#এসো_রূপকথায়
#কলমে_ফাতেমা_তুজ_নৌশি
#পর্ব:৭
বেশ কিছু মাস পেরিয়ে গেছে। মেহনূরের বেড়াতে আসার কথা। জাহিদ ব্যবসায়িক কাজে দেশের বাইরে। তাই রিসান দিতে এসেছে। মেহনূরকে দেখে বুকের ভেতরে থাকা সকল অনুভূতি বেরিয়ে এল রিয়ার। জড়িয়ে ধরল দু হাতে।
“আপা, কত দিন পর তোকে দেখছি।”
“পাগল মেয়ে। রাস্তাতেই শুরু করে দিলি।”
কথার মাঝেই চোখ গেলে গাড়ির দিকে। চোখে সানগ্লাস পরা পুরুষটিকে দেখতে পেয়ে কোথাও একটা য ন্ত্র ণা অনুভব হলো। চোখ নামিয়ে নিল কন্যাটি।
“ভাইয়া, বাসায় আসেন।”
“সময় নেই মেহনূর।”
“এটা বললে হয় নাকি। মা রাগ করবেন।”
রিসান আরো কিছু বুঝ দিচ্ছিল। সে সময়েই ফাহমিদাকে দেখা গেল। ভদ্রমহিলা আসাতে যেতে হলো রিসান কে। কিছুটা দূরত্ব রেখে হাঁটছে রিসান আর রিয়া। কোনো কথা বলছে না। অথচ ভেতরে ভেতরে দুজন ই চায় কথা বলতে। তবে অভিমানের পাল্লা যে বড্ড ভারী।
টেবিলে চা রাখতেই ফোন থেকে নজর ঘুরিয়ে চাইল রিসান। থমথমে মুখশ্রীতে রিয়া বলল,”মা দুপুরে খেয়ে যেতে বলেছে।”
“সময় কম।”
“সেটা মায়ের সাথে বুঝবেন।”
রিসান চুপ করে গেল। রিয়া পুনরায় খাবার নিয়ে এল। রাখল টেবিলে। সেই সময়টায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিসান। স্বাভাবিক ভাবেই রিয়ার অস্বস্তি হচ্ছে।
“এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?”
“দেখছি।”
“কী?”
“কত বড়ো হয়ে গেছ।”
“কথাটি ভুল। আমাদের তিন মাস আগেও দেখা হয়েছে। আর তিন মাসে কেউ বড়ো হয় না।”
মৃদু হাসিতে অধর রাঙাল রিসান। রিয়া পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দিল।
“কথা ছিল আর কখনো তোমার সামনে আসব না। অথচ আসতেই হলো।”
“আসলেন কেন? আপনার গার্লফ্রেন্ড’রা সব চলে গেল নাকি?”
বাক্যটিতে খোঁচা অনুভব করে রিসান। গত তিন মাসে ব্যবসায়িক কাজে নানান জায়গায় আসা যাওয়া করতে হয়েছে। সেখানে অনেক মেয়েরা ও ছিল। সেসব ছবি নানান ক্ষেত্রে পোস্ট ও করেছে। সেই জন্যেই কথাটি বলেছে রিয়া। বিষয়টি ভেবে দীঘল শ্বাস ফেলল রিসান।
“আমরা চাইলেই সব ঠিক হতে পারে রিয়া।”
“পারে না। আমরা দুই পৃথিবীর মানুষ। আপনি খুব হাই প্রোফাইলের,আমি সাধারণ একজন। আপনার গার্লফ্রেন্ড হওয়ার যোগ্যতা ও নেই আমার।”
কথাটিতে কান্না মিশে আছে। অথচ মেয়েটির চোখে এক বিন্দু জল নেই।
“চা ঠান্ডা হচ্ছে।”
খেয়াল হলো রিসানের। ও চা কাপে চুমুক বসাল।
“এটা খুবই সাধারণ বিষয় রিয়া। আমার গার্লফ্রেন্ড থাকাকালীন আমি তোমায় কেমন করে এক্সসেপ্ট করতাম? সেই সময়ে আমি অন্য একটি সম্পর্কে ছিলাম।”
“এখন কেন চাইছেন আমরা এক হই?”
“কারণ সময় বদলেছে। তখন তুমি সবে ক্লাস নাইনে ছিলে। আর এখন ভার্সিটিতে পড়ছ। আমাদের উভয়ের জীবনে পরিবর্তন এসেছে।”
“একদম। আমাদের উভয়ের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। সেই সময়ে আমি আপনাকে চাইতাম। এখন চাই না।”
“কেন চাও না?”
“কারণ নিশ্চয়ই আমি আপনার জীবনে অপশন ছিলাম। চয়েজ নয়।”
“তুমি আবার ভুল বুঝলে।”
“আমি সর্বদা ভুল ই বুঝি রিসান। আমি কখনো কারো অপশন হতে চাই নি। এটি খুব দুঃখের। আপনি বুঝবেন না। পা ষা ন কোথাকার।”
রিসান করুণ চোখে তাকাল। মেয়েটি সহজ বিষয়টা কঠিন করে তুলেছে। মৃদু শব্দ করে ওঠে পড়ল রিয়া। এই পুরুষটি তাকে দয়া করতে চায়? সে দয়া নিবে না। সব এতটাও সহজ নয়।
দুদিন বাদেই মেহনূরকে নিতে এল জাহিদ। ঠিক হলো রিয়া ও সাথে যাবে। যাওয়ার পথে দুজনের দূরত্ব চোখে পড়ল রিয়ার। ও প্রশ্ন তুলল,”তোরা দুজন আপসেট হয়ে আছিস?”
মেহনূর ঘাবড়ে গেল যেন। কিছু লুকানোর মতন করে বলল,”না। কেন বল তো?”
“দুজনের মাঝে স্বাভাবিক ভাবটা বজায় নেই।”
এবার জাহিদ বলল,”তোমার বোনের সাথে ঝগড়া হয়েছে।”
বিস্মিত নয়নে তাকাল মেহনূর। তাদের ঝগড়া হলো কখন?
“সে কি, ঝগড়া কেন হলো?”
“এই যে,আমি ব্যস্ত থাকি। সময় দিতে পারি না। এবার লং ছুটি পেয়েছি।”
কথাটি বলতেই রিয়া হাসল। ও শুধু চায় আপা খুশি থাকুক। খুব খুশি।
সেদিন ও রাত করে ফিরল রিসান। রিয়া তখন সানার সাথে বসে গল্প করছে। হাতে ব্লেজার ঝুলিয়ে ঘরে প্রবেশ করল পুরুষটি। সুবাসটি নাকে যেতেই রিয়ার মন চনমনে হয়ে ওঠল।
“ভাই, আজ ও লেট করলি?”
“হুম লেট হলো। সবাই ঘুমিয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ। আমি আর রিয়া জেগে।”
রিয়া নাম শুনেও তাকাল না রিসান। সানা ওঠে এসে খাবার বাড়তে লাগল। পেছন পেছন এল রিয়া ও। হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে।
“তুমি অতিথি হয়ে কাজ করছ!”
“তাতে কী?”
“সেটা কিছু না। তবে অতিথিকে দিয়ে কাজ,কেমন লাগবে না?”
অবচেতনেই রিয়া বলে ফেলল,”আমি তো বাড়ির অংশই আপু।”
অস্পষ্ট সুর হওয়ায় বুঝল না সানা। তাই প্রশ্ন ছুড়ল,”কী বললে?”
কিছুটা ভয় পেয়ে গেল রিয়া। অদ্ভুত তার মন। এখনো এই বাড়ির অংশ হওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে আছে! অথচ মস্তিষ্ক ভিন্ন কথা বলে। মৃদু হাসিতে অধর রাঙানোর চেষ্টা করল ও।
“কিছু না তো।”
“আচ্ছা। চলো আমরা মুভি দেখি।”
“হুম।”
ওরা মুভি দেখতে গেল। রিসান ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার খেতে যাচ্ছে। রিয়ার সাথে চোখাচোখি হলো তবে কোনো বাক্য বিনময় ই হলো না। যেন দুটি মানুষ পুরোই অপরিচিত।
বেলা করে ঘুম ভাঙল রিয়ার। ওঠে এসে দেখল আয়োজনে পরিপূর্ণ পুরো বাসা। অতিথি’রা ভীড় জমিয়েছে। রিয়া কিছুই বুঝল না। রুবাই ফুল নিয়ে যাচ্ছিল। ওকে ডেকে নিল রিয়া।
“এই রুবাই, কোনো অনুষ্ঠান আছে বাসায়?”
“হ্যাঁ। তুমি জানো না?”
“না। কী অনুষ্ঠান?”
“সানা আপু কে দেখতে আসবে।”
“ও আচ্ছা।”
রুবাই চলে গেল। চুল গুছিয়ে নিয়ে সানার ঘরে এল রিয়া। মেয়েটি তার মায়ের সাথে কথায় ব্যস্ত। তাই ঘরে প্রবেশ করল না। তবে থেমে গেল কথা গুলো শুনে।
“মা এটা কোন ধরনের লজিক বলতে পারো?”
“এটা আমাদের ঐতিহ্য সানা।”
“কেমন ঐতিহ্য এটা! আমি এই বিয়েটা করতে পারব না।”
“আচ্ছা, কোরো না বিয়ে। দরকার হলে অন্য ছেলে দেখানো হবে।”
“সেই তো এক বংশের ছেলেই দেখানো হবে মা।”
“সেটাই কী স্বাভাবিক না?”
“মোটেও স্বাভাবিক না। আমার ভালো লাগছে না কিছু। এটা কেমন নিয়ম! কে তৈরি করেছে!”
আলিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,”নিয়ম তো নিয়ম ই হয় তাই না? এমন তো নয় তোমায় জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে। তুমি তোমার পছন্দ বহাল রাখতেই পারো। শুধু বংশটা এক হতে হবে।”
সানা চুপ হয়ে গেল। আলিয়া মেয়ের কপালে চুম্বন করলেন। রিয়া দ্রুত আড়াল হয়ে গেল। ওর সমস্ত শরীরে একটা শিরশির অনুভূতি এসে খেলা করছে। কথা গুলো তখনো বুঝল না ও।
স্বাভাবিক ভাবেই পাত্র রিজেক্ট করল সানা। ছেলেটার মাঝে কোনো খামতি নেই অথচ রিজেক্ট করল সে। এই নিয়ে সকলে বেশ একটা ঝামেলা ও তৈরি করল। রিয়া তখনো বিষয় গুলো বুঝে নি। নিজের ঘরে বসে কাঁদছিল সানা। রিয়া দরজায় টোকা দিতেই সচিত হলো।
“কে?”
“আমি।”
“ও আসো।”
সানা চোখের জল মুছে নিল। তবে হাসিতে অধর রাঙানোর চেষ্টাটা করল না। রিয়া বুঝল কোথাও একটা সমস্যা রয়েছে।
“আপু।”
“হুম।”
“কোনো সমস্যা?”
“তেমনটি নয়।”
“তোমার কাউকে ভালো লাগে?”
“সেটাও নয়।”
“তবে?”
সানা পূর্ণ দৃষ্টি ফেলল এবার। রিয়া একটু অসহায় হয়ে বলল,”সরি। পারিবারিক বিষয়ে প্রশ্ন করার জন্য।”
“সমস্যা নেই। আসলে আমার কপাল ই খারাপ। নাহলে এই বংশে জন্ম হতো না।”
কথাটি বলেই কান্নায় ভে ঙে পড়ল সানা। রিয়ার খারাপ লাগল। ভরসা দিতে বাহুতে স্পর্শ করল।
“তোমার পছন্দ থাকলে তাদের বলো। তারা নিশ্চয়ই বুঝবে।”
সানার বড়ো হাসি পেল। ও চোখের জল টুকু পুনরায় হাতে মুছে নিল। ব্যথার মুখশ্রীতে হাসি ফুটিয়ে বলল,”অদ্ভুত নিয়ম তৈরি করেছে এরা। বংশের বাইরে কেউ বিয়ে করতে পারবে না। জানি না কোন রাজকার্য হাসিল হবে এতে। এসবের কোনো মানে হয় বলো?”
রিয়া থমকাল। বিষয়টি বুঝতে সময় লাগল ওর। পরমুহূর্তেই বুকের মাঝ বরাবর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। সানার রুম থেকে বের হতেই রিসানের মুখোমুখি হলো। মেয়েটার ক্রন্দনরত মুখ।
“কী হয়েছে?”
রিয়া উত্তর দিল না। বরং সরতে চাইল। রিসান ওর হাতটি আগলে নিল।
“চোখে পানি কেন?”
পুরুষটিকে দু চোখ ভরে দেখে নিল রিয়া। একটা মানুষ এতটা মিথ্যুক হয় কী করে?
“আমার চোখে আপনি আবার ও খারাপ হয়ে গেলেন রিসান।”
“সর্বদা তোমার চোখে খারাপ ই ছিলাম। বলো কী হয়েছে?”
“আপনাদের পরিবারের নিয়ম, একই বংশে বিয়ে করতে হবে। তাই না?”
বড়ো একটা ধাক্কা খেল রিসান। তবে উত্তর করল না। পুরুষটির কলার চেপে ধরল রিয়া।
“কথা বলেন। বলেন না কেন? আপনি তো আমায় বিয়ে করতেই পারবেন না। তবে কেন, কেন বার বার আসেন আমার জীবনে?”
এবার ও নিশ্চুপ রিসান। তবে ভেতরটা ভীষণ ছটফট করছে। এদিকে অনবরত কাঁদছে রিয়া। কলার ছেড়ে দিয়ে যে ই না বের হবে ওমনি মনে পড়ল মেহনূরের কথা। ওর সমস্ত শরীর আন্দোলিত হলো। পুরোটাই যেন ঘেটে যাচ্ছে। হৃদয়ে একটাই প্রশ্ন এল। কেমন করে আপার বিয়েটা হলো?
চলবে…..