#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৫৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
শাড়িটা পেঁচিয়ে আকাশে তাকালো মেহনূর। টুপটুপ করে চুল নিঃসৃত পানি ফ্লোরে পরছে। তার উদাস দৃষ্টিদুটো মলিন আকাশে নিবদ্ধ। বাইরের আবহাওয়া আজ গুমোটপূর্ণ। চারধার কেমন ভুতুড়ে ভঙ্গিতে নিঃশব্দ হয়ে আছে, যেনো ভয়ংকর কিছু ধেয়ে আসার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি চালাচ্ছে। পুরো নীল আকাশটা কালো রঙে আক্রান্ত, যেনো বিশাল-বিশাল কালো মেঘেরা দিনের আলোটা গোগ্রাসে গিলে ফেলেছে। কোথাও কোনো আলো নেই, সন্ধ্যে নামা মূহুর্তের মতো সময় থমকে আছে। একটু আগে গোসল করে রুমে ফিরেছে মেহনূর। সকাল সাতটা বাজলেও সেটা বৈরি আবহাওয়ার জন্য বোঝা যাচ্ছে না। মাহতিম রুমে নেই, সে পরিপাটি হয়ে নাস্তার আসরে চলে গেছে। সালেহের মৃত্যুর সংবাদ শুনেও ভড়কায়নি লোকটা। এতো শক্ত মানুষ দেখেনি মেহনূর। মানুষ এতো কঠিন হয়? কিভাবে হয়? নিজের ছোট ভাই যেদিন মারা গেলো, সেদিনও তাকে ভড়কাতে দেখেনি। চুপচাপ দাফনকার্য শেষ করে ফিল্ডে ফিরে গেছে, যেনো মামুলি ঘটনায় উত্তেজিত হতে নেই। পিঠের ব্যান্ডেজটা খুলে দিলেও ক্ষতের মুখটা এখনো লাল হয়ে আছে, পুরো জায়গাটা উঁচুস্তম্ভের মতো ফুলে শেষ। যন্ত্রণাদায়ক ব্যথাটা হয়তো এখনো সহ্য করছে, কিন্তু চেহারা দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না। হাসি দিয়ে কথা বলাটা তার অদ্ভুত গুণ, পুরো অদম্য ব্যক্তিত্বটা হাসির মধ্যেই লুকায়িত। মাহতিম কিসের মিশনে এসেছে এ ব্যাপারে কিচ্ছু জানায়নি। গতরাতটা ছিলো সুন্দর, মাহতিমের ছোঁয়ায়-মায়ায় সময়ের গণ্ডি কিভাবে পেরিয়ে গেছে জানা নেই। মেহনূর শুধু এটুকু জানে, মানুষটা তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। হয়তো সেটা পাগলের মতোই। নয়তো ঘুমের ঘোরেও বিড়বিড় করে ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা উচ্চারণ করতো না। দরজায় ঠকঠক শব্দ হলে ধ্যান ভাঙে মেহনূরের, আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পিছু তাকায় সে। দরজার কাছে নীল শাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে সুরাইয়া, চোখ শক্ত, মুখ গম্ভীর। মেহনূর সৌজন্যতা দেখিয়ে রুমে আসতে বললে সুরাইয়া দেমাকী ভঙ্গিতে ঢুকলো। অহংকারে পা মাটিতে পরে না এমন কান্ড। মেহনূরের সামনে এসে শক্ত চোখে বললো,
– এখান থেকে ফুটবি কবে? বেহায়ার মতো এতোদিন ধরে বাপের বাড়িতে পরে আছিস লজ্জা করে না? আমারই তো তোর ঘটনা দেখে লজ্জা করছে। বর নিয়ে এখানেই সংসার পাতবি? যাবি না?
আশ্চর্য হয়ে গেলো মেহনূর। ভ্রুঁ কুঁচকে শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
– আমার থাকাথাকি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে কেনো? আমি তো কোনো ঝামেলা সৃষ্টি করছিনা।
সুরাইয়া দাঁত কটমট করে চোখ পাকিয়ে তাকালো। ফর্সা গালে ঠাস করে চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে। শহরের হাওয়া-বাতাস খেয়ে একেবারে বখে গেছে। কুঁচকানো ঠোঁটটা স্বাভাবিক করে গজগজ রাগে বললো,
– তোর জামাই নিয়ে বিদেয় হ! তোর চেহারা দেখলেই থুথু মারতে ইচ্ছে করে। যেভাবে নাটক করে বিয়েটা করলি, সারা গ্রামে এখনো মুখ দেখাতে পারিনা।
মেহনূর পালটা জবাব দিতে গিয়ে হঠাৎ কিছু একটা দেখে থেমে গেলো। চোখদুটো ফ্লোরে রাখতেই সুরাইয়া একটু অবাক হলো। হঠাৎ এই বেহায়াটা চোখ নামালো কেন? কৌতুহলের বশে মাথা পিছু ঘুরালো সুরাইয়া, তৎক্ষণাৎ চরম ভয়ে কেঁপে উঠলো সে। একজোড়া তীক্ষ্মদৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেনো এখুনি চোখ দিয়ে হামলা করার আকাঙ্ক্ষা! সুরাইয়া থতমত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে রুমে নিরব পায়ে ঢুকলো মাহতিম, গায়ে হান্নান শেখের ঘিয়ে রঙের পান্ঞ্জাবী পরা। পাণ্ঞ্জাবীটা ফিটিং বলে হাতের পেশিগুলো ফুলেফেঁপে আছে, বুকের উপর আঁটসাঁট ভাব। হাতের স্লিভগুলো সযতনে কনুইয়ের ভাঁজে গুটানো। মাহতিমকে দেখে কটু কথার জন্য ভীত হলো সুরাইয়া। সেদিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টি না দিয়ে মেহনূরের জবুথবু মুখের দিকে তাকালো মাহতিম। হাতদুটো বুকের কাঁছে ভাঁজ করতে-করতে আদেশের সুরে বললো,
– ওকে কষে দুটো চড় লাগাও।
প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি তুলে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর, এদিকে সুরাইয়া পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মেহনূরকে আবারও শঠতা গলায় আদেশ করলো মাহতিম,
– ওকে চড় লাগাতে বলেছি!
কন্ঠের তেজে দু’বোনই গা কাঁপিয়ে শিউরে উঠলো। মেহনূর প্রচণ্ড ভীতগ্রস্ত হলেও সুরাইয়ার দশা একদম কাঁদো-কাঁদো। মেহনূর ঢোক গিলে ডানহাত তুলতেই ঝট করে আবার নামিয়ে ফেললো। যতই হোক, মাসখানিকের জন্য হলেও সুরাইয়া ওর বড়। বড়দের গায়ে হাত তোলার নিয়ম নেই, আবার স্বামীর কথাও অমান্য করার অবস্থা নেই। করুণচোখে মাহতিমের দিকে তাকালো সে, মাহতিম কোনো সহানুভূতি দেখালো না। উলটো বাঁ ভ্রু-টা উঁচু করে কঠোর ভঙ্গিতে বললো,
– তুমি কি আমার অবাধ্য হতে চাইছো?
সাথে-সাথে পাগলের মতো ডানে-বামে মাথা নাড়ালো মেহনূর। একবার সুরাইয়ার ছলছল মুখের দিকে তাকালো, আরেকবার চোখ ঘুরিয়ে মাহতিমের শক্ত মুখটা দেখলো। নিরুপায় হয়ে মাহতিমের কাছে গেলো সে, মাহতিমের কনুইটা ছুঁয়ে চোখের দিকে তাকালো। ইশারায় যেনো বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘ এবারের জন্য ছেড়ে দিন, আমি চড় মারতে পারবো না, আমাকে মাফ করুন ‘। রাগে-ক্ষোভে-জেদে এক ঝটকা দিয়ে মেহনূরের হাতটা সরিয়ে দিলো মাহতিম। রাগে ফুসফুস করে নিশ্বাস নিতেই সুরাইয়ার দিকে একপলক তাকালো সে, জোরালো কন্ঠে বললো,
– এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যাও!
সিংহের থাবা থেকে মুক্ত ইঁদুর যেভাবে চালায়, সেভাবেই পা ছুটিয়ে পালালো সুরাইয়া। ধপ-ধপ পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেও কান্নার অস্ফুট আওয়াজটা মেহনূর শুনতে পেলো। সুরাইয়া ভালোই ভয় পেয়েছে, ভাগ্যিস চড়টা মাহতিম লাগায়নি। থাবার মতো হাতে থাবড়া খেলে জান বেরিয়ে যেতো। মাহতিম হাতদুটো আলগা করে সশব্দে রাগী নিশ্বাস ছাড়লো, মেহনূরকে অগ্রাহ্য করে বিছানা থেকে ফোন উঠালো। কাউকে কল করতেই বিছানায় বসলো মাহতিম। জরুরী কলটা রিসিভ হতেই কথা শুরু করলো। মেহনূর অভাগার মতো তাকিয়ে থেকে শেষমেশ কাছে আসতে নিলো। হাত উঠিয়ে বাধা দিলো মাহতিম, দাম্ভিকতার সাথে এক তুড়ি বাজিয়ে দরজা দিকে তর্জনী তাক করলো। অসহায়ের মতো তর্জনী ধরে-ধরে খোলা দরজায় দৃষ্টি দিলো মেহনূর, নিজের অপারগের জন্য মাহতিম তাকেও বেরিয়ে যেতে বলছে। তর্জনীটার কাছে নত স্বীকার করে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো মেহনূর, দরজার বাইইরে দু’পা ফেলতেই পেছন থেকে ধড়াস করে দরজা বন্ধ হলো। আর পিছু ফিরে তাকালো না মেহনূর, দোষটা নিজের ভেবে একপা-একপা করে চলে যেতে লাগলো। রাগের চোটে দরজাও বন্ধ করলেন? মনে-মনে প্রশ্নটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই মনক্ষুণ্ণ হলো মেহনূর। ভাবনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো।
.
খুবই সংযত কন্ঠে বলে উঠলো,
– স্যার, সালেহের ডেডবডি কি করবো? পাঠাবো, না রাখবো? ওর ফ্যামিলি এখনো জানে না। ব্যাপারটা কি করবো?
মাহতিম কিছু একটা ভেবে সেকেন্ডের ভেতর উত্তর দিলো,
– হেড অফিস থেকে আপডেট না পেলে আমি কিছুই করতে পারবো না। টিম কি রেডি?
চটপট উত্তর দিলো,
– জ্বী, স্যার রেডি। আপনি যেভাবে প্ল্যান বুঝিয়েছেন, সেখানে অল রেডি। স্যার, আপনি যদি একবার মেডিকেল চেকআপ করিয়ে নিতেন তাহলে ভালো হতো। আপনার ইন্ঞ্জুরিটা কোন স্টেজে আছে জানা যেতো।
মাহতিম সাথে-সাথে উত্তর দিলো,
– নাথিং সিরিয়াস। আমি ঠিক আছি। কোনো টেনশন নেই। আপাতত মেডিকেল চেকআপ লাগবে না। টিম রেডি করো। যেই-যেই সেক্টর আর পয়েন্টে মার্কিং করে দিয়েছি, সেখানে মানুষ পাঠাও।
জুনিয়র কর্মকর্তা সোহেল হতাশার নিশ্বাস ফেললো। লিডার ইন্ঞ্জুর্ড হয়ে আছে, অথচ মেডিকেল ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে না। ক্ষুরের আঘাতে যদি এক ইন্ঞ্চিও ডেবে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ ট্রিটমেন্ট ছাড়াই চিৎকার করে হাহাকার করতো। পুরো ডিপার্টমেন্ট তাকে বাঘের মতো ভয় পায়। ‘ ভালোর সাথে ভালো, খারাপের সাথে জঘন্য ‘ এই নীতিতে চলে বেড়ায়। মাহতিম কলটা রেখে দিলো, যা-যা বুঝানো দরকার সবই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাতে সময় কম! তাদের হাতে ইনফরমেশন এসেছে, আজ বা কাল বিরাট একটা অংশ পাচার করা হবে। সেখানে নারী-শিশু-যুবক তিনটা দলই বিদ্যমান। নারীদের বাইরে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, শিশুদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ হরণের চিন্তা সাজিয়ে রেখেছে, যুবকদের ভয় দেখিয়ে নানা নৃশংস কর্ম সাধনের চিন্তা করেছে। ড্রাগসের একটা বিশাল অংশও এতে যুক্ত আছে। পুরো ঘটনায় জড়িতদের এখনো ধরা যায়নি, কিন্তু একটি নেটওয়ার্কের সূত্র পেয়েছে মাহতিম। এখন সেটাই গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য মোল্লাবাড়িতে এসেছে সে। তার ধারণা হান্নান শেখ ওরফে কালার সরদার তার ব্যাপারে সবটাই জেনে গেছে, গতকাল হয়তো ধরে ফেলেছে মাহতিম মরেনি। তার মন বলছে হান্নান শেখ বিভৎস কিছুর পরিকল্পনার জন্য রাতে বাড়ি ফিরেনি। রুমের ভেতর পায়চারী করতে-করতে অনেক কিছুই চিন্তা করলো। প্রথমে এ বাড়ির সবাইকে অন্যত্র পাঠাতে হবে। এটার জন্য যোগ্য জায়গা ওই গ্রাম্য রেসোর্ট! এটাই সবচেয়ে বেটার অপশন। ইয়েস! ওখানে নিরাপত্তার ব্যাপারটা জোরদার রাখতে হবে, যেনো ভুল করেও ফাঁকফোঁকর ডিঙিয়ে জাল না ঢুকে। তারপর এই বাড়িটা খালি হয়ে গেলে একটা সশস্ত টিমকে রেডি থাকতে বলবে, যখনই হান্নান শেখ বাড়ির চৌকাঠায় পা ফেলবে তখনই এ্যাকশন! পায়চারী বন্ধ করে পা থামালো মাহতিম, চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস নিলো। আজকের এই অপারেশন খুবই স্মার্টলি হ্যান্ডেল করতে হবে, একটুও অসতর্কতা এখানে কাম্য না। শরীরটা ফিট না হলেও মাইন্ড পুরোপুরি এক্টিভ আছে। দীর্ঘদিনের ফেরারি জীব এবার মুঠোর মধ্যে এসে যাবে। ভাবতে গেলেই গা-টা উত্তেজনায় ফেটে পরছে।
অচেনা মেয়ের শাড়ি পরার দৃশ্য দেখে লজ্জিত ছিলো মাহতিম। লজ্জায় নাস্তানাবুদ হয়ে নিজেই নিজেকে গালিগালাজ করলো। নিজের ভুলটা বড্ড বেশি ছিলো বলে রাতটা স্বস্তিতে কাটেনি। পরদিন সকালে শুনতে পেলো মেয়েটার অবস্থা করুণ! রাতে নাকি একশো চার ডিগ্রী পযর্ন্ত জ্বর উঠে গেছে। নিজেকে ধিক্কার দিতে-দিতে রুম থেকে বেরিয়েছিলো মাহতিম। অনুশোচনায় বিদ্ধ হয়ে কখন যে লাইব্রেরি কক্ষে পৌঁছে গেলো বুঝতে পারেনি। দরজাটা ফাঁক দেখে ঢুকেছিলো সে। সেখানে পুরোনো আলমারি পাশাপাশি বইয়ের ভাণ্ডার দেখে আশ্চর্য হয়েছিলো। একটা শেল্ফের কাছে গিয়ে বই নাড়াচাড়া করতেই হঠাৎ অদ্ভুত একটা জিনিস পেলো। উঁচু শেল্ফটার সবচেয়ে উপরের তাকটায় কিছু একটা রাখা। বস্তুটা দেখার পর চিনতে সময় লাগলো না, সাথে-সাথে এক থাবায় ওটা হাতের মুঠোয় নিলো। ভ্রুঁ কুঁচকে জিনিসটা দেখতেই বুকের ভেতর ধুকপুক অনুভব করলো। এটা মামুলি বস্তু না, এটা বিদেশ থেকে আমদানি করা খাস রেফারেন্সের রিভলবার। এসব জিনিস একমাত্র তাদের সাথেই থাকে, যারা দুষ্কৃতির সাথে জড়িত। রিভলবারটা চেক দিয়ে আগের জায়গায় রাখলো। মনের প্রথম খটকাটা না মিটতেই দ্বিতীয় খটকাটা দেখতে পেলো। এবার আর শান্ত রইলো না মাহতিম, রহস্যের ধোয়াটা হাতড়ে-হাতড়ে কাটিয়ে ফেললো। সারি-সারি বইয়ের ফাঁকে একটা পুরোনো টেবিল ক্যালেন্ডার রাখা, একটা তারিখের উপর গোল মার্ক করা। ছোট-ছোট চোখে কপালে ভাঁজ ফেলে সংখ্যাটার দিকে তাকালো মাহতিম। কয়েক মিনিট চুপচাপ একদম স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো, এরপরই আচমকা কপালের ভাঁজগুলো স্বাভাবিক হলো তার। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটতেই ক্যালেন্ডারটা হাতে নিলো, বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে সংখ্যাটার উপর ছুঁয়ে দিতেই পলাতক আসামীর কথা এ-টু-জেড মনে পরলো। জীবনের গরল মোড়টা এভাবে বাক ভাবতে পারেনি। যাকে তন্নতন্ন করে গোটা শহর খুঁজেছে, সেই আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি গ্রামের একজন গণ্যমান্য মানুষ। কতটা হাস্যকর ব্যাপার! একদিকে মানুষ পাচার, অস্ত্রের চোরাচালান, ড্রাগসের সওদাগিরি সবই করে, অন্যদিকে লুকিয়ে-লুকিয়ে গ্রামে এসে অন্যরূপে সেজে আছে। মানুষ যে দুনিয়ার সবচেয়ে চতুর জীব, এটাই সাক্ষাৎ প্রমাণ। ক্যালেন্ডারটা রেখে শার্লক হোমসের বইটায় পেলো আরেকটা ক্লু। সেখানে হার্ডকভারের শেষ পৃষ্ঠায় নীল কালিতে কিছু লিখে রেখেছে। ইংরেজি বর্ণমালায় শর্টকাটে লিখা, ‘ K S ZILL ‘ . সব রহস্য পানির মতো ঝরে পরলো, ‘ কালাম সরদার ঝিলতলা ‘ এটাই বুঝা যাচ্ছিলো। ওইদিন লাইব্রেরি কক্ষে বিশ্বজয়ীর হাসিটা দিতেই কানে মেয়েলি সুর বাজলো,
– দাদাভাই, আমি লজ্জার মাথা খেয়ে আজ বাধ্য হয়ে কিছু বলতে এসেছি। আমি কখনো চাইনি তোমার কোনো অপমান হোক। কিন্তু তোমার যেই বন্ধুর মেয়ে এখানে এসেছে, তার বড় ছেলেটা খুবই জঘন্য কাজ করেছে। আমি এসব একদমই সহ্য করতে পারিনা দাদাভাই। ওই লোকটার নাম সম্ভবত মাহতিম! লোকটা যা কাজ করেছে আমি এগুলো নিতে পারিনা! তুমিতো জানো, আমি তোমার কাছে কিছুই লুকাইনি, আজও লুকাবো না। সেদিন সবাই লিয়াকত কাকার বাড়িতে যখন গেলো, তখন ওই লোক ইচ্ছে করে আমার রুমে এসেছিলো। আমি গোসল করে শাড়ি পরছিলাম আর ওই লোক তখন,
হঠাৎ দরজায় ‘ টুকটুক ‘ করে আওয়াজ হলো। সমস্ত ধ্যান ভেঙ্গে বাস্তবে ফিরলো মাহতিম। দরজার দিকে চোখ যেতেই আবার শব্দটা শুনলো। ফোনটা বিছানায় রেখে দরজাটা খুলে দিলো। দরজার দুই পাল্লা ধরে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে দেখলো সে, কিছুটা ঝাঁঝ মাখানো কন্ঠে বললো,
– অপমান করে শান্তি পাওনি? কি চাও?
কথা শুনে মেহনূর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চোখ তুলে মাহতিমের দিকে তাকাতেই আস্তে করে বললো,
– সময়। আপাতত সময়ই চাচ্ছি। দিবেন?
দুই মিনিট ভাবলো মাহতিম, এরপর নিজেই দরজা ছেড়ে মেহনূরকে ঢুকতে দিলো। মেহনূর ঘরে ঢুকলে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসলো। মেহনূর দরজাটা আঁটকে দিয়ে মাহতিমের কাছে আসলো। ওর পরিস্থিতিটা বুঝার আগেই প্রশ্ন করলো মাহতিম,
– বলো, কি বলতে চাও বলো।
প্রশ্ন শুনে নিরব মুখে কাছে আসলো মেহনূর। কোনোদিকে না তাকিয়ে মাহতিমকে চরম আশ্চর্য করে তার কোলে বসলো সে। মাহতিমের অবাক হওয়া দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে তার বুকটার আস্তানায় চলে এলো, পরম উষ্ণতায় নিজেকে জড়িয়ে নিলো সে। নিঃসঙ্কোচে দুহাত বাড়িয়ে মাহতিমের গলা পেঁচিয়ে ধরলো। চওড়া কাধটায় গাল লাগিয়ে চোখ বন্ধ করলো মেহনূর, নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
– রাগটা ঝেড়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন। কালরাতের মাহতিমটার মতো একটু আদর করে দিন। আবার কতোদিন পর আসবেন তাতো জানি না। রেগেমেগে এভাবে দরজা আঁটকে থাকলে চলবে? যতটুকু সময় আছে, সেখান থেকে একটু আমাকে দিয়ে যান।
নির্বাক মাহতিম কয়েক মূহুর্তের জন্য পিছলে গেলো। তার ভেতরে অনুভূতির জায়গায় প্রচণ্ড অনুকম্পা হচ্ছে। আসলেই তো সময় নেই। একটা ঘন্টার ভেতর সবাইকে রেসোর্টে পৌঁছানোর কাজ করতে হবে। মোল্লাবাড়িতে নজরদারির পাশাপাশি গোপন আস্তানাগুলোর উচ্ছেদ করতে হবে। তিন-তিনটা নৃশংস অভিযান পণ্ড করতে হবে। যদি বুলেটের একটা গুলি ব্রেনে বা হার্টে ঢুকে? তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর দৃশ্যটা কল্পনা করতেই জড়িয়ে ধরলো মাহতিম। শক্ত করে দুহাতের বন্ধন কঠোর করে মেহনূরকে বুকে চাপলো। চোখ বন্ধ করে আরো কঠোর করলে তুলোর মতো দেহটা বুকের মধ্যে যেন ঢুকে যেতে লাগলো। আদুরে মুখটা নাগাল না পেলেও ডানে মুখ বাড়িয়ে চুলে ঠোঁট রাখলো। সদ্য স্নান শেষে লাবণ্যময়ী দেহটাকে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে মিলিয়ে-জড়িয়ে শান্ত হলো মাহতিম। বাঁ-হাতটা মেহনূরের মাথায় রেখে চুলের চামড়া স্পর্শ করলো, আঙ্গুলে-আঙ্গুলে নম্রভাবে বুলিয়ে দিতেই শান্ত গলায় বললো,
– একা-একা সামলাতে পারবে তো?
মেহনূর নাছোড়বান্দার ভঙ্গিতে বললো,
– পারবো না। পারতেও চাই না। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন।
হাসলো মাহতিম। প্রশ্ন করলো,
– কেনো? মেয়েরা তো বাবার বাড়িকে সবকিছু মানে। তাহলে আজ এই আবদার কেনো? তোমার তো খুশী হওয়া উচিত।
মেহনূর একটু চুপ থাকার পর মাথা তুলে তাকালো। মাহতিমের দিকে ফ্যালফ্যাল তাকাতেই মলিন হাসিতে বললো,
– আমার তো পোড়া কপাল, বাবার বাড়িতে বাবাই নেই।
ডান চোখ গলে টপ করে একফোঁটা পানি ঝরলো। ঠোঁটে এখনো মলিন হাসিটা ঝুলছে। দৃষ্টি নিচু করে রাখলে ওর ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো মাহতিম। মেহনূরের চিবুকে হাত রেখে প্রসন্ন দৃষ্টিতে বললো,
– আমি যতোদিন আছি, তোমার কোনোকিছুতে কমতি রাখবো না। আমি ম-রলেও তোমার ভয় নেই। মাহদির নামে যেই প্লটটা ছিলো ওটা তোমার নামে করে দিয়েছি। ফাইনেন্সিয়াল সমস্যাও ফিউচারে ফেস করতে হবেনা। তোমার নামে ডিপোজিট করা আছে, মাসে-মাসে টাকা যাবে। কখনো কোনো বিষয় নিয়ে ভয় পেলে সৌভিক আছে, নীতি আছে, মা আছে। ওদের যে কাউকে সমস্যার কথা বললেই হেল্প পাবে। কোনো ভয় নেই। শুধু একা থাকাটা শিখে নাও। আমি জানি তুমি পারবে। বলো পারবে না?
মেহনূরের ইচ্ছা করছে চিৎকার করে বলতে, ‘ আমি পারবো না ‘। কিন্তু মাহতিম কি এটা শুনতে পাবে? তার কি এটা পছন্দ হবে?
.
বাড়ির বাইরে মাইক্রোবাস দেখে অবাক হলেন সুজলা। সব মাল-পত্তর এক-এক করে তুলে দিচ্ছে মাহতিম। গাড়িটা কিভাবে জোগাড় হলো এই প্রশ্ন করতে গিয়েও ধন্দে পরলেন তিনি। শেফালি, সাবা, সুরাইয়া আপাতত কিছুই জানে না। তারা উৎসবমুখর ভঙ্গিতে মাইক্রোতে চড়ে বসেছে। মাহমুদার মুখ আজ গম্ভীর, শানাজ প্রচণ্ড অস্থির, মেহনূরের অবস্থা স্বাভাবিকই ঠেকছে। তাহলে মেহনূর কি এ বিষয়ে কিছুই জানে না? রেসোর্টে বেড়াতে যাওয়া যে বিরাট পরিকল্পনার অংশ, এটা কি জানে না? মাহতিম এখন পান্ঞ্জাবী পালটে শার্ট গায়ে দিয়েছে। খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে সব গুছিয়ে ড্রাইভারকে দেখিয়ে দিচ্ছে। ড্রাইভার লোকটাকে দেখলে মাসুম, ভোলাভালা লাগে। কিন্তু সুজলা জানে এটা ওদের ছদ্মবেশ। ড্রাইভারটা মাহতিমেরই লোক। সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করলে সুজলা নিজেও গাড়িতে চড়লো। উনার ডানে শানাজ, বায়ে মেহনূর বসবে। কিন্তু মেহনূর এখনো মাহতিমের সাথে হাত লাগাচ্ছে। কাজ শেষে মাহতিম মাহমুদার দিকে তাকালো, গম্ভীর মুখটা দেখে কিছু বুঝতে পেরে ফিচেল হাসি দিলো,
– মা, ওখানে খুব সুন্দর পুকুর আছে। আরেকটু এগোলেই একটা নদীতীর দেখতে পাবেন। জায়গাটা চমৎকার। আপনার কোনো সমস্যা হবেনা।
মাহমুদার চেহারায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিনি এসব কথায় অভ্যস্ত নন। কিন্তু ভেতরের ছটফটানি ভাবটা কাটাতে না পেরে মাহতিমের উদ্দেশ্যে বললেন,
– মাহতিম, বাবা একা থাকার দরকার নেই। তুমিও সঙ্গে চলো।
কথাটার গূঢ়ার্থ বুঝতে পারলো মাহতিম। মেহনূরও এখন সেই কথার প্রেক্ষিতে অটলভাবে তাকিয়ে আছে। জানালায় থাকা মায়ের হাতটা খুব সন্তপর্ণে ধরলো মাহতিম, স্নেহের চাহনিতে বললো,
– আমি আসবো মা, আমার জন্য একটু দুয়া রাখবেন। কাজটা শেষ করেই ফিরবো।
হাতটা দুহাতের ভেতর নিয়ে মৃদ্যু ঝাঁকুনি দিলো। সাংসারিক হাতটা ছেড়ে দিতেই মেহনূরকে উঠার জন্য ইশারা করলো। মেহনূর গাড়িতে উঠতেই স্লাইডিং ডোরটা টেনে দিলো মাহতিম, সাথে-সাথে ড্রাইভিং সিটের জানালা দিয়ে ড্রাইভারকে কিছু বুঝিয়ে দিলো। মেহনূর যে কথা বলার জন্য বাহানা করতে চাইছে সেটা চোখের তারায় ফুটে উঠেছিলো। মাহতিম পুরোপুরি সেটা ইগনোর করে গাড়ি স্টার্ট দিতে বললো, ড্রাইভার মাইনুদ্দীন গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে একটান দিতেই বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে চলে গেলো। ধূলো উড়তে লাগলো উঠানে, গাড়িটা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হতেই পা ঘুরালো মাহতিম। বুকের ভেতর এখন পাথর চাপা নেই, ঠিকঠাক মতো পৌঁছালেই স্বস্তি। একপা-একপা করে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে সে, মাথায় বিশাল ভাবনা নিয়ে চিন্তায় ডুবে আছে। সিড়িতে পা ফেলে মোল্লাবাড়ির দিকে এগোতেই ভেতরের অন্ধকার দৃশ্যটা দেখতে পেলো। ধীরে-ধীরে মানবশূন্য মোল্লাবাড়িটা অন্ধকারে তলিয়ে যেতে লাগলো। সূর্যটা আজ চালাকি করে আলো বিকোয়নি। বিকেল টাইম হলেও চারপাশে অন্ধকার নেমেছে। বাড়িতে ঢুকে আঙিনার চারপেয়ে চৌকিতে বসলো সে, অলসতার জন্য বাড়িতে লাইট জ্বালালো না মাহতিম। অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটায় চোখ বুলাতেই হঠাৎ দৃষ্টি থমকে গেলো! কেউ লাইব্রেরির কাছে দাঁড়িয়ে আছে! একটা কালো ছায়া স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! কোনো নড়াচড়া করছেনা ছায়াটা! মূহুর্ত্তেই লাফ দিয়ে উঠলো মাহতিম! বুঝতে পারলো সে মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে। সর্বনাশ!
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
#নোটবার্তা : কিছু কিছু জায়গায় ভুল ছিলো, সেটা ঠিক করার চেষ্টা করেছি। তবুও যদি ভুলত্রুটি থেকে যায়, তাহলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। 💔