#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশ ০১.
সমুদ্রের জলরাশির কাছে ভিড় করলো সবাই। সময়টা ঘড়ির কাটায়-কাটায় তিনটা বাজে। পর্যটকের টালমাটাল ভিড়টা এসময় একদম কম। জায়গাটা ফাঁকা-ফাঁকাই। মাহতিম তার পরিবার নিয়ে ঠিক জায়গাটা খুঁজে নিলো। সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু রেস্ট নিয়ে পানিতে নামার প্রস্তুতি নিয়েছে, সবার গায়েই হালকা মতোন পোশাক। ছেলেদের গায়ে শার্ট-গেন্ঞ্জি, মেয়েদের পড়নে জিন্স-কূর্তি। মেহনূর, মারজা, রজনী তিনজন কেবল নিজেদের বেশভূষা ছাড়েনি। মাহতিম একটু দূরে গিয়ে কাদের সাথে যেনো কথা বলছে, ঘাড় ঘুরিয়ে মেহনূর সেটা দূর থেকে দেখছে, মেহনূরের ডানহাত ধরে নীলাভ পানির দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহদি। কান্না থেমে গেলেও ফোঁপানির হিড়িকে একটু পরপর গা কেঁপে উঠছে। মাথায় ওড়না টেনে চুপচাপ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মারজা, গায়ের দামী শালটা আরেকটু টেনে শীতের হাওয়াটা আঁটকে নিচ্ছেন। চোখ থেকে কালো সানগ্লাসটা খুলে মাথায় রাখলো রজনী, আশেপাশে চোরাদৃষ্টিতে কাউকে খুঁজে যাচ্ছে, ফোনের ডিটেলস মতে তার এখানেই থাকার কথা। বাকিরা হাঁটু পযর্ন্ত পানিতে নেমে হৈ-হুল্লোড় করছে, একে-অন্যকে পানি ছোড়াছুড়ি খেলায় ঠিক শৈশবের মতো ফূর্তি করতে মত্ত। ডানহাতটায় মৃদ্যু ঝাঁকুনি খেতেই চমকে উঠলো মেহনূর, মাহতিমের দিক থেকে চোখ সরিয়ে মাহদির দিকে তাকালো সৈ, একজোড়া অশ্রুমোচন চোখে মেহনূরের তাকিয়ে আছে মাহদি। ওই চোখ দিয়েই বলে যাচ্ছে আমি একটু সমুদ্রে নামতে চাই।হাত ছেড়ে দিয়ে ঝলমলে চুলে হাত রাখলো মেহনূর, পাতলা-কালো-ঝলমলে চুলটা যেনো মাহতিমের মতোই। কপাল থেকে সারি-সারি চুলগুলো ডানহাতে পেছনে ঠেলে দিলো, ছোট্ট নিষ্পাপ মুখটা ধরে গালে-কপালে-চক্ষুপাতায় চুমু খেলো মেহনূর। মাহদির চোখের দিকে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বললো,
– আমি তোমার ভাইয়াকে রাজি করাবো, কোনো চিন্তা নেই। উনি রাজি না হলে আমিই তোমাকে নিয়ে ঘুরিয়ে আনবো, ঠিক আছে?
মলিন ঠোঁটে হাসি ফুটলো মাহদির। খুশীতে আমোদে গদগদ হয়ে বললো,
– সত্যি? তুমি সাঁতার পারো?
মেহনূর হাসি দিয়ে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়ালো। তা দেখে খুশীতে লাফিয়ে উঠলো মাহদি, উল্লাসে দুহাত বাড়িয়ে মেহনূরকে জাপটে ধরলো সে। হঠাৎ কথা বলার সময় কিছু একটা দেখতেই চোখ আঁটকে গেলো মাহতিমের, দূর থেকে মাহদি-মেহনূরের সুন্দর মূহুর্ত দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। ভারী আশ্চর্য হয়ে দেখতে-দেখতে হেসে উঠলো মাহতিম। বুক থেকে বিষাদের ভারী নিশ্বাসটা বেরিয়ে পরলো। যাক কেউ-না-কেউ আছে, সে না থাকলেও পিঠ-পেছনে কেউ তো মাহদির খেয়াল রাখবে। মারজাকে নিয়ে আর টেনশন নেই, সবটুকু টেনশন আড়ালে-আবডালে মেহনূর গুড়িয়ে দিয়েছে। আজ যখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ গরম করে তাকালো, তখনই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। যেই সরল-সহজ মেহনূরকে সে বিয়ে পরিয়ে সঙ্গে এনেছিলো, সে একটু-একটু করে বুঝতে শিখেছে, পরিস্থিতির ভেতর জড়িয়ে নিচ্ছে, অন্যায়ের প্রতিও রুখতে শিখছে এখন। প্রীতি চুপিচুপি করে নীতির কাছে এসে ছোট্ট প্রশ্নটা করলো,
– আপু, ভাইয়া কি রেগে আছে নাকি?
নীতি উল্লাস থেকে মুখ ঘুরিয়ে প্রীতির দিকে তাকালো। এরপর চোখ সরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকাতেই নিরুত্তেজ ভঙ্গিতে বললো,
– না, রাগেনি। রাগলে তো হল্লা করে ফেলতো। চোখ-কান লাল হয়ে ডেন্ঞ্জারাস অবস্থা। উলটো মনেহচ্ছে যে, ভাবীর আচরণে খুশী হয়েছে।
প্রীতি প্রশ্নসূচকে বললো,
– খুশী? তুমি পাগল? ভাবীর রাগ দেখে ভাইয়া খুশী হবে?
ছোটবোনের নির্বুদ্ধিতা দেখে মাথায় একটা চাপড় মারলো প্রীতি। বিরক্তির সুরে বললো,
– খুশী হবে নাতো কি হবে? কোনো ডিফেন্সের বউ যদি গাধা হয় সেটা কি ঠিক? ভাবী এখন চালাক হচ্ছে এটা দেখেই ভাইয়া খুশী। ওসব তুই বুঝবি না। চুপ থাক।
মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে চুপ মেরে যায় প্রীতি। বোনের কথায় একটু রাগ হলেও সেটা অদৃশ্যের মতো উবে যায়। সামিকের ক্যামেরায় ফটো বন্দি করার জন্য চটপট দুবোন সেদিকে দৌঁড়ে ছুটলো। সবাই দফায়-দফায় অনেক ছবি তোলার পর সবাইকে নিয়ে গ্রুপ ফটো তোলার জন্য হট্টগোল উঠলো। মাহতিমকে নেওয়ার জন্য ভেজা গায়ে পানি থেকে উঠলো সৌভিক, বন্ধুর কাধ জড়িয়ে অনুনয় করতে-করতে সবার সাথে একত্র করলো সে। মাহতিম হার মেনে চুপ হয়ে গেলে ফারিন তাকে মেহনূরের পাশে দাঁড় করিয়ে দিলো। একদল দাঁড়িয়ে রইলো, একদল হাঁটু মুড়ে বসলো।পেছনে নীল সমুদ্রকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে এক পর্যটকের হাতে ক্যামেরা তুলে দিলো সামিক, ওমনেই হুড়মুড় করে নিজেও ফারিন-নীতি-প্রীতির পাশে হাঁটুগেড়ে বসলো। পর্যটকটা ক্যামেরার লেন্স আরেকটু পরিষ্কার করতে নিলে এইফাঁকে বাঁহাতটা বাঁদিকে বাড়িয়ে দিলো মাহতিম, চুপিসারে বাঁদিকে এগুতে-এগুতে হাতটা খপ করে কোমর জড়িয়ে ধরলো। সাথে-সাথে ডানদিকে চোখ ফিরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর। মাহতিম এমন ভান ধরে দাঁড়িয়ে আছে যেনো সে কিছুই করেনি। একবার ভাবলো ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিবে, পরক্ষণে হাতের উপর হাত রাখলো মেহনূর। হাতটা সরালো না। লেন্স পরিষ্কার হলো, ক্যামেরাটা তাদের দিকে তাক করে ধরলো, ওমনেই হাঁটুগেড়ে বসা নীতিরা দুহাতে ‘ ভি ‘ পোজ দিতেই একটানা ছবি উঠলো। আনন্দ-কল্লোলে মেতে উঠলো সবাই। বাতাসে যেনো আনন্দের গন্ধ, হৈচৈ উল্লাসের সুভাস, প্রাণচাঞ্চল্যে মেতে উঠা প্রফুল্ল মনের গান, সবমিলিয়ে সুখের ঠিকানাটা ফুটে উঠলো ছবিতে। সমুদ্রে একটুখানি ঘুরানোর জন্য ছোটোখাটো রাইডের ব্যবস্থা করলো মাহতিম, ওয়াটার বাইক রেডি করে সবাইকে এক চক্কর ঘুরানোর বুদ্ধি আঁটলো। এই উছিলায় মাহদিকে পানির উপর ঘুরিয়ে আনলে বদমাশটার মন গলে যাবে। বাতাসের জন্য আকাশী রঙের শার্টটা গায়ের সাথে আষ্টেপৃষ্টে সেঁটে আছে, কালো প্যান্টের সাথে বেল্ট পরলেও আজ শার্টটা ইন করা নেই। হাতের কালো ঘড়িটা খুলে মেহনূরের দিকে এগিয়ে গেলো মাহতিম, মেহনূরের মুখোমুখি হয়ে ওর দিকে ঘড়িটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– এটা রাখো।
ঘড়িটা একপ্রকার মেহনূরের হাতে গুঁজে দিলো সে। চটপট শার্টের স্লিভদুটো গুঁটিয়ে নিতেই মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললো,
– মাহদি সাঁতার জানে না। এটা যদি গ্রামের নদী হতো আমি ‘ না ‘ করতাম না। কিন্তু এটা সমুদ্র, এখানে একটু-আধটু এদিক হলেই শেষ। তুমিযে ওর কথায় নেচে বেড়াচ্ছো এটা ঠিক না মেহনূর। খাবার টেবিলে কিছু বলিনি, এর মানে এটা না তোমার কথায় দমে গেছি। ওর প্রতি খেয়াল রাখছো বলে আমি খুশী, কিন্তু আসকারাটা কমিয়ে করো।
মাহতিমের কথায় মাথা নিচু করলো মেহনূর। আসলেই ঠান্ডা মাথায় ভাবলে দোষটা মাহতিমের না। মানুষটা তো নিজের দিকেই খেয়াল রাখে না। এবার যখন ফিল্ড থেকে ফিরলো, তার চোখদুটোয় ক্লান্তি জড়ানো ছিলো, যেনো কত রাত ঘুমোয়নি। মুখটাও ছিলো রুক্ষ-রুক্ষ। সেখানে থাকলে যে একরাশ ব্যস্ততার ভেতর জড়িয়ে যায়, নানা কাজের জটিলতায় আঁটকে পরে এটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছে মেহনূর। সমুদ্রের রোমান্ঞ্চকর অনুভূতির জন্য ওয়াটার বাইকে চড়েছে। প্রথমটায় সৌভিকের পিছনে সাবির, দ্বিতীয়টায় সিয়ামের পেছনে নীতি, তৃতীয়টায় তৌফের পেছনে সামিক উঠলো। এদিকে তৌফ হাজার তোষামোদ করেও ফারিনকে নিজের পেছনে উঠাতে পারলো না। ফারিন পাগলাটে ভঙ্গিতে ‘ না, না ‘ করেই যাচ্ছে, শেষমেশ স্পষ্ট করে বলে দিলো মাহতিমের রাইডেই উঠবে। তৌফের ওইসব ফটকা টাইপের হিরোগিরি দেখার ইচ্ছে তার নেই। সবার কীর্তিকলাপ দেখে হাসতে-হাসতে ফারিনকে লাইফ জ্যাকেট পরতে বললো মাহতিম, নিজে প্রস্তুত হয়ে ওয়াটার বাইকে চড়তে-চড়তে বললো,
– আমি কিন্তু স্পিডে চালাতে পারিনা। স্পিড বাড়াবাড়ির জন্য হাউকাউ করলে লাভ নেই।
ফারিন দাম্ভিকতার সাথে মুখ ভেঙিয়ে বললো,
– হু, আমিতো গা’ধা না? তুমি বললেই আমি হ্যাচোঁড়-প্যাঁচোড় করে বিশ্বাস করবো? এর আগেরবার যেই স্পিডে চালিয়েছো, তৌফ ভাই লুঙ্গি পরলে সেটা ভয়ের চোটে খুলেই যেতো।
ফারিনের গলা শুনে বাঁজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো তৌফ। বাকিদের অবস্থা হাসতে-হাসতে কাত। ফারিনের লাইফ জ্যাকেটটা পরা হলেই এক ছুট দিয়ে মাহতিমের কাধ ধরে বাইকে উঠলো। বড় ভাইয়ের গলাটা পিছন থেকে ঠিকঠাক মতো ধরতেই উত্তেজিত গলায় বললো,
– ভাইয়া, তুমি কিন্তু আজকেও স্পিড দিয়ে চালাবা। সৌভিক আর তৌফ ভাইয়াদের একদম পিছু ছাড়িয়ে দিবা ঠিক আছে?
হ্যান্ডেল দুটো গ্রিপ করে মৃদ্যু হাসলো মাহতিম। মুখটা ডানকাধের কাছে এনে প্রসন্ন হাসিতে বললো,
– রেডি তুই?
চটপট উত্তর দিলো ফারিন,
– ইয়েস ভাই, ফুলপ্রুফ রেডি।
মুখটা সামনে ঘুরিয়ে ওয়াটার বাইক স্টার্ট দিলো মাহতিম। ওমনেই পানির উপর দারুণ স্পিডে জলতরঙ্গ উঠে বাইক ছুটালো সে, সামনেই সৌভিক ও তৌফদের বাইকে টক্কর চলছে। ফারিন এক্সাইটমেন্টে চিৎকার করে ‘ সাব্বাশ ভাই, ইয়াহু ‘ বলে-বলে পাগল। ভুম-ভুম শব্দে তুমুল গতিতে ওয়াটার বাইকটা ছুটছে, ওয়াটার বাইকের দুধারে পানি ভেঙ্গে পায়ে লাগছে, বাইকটা কখনো ডানে কাত হয়ে যাচ্ছে, কখনো বাঁদিকে। দূর থেকে তিন বাইকের অবস্থা দেখে মাহদিও আমোদে চেঁচিয়ে উঠে, সে জানে ভাইয়া একটা-একটা করে দুটো বাইকই পিছু হটিয়ে দিবে। হলোও তাই। মিনিটের ভেতর দুটো বাইককে পিছু করে গোল-গোল রাউন্ডে বাইক ঘুরালো মাহতিম, এরপরই তীড়ের কাছে এনে ফারিনকে নামিয়ে নিলো। মেহনূরকে রেখেই এক দৌড়ে মাহতিমের কাছে গেলো মাহদি, আবারও লজ্জা-শরম সব ভুলে আকুতি গলায় বললো,
– ভাইয়া উঠবো।
মাত্র গা থেকে লাইফ জ্যাকেট খুলতে নিচ্ছিলো মাহতিম, মাহদির আগমন ও চোখের করুণ দেখে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– উঠ।
সায় পেতেই তাড়াহুড়ো করে ফারিনের জ্যাকেটটা নিলো মাহদি। মাহতিমের জ্যাকেট পরা ততক্ষণে শেষ, মাহদির হাত থেকে জ্যাকেটটা নিয়ে ঠিকঠাক মতো নিজেই তাকে পরাতে লাগলো। মাহদি জুলজুল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেই স্মিত স্বরে বললো,
– সরি ভাইয়া।
হাঁটু গেড়ে জ্যাকেট পরাতেই দৃষ্টি তুললো মাহতিম। কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে অম্লানবদনে হেসে বললো,
– সরি বলিস না।
আবার জ্যাকেটের দিকে মনোযোগ দিলো মাহতিম। জ্যাকেটের সবকিছু ঠিকঠাক কিনা দেখতেই ঝট করে জাপটে ধরলো মাহদি। গলাটা দুহাতে জড়িয়ে মাহতিমের কাধে মুখ গুঁজে বললো,
– তুমি আমার উপর রাগ কোরো না ভাইয়া। আই মিস ইউ।
চোখ বন্ধ করে ফেললো মাহতিম। গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে সেটা ছাড়তে-ছাড়তে তাকালো। মাহদির পিঠে হাত বুলাতেই দেখলো সামিকের ক্যামেরাটা ‘ খট ‘ করে শব্দ করলো। মাহতিম হালকা একটু ভ্রুঁ কুচকাতেই ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে হাসি দিলো সামিক,
– জাস্ট দুটো তুলেছি।
ভ্রুঁ সমান করে হেসে ফেললো মাহতিম। মাহদিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়ে দিলো, প্রায় পনের যাবৎ তাকে নিয়ে মনের ইচ্ছায় সমুদ্র ভ্রমণ করাতে ব্যস্ত হলো। মারজার ঔষুধ নিতে প্রীতির সাথে একটু হোটেলমুখো হয়েছিলো মেহনূর, এসেই দু’ভাইয়ের এ্যাডভেন্ঞ্চার দেখে আনন্দে আটখানা হলো সে দুহাত বুকের কাছে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে রজনী, তার চোখে এখন সানগ্লাস আঁটা। সানগ্লাসের নিচে থাকা চোখদুটো অদ্ভুত রহস্যে হাসছে। চোখটা একটু নিচু করে হাতের হাতঘড়িটা পরোখ করে হাসলো, আর বেশি সময় নেই। বামে তাকিয়ে মেহনূরের হাসিমাখা মুখটা দেখলো, এবার চোখের হাসিটা ঠোঁটে ছলকে উঠতেই দারুণ উত্তেজনায় সামনের দিকে তাকালো। হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোনটা ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে দক্ষতার সাথে চটপট টাইপ করলো, অনেকটা ইংরেজি শব্দে বাংলায় লিখলো,
– Ready how. Shomoy 10 min.
বেঁধে দেওয়া সময় দশ মিনিট। মাহতিম শেষ রাউন্ডটা কমপ্লিট করে বাইক ঘুরিয়ে ফিরছে। রজনীর হাসিটা পাতলা থেকে আরো গাঢ় হচ্ছে। গুনগুন করে সুর ধরেছে পুরোনো দিনের গান, গানটা সম্ভবত এমন। ‘ আমার ভেতর বাহিরে অন্তরে-অন্তরে, আছো তুমি হৃদয় জুড়ে… ‘। তীড়ে ভিড়লো বাইকটা, এবার মাহদি আস্তে করে নেমে পরলো। ছুটে গেলো মায়ের কাছে, কি কি থ্রিল পেয়েছে সেটা ছোট-ছোট শব্দ জুড়ে মা’কে বলতে লাগলো। নীতিরা ভেজা গায়ে একটু দূরে থাকা ঝালমুড়ির পসরা দেখে সেখানে ছুটে গিয়েছে, গা থেকে জ্যাকেট খুলে লোকের কাছে সপে দিতেই মেহনূরের কাছে গিয়ে হাজির। কোনোদিকে পরোয়া না করে মেহনূরের আঁচল টেনে মাথা মুছতে লাগলো। লজ্জায় আশেপাশে তাকাতে পারলো না মেহনূর। সবাই কি ভাববে বাবা! মা-ও তো অদূরে বসে আছে। তাঁর সামনেও কি নূন্যতম লজ্জাবোধ নেই? এই লোক কি ট্রেনিংয়ের নামে সবটুকু লজ্জা গিলে এসেছে? মেহনূর নতমুখে মিনমিন করে বললো,
– আপনি আঁচলটা ছাড়ুন। এখানে সবাই আমাদের দিকে তাকাবে।
মাহতিম বেপরোয়া কন্ঠে বললো,
– তাকালে তাকাক। আজ তো চলেই যাচ্ছি।
মেহনূর দিশাহীন ভঙ্গিতে কাঁচুমাচু করছে। শেষে সহ্য করতে না পেরে মুখ ফসকে বললো ,
– আপনার কি একটুও শরম নেই?
মাহতিম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে গেলো। চরম আশ্চর্য হয়ে বললো,
– আজব, আমি কি তোমার ঠোঁট কাম’ড়ে চুমু খাচ্ছি?
লজ্জায়-কাতরে চোখ খিঁচুনি দিয়ে গুটিয়ে গেলো মেহনূর। আর পারা যায়না! এই লোক এতো ঠোঁটকাটা কেন? মুখের উপর কিভাবে ঠাস-ঠাস করে এসব বলে ফেলে? ছিঃ ছিঃ অবস্থা। মেহনূরের জড়সড় অবস্থা দেখে নিজেই আঁচল ছেড়ে দিলো মাহতিম। মাথাটা ডানে-বামে নাড়াতে-নাড়াতে বললো,
– তোমাকে যে কি করতে ইচ্ছে করছে, তোমাকে নিয়ে কোথাও শান্তি —
আর কোনো শব্দ নেই। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড টানা অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। তাও, আওয়াজ নেই। মেহনূর খিঁচুনি দেওয়া চোখ খুলে তাকাতেই এক চিৎকার দিলো কেউ! চিৎকারের সাথে-সাথে আরো আট-দশটা গলা হাহাকার করে উঠলো! শোরগোল বাড়ছে-বাড়ছে, আরো চড়াও করে বাড়তেই মেহনূর লক্ষ্য করলো নীতি হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছে। মাহতিম সামনে নেই! ফারিন ‘ ইয়া আল্লাহ্ ‘ বলে এক চিৎকার দিয়েই ধপ করে বালুতে বসে পরলো। সৌভিক-তৌফ-সিয়াম সবকিছু ফেলে সমুদ্রের দিকে দৌঁড় লাগিয়েছে, নীতি বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উলটে কেঁদে দিয়েছে, বারবার সমুদ্রের দিকে ছুট লাগাতে চাইছে, পারছেনা। পেছন থেকে সামিক চেঁচামেচি করে নীতিকে আঁটকে দিয়েছে, সেও রীতিমতো উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করে যাচ্ছে। পুরো কাহিনী বুঝতে সময় লাগলো মেহনূরের, বড় করে ঢোক গিলতেই একবুক ভয় নিয়ে সমুদ্রের দিকে এবার ভাল করে তাকালো। তৎক্ষণাৎ বুকের মধ্যে কামড়ে এলো ওর, নিশ্বাসটা গলার কাছে আঁটকে যেতেই হাঁপানির মতো ঠোঁট খুলে ফেললো। নিশ্বাস নিতে পারছেনা মেহনূর, কেউ গলার কাছটায় যেনো দানবীয় হাতে টিপে ধরেছে, চোখ ফেটে পানি বেরুচ্ছে, চিৎকার করতে মন চাইছে! কানে এবার মারজার গগনবিদারী চিৎকার শুনতে পেলো, বুকটা যেনো গুলির আঘাতের মতো ঝাঁঝরা হয়ে খেলো। কপাল ঘেমে উঠছে, হাত-পা ভয়ংকর ভাবে কাঁপছে, গলায় নিশ্বাস জমে ঠোঁট দিয়ে ফোসফোস করে বেরুচ্ছে। নীতি পাগলের মতো কেঁদে যাচ্ছে, তার চিৎকারের করুণ সুর ভয়াবহ। বারবার আর্জি জানাচ্ছে, ‘ আল্লাহ্ মাফ করো, আল্লাহ্ মাফ করো। ওকে ফিরিয়ে দাও। ‘
হা করে জোরে-জোরে নিশ্বাস নিতেই টলমল চোখে আবার সামনে তাকালো মেহনূর। সমুদ্রে একটুখানি বাঁচার তাগিদে হাবুডুবু খাচ্ছে মাহদি, বারবার দুই হাত উঁচিয়ে সাহায্যের জন্য ডাকছে। স্রোতের জোয়ারে বহু দূরে চলে গেছে মাহদি, নাগালহীন হাতদুটো বারবার ডেকে যাচ্ছে। তাকে নাগালে পাওয়ার জন্য প্রাণপণে ছুটেছে চারজন, সমুদ্রের দূরত্ব যেনো কয়েকশো মাইলের মতো ঠেকছে। আজ মাহতিমের স্থিরজ্ঞান নেই, পুরো দুনিয়াটা অন্ধকার লাগছে। সমুদ্রের নোনাপানির সাথে তার চোখদুটো মিলে গেছে। এই সমুদ্রেই যাত্রা তার শুরু, সমুদ্রের জন্যই সে দূরে থাকে, আজ কি এই সমুদ্র সবটুকু মায়া গিলে নিবে? হঠাৎ বাতাসের সাথে করুণ সুর শুনে থমকে গেলো মাহতিম, পেছন থেকে নীতির কন্ঠে ‘ মেহনূর ভাবী ‘ ডাকটা শুনে সাঁতার থেমে গেলো তার। মুখটা পিছু ঘুরাতেই বুকের ভেতরটায় সজোড়ে একঘা চাবুক লাগলো! সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে বাজতেই স্থির হয়ে গেলো সে, কানে-কানে চিরপরিচিত স্লোগানের সুরটা শুনতে পেলো,
– শান্তিতে সং’গ্রামে সমুদ্রে দূর্জয়, শান্তিতে সং’গ্রামে সমুদ্র দূর্জয়।
– চলমান .
#FABIYAH_MOMO .