মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤ #পর্বসংখ্যা_৪৮. #ফাবিয়াহ্_মমো

0
100

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৮.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

মনের ভেতর কু ডেকে উঠছে। আজ এমন কিছু হবে যেটা ঝড়ের মতো লন্ডভন্ড করে দিবে। তছনছ হয়ে সবকিছু গুড়িয়ে যাবে। মারজা ভয়ে কাতর, সকাল থেকে মুখে কিচ্ছু রোচেনি। মেহনূরকে পাশে না পেয়ে প্রথম-প্রথম ভয় পেলেও আস্তে-আস্তে বুঝতে পারেন ছেলে সম্ভবত সঙ্গে নিয়ে গেছে। গতকাল রাগের মাথায় খুবই জঘন্য গালাগাল করেছেন তিনি, মায়ের ঝাঁঝ মাখা বকুনি খেয়েও মাহতিম টু শব্দটি পযর্ন্ত করেনি, চুপচাপ অপরাধীর মতো পরাজয় স্বীকার করে মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছিলো। আজ মনেহচ্ছে বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন, মেহনূরকে মেয়ের মতো আদর সোহাগ করতে গিয়ে একটু বেশিই উচাটন হয়ে গেছেন। মাহতিম বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে চলে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি রেডি। তার গোছানো লাগেজটা মেহনূর আরো একটু গুছিয়ে দিলো। মনটা ভারী উদাস, ডুকরে বারবার কেঁদে উঠলেও ঠোঁট কামড়ে শক্ত হচ্ছে। সমুদ্রের কাছাকাছি আসাটা জীবনের সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা, অথচ যে মানুষটা এখানে নিয়ে আসলো সেকিনা বিকেলের দিকেই চলে যাচ্ছে। যাচ্ছে-তো-যাচ্ছে তাও আবার মাস খানেকের জন্য। কবে ফিরবে এ ব্যাপারে কিচ্ছু বলতে পারেনা। আহ্লাদ করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে, কোলে মাথা টেনে ঘুম পাড়াবে, দুগাল ভরে-ভরে আদর করবে সেই সুযোগটুকুও কপালে জুটেনি। এখন তো ইচ্ছে করছে হাউমাউ করে কেঁদে তার যাওয়া আঁটকাতে, মাহতিমের উপর যে গাঢ় মায়া পরে গেছে। এই মায়ার ছাপ কি তাকে শান্তি দিবে? মুখ ফুটে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, একটু থাকুন, আপনাকে একটু আমার করে নেই। সময় তো চলে যাচ্ছে না, আমার যে অপেক্ষা ভালো লাগে না। আর কতো অপেক্ষা? কেনো অপেক্ষার মতো যন্ত্রণা সহ্য করবো বলুন? এই যন্ত্রনা যে প্রতিটা সেকেন্ডে-সেকেন্ডে বি’ষযুক্ত সূঁইয়ের মতো বিঁধবে!

মাহতিম মন ভার করে থাকলেও নিজেকে একটু প্রাণবন্ত রাখার মিথ্যে অভিনয় করছে। অভিনয়টা না করলে সৌভিক, সিয়াম, তৌফ এই তিনটা নেং’টাকালের বন্ধু সত্যি-সত্যিই বিষাদের মুখে বিদায় দিবে। নীতি-প্রীতি-ফারিন নামক তিনটা বোনকে আপনের চেয়েও আপন ভাবে, তাদের ভালোবাসার মমার্থটা দেখলে মাহতিম নিজেকেই ক্ষুদ্র কীটের মতো অযোগ্য মনে করে। কোলে-পিঠে এই তিনটা বোনকে কোনোদিন চাচাতো-ফুপাতো বোনের মতো লাগেনি, যেনো মায়ের পেটের সহোদর বোন ছিলো। মাহদির প্রতি সবচেয়ে বড় আক্ষেপটা কাজ করে, ছোট থাকতে একবার পা ভাঙ্গার জন্য একটুও ছুটি পায়নি। তখন সবে কর্মজীবনে নিজেকে গড়ার জন্য, প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করছিলো সে, ওইসময় একমাত্র ছোট ভাইটার জন্য ডিপার্টমেন্টে কয়েক দফা এ্যাপ্লিকেশন করেও ছুটি মন্ঞ্জুর পায়নি। ঈর্ষান্বিত কিছু অফিসার তার পেছনে আদাজল খেয়ে লেগেছিলো, তাদের কূটনৈতিক চালাকির জন্য মাহদিকে একবারের জন্যও দেখে আসতে পারেনি। জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বোধহয় সেদিনই বুঝতে পেরেছিলো, তখন থেকেই ভেতরের ক্রোধটা তাকে জেদে পরিণত করে দেয়। সেই ডিপার্টমেন্ট এখন তাকে নমঃ নমঃ ভক্তির মতো সম্মান করে, তার কোনো ছুটিই তারা সাথে-সাথে খারিজ করার সাহস দেখাতে পারে না। কিন্তু জীবনের ওই ব্যর্থতার ব্যথা আজও মাহতিমের মস্তিষ্কে রিনরিন করে বাজে, চোখ বন্ধ করলে হতাশার নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। আজ সে সফল। সফল বলেই চারিদিকে এতো কদর। সৌভিকের রুম থেকে চুল ছেঁটে আসার সময় হঠাৎ অজানা কারণে পাদুটো থেমে যায়, তার উর্বরমস্তিষ্কটা ধরতে পারে বিপদের ব্যাপারটা ধীরগতিতে আগাচ্ছে। দরজার সরু ফাঁকটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, অনামিকা এখনো ইনজেকশনের কড়া ডোজে ঘুমাচ্ছে। তার মাথার কাছেই শিউরের দিকটায় বসে আছে রজনী। নিঃসন্তান রজনী নিজের ভাতিজিকে কলিজার খনিই ভাবে। যদি অনামিকার মুখ থেকে চড়ের কথাটা শুনে ফেলে, তাহলে রাগে হয়তো অকল্পনীয় কিছু করে ফেলবে। হামলা যেনো কোনোভাবেই মেহনূরের উপর না আসুক, সেজন্য নিজেই রজনীর কাছে ধরা দিলো মাহতিম। আধ ভেজানো দরজায় ঠকঠক করে নক করতেই ভেতর থেকে রজনীর অনুমতি পেয়ে যায়, দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতেই গুছানো কথাগুলো ঠোঁটের আগায় সাজিয়ে নেয়। রজনী দরজার দিকে মাহতিমের অবয়ব দেখে চমকে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করে,

– কি ভেবে এই রুমে এলে? কোনো দরকার ছিলো? শুনলাম, তুমি নাকি বিকেলেই ফিরে যাচ্ছো?

মাহতিম একগাদা প্রশ্ন শুনে একটু হাসলো। বিছানার কাছে চেয়ার টেনে বসতেই সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,

– কিছু প্রয়োজন ছিলো বলেই এই রুমের রাস্তা ধরেছি। নাহলে আপনি ভালো করেই জানেন, এই রুমের রাস্তাটা আমার জন্য বিষাক্ত কিছু।

শেষ বাক্যটা বলার সময় চোখ শক্ত করে দাঁত চিবিয়ে বললো মাহতিম। সেকেন্ডের ভেতর হাসি-হাসি মুখটা কিভাবে পালটে গেলো তা দেখে আরেকবার আশ্চর্য হলো রজনী। সেও একইভঙ্গিতে সৌজন্য হাসি ছুঁড়তে-ছুঁড়তে শেষে চাপা ক্ষোভের সাথে বলে বসলো,

– তোমাকে নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। কিন্তু মাঝে-মাঝে বিশেষ ভাবে শিক্ষা দিতে ইচ্ছে করে। দিই না।

রহস্যভাবে হেসে ফেললো মাহতিম, দৃঢ়চিত্তে অটল থেকে শান্ত কন্ঠে বললো,

– শিক্ষাটা আমাকেই দিবেন, এটার জন্য অন্য কাউকে দাবার গুটি বানাতে যাবেন না।

চাপা আক্রোশে তির্যকদৃষ্টিতে বললো রজনী,

– মানুষ দরকার পরলে নিজের বাপকেও শূলে চড়াতে ভুলে না। সেখানে তুমিতো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকো। তোমাকে ধরাশায়ী করতে হলে তো গুটি লাগবেই।

কথার মা’রপ্যাঁচ আর বাড়তে না দিয়ে মোদ্দাকথায় ফিরলো মাহতিম,

– আমি নিজে ধরা না দিলে আপনি কখনো আমাকে কবজা করতে পারবেন না মামী। এই কথা আরো একবার আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। আপনার সাথে দুটো জরুরী কথা বলার জন্যেই এসেছি। আপনার ভাতিজির সার্ডেন অসুস্থতার জন্য আমি দায়ী। কিন্তু আমাকে ক্ষেপানোর জন্য ও নিজেও যথাযথ দোষী ছিলো। আপনি এটা ঠিকই জানেন, আমি শুধু-শুধু আমার শ্রম ও সময় ওর মতো ফা’লতুর জন্য নষ্ট করবো না। একজন বিবাহিত পুরুষকে কিসের জন্য এ্যাপ্রোচ করাটা সত্যিই ধি’ক্কারজনক।

রজনীর স্থির মুখটা কয়েক মিনিট স্থির থেকে ভারী গলায় বললো,

– আমার ভাতিজির প্রতিশোধটা যেনো মেহনূরের উপর না নেই, সেজন্যই তুমি এখানে ধরা দিতে এসেছো। কথা কি ঠিক বললাম মাহতিম?

কথাটা হ্যাঁ সূচকে সায় জানিয়ে বলতে লাগলো মাহতিম,

– জ্বী। আপনি আমার উপর যা ইচ্ছা তা করুন, আমি কিচ্ছু বলবো না, কোনোপ্রকার এ্যাকশনও নিবো না। আমি ডাইরেক্ট আপনার কাছে সারেন্ডার করলাম। কিন্তু খবরদার! প্রতিশোধের জ্বালাটা যেনো আমার মেহনূরের উপর না আসে। আমার মাথা নষ্ট হলে কিন্তু খুবই খারাপ হবে মামী। ওকে ছেড়ে কথা বলবেন।

একটু থেমে ফের বললো রজনী,

– তুমি কাকে শাষাচ্ছো ভেবে দেখেছো? আমি কিন্তু ডরাই না।

নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে হাসলো মাহতিম। পরক্ষণে হাসিটা সাইডে ফেলে কঠোর চাহনিতে জোরালো কন্ঠে বললো,

– জানি দেখেই শাষিয়ে যাচ্ছি। অন্য কেউ হলে শাষানোর সময়টুকুও নষ্ট করতাম না। বিকেলে ফিরতে হচ্ছে বলে ধরা দিলাম, আশাকরি আমার অনুপস্থিতিতে ঘোঁট পাকানোর চেষ্টা করবেন না। আমার বউ এসব বিষয়ে যথেষ্ট সরল, ওকে নিজের থাবায় আনতে গিয়ে নিজের দূর্গতি ডাকবেন না মামী।

রজনীকে পাত্তা না দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পরলো মাহতিম। রাগে গজগজ করা রজনী তুমুল আক্রোশে গর্জে উঠবে, ঠিক তখনই দরজার কাছ থেকে মাথা ঘুরিয়ে বললো মাহতিম,

– আরো একটা কথা, আমার উপর কোনো ধরনের পলিটিক্যাল পাওয়ার খাটানোর চেষ্টা করবেন না। ওইসব নোংরা পলিটিক্সের ভয় দেখানোর ধান্দা আপনার ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর রাখবেন। বি অন দি সেফ সাইড রজনী ইবনাত মামী।

চোখ খুললো মাহতিম। একটু আগের ঘটনাটা স্মরণ করতে-করতে কখন রুমের সামনে এসে পরেছে বুঝতে পারেনি। লান্ঞ্চটা একসাথে করবে বলে সবাইকে একত্র করতে রুম থেকে বেরিয়েছিলো, তখনই আসার পথে অনামিকার রুমে কথাগুলো উগলে দিয়ে আসে। সিলভার নবটায় হাত দিয়ে রজনীর কথা ঝেড়ে ফেলে দরজা খুলে ঢুকলো, ঢুকেই প্রথম কদমটা ফেলতে গিয়ে বিছানার দিকে চোখ স্থির করে দাঁড়িয়ে পরলো। দরজার দিকে পিঠ দিয়ে চুপচাপ বসে আছে মেহনূর, বিছানায় বসে ফ্লোরে পা রেখে সামনের বিশাল জানালার দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই চোখমুখের অবস্থা বারোটা থেকে তেরোটা বাজিয়ে শেষ! জোরে নিশ্বাস ফেলে দরজাটা বিনা শব্দে ভেজিয়ে নিঃশব্দ পায়ে মেহনূরের সামনে এসে দাঁড়ালো। মায়াবী চোখদুটো বন্ধ হয়ে আছে, চোখের দু’কোনা ভেজা-ভেজা। লম্বা-দীঘল চুলগুলো বাঁদিকে বেণী করে রেখেছে, কান্না শেষে মুখের উপর লালচে আভা পরেছে। ছোট্ট কোলটার দিকে দৃষ্টি দিতেই মনটা লোভীর মতো কাঙাল হয়ে উঠলো, ওই কোলের উপর মাথা রেখে দুটো মিনিট চোখ বুজে থাকতে চায়। মেহনূরের হাতের ছোঁয়ায়, গায়ের গন্ধ পাবার একটু আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে। ফ্লোরে হাঁটুগেড়ে চোখদুটো বন্ধ করে ধীরে-ধীরে ছোট্ট নীড়ের কোলে মাথা গুঁজে দিলো, মনের উপর সমস্ত চাপ যেনো হালকা হতে লাগলো। দুহাতে কোমর বেষ্টন করে নিজেকে সপে দিতেই হালকা গলায় বললো,

– নিচে চলো মেহনূর, সবাই লান্ঞ্চটা একসাথে করতে চাই।

নিশ্বাস নিতেই ফোঁপানির হিড়িকে কেঁপে উঠলো মেহনূর। নাক টেনে ঢোক গিলে চোখ খুলে তাকালো, দৃষ্টি নিচু করে কোলের মাথাটা আঙ্গুলে-আঙ্গুলে ছুঁয়ে দিতে লাগলো। ট্রিম-কাটের চুলগুলো ঘন্টাখানেকের ভেতর উধাও, আঙ্গুলের ডগায় এখন ছোট করে ছাঁটা চুলের খোঁচা লাগছে। বুক ফুলিয়ে ভারী নিশ্বাস ছেড়ে কোমল কন্ঠে বললো মেহনূর,

– একটু সমুদ্র দেখিয়ে আনবেন?

আবেশে-আরামে চোখ বন্ধ করে আছে মাহতিম। এই অদ্ভুত শান্তিটা শরীরের নেগেটিভ ভাইবটা যেনো শুষে নিচ্ছে। একটু নড়েচড়ে উঠতেই আরামসিক্ত কন্ঠে বললো,

– আগে খাবে, তারপর।

মলিন মুখে একটুখানি হাসলো মেহনূর।

মুখ নিচু করতেই চোখ বন্ধ করে মাহতিমের খোঁচা-খোঁচা চুলে ঠোঁটের গাঢ় চাপে চুমু খেলো। স্থির রইলো কিছুক্ষণ, নিশ্বাসের টানটাও স্থির করে রাখলো, যেনো অনাবিল সুখটুকু রন্ধ্রে-রন্ধ্রে টের পাচ্ছে মেহনূর। এরপর ছেড়ে দিলো আঁটকানো নিশ্বাস ও মাহতিমের ডোর বন্ধনটা। দুজনের মধ্যবর্তী নিরবতা কাটিয়ে দুপুরের খাবারের জন্য নিচে রওনা দিলো তারা, পথিমধ্যে কানটা কঠিন মোচড় মেরে গেমাসক্ত মাহদিকে ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত করলো মাহতিম। ব্যথার চোটে চোখ কুঁচকে ‘ ও ভাইয়া, কান ছিঁড়ে যাচ্ছে, ছেড়ে দাও ‘ বলতে-বলতে কাতরালো মাহদি, বেচারা মাহদি দানবের হাতে ভয়ংকর কানমলা খেয়ে কেঁদে দিবে-দিবে অবস্থা। শেষে অনামিকা বাদে বিশাল গোল টেবিলে আসন নিলো সবাই, কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, রজনী বারবার কাকে যেনো কল দিয়ে যাচ্ছে। তার আচরণটা সন্দেহজনক ঠেকলেও মাহতিম সেদিকে তোয়াক্কা করার প্রয়োজন মনে করলো না। মাহদি চোখ লাল করে ইতিমধ্যে বারবার চোখ মুছছে। মায়ের কাছে বিচার দিয়েও লাভ হয়নি, মা ভাইয়াকে একটুও বকে না, শুধু আদর করে খালি। সবাই খাওয়া শুরু করলেও ঘাপটি ধরলো মাহদি, খাবারের প্লেটটা না ছুঁয়ে মুখ নিচু করে আছে। ডানে বড় ভাই, বামে মা বসেছে। ভাইয়া ইচ্ছে করে মেহনূরকে তার সঙ্গে বসতে দেয়নি। ভাইয়া তাকে একটুও ভালোবাসে না, সবসময় খালি বকাবকি করে। কেউ তার দিকে খেয়াল করে না, উলটো নিজেদের কথায় মজে থাকে। সবাই যখন খাওয়ার জন্য ব্যস্ত, তখনই মাহদির দিকে মেহনূরের চোখ পরলো। একপলক সেদিকে তাকিয়ে মাহতিমের উরুতে হাত রাখলো মেহনূর, উরুতে স্পর্শ পেয়ে ডানে চোখ ঘুরাতেই মেহনূরের দিকে ‘ কি হয়েছে ‘ টাইপ ইশারা করলো মাহতিম। মেহনূর চোখ বড় করে মাহদির দিকে তাকাতে বললো, মেহনূরের ইঙ্গিতে এবার বায়ে তাকাতেই মুখে চিবানো খাবারটা গিলে ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,

– খাস না কেনো? কি সমস্যা? প্লেটের খাবার ওভাবে পরে আছে কি জন্যে? সারাদিন ফোন গুতাগুতি করতেই মজা লাগে, না?

মাহতিমের ঝাঁঝালো কন্ঠে শিউরে উঠলো মাহদি। এবার ঠোঁট উলটে মাথা নুয়ে কেঁদেই দিলো। দ্রুত মেহনূর চেয়ার ছেড়ে উঠে মাহদির কাছে ছুটে গেলো, মাহতিমের পাশাপাশি সবার অবস্থাই কৌতুহলে চূর্ণ। চোখ মুছাতে-মুছাতে মাহদিকে নিজের সিটে আনলো মেহনূর, দূর্বল-জীর্ণ শরীরেই নিজের কোলে বসিয়ে আঁচলে চোখ মুছিয়ে বললো,

– তুমি না অনেক বড় হয়ে গেছো? বড় ছেলেরা কি সবার সামনে কাঁদে? তোমার ভাইয়াকে কখনো কাঁদতে দেখেছো? সৌভিক ভাইয়া, সামিক ভাইয়া তারা কি বকা খেলে কাঁদে? আমার দিকে তাকাও, মাহদি তাকাতে বলেছি না?

মাহদি ঠোঁট কুঁচকে মেহনূরের দিকে তাকালো। মেহনূর গালদুটো ধরে চোখের নিচের পানিটুকু বৃদ্ধাঙ্গুলে মুছিয়ে বললো,

– সারাদিন গেমস খেলা কি ভালো? খাওয়ার সময় যদি না খাও, তখন যদি গেমস খেলো তাহলে এই শরীর কি তোমার ভাইয়ার মতো শক্তপোক্ত হবে? শরীরে মাংস লাগবে না? আমি খাইয়ে দিচ্ছি, একটুও এঁটো করবে না। এঁটো করলে রাগ করবো, আর কোনোদিন আদর করবো না।

মেহনূরের প্ররোচনায় কান্না একটু থামলো মাহদির। কিন্তু রাগ কমলো না তার। বড় ভাইয়ের প্রতি তীব্র ক্ষোভ জাহির করতে গিয়ে টপটপ অশ্রু ফেলতে-ফেলতে বললো,

– আমাকে কেউ মূল্য করে? কেউ করে না! আমি যেদিন ম’রে যাবো, সবাইকে ছেড়ে যাবো, সেদিন দেখিও মেহনূর ওরা কিভাবে কাঁদে। আমাকে কেউ ভালোবাসে না, ভাইয়া আমার উপর ইচ্ছামতো চিল্লাচিল্লি করে শান্তি পায়, কেউ আমাকে ভালোবাসে না, কেউ না! আমার স্কুল সেরেমনিতে আজ পযর্ন্ত ভাইয়া আসেনি। আমি যেদিন রেকর্ড ব্রেক করে লং জাম্প খেলায় পুরষ্কার নিতে গেলাম, ওইদিনও ভাইয়া ধমকানি দিয়ে বলেছে সে আসবেনা! আমি ফ্রেকচার পা নিয়ে ছয় মাস বিছানায় ছিলাম, ডাক্তার কতগুলো ইনজেকশন দিয়েছিলো তাও ভাইয়া আমাকে দেখতে আসেনি। ফোন করে বলেছে আসবেনা! ভাইয়া আমাকে খালি বকেই, সে আমার কোনো ইচ্ছাই পূরণ করেনি। আমি সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবো। দেখিও চলে যাবো।

হু হু করে কেঁদে উঠলো মাহদি। হিচকির সুরে কাঁদতে-কাঁদতে বললো,

– আমি বাবাকে দেখিনি। ভাইয়া বাবার আদরও পেয়েছে, মার আদরও পেয়েছে। অথচ আমি কারোরটাই পাইনি। কেউ আমার কথা রাখে না। আমি গতকাল পানিতে নামতে চেয়েছিলাম, ভাইয়া চড় মেরে আমাকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাকে কেনো মা’রলো? আমি কি —

কন্ঠ রোধ হয়ে থেমে যায় মাহদি। কান্নায় চোখ খিঁচুনি দিয়ে ফোঁপাতে থাকে। মাহদির কান্নায় মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো মেহনূর। বিমূঢ় সবাই কিছুক্ষণের জন্য বাক্যশূন্য হয়ে আছে, শুধু অনামিকার চতুর মস্তিষ্ক অন্য কিছুর রটনায় ব্যস্ত! তার ঠোঁটে জয়ীর মতো হাসি, এই বুঝি ফাঁদে ফেলার মহড়া পেয়ে গেছে। এবার এমনভাবেই চালটা চেলে দিবে যাতে, অ’ সাপও না ম’রে, লাঠিও না ভাঙ্গে ‘ অনেকটা এই প্রবাদের মতো। মাহতিম ভ্রুঁ কুঁচকে শক্ত মুখে কিছু বলবে এই প্রথম মেহনূর চোখ গরম করে তাকালো। রাগটা পুরোপুরি প্রকাশ না করলেও স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

– খেয়ে নিন। নাহলে আপনার মতো ব্যস্ত মানুষ খাবার এঁটো করলে সেটা লজ্জার হবে।

দারুণ আশ্চর্যের সাথে দমে যায় মাহতিম। তার কান গরম লাগছে, মুখে খাবার দেওয়ার ইচ্ছাও ম’রে গেছে। দূর থেকে মেহনূরের রূপ চেপে খামচে হাসছে তৌফরা। তৌফ মুখে খাবার চিবাতে-চিবাতে ডানে থাকা ফারিনের কানের গোড়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

– ওই ফারিন, ফারিন রে, পোল্ট্রি মুরগী দেখি বাঘে’র সামনে ছোঁক ছোঁক করতাছে।

কানের কাছে সুড়সুড়ি খেয়ে চমকে উঠলো ফারিন। সিনারি দেখতে ব্যাঘাত পাওয়ায় তৌফের দিকে বিরক্ত ভরে বললো,

– তোমার এই গাঁ’জাখুরি স্বভাব আর গেলো না তৌফ ভাই! অসহ্য লাগে কিন্তু! এগুলা কি —

তৌফ সেই কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে আবার বলে উঠলো,

– ফারিন, ফারিন রে, হাতে একটা চিমটি কা’ট তো। দেখি ঘটনাটা স্বপ্ন না বাস্তব।

ফারিন বেজায় ক্ষেপে গিয়ে স্বর নামিয়ে বললো,

– তোমাকে আমার কি করতে মন চায় জানো? যখন এই ফিসফাস আচরণটা করো, মনে চায় তোমার ওই কানটা আমি কাম’ড়ে ছিঁ’ড়ে ফেলি!

এবার যেনো টনক নড়লো তৌফের। ফারিনের দিকে তাকিয়ে বললো,

– তুই তো দেখি ভালোই দু’ষ্টু হইছোস। আমার কান কাম’ড়াতে চাস কেন?

ফারিন আহাম্মকের মতো হতভম্ব হয়ে বললো,

– হোয়াট দ্যা…, ছিঃ ছিঃ তৌফ ভাই, আমি তোমাকে একটুও পছন্দ করি না। ছিঃ ছিঃ!

সন্দেহপ্রবণ চাহনিতে চোখ ছোট করলো তৌফ। ফারিনের দিকে মুখ এগুতেই ফারিন বিব্রত হয়ে মাথা পিছিয়ে ফেললো, তোতলাতে-তোতলাতে বললো,

– তুতুতুতু, তুতুতু মি —

তোতলাতে লাগলো ফারিন। তৌফ কপালে ভাঁজ ফেলে সরু চোখে বললো,

– তুতু করতেছিস কেন? আমি কুত্তা না, আমি মানুষ। পছন্দ করলে সোজাসুজিই বলবি, আমি মাইন্ড খাই না।

এ কেমন জ্বালারে ভাই! এর চেয়ে খাবার টেবিলে না বসাই ভালো ছিলো। একদিকে ভাইয়া-ভাবী নিরব দাঙ্গা করলো, অন্যদিকে এই তৌফ ঘাড় ম’টকে বসেছে। সবার দৃষ্টি যখন মাহদিকে শান্ত করায় উঠে-পরে লাগলো, তখনই রজনী চোখের আড়াল হয়ে একটু দূরে কলে গেলো। হোটেলটার এন্ট্রেস পথের কাছে এসে আশেপাশে তাকাতে-তাকাতে ফোন নিয়ে চটপট কাউকে কল করলো, কলটা রিসিভ করতেই সেখানকার এক আভিজাত্য পিলারের পেছনে লুকিয়ে পরলো। কন্ঠ যতটা সংযত করা যায়, ততটাই নিচে নামিয়ে বললো,

– হ্যালো, হ্যাঁ। সব রেডি তো? শোনো, প্ল্যান পরিবর্তন করো। হ্যাঁ এক্ষুনি করো! ওকে মা’রার দরকার নেই। কোনো সাফাই চাই না। এখন ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় নেই। অনা ওর রুমে আছে, হ্যাঁ ঘুমাচ্ছে। না, মাহতিমের গাড়ি আসতে এখনো দেরি। ওর সিভিল টিম আশেপাশেই আছে। না, আমি কাউকে চিনি না। শুনেছি, সিভিল ড্রেসে হোটেলের বাইরে গার্ড দিবে। হ্যাঁ, খাওয়া শেষ হতে বেশি দেরি নেই। প্ল্যান ঘুরাও। ‘ ইত্তেফাক ‘ নিউজপেপারে এডভান্স এক লাখ সবুজ রঙের বিনে ফেলেছি, কাজ হলে আরো দেবো। শুরু কাজটা হওয়া চাই। মাহতিম যাওয়ার আগেই যেনো ধাক্কাটা খেয়ে বিদায়। আমি ওর চোখে পানি দেখতে চাই! কাউন্ট-ডাউন শুরু।

– চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here