#এসো_রূপকথায়
#কলমে_ফাতেমা_তুজ_নৌশি
#পর্ব:৩
কনের বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে। তাদের সর্বোচ্চ
আপ্যায়ন চলছে। এদিকে রিয়া মেহনূরের কাছাকাছি আসার জন্য অস্থির হয়ে আছে। সুযোগ পেতেই রুমে প্রবেশ করল। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে মেহনূরকে। রিয়া আপাকে জড়িয়ে ধরল। মেহনূর মৃদু হাসার চেষ্টা করলেও বিশেষ কোনো বাক্য করল না।
“আপা, তোর কী হয়েছে? তুই পালিয়ে কেন গিয়েছিলি? এমন না জাহিদ ভাইকে তোর পছন্দ না। অনেক দিন ধরে একে অপরকে পছন্দ করিস। অথচ পালিয়ে গেলি বিয়ের দিন। পালিয়ে যাওয়ার পর ফিরেই বা কেন এলি?”
টানা প্রশ্ন গুলো করল রিয়া। মেহনূর জবাবহীন। বোনের বাহু টেনে ধরল রিয়া। ওর মনের মাঝে থাকা প্রশ্ন গুলো হুংকার তুলল।
“বল, কেন এমনটা করলি?”
মেহনূর বোনের পানে তাকাল। গুমোট হয়ে আছে ওর অনুভূতি। হয়ত কিছু বলতে চাইছে তবে অজ্ঞাত কারণেই কণ্ঠটা স্থির হয়ে আছে।
“মেহনূর,এখনো বসে আছ!”
কথাটি বলেই হাসল রিসান। ঘরে প্রবেশ করল। রিয়ার অনুভূতিরা হারিয়ে গিয়েছে। ছেলেটা সর্বদা ঝামেলা তৈরি করে! মেহনূরের মাথাটা নত হয়ে আছে। রিসান মৃদু স্বর শক্তভাবে বলল,”যাও,তোমার বাড়ির লোক এসে গেছে। বাইরে মেয়েরা অপেক্ষা করছে।”
বিনা বাক্যে চলে গেল মেহনূর। তারপরই রিয়ার রাগটা প্রকাশ পেল। ছেলেটার কলার চেপে ধরল ও।
“আপনার সমস্যাটা কী?”
“তোমার সমস্যাটা কী? কেন,বার বার এমনটা করছ?”
“সমস্যা তো আপনার। আপার কাছে আসতে দিচ্ছেন না। কি সত্যি লুকিয়ে আছে এখানে?”
“কোনো সত্যি লুকিয়ে নেই।”
“আছে, আলবাত আছে।”
“নেই।”
“আছে।”
“বললাম তো নেই।”
রিসানের কণ্ঠটা একটু বেশিই বেজে ওঠেছে। ও চোখ বন্ধ করে ফেলল। নিজের রাগকে আড়াল করে রিয়ার দু বাহুতে স্পর্শ করল। মেয়েটার দু চোখ ভেজা।
“প্লিজ,ঝামেলা করবে না।”
“আমি ঝামেলা করছি না রিসান। আপনি করছেন এসব।
ঘৃ ণা হচ্ছে আমার।”
কথাটি শেষ করেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রিয়া। বেরিয়ে গেল ছলছল নয়নে। সে দিকে তাকিয়ে রিসান হাসল। মনে মনে বলল ‘ঘৃ ণা তো তোমায় করা উচিত মেয়ে। নি ষ্ঠু র কোথাকার।’
একচোট কান্না করে মেকাপ নষ্ট করে ফেলল রিয়া। পুনরায় সাজতেও ইচ্ছে করছে না। ও জামা বদলে নিল। একটা সাধারণ কাপড়ে বেরিয়ে এল। আসতেই নজরে পড়ল রিসানকে। পুরুষটিকে এক নজর দেখে নিয়ে অন্যদিকে চলল ও। রিসান ও কিছু বলল না। শুধু দীঘল শ্বাসে ভেসে গেল বুক। পরিবারের সকলকে দেখে রিয়ার মন ভালো হয়ে গিয়েছৃ। সুযোগ বুঝেই মা কে নিয়ে আড়াল হলো ও।
“মা,বাসার কী অবস্থা?”
“তেমন কিছু ঘটে নি।”
“আশেপাশের মানুষরা আপাকে খারাপ বলছে তাই না?”
“সে তো বলবেই। যাক গে, এখন এসব কথা বলে লাভ নেই।”
“হুম।”
রিয়ার কণ্ঠটা নেমে গেল। ওর মনে প্রশ্ন জাগল, সবাই এতটা স্বাভাবিক কেন? তবে উত্তর নেই। রিয়ার খাওয়া হয় নি। এদিকে পেটে ক্ষুধার যন্ত্রণা চলছে। ও খাবার নিয়ে বসল। সকলের খাওয়া শেষ। তাই একাই খাচ্ছিল। ওমন সময় জ্বালাতে এল রিসান।
“লাঞ্চে কতবার খাও তুমি?”
এক টুকরো মাং স কামড় দিয়েছিল রিয়া। ওর খাওয়া থেমে গেল। চাইল পুরুষটির পানে।
“এভাবে খাওয়া মানে অপচয়। তোমার এই খাবারটি আরেকজন খেতে পারত।”
“আপনি আমায় খোঁটায় দিচ্ছেন?”
“কিছুটা।”
অপমানিত বোধ হলো রিয়ার। খাবারের প্লেট রেখে ওঠতে যাচ্ছিল। রিসান ওকে থামিয়ে দিল।
“খাবার রেখে যেতে নেই।”
“আমার খাওয়া হয়ে গেছে। হাত ছাড়েন।”
“বললাম না, খাবার রেখে যেতে নেই।”
“একটু আগেই খোঁটা দিয়েছেন।”
“দিলে দিয়েছি। এখন বলছি খাও।”
“খাব না।”
“জেদ করলে আমি খাইয়ে দিতে বাধ্য হব। আশা করছি এটা তোমার জন্য শুভ হবে না।”
দাঁত কিড়মিড় করে ওঠল রিয়া। এই পুরুষটির দৌড় জানে ও। তাই পুনরায় খেতে বসতে হলো। রিসান নিজের হাতে কোক ঢেলে দিচ্ছে। রিয়া সেটা তুলতে যেতেই গ্লাস নিয়ে খেতে শুরু করল ও। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল রিয়া। এদিকে রিসানের অধর জুড়ে ফিঁচেল হাসি।
রিসিপশনের পর মেহনূরকে আর পাঠানো হলো না। কনের বাড়ির লোককে খালি হাতেই ফিরতে হবে। রিয়া বার বার বলল যাতে মেহনূরকে পাঠানো হয়। তবে হলো না। কোনো কাজে দিল না তার কথা গুলো। ঠিক হলো মেহনূরের সাথে রিয়া ও কিছুদিন থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই জামাকাপড় নিয়ে ঝামেলা হলো। রিয়ার সাইজের সাথে কারো মিল নেই। দুই বাড়ির দূরত্ব ও কম নয়। তার চেয়ে ভালো নতুন কিছু জামা কিনে নিবে। কনে পক্ষের বিদায়ের পর ই শপিংয়ে বের হলো ওরা। রিসান,জাহিদ, মেহনূর আর রিয়া যাবে। দুটো গাড়ি বের করা হয়েছে। রিয়া মেহনূরের সাথে যেতে নিলেই হাত ধরে আটকে নিল রিসান।
“ভাইয়া,তুই মেহনূরকে নিয়ে যা। আমি আমার বেয়ানকে নিয়ে যাই। নতুন করে একটু পরিচিতি হয়ে নিই।”
প্রতিবাদের সুযোগ মিলল না। তার আগেই রিয়াকে নিয়ে এল রিসান। গাড়ির দরজা খুলে বলল,”যাও।”
“এমনটা কেন করলেন? জাহিদ ভাইয়ার সামনে আমি তো কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারতাম না।”
“জানি।”
“তাহলে?”
“তুমি একটা গাধা। উপস সরি, গাধি।”
“আশ্চর্য। এখানে গাধামির কী দেখলেন?”
“ওরা নিউলি ম্যারিড কাপল। আলাদা স্পেসের দরকার আছে না?”
রিয়া থেমে গেল। ওঠে পড়ল গাড়িতে। মৃদু সুরে গান বাজছে। এই গান গুলো একদম ই পছন্দ নয় ওর।
“মিউজিক চেঞ্জ করুন।”
“করব না।”
“আমার ভালো লাগছে না।”
“তাতে আমার কী?”
“সেটাই আপনার কী।”
কথাটি বলেই মন খারাপ করে ফেলল রিয়া। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে রইল। রিসান ওর পানে একবার চাইল। মিউজিক অফ করে দিয়ে বলল,”জানালায় মাথা রেখো না। যেকোনো সময় এ ক্সি ডে ন্ট হতে পারে।”
“তাতে আপনার কী?”
প্রশ্নটি করেই রিসানের দিকে চাইল রিয়া। ছেলেটা চুপ হয়ে গেল। মুখটা কিছুটা শুকনো দেখাল। অথচ রিয়া ওমন করেই চেয়েই রইল। কোনো উত্তরের আশায় নয়, এক বুক হাহাকার নিয়ে চেয়ে রইল।
শপিং থেকে ফেরার পথে অনেক স্ন্যাকস আনা হয়েছে। উদ্দেশ্য আড্ডা দেওয়া। এখন কিছুটা ঠান্ডা পড়েছে। রাতে ইষৎ কুয়াশার দেখা মিলে। বাগানে আড্ডা দেওয়া যাবে। বাড়ির সব বাচ্চারা হাতে হাতে কাজ করছে। রিয়া এসবের কিছুই জানে না। ও এমনি বাইরে ঘুরতে এসেছিল। তখনই সানার সাথে দেখা।
“আরে রিয়া, এসে পড়েছ। তোমাকেই ডাকতে যাচ্ছিলাম।”
“এখানে কী হচ্ছে আপু?”
“আড্ডা দিব। বার বি কিউ ও করা হবে। আসো,আসো।”
বিশাল মাদুর পাতা হয়েছে। সেখানে গিয়েই বসল রিয়া। ওর পাশে বসল নিতু আর রুবাই। রিসানের ছোট চাচার ছেলে মেয়ে এরা। দুজনের বয়সের ব্যবধান এক বছর হলেও একই সাথে ক্লাস ফোরে পড়ছে ওরা। খানিকটা দূরেই বার বি কিউর ব্যবস্থা করছে রিসান। কয়লা ধরাচ্ছে সে। রিয়া, নিতু, রুবাই গল্প করছিল। এটাই যেন সহ্য হলো না রিসানের।
“নিতু, রুবাই এদিকে আয় তো তোরা।”
কোনো কাজ নেই। তবু উল্টাপাল্টা কাজে পাঠিয়ে দিল ওদের। এবার রিয়া একা। ছেলেটার এই বদ মতলব বুঝতে পারে রিয়া। তবে কিছুই বলে না। খানিকক্ষণ যেতেই জাহিদ আর মেহনূর উপস্থিত হয়। দুজনেই চুপ করে বসে থাকে। রিয়া ও তাই। তবে কোথাও একটা দীর্ঘশ্বাস আসে, আবার মিলিয়ে যায়। কয়লায় আগুন ধরিয়ে এদিকে আসে রিসান। জাহিদের সাথে হাত মিলায়।
“তোরা এখানে কেন?”
“সানা ই তো আসতে বলল। কি যেন আয়োজন করেছিস।”
“এটা তো সিঙ্গেল পার্টি ব্রো।”
“তাতে কী? আমরা জয়েন হবই।”
“আচ্ছা,তাহলে কাজ করতে হবে।”
“ওকে,রাজি।”
এদের ও কাজে পাঠিয়ে দিল রিসান। রিয়া চোখ ছোট করে ফেলল।
“এই যে মিস্টার।”
থামল রিসান। রিয়া ওঠে এসে ওর বরাবর দাঁড়াল।
“সবাইকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন তাই না?”
“হুম।”
ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর এল। ছেলেটার এই স্বীকারোক্তি মানতে কষ্ট হচ্ছে রিয়ার। ও নাক ফুলিয়ে রইল।
“সবাইকে সরিয়ে দিলেন, এখন আমি আপনার পেছন পেছন ঘুরঘুর করব। দেখি কী করতে পারেন।”
সত্যিই তেমনটা হলো। রিসান যেখানে যাচ্ছে রিয়াও সেখানে যাচ্ছে। যেভাবে অঙ্গ ভঙ্গি করছে ঠিক তেমনটাই করছে ও। সাধারণভাবেই বিষয়টি বিরক্ত করে তুলল রিসানকে। ও এগিয়ে এসে মেয়েটির চুল টেনে ধরল।
“আর একবার এমন করলে একদম পানিতে ফেলে দিব।”
“আমি সাঁতার জানি।”
“আচ্ছা, ফেলি তবে?”
“এই না।”
কথাটি বলেই ধাক্কাল রিয়া। রিসান কিন্তু ছাড়ল না। বরং কিছুটা কাছে টেনে নিল। ওর উত্তপ্ত নিশ্বাস মেয়েটির মুখে পড়তে শুরু করেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটার পূর্বেই রিয়া আটকে দিল। রিসান ও অপ্রস্তুত বোধ করল। ছোট করে বলল,”সরি।”
চলবে…