#মৃগতৃষ্ণিকা
#পর্বঃ১৮
মঙ্গলবার!!
হুম মঙ্গলবারই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে আনমনে বলে উঠল সিরাজ।
– কীভাবে??
সিরাজএকটু মৃদু হেসে বললো আমি তো আপনাকে বুদ্ধিমতী ভাবতাম।
হেমন্তি কিছুটা সময় চুপ করে থেকে হুট করেই বলে উঠল – সত্যিই তো সিরাজ, মঙ্গলবারই তো পারে আমার সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে। হেমন্তির চোখেমুখে খুশির আভা দেখা দিচ্ছে কিছু সময়ের জন্য সে যেনো অনেকটা খুশি হলো তবে সে জিভে কামড় বসিয়ে পিটপিটিয়ে সিরাজের দিকে চেয়ে বলল- আসলেই কত্ত বোকা আমি!!
ঠিক তা নয় অনেকসময় আমরা সহজ জিনিস কে গুরুত্ব দেইনা ভাবতে থাকি অনেক জটিল উপায়ে যেটা করতে গিয়েই বাজে বিপত্তি।
– কিন্তু আমরা যেই ফকির বাবাকে খুজছি সে ছাড়া তো আরও অনেকেই মঙ্গলবারে বসেন। তবে আমরা কি সঠিক মানুষের সন্ধান পাবো?আর এই মঙ্গলবার যদি আমরা তাকে খুজে বের করতে না পারি তবে আবার আরেক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে এতদিনে আরও অনেক বাচ্চার প্রাণ চলে যাবে।
– এত চিন্তার কি আছে একটু বুদ্ধি খাঁটিয়ে প্রশ্ন করলেই উত্তর পাওয়া যাবে। যাইহোক এখন এসব নিয়ে ভাবার দরকার নেই আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন কাল রাতে হয়তো অনেক ভয় পেয়েছেন।
– হুম তা পেয়েছি। আমি তখন হাতে চিমটি কাটলাম আর আমি ব্যথা অনুভব করলাম তার মানে আমি যা দেখেছি সব সত্যি।
– পাগলের প্রলাপ বকছেন।বাচ্চাদের মতো কথা হয়ে গেলোনা। আরে আমি যখন ভেতরে প্রবেশ করলাম তখন তো কেউ ছিলোনা, ছিলেন আপনি একা।
– আমি সত্যি বলছি সিরাজ বেগম জুলেখা ফিরে এসেছে আর আর সে ফিরে এসেছে জোছনার শরীরে!!!
জানো সেদিন আমি জোছনার ঘরের পাশেই হাসনাহেনা ফুলের সুবাস পেয়েছি যা এর আগেও আমি রাজবাড়ীতে পেয়েছি। তীব্র গন্ধ যেনো আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা তো সবাই জানে জনাব সুলায়মান হাসনাহেনার সুবাস পছন্দ করতেন না তাই তিনি রাজবাড়ী তে এই গাছ কখনোই রোপণ করেননি।
আমি খুব ভালো করে রাজবাড়ীর আশেপাশে দেখেছি সেখানে কোথাও এই গাছের চিহ্ন পর্যন্তটুকু নেই।
সিরাজের কপাল কুঁচকে নিয়ে বলল – আহ্ বাদ দাও তো এসব। হাসনাহেনার সুবাস খুবই তীব্র হয়তো আশেপাশে কোথাও আছে যা আমরা দেখিনি সেখান থেকেই আসছে। তোমার কথা যদি মেনেও নেই তবে জোছনার বাড়ির হাসনাহেনার সুবাস কিভাবে রাজবাড়ী তে আসবে। আদও কি সম্ভব এটা?
হেমন্তি মাথাটা সামান্য হেলিয়ে দিয়ে বলল – সব কিছু যদি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যেতো তবে তো হতোই। যাই হোক আর কথা না বাড়াই তুমিও যাও বিশ্রাম নাও আসার পর থেকে তো দু দন্ড বসতেও পারোনি আমার জন্য।
– হুম তা ঠিক। তোমার জন্য ঘুরতে ঘুরতেই আমার জীবন শেষ। দু দন্ড বিশ্রাম নেওয়ার ও জো নেই।
হেমন্তি অবাক দৃষ্টিতে তাকালো সিরাজের দিকে সে ঠিক কি বোঝাতে চাইলো বোধগম্য হলোনা হেমন্তির।সিরাজ চলতে শুরু করলো সে তার কক্ষের দিকে যাচ্ছে যতদূর চোখ যায় হেমন্তি তাকিয়ে থাকে অপলকভাবে।
সিরাজ নিজের কক্ষে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করলো এটা রফিকের ডায়েরি , কি যেনো লিখতে শুরু করলো সিরাজ।
সে রফিকের রেখে যাওয়া সেই ডায়েরিটাতে কিছু লিখলো এরপর আবার সেটা তার ব্যাগে রেখে দিলো।
বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিয়ে কিছু একটা ভাবতে বসলো কিছু মুহুর্ত এভাবেই চোখ বন্ধ রেখে আচমকাই চোখ খুলে ফেললো এবার সে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো সে হাঁপাতে লাগলো তবে কি তার সাথে রাজবাড়ী তে যা হয়েছিলো সব সত্যি হয়েছিলো।বেগম জুলেখার কথামতো তার শরীরের সেই অঙ্গে শুরু হয়েছে তীব্র যন্ত্রণা।
সিরাজ ডকুমেন্টারি তৈরি করতে যখন এসেছিলো সেবারের কাটানো শেষ রাতের কথা ভেবে শিউরে ওঠে। বুকের মধ্যে হাত বুলিয়ে বলতে থাকে- তবে কি এবার আমার কলিজা হারানোর পালা? পঁচে গলে কি শেষ হয়ে যাবো আমিও?
বেগম জুলেখা আমায় কয়েক মাস সময় দিয়েছিলো
তার ভাষ্যমতে,আমি যদি রূপাকে তার হাতে তুলে না দেই আর আমার কথার বরখেলাপ করি তার সাথে ছলনা করি তবে সে আমার কলিজা ছিনিয়ে নিবে কিন্তু সেটা ভিন্ন উপায়ে।
কয়েক মাস অতিক্রম করার পর থেকেই শুরু হবে আমার কলিজায় পচনধরা। তার হাতের ছোঁয়াই নাকি পারবে আমার পচনধরা কলিজা ঠিক করতে।
আদও কি সম্ভব এগুলো?নিজেকেও নিজে প্রশ্ন করে বসলো সিরাজ।
কিন্তু এটাও মানতে বাধ্য যদি এই কথাগুলো সত্যি না হয় তবে কেনো তার বুকে ব্যথা অনুভূত হয় মনে হতে থাকে কেউ যেন কলিজায় আঘাত করে যাচ্ছে ক্রমশ।
কয়েকদিন হলো ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনা সিরাজ স্বপ্ন তাকে তাড়া করে বেড়ায় রাজবাড়ী তাকে পাগল করে তুলেছে। স্বপ্নের মধ্যেই সে রাজবাড়ীতে এসে হাজির হয় রূপাকে নিয়ে। তাৎক্ষনাত আবির্ভাব ঘটে বেগম জুলেখার অবয়ব। কালো পরিহিত অবয়বটা মাটি থেকে এক হাত উচ্চতায় হাওয়ায় ভাসছিলো আচমকাই সিরাজের কোল থেকে ছো মেরে নিয়ে যায় রূপাকে। সিরাজ শত চেষ্টা করেও রূপাকে বাঁচাতে সক্ষম হয়না।অদৃশ্য এক শিকলে বাঁধা পড়ে যায় সে।
বেগম জুলেখা কর্কশ গলায় বলে উঠে- কি চাস তুই??
রূপা নাকি তোর জীবন?
সিরাজ অকপটে স্বীকার করে সে রূপাকে চায় দুহাত জোর করে ভিক্ষা চায় রূপার কলিজাখানা।
বিকট শব্দে জোরে জোরে হাসতে থাকে বেগম জুলেখা তার হাসির শব্দে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম প্রায় সিরাজের এদিকে রূপার কান্নাভরা চিৎকারে বুক ফেটে যাচ্ছে তার।সিরাজ সহ্য ক্ষমতা হারাতে বসেছে প্রায় সে নিজেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে চিৎকার করে ওঠে গলা ফাটিয়ে।
না আআআআআআআআআ।
তারপরই হুট করে সিরাজের ঘুম ভাঙে সে নিজেকে আবিষ্কার করে তার বিছানায়। পরপর তিনদিন সে এমন দুঃস্বপ্ন দেখেছে।
তারওপর খবরের কাগজের শিরোনামে উঠে এসেছে প্রতিনিয়ত বাচ্চা চুরি হওয়ার ঘটনা। বুকের মধ্যে পীড়াটাও তীব্রতর হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে কি সেদিনের স্বপ্নটা সত্যি ছিলো কিন্তু সিরাজের বুকের ক্ষত সেরে গেলো কি করে এক রাতের মধ্যেই আবার গায়ের ফতুয়া তে ও রক্তের দাগ ছিলো না। সিরাজ জানে তার সকল প্রশ্নের উত্তর কেবল রাজবাড়ীতেই আছে তাই সে তার উত্তর খুঁজতেই এখানে এসেছিলো অতঃপর সে অন্দরমহলে হেমন্তি কে দেখে ঝটকা খায়।মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে,
একি হেমন্তি রাজবাড়ী তে কেন? তবে কি সে বাড়ি থেকে মিথ্যা বলে এসেছে কিন্তু সে তো মিথ্যা কখনোই পছন্দ করে না কেনো তাকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলো?
অনেক জল্পনা কল্পনার পর সিরাজ বুঝতে পারলো সত্যি বললে হয়তো কখনোই এই অভিশপ্ত রাজবাড়ী তে হেমন্তি কে একা আসতে দিতো না তাই সে এমনটা করেছে।
কিন্তু হেমন্তি কে আমার সাথে হয়ে যাওয়া ঘটনাটা বলা যাবে না তবে হয়তো ও রূপাকে নিয়ে আরও দুশ্চিন্তায় পরতে পারে।
কিছুক্ষণ পর সিরাজ হেমন্তির কক্ষে গেলো তাকে দেখতে তারপর বললো রাতে যেনো সে কিছুতেই তার কক্ষ থেকে বের না হয়। কিন্তু হেমন্তি জানালো সে অবশ্যই বের হবে অস্বাভাবিক কোনো কিছু দেখলে বা অনুভব করলেই সে বের হবে।বসে থাকার জন্য তো আর সে এখানে আসেনি রহস্য উদ্ঘাটন না করতে পারলে এখানে এসে লাভ কি হলো।
হেমন্তির উদ্ধতস্বভাব বরাবরই সিরাজের প্রিয় ছিলো কিন্তু আজ যেন বড্ড গায়ে লাগলো।রাগে দপদপ করছে মাথাটা চোখ জোড়ায় লাল আভা স্পষ্ট নিজের রাগকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করে বলল- ❝আমি ভুল মানুষের ওপর অধিকাট খাটিয়েছি, উপেক্ষা তো আমার প্রাপ্য।❞
তুমি ঠিকই করেছো সবাইকে সব অধিকার দিতে হয়না বরং কেড়ে নিতে তার প্রাপ্য। চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে স্থান তার কোথায়।
কথাগুলো বলেই সিরাজ গটগট করে চলে যেতে শুরু করলো।
হেমন্তি বুঝতে পেরেছে সিরাজ তার কথায় রাগ করেছে তাই আচমকাই বলে উঠল – আমি আজ রাতে কক্ষ থেকে বের হবো না যদি প্রয়োজন হয় তবে না হয় তোমায় ডেকে নিবো।
দরজার কাছাকাছি যেতেই কানে পৌছালো হেমন্তির বলা কথাগুলো জোরে একটা নিশ্বাস টেনে নিয়ে আবার চলতে শুরু করলো তার যাওয়ার পানে অপলক চেয়ে রইলো হেমন্তি।
রাতের অন্ধকারে ছেয়ে গেছে রাজবাড়ী ঘুম যেনো আজ জেঁকে বসেছে হেমন্তির দুচোখে সারারাতে সে আর জাগেনি তবে ভোরে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়।অস্থির লাগছিলো ভীষণ কিছুতেই স্থির হয়ে থাকতে পারছেনা সে বিছানা ছেড়ে উঠে প্রকৃতির ঘ্রাণ নিতে বের হয় বাইরে হাটতে হাটতে পদ্মপুকুরে গিয়ে বসলো ভোরের শীতল হাওয়া যেন তার উত্তাল মনকে শান্ত করতে পারছেনা। বর্ষার পানি কমতে কমতে এখন পুকুর নদনদী তার নিজের স্থানে ফিরতে শুরু করেছে। থইথই পানিগুলো এখন শুধু স্মৃতি জীবনটাও ঠিক তাই, সব ভালো মুহুর্ত গুলো যেনো এক নিমিষেই স্মৃতি হয়ে গেলো। কারো পায়ের শব্দ শুনতেই হেমন্তি পেছন ফিরে তাকালো দেখলো সিরাজ আসছে সে আবার তার ভাবনায় ডুব দিলো। সে এসে তার পাশ ঘেঁসে বসলো পদ্মপুকুরে দৃষ্টি দিয়ে হেমন্তি কে জিজ্ঞেস করলো- আজ রাতে অস্বাভাবিক কোনো কিছু অনুভব করেছিলে?
সিরাজের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হেমন্তি বলল- না।তুমি?
সিরাজ আমতা আমতা করে বলল- আ আ আমিও তে তেমন কিছু দেখিনি।
হেমন্তি কপাল কুঁচকে নিয়ে বলল- মিথ্যাও বলতে পারিস না ঠিকমতো।
– কি আবোল তাবোল বকছিস মিথ্যা বলতে যাবো কেনো?
– বলবি কি না?
– তেমন কিছু না।
– আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের থেকে লুকাই তবে কি করে রহস্য ভেদ করবো বলতো !
– লাল শাড়ি পরিহিত এক মহিলাকে আমি অন্দরমহলের দিকে যেতে দেখেছি পেছন পেছন আমিও ধাওয়া করেছি তন্মধ্যেই ওই মহিলার শাড়ির আঁচল এর বাতাসে নিভে গেলো মশালের আলো।আমার মনে হতে লাগলো সে পাতালঘরের দিকে দৌড়াতে লাগলো। আমিও আমার পকেটে থাকা দিয়াশলাই কাঠি জালিয়ে নিলাম মুহুর্তেই কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো কোথাও কেউ ছিলো না কারো অস্তিত্বই আমি খুঁজে পেলাম না।
– আমি বলেছিলাম না সিরাজ বেগম জুলেখা ফিরে এসেছে দেখেছিস এ আর কেউ না এই বেগম জুলেখা। কোনো সাধারণ মানুষ এক মুহুর্তে উধাও হয়ে যেতে পারে না।
– আমার মনে হয় আমাদের পাতালঘরে যাওয়া উচিৎ সেখানে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ক্লু পাওয়া যাবে।
– কিন্তু পাতালঘরে ঢুকবো কি করে?আমরা তো জনাব সুলায়মান এর কক্ষেই প্রবেশ করতে পারবো না।
– সেজন্য প্রথমেই জনাব সুলায়মান ও বেগম জুলেখার কক্ষে প্রবেশ করতে হবে তালাবদ্ধ কক্ষটি দিনের আলোয় খোলা যাবে না মানুষের চোখের আড়ালেই কাজটা সম্পন্ন করতে হবে।
– রাজবাড়ীর তালা কিরূপ হতে পারে তা বোধকরি তুই জানিস এটা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব??
– সম্ভব করতে হবে।আজ রাতেই পাতালঘরে ঢোকার ব্যবস্থা করতে হবে।আব্দুল চাচাকে বলে তালা ভাঙার জিনিসপত্র জোগাড় করে রাখতে হবে।
ওরা দুজন দুজনকে তুই করে সম্বোধন করছে ব্যপারটা দুজনেই খেয়াল করে। চোখে চোখ পড়তেই সরিয়ে ফেলে দুজনেই।
সিরাজ বলে উঠল – একবার বিশ্বাস করে দেখতি আমায়!!বোধহয় ঠকতিস না।
মিইয়ে গলায় হেমন্তি বলে উঠল – জানি আমার বলার কোনো মুখ নেই রূপাকে আমি ঠিক যতটা ভালোবাসি তুইও ততটাই বাসিস কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো আমি বিশ্বাস অবিশ্বাসের পর্যায়ে ছিলাম না আমি তোর পাশে দাড়াতে পারিনি বরং আমার জন্যই তোকে এসব ঝামেলায় পড়তে হয়েছে।
[অবশ্যই লাইক কমেন্ট ও শেয়ার করে পাশে থাকবেন। গল্প সম্পর্কে আপনাদের মতামত দিয়ে সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ]