুরুষ বলে সম্বোধন করেছে এটা যেন কিছুতেই মানতে পারছেনা মতি। পরিবানু এতক্ষন চিৎকার করলেও জোছনার চোখ রাঙানোতে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে আছে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে একবিন্দু নড়ছেও না।
পরি বানুর চিৎকারে আশে পাশের মানুষজন ভিড় জমালেন যেহেতু সকলের বাড়ির দুরত্ব দীর্ঘ তাই আসতে দেরি হয়।সকলেই জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?
কিন্তু কেউ কোনো কথা বলেনা।
কি হয়েছে? কি হয়েছে? প্রশ্নে যেন গাছের পাখিরাও টিকতে পারছেনা। মতি বলে উঠল আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেছি তাই বুড়ি চিৎকার করছিলো।আপনেরা যে যার কাজে যান কিছুই হয়নাই।একে একে সকলে বিরক্তিকর ভাব নিয়ে চলে গেলো।
জোছনাও এবার নিজের ঘরে চলে গেলো, পরিবানু যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন হুট করেই মতিকে ধরে কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন আর বললেন- মতি ও মতিরেএএএএ, তোর বউরে তো মনে হয় পেত্নী ধরছে আমি এই বুড়া বয়সে আর কি যে সহ্য করমুউউউউ।
– আহ্! বুড়ি চুপ করো তো। জোছনার হয়তো শরীর খারাপ করেছে তাই কি বলতে কি বলছে
– আর তোর গলা যে টিপা ধরলো তার বেলা?
– বুড়ি যাও তো! আমারে একলা থাকতে দাও।
মতি পরিবানুকে উপেক্ষা করে উঠে চলে গেলো।মতি হাটতে হাটতে চলে গেলো একটা খোলা মাঠে যেখানে এই ভরদুপুরে কেউ ছিলো না। একা একা মতি ভাবতে লাগলো তবে কি সত্যি সত্যিই জোছনাকে ভুতে ধরেছে? মতি যখন ছোট ছিলো তখন তাদের প্রতিবেশী আবুল মিয়ার স্ত্রীরও এমন হয়েছিল মতিকে সে বেশ আদর করত এতিম ছিলো বলে।মতি তাকে চাচি আম্মা বলে ডাকতো একদিন তাকে পাওয়া গেলো আকাশি গাছের উঁচু ডালে। তার শরীরের ওজন বেশি থাকায় যেখানে হাটতে চলতে অসুবিধা হতো সেখানে সে গাছে কি করে উঠলো? আরেকদিন রাতে তাকে পুকুরে গোসল করতেও দেখা গেছে লোকমুখে নানা কথা প্রচলিত আছে তবে মতিও দেখেছে তার পরিবর্তন। মতি ভাবনায় ডুব দেয় তবে কি জোছনাকে ফকির দেখাতে হবে নাকি ভুল হচ্ছে কোথায়? মতি কয়েকটা দিন সময় নেয় সে সিদ্ধান্ত নেয় এই কয়েকটা দিন জোছনার আচরণ উপলব্ধি করবে যদি সত্যি এমন কোনো কিছু হয়ে থাকে তবে পরিবানুর সিদ্ধান্ত সে মেনে নেবে।
আগামী মঙ্গলবার ফকির বাবার কাছে জোছনাকে নিয়ে যাবে।
_____________
হেমন্তির বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া হয়। সিরাজের আম্মা লতিফা বেগমের দুহাত চেপে ধরে বলল -আপা আপনার মেয়েটাকে কি আমার ঘরের বউ বানানোর অনুমতি দিবেন? বিশ্বাস করুন আপা খুব সুখে থাকবে আপনার মেয়ে। আর ওরা তো একে অপরের বন্ধু দেখবেন দুজন দুজনকে নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটাবে ওরা।তাছাড়া আমরা রূপাকেও নাতনির মর্যাদা দিতে চাই আপা।
লতিফা বেগম ভেজা কন্ঠে বললেন- ছি!ছি! আপা আপনি এমন করে কেন বলছেন? অবশ্যই হেমন্তিকে আপনার বউ বানাবেন। আমার মেয়েটাকে দেখে রাইখেন আপা একদম চাপা স্বভাবের তবুও বলবো একটু মানিয়ে নিবেন মেয়ে মনে করে।
– কি বলেন আপা।হেমন্তি তো আমার আরেকটা মেয়ে।আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না হেমন্তি আমাদের কাছে বেশ ভালো থাকবে। তাহলে আমি হেমন্তি কে আংটি টা পড়িয়ে দেই আপা? কি বলেন ভাইজান?
-লতিফা বেগম মাথা ঝাকালেন।
হেমন্তির বাবাও বললেন শুভ কাজে দেরি করা উচিৎ নয়। আজই তবে আংটি পড়িয়ে যান।এরপর না হয় দুই পরিবার মিলে বিয়ের তারিখ ঠিক করবো।
হেমন্তি কে আংটি পড়িয়ে দিয়ে যাওয়া হলো।দুটো মনের মধ্যে যেমন খুশির ঢেউ খেললো তেমনি দুটো পরিবারে মাঝেও আনন্দের বন্যা বয়ে চলেছে।
আগামী চব্বিশ তারিখ বিয়ের দিন ধার্য করা হলো।রূপার সে কি আনন্দ আধো আধো গলায় হাত তালি দিতে দিতে বললো কি মজা! কি মজা! মা বাবার বিয়ে হেমন্তি আর সিরাজের বিয়ে!!!
হেমন্তিকে লাল পাড়ের শাড়িটা পড়তে বললো সিরাজ আজ তারা বিলের পাড়ে দেখা করবে।হেমন্তিও শাড়িটা পড়ে নিলো আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে, দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে টিপটিপ করে আবার দেখছে নিজেকে।
আজ হেমন্তি বিলের পাড়ে যেতেই দেখে সিরাজ তার জন্য আগেই এসে অপেক্ষা করছে। সিরাজ কারো উপস্থিতি অনুভব করে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে হেমন্তি সে যেন তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা একি তার দেখা সেই হেমন্তি যাকে দেখে প্রেমে পড়েছিলো সে যেন আবার প্রেমে পড়লো।
মেয়েদের বিয়ের সময় নাকি আলাদা এক সৌন্দর্য এসে তাদেরকে ভর করে অসম্ভব সুন্দর দেখায় তখন। হেমন্তি কে দেখে সিরাজের আজ সেই কথা বিশ্বাস হলো হুট করেই বলে উঠল – বউ!!
হেমন্তি আঁচল তার লজ্জামাখা লাল টুকটুকে মুখখানা লুকিয়ে রাখলো। ইস! কি বলছিস বলতো?
সিরাজ হাসলো আর বললো সত্যি তোকে বউ বউ লাগছে সামনে এগোতে লাগলো সিরাজ এক পা দু পা করে হেমন্তির কাছাকাছি এসে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বলল আর মাত্র দুটো সপ্তাহ এই মঙ্গলবার এর পরের মঙ্গলবারই তোর আর আমার বিয়ে।আমার ঘরের বউ হবি তুই।
হেমন্তি পেছন দিকে ঘুরে গেলো লজ্জায় বললো তুই থামবি নাকি চলে যাবো? আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার লজ্জা করে।
– আমার তো তোর থেকে চোখ সরছেই না যেন মনে হচ্ছে তোর নয়নে নেশা আছে আর সেই নেশা বড় ভয়ংকর একবার আসক্ত হলে আর সারবার উপায় নেই।আমি সারতেও চাই না আসক্ত হতে চাই তোর নয়নের মায়ায়।
হেমন্তি মৃদু হেসে বললো থামবি কি? নাকি চলে যাবো?
-আচ্ছা যা চলে যা।
– গেলাম তবে।
– যা।
হেমন্তি ভ্রু কুঁচকে চলতে শুরু করলে সিরাজ পেছন থেকে হাত ধরে হেঁচকা টান দিতেই হেমন্তি টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলেই সিরাজ তার দুহাত দিয়ে আগলে নেয় হেমন্তি কে।
এভাবেই সারাজীবন তোকে আগলে রাখতে চাই হেমন্তি।
হেমন্তি সিরাজের হাতে হাত রেখে বললো আমিও সারাজীবন এভাবেই তোর ভরসায় নিজেকে উজার করে দিতে চাই। টাল সামলানো নিয়ে আমার আর কোনো চিন্তা নেই সবটা তোকে দিয়েছি যে!!
____________
মতির মাথায় কেবল জোছনার বলা সেই কথাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে, পরপুরুষ!
কেন পরপুরুষ সম্বোধন করলো তার বউ?
দুদিন হলো মতি জোছনার বেশি কাছাকাছি যায় না তেমন কোনো অস্বাভাবিক কিছু ঘটেওনি।আজ হঠাৎ করেই মতি লক্ষ্য করল জোছনার মন খারাপ।
সে ভেবে পাচ্ছে না জিজ্ঞেস করবে কি না সব ভাবনা মাথা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বললো – জোছনা কি হয়েছে তোমার? মন খারাপ?
জোছনার চোখে টলমল করা পানিরা এবার বাধ ভাঙা বন্যার রূপ নিয়েছে। চোখ থেকে কেবল পানি গড়িয়ে পড়েই চলেছে।
মতি যেন আর সহ্য করতে পারছেনা সে তার বউয়ের চোখে এত কষ্ট এর আগে কখনোই দেখেনি। বাম পাশের বুকটায় কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভূত হলো।
জোছনা বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে হুট করেই মতিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল মতি বারবার জিজ্ঞেস করে চলেছে কি হয়েছে কিন্তু জোছনা কেবল কেঁদেই চলেছে।
অবশেষে জোছনা মুখ খুললো বললো আপনে কেন আমারে দূরে সরায় রাখছেন দুই দিন যাবৎ খেয়াল করতাছি আপনে আমার থেকা দূরে দূরে থাকেন। আমগো গ্রামে আশু আপার জামাই তারে রাইখা আরেকটা বিয়া করছে সে যে কি কান্না তার।সে কাঁদতে কাঁদতে কইছিলো যে তার স্বামী নাকি দুইদিন ধইরা তার সাথে বেশি কথা কয় না দূরে দূরে থাকে।
সরল মুখখানা নিয়ে মতির চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলো – আপনিও কি আমারে রাইখা আবার বিয়া করবেন?
মতি যেন হতভম্ব এই মেয়ের তো দেখছি নানা রূপ।এই বলছে ছোবে না মেরে ফেলবো আবার এই বলছে আপনি দূরে সরে যাচ্ছেন কেন?
মতি জোছনা কে আরও জোড়ে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললো আমি তোমারই আছি তোমারই থাকবো বউ। তোমারে ছাড়ার আগে আমার যেন মরণ হয়!
জোছনা মতির মুখ চাপা দেয় তার হাত দিয়ে কড়া কন্ঠে বলে – আর একবারও আপনি এই কথা কইবেন না তাইলে কিন্তু আমি এক্ষুনি চইলা যামু।
মতির চোখেও পানি ছলছল করছে। পরিবানু এসব দেখে যেন লজ্জায় মুখ লুকোতে পারছেন না। ছি! ছি! ছি! কি দিনকাল আইলো রে।আমগো তো সোয়ামি ছিলো না একলা ওনাগোই সোয়ামি হইছে। দিনদুপুরে বলে এসব করে ছিহ্!
আজ জোছনার মন খারাপ হলো না বরং সে মতির দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো।
এই কয়েকটা বেশ কাটলো মতি আর জোছনার।স্বাভাবিক ভাবেই দিনগুলো পার হতে লাগলো কিন্তু পরিবানু বেশ চিন্তিত হয়ে আছেন মঙ্গলবার ফকির বাবা যেতে বলেছিলেন কিন্তু মতির জেদের কাছে উনি হেরে যান। মতি জানায় সে তার বউকে কোনো ফকিরের কাছে যেতে দিবে না তার বউ পুরোপুরি সুস্থ।
দুদিন হলো জোছনার পেটে ব্যথা হচ্ছে তবে সেটা খুব অল্প সময়ের একটু পরেই সেরে যাচ্ছে। পরিস্থিতি অন্যরকম বলে মতিকে বিষয়টা জানায় জোছনা, মতিও কবিরাজ মশাইকে সে কথা জানায় কবিরাজ মশাই বলেন এটা হয়তো স্বাভাবিক। বেশিক্ষণ সময় ব্যথা স্থায়ী হলে তাকে জানাতে বলে নতুবা চিন্তার কোনো কারণ নেই।
আজকে ভোর রাত থেকেই জোছনার পেটে ব্যথা শুরু হয় সারাদিন পার হলেও ব্যথা সারে না আরও তীব্র হচ্ছে কবিরাজ মশাইকে ডাকা হলে তিনি কিছু বড়ি দিয়ে যান এগুলো খাওয়ানোর পরে ব্যথা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কবিরাজ মশাই আরও কিছু বড়ি দিয়ে যান সেবনের জন্য।
রাত যত গভীর হতে থাকে জোছনার পেটের ব্যথা তত বাড়তে থাকে পরিবানু জোছনার পেটে হ্যারিকেনের স্যাক দিতে গেলে কাপড়খানা সরাতেই আতকে ওঠে, চোখগুলো বড় বড় তাকায় মতির দিকে চেয়ে বলে মতি! তোর বউয়ের পেটে কি?
মতিও বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলে কই বুড়ি কি?
তোর বউয়ের পেট তো পাতিলের তলার থেকাও বেশি কালা হইয়া গেছে। আমার তো ডর করতাছে রে মতি!
এখন কি হইবো?
চলবে,,,,,,
#লেখা: মুন্নি ইসলাম