এলিসা ও আদ্রিয়ান রাজবাড়ী প্রবেশ করতে না করতেই দেখলো সারা গাঁয়ের মানুষের হট্টগোল আর ভীড়। আরও মানুষজন এদিকেই ধেয়ে আসছে, সবাইকে ঠেলে ঠুলে রাজবাড়ীর ভেতরে ঢুকতেই শুনতে পেলো- “পদ্মপুকুরে নাকি একজনের লাশ ভেসে উঠেছে”।
আটানব্বই এর বন্যায় পুরো দেশ ডুবে আছে পানিতে টইটুম্বুর করছে পদ্মপুকুরও তবে রাজবাড়ী অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ উঁচু গ্রাম।তাই এখানে তেমন করে বন্যার পানির রাজত্ব নেই বললেই চলে।
“পদ্মপুকুরে নাকি বিশ বছর পর আবার লাশ ভেসে উঠেছে ” বলাবলি করছে গ্রামের মানুষজন, তাদের চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ।
পুলিশও এসেছে সেখানে উপস্থিত হয়েছে, তারা সবাইকে পদ্মপুকুরের সামনে থেকে সরে দাড়াতে বলছে, হাতে মাইক নিয়ে সমস্ত মানুষকে চলে যেতে বলা হচ্ছে কিন্তু কে শোনে কার কথা সবাই রাজবাড়ীর সামনেই ভীড় করে আছে।
পুলিশ প্রশাসন আর দেরি না করে পদ্মপুকুর থেকে মধ্যবয়স্ক লোকটার লাশ উদ্ধার করে আনলো। তবে সবাই বলাবলি করছে রাজবাড়ীতে শুধুমাত্র এই লোকটি একা আসেনি বরং তার সাথে একজন মহিলাও এসেছিলো, হয়তোবা তার স্ত্রী।
লোকটির দাবি ছিলো তিনি সুলায়মানের ছোট ভাই ওসমানের ছেলে।ওসমান বিলেতে গিয়ে বিবাহ করেছিলো এবং তার একটি পুত্রসন্তান হয় তবে তিনি সেখান থেকে দেশে বেড়াতে এসেছিলো অতঃপর আর কখনো সেখানে ফিরে যায় নি। জানা গেছে তিনি মারা গেছেন।
রাজবাড়ীর মালিকানা নিয়ে কয়েকবছর ধরেই আনাগোনা চলছে এটা নাকি সুলায়মান তার পালিত মেয়ের নামে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন এখন তার অবর্তমানে এই রাজবাড়ীর মালিকানা তার বড় মেয়ের হাতে হস্তান্তর করা হবে।
আর এই নিউজ লোকটি পাওয়া মাত্রই এ দেশে আসেন এবং এর ভাগিদার হওয়ার দাবিতে রাজবাড়ীতে অবস্থান করছেন গত চার পাঁচ দিন যাবৎ।
আজ সকালেই একজন পথযাত্রীর চোখে পড়ে পদ্মপুকুরে ভেসে ওঠা লাশ খানা।
তবে সারা রাজবাড়ী তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও তার সাথে আসা মহিলাটিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
উধাও হয়ে গেলো নাকি এই মহিলা??প্রশ্ন জাগে সকলের মনে।
এলিসা আর আদ্রিয়ান বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে এসব প্রথম দিন রাজবাড়ীতে এসেই তারা এমন এক কান্ডের মুখোমুখি হবে ভাবতে পারেনি।তারা পুলিশকে জানায় জনাব ওসমান আসলেই বিলেতে(লন্ডন) গিয়ে বিয়ে করেন তবে যেই লোক মারা গেছেন তিনি ওসমানের ছেলে নন। ওসমানের অবশ্যই একটি পুত্র সন্তান হয়েছিল এবং তার নাম রেখেছিলেন ওয়ারিদ।
মি.ওয়ারিদ গত হয়েছেন আরও কয়েক বছর আগেই আর তিনি রাজবাড়ী সম্পর্কে সমস্ত তথ্য এলিসাকে দিয়ে বলেন সেখানে যেতে।যেহেতু সে এই বংশের ছেলে তাই তার পূর্ণ অধিকার রয়েছে এ রাজবাড়ীর ওপর। মি.ওয়ারিদ একবার দেশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তবে তার মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ফলে তার আর আসা হয়নি এদেশে।তাই তার অপূর্ণ ইচ্ছে রক্ষার্থেই এলিসা এখানে আসে, যেহেতু লন্ডন থেকে এখানে আসবে তাই তার মা আদ্রিয়ানকে তার সাথে পাঠায়।এলিসার ফিওন্সে আদ্রিয়ান। পারিবারিক ভাবেই তাদের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।
এলিসা অত্যন্ত সাহসী একজন মেয়ে কিন্তু আদ্রিয়ান ভীতু বললেই চলে কেননা রাজবাড়িতে এলিসা অবস্থান করতে চাইলেও আদ্রিয়ান কিছুতেই এই বাড়িতে অবস্থান করতে পারবে না বলে জানায়। যে বাড়িতে একজন মহিলাকে পাওয়া যাচ্ছে না আবার একজনের মৃত্যুও ঘটেছে ইতিমধ্যে সে বাড়িতে থাকার মতো দুঃসাহস কি করে পায় এলিসা, ভেবেই শরীরে কাটা দিয়ে ওঠে আদ্রিয়ানের।
এলিসা আদ্রিয়ানের ভয়ের স্বভাবটা বেশ অপছন্দ করে, তার মতে পুরুষ মানুষ হবে সাহসী ও রাগী কিন্তু আদ্রিয়ান ঠিক তার উল্টো। এলিসা বিরক্তির স্বরে বলে ওঠে – তোমার এখানে থাকতে ইচ্ছে না করলে যেকোনো একটি হোটেল কামরায় গিয়ে থাকো আমি আমাদের রাজবাড়ীতেই থাকবো।
তোমার এত ভয় পাওয়া আমার বোধগম্য হচ্ছে না আদ্রিয়ান ওই মহিলাই আই মিন ওনার স্ত্রী ই হয়তো লোকটাকে মার্ডার করে পালিয়েছে। এতে তোমার এ বাড়িতে না থাকার কি হলো বুঝলাম না। যেখানে পুলিশ কর্মকর্তারাই আমাদের থাকার অনুমতি দিয়েছে সেখানে………
এলিসার কথা শেষ হওয়ার আগেই আদ্রিয়ান ভেজা ঢোক গিলে ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে ওকে থামিয়ে বলে –
মিস. এলিসা আপনি আবার ওই মহিলার মতো প্ল্যান করে আসেন নি তো? তাহলে আগেভাগেই বলে দেন আমি এত অল্প বয়সে অঘোরে আমার প্রানটা চলে যেতে দিতে পারিনা।
এলিসা হেসে ফেললো আদ্রিয়ানের কথায়।
আদ্রিয়ান আবার বলে ওঠে হাসছেন যে তবে কি আমাকে সত্যি সত্যিই মার্ডার করে ফেলবেন নাকি??
– আরে আপনি কি পাগল নাকি বোকা, আমি কেন বিয়ের আগে বিধবা হতে যাবো বলুনতো?
আপনার সাথে আমার বিয়েটাতো আগে হোক তারপর যদি আমার সাথে কোনো উল্টাপাল্টা করেছেন তো এইভাবে পদ্মপুকুরে ডুবিয়ে মারবো।
এলিসার কথা শুনে এবার আদ্রিয়ান হেসে ফেললো তারপর বললো- আচ্ছা এলিসা বলছি কি প্রয়োজন রাজবাড়ীতে অবস্থান করার দেখোনা কেমন যেন ছিমছাম পরিবেশ এখানে, ভৌতিক ফিল হচ্ছে যে!!
এলিসা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে নিয়ে বলল এটা আমার বাবার স্বপ্নের গ্রাম আমার দাদুর জন্মস্থান। এখানে আমার জন্ম হয়নি ঠিকি তবে অসম্ভব এক মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে নিয়েছে এক মুহূর্তেই যেন মনে হচ্ছে কত বছরের চেনা গ্রাম কতবছরের চেনা এই রাজবাড়ী। আমি ইতিহাসে জনাব সুলায়মান এর কাহিনি পড়েছিলাম আমার আরেক দাদু তিনি। অনেক ন্যায়পরায়ন মানুষ ছিলেন তিনি আর জানো তার স্ত্রী ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী আমার দাদির কাছে শুনেছি দাদু নাকি অনেক প্রশংসা করতো তার। অনেক ভালোবাসতেন দুজন দুজনকে তবে শেষ পরিনতি কেনো এমন হলো সেটাই বোধগম্য হলো না জনাব সুলায়মান নাকি তার প্রানপ্রিয় স্ত্রীকে জীবন্ত সমাধি দিয়েছিলেন যার সমাধি এখনো রাজবাড়ীতে রয়েছে।
এবার আদ্রিয়ান ভয়ে আরও কাচুমাচু হয়ে বললো এই যে এলিসা ভালো হচ্ছে না কিন্তু বলে দিলাম এখানে আসার পর থেকে শুরু করেছ স্বামী তার স্ত্রীকে মেরে ফেলেছে আবার স্ত্রী তার স্বামী কে মেরে ফেলছে আসলে হচ্ছে টা কি আমার সাথে।
গ্রামের একজন বয়স্ক লোক পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন এলিসার একটা কথা তার কানে বাজে জনাব ওসমানের নাতনি সে। লোকটি এলিসাকে জিজ্ঞেস করে তুমি জনাব ওসমানের নাতনি বুঝি??বেশ সুন্দর দেখতে হয়েছো গো আসলে রাজ বংশীয় বলে কথা।দেখো কেমন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলো আবার তোমার দাদুও যে এই পদ্মপুকুরে লাশ হয়ে ভেসে উঠেছিলো। এইটা একটা অভিশপ্ত পুকুর।আরো অনেকের প্রাণ নিয়েছে এই পদ্মপুকুর।
এলিসা দাদুর এমন মৃত্যুর কথা শুনে খানিকটা চমকে যায়। তবে কি তার দাদু তাঁদেরকে ঠকায়নি আসলে সে মারা গিয়েছিলো তাই ফিরতে পারেনি। চোখের কোণে পানি জমে দাদি বেঁচে থাকাকালীন যদি এই খবরটা তাকে দেওয়া যেতো তবে কখনোই সে মনে অতৃপ্তি নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতো না এমনকি তার বাবাও আজীবন ভুল বুঝে এসেছে তার পিতাকে। একটাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলো কেন ফিরলেন না??
লোকটি আর কথা না বাড়িয়ে চলতে শুরু করল।
এলিসাও নিজেকে সামলে নিয়ে পদ্মপুকুরের কাছে গেলো এখানেই তার দাদু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন তবে পদ্মপুকুরকে কেন যেন এলিসার কাছে অভিশপ্ত মনে হচ্ছে না বরং হৃদয় প্রশান্ত করার মতো স্থান মনে হচ্ছে।
পুলিশ প্রশাসন লাশ নিয়ে গেছে পোস্টমর্টেম করতে আর এলিসাকে বলে যাতে রাজবাড়ীতে সাবধানে থাকে। গ্রামের মানুষ রাজবাড়ীকে অভিশপ্ত বলে।
বিশ বছর আগেও এখানে লাশ ভেসে উঠেছিলো আর এর আগেও বহুবার একই কান্ড হয়েছিল। আদ্রিয়ান পুলিশ অফিসারের মোবাইল নম্বর রেখে দেয় যাতে কোনো অসুবিধা হলে জানাতে পারে।
রাজবাড়ী গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি তাই সবাই রাতে হ্যারিকেনের আলোতেই চলা ফেরা করে।তবে এখানে রাত আট টার পর কেউ তেমন বের হয় না বললেই চলে।
দিনের আলো ধীরে ধীরে অন্ধকারে রূপ নিচ্ছে রাজবাড়ীকে দেখতেও কেমন যেন ভুতুরে মনে হচ্ছে আদ্রিয়ানের কাছে। এলিসা গোল গোল করে বাড়ির চারপাশে কেবল ঘুরেই চলেছে আর মুগ্ধ হচ্ছে। রাজবাড়ীর অনেক জিনিসই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। বংশীয় অলংকারও জাদুঘরে রক্ষিত আছে। তবে এগুলো না থাকলেও রাজবাড়ী তার সৌন্দর্য হারায়নি।
এলিসা অবাক হয়ে অন্দরমহলের দিকে তাকিয়ে থাকে সুলায়মান ও জুলেখার কক্ষের বাইরে সুলায়মান ও বেগম জুলেখার স্কেচ দেখতে পায় যা দেখে রীতিমতো থ হয়ে যায়।এলিসা নিজেও অনেক সুন্দর তবে জুলেখা ও সুলায়মানের স্কেচ দেখে নিজেকে কুৎসিত মনে থাকে তার এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে সে,
এদিকে আদ্রিয়ান সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এলিসার দেখা পায়না হঠাৎ করেই অন্দরমহলের দিকে চোখ যায় দেখে এলিসা এক ধ্যানে চেয়ে আছে দেয়ালে টাঙানো ফ্রেমের দিকে। এলিসার কাঁধে কারো স্পর্শ অনুভব করতেই আৎকে ওঠে সে। আদ্রিয়ান নিজেও ফ্রেমটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য থ হয়ে গেলো এত সুন্দর মানুষও হয় সুলায়মানের বংশধর বলেই হয়তো এলিসাও এত সুন্দর।
আদ্রিয়ান ভয়ে আছে সে রাতের বেলা আর এলিসার কাছে কিছু জানতে চাইবে না কারণ কি বলতে কি বলে ফেলে আবার।
– এলিসা আমার না কেমন যেন ভয় ভয় করছে, এই বিশাল বাড়িটাতে কেবল তুমি আর আমি ভাবতেই কেমন যেন গা শিউরে উঠছে আমার।
-আসার পর থেকে এমন ঘেঙানি ভালো লাগছে না বলে দিলাম তুমি কালকেই কোনো হোটেলে সিফট করবে বলে দিলাম।
– না না একদম ভয় করছে না! আমি কোন রুমে থাকবো যদি দেখিয়ে দিতে তবে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে রাতটা পার করে দিতাম আরকি।
এলিসাও বুঝতে পারছেনা কোন রুমে থাকতে দিবে এত এত রুম থেকে বেছে নেওয়া বড় ঝামেলা তবুও সে অন্দরমহলের পাশেই দুটো রুম বেছে নেয়।
এলিসার খুব ইচ্ছে করছিলো সুলায়মানের কক্ষটা ঘুরে দেখার কিন্তু পুলিশ অফিসার ওই কক্ষটা সিল মেরে দিয়েছেন পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট না আসা অবধি খোলা হবে না কক্ষের তালা।
এলিসাও বেশি রাত করেনা অনেকটা জার্নি করার কারনে তার টায়ার্ড লাগে।সে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো সকালে উঠে রাজবাড়ীর প্রকৃতির ঘ্রাণ নিবে সে। আদ্রিয়ানও কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে হ্যারিকেন ও মশালের লাল আলো তার মোটেও ভালো লাগছেনা তাই ভয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকে।
মাঝরাতে হঠাৎ করেই এলিসার ঘুম ভেঙে যায়। অন্দরমহলের দিক থেকে কোনো আওয়াজ আসছে বলে তার মনে হয়।
পালঙ্ক থেকে উঠে সে আওয়াজ অনুসরণ করে এগোতে থাকে, আওয়াজটা খুবই ভয়ংকর যেন মনে হচ্ছে কেউ হাড়-গোড় চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। কিন্তু এত রাতে এ বাড়িতে কে আসবে ভাবতে ভাবতেই চলে আসে সুলায়মান ও জুলেখার কক্ষের সামনে।মনে হচ্ছে এ কক্ষ থেকেই আওয়াজটা আসছে।
এলিসা কান পাতে দরজায় কক্ষের ভেতরই কেউ হাড়গোড় চিবিয়ে খাচ্ছে বলে মনে হতে থাকে এলিসার।
এবার এলিসার মনেও ভয়ের জন্ম হয় তালাবদ্ধ ঘরে কে হতে পারে আর কোনো মানুষ তো এমন শব্দ করে এত রাতে খেতে যাবেনা। এলিসার অনেক সাহসী হলেও এখন তার মনে ভয়ের সৃষ্টি হতে থাকে মনে প্রশ্ন জাগে ভেতরে কে হতে পারে???আদ্রিয়ানকে ডাকবে বলে একবার ভাবলেও সে আর ডাকে না কারণ ও এমনিতেই ভীতু এখন যদি এমন ভয়ংকর আওয়াজের সম্মুখীন হতে হয় তবে তো বেচারার অবস্থা দফারফা।
এলিসা দরজায় টোকা দিতেই…….
চলবে,,,,,,
#মৃগতৃষ্ণিকা
( মৃগতৃষ্ণার ২য় সিজন)
#সূচনা পর্ব
#লেখা: মুন্নি ইসলাম
[ অবশ্যই জানাবেন কেমন লাগলো প্রথম পর্ব আর লাইক কমেন্ট ও শেয়ার করে পাশেই থাকবেন। ধন্যবাদ]