#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৫০.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
ব্যথায় চোখ কুঁচকে ফেললো মেহনূর। বিছানার চাদরটা সাথে-সাথে খামচে ধরতে চাইলো, কিন্তু আফসোস সে একটুও পারলো না। বাঁহাতের রগটা প্রচণ্ড ব্যথা করছে, রাতের এই টাইমটা তার জন্য যন্ত্রণার। অসহন ব্যথায় চোখ-মুখ খিঁচে ফেলেছে মেহনূর, দুচোখের কিনারা দিয়ে মোটা-মোটা দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। সেটা দূর থেকে দেখতে পেয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো কেউ। হতাশায় চূর্ণ হয়ে নিজের রুমে ফিরলো সে, অলস পায়ে জানালার কাছে এসে পকেট থেকে ফোন বের করলো। একবার ভাবলো কল করবেনা, পরক্ষণে চিন্তা করলো কলটা দেওয়া উচিত। কানে ফোন এঁটে চাঁদহীন আকাশে তাকিয়ে আছে সৌভিক, রাত এখন দুটোর একটু বেশি। কলটা রিং হচ্ছে, তার মানে ওই ব্যক্তি এখনো জেগে আছে। বড় করে ঢোক গিললো সৌভিক, আজকাল সেই ব্যক্তিকে ফেস করতে প্রচণ্ড ভয় লাগে। সে আর আগের মতো নেই। তার মধ্যে যেনো জ্বলন্ত আগুনের টগবগে ভাব কাজ করে, কথা বলতে গেলে অদ্ভুত ঝাঁজের সাথে কথা বলে। শক্ত ভঙ্গিতে কাটকাট স্টাইলে আচরণ করে, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মুখ খুলতে চায় না সে। একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে খুব অপেক্ষায় থাকা লাগে, নয়তো সংক্ষিপ্ত জবাব বুঝিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মাহদির মৃত্যু ঝড়ের মতো তাণ্ডব চালিয়েছে, বিধ্বস্ত করে দিয়েছে সব! কেউ কোথাও আগের মতো নেই, প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে তছনছ চালিয়েছে। সবাই কঠিনভাবে ভেঙ্গে পরলেও মাহতিম আনসারী এখনো অটল। তার স্বভাব, চালচলন, কথাবার্তার মার্জিত রূপ সবকিছু আরো চমকে দেওয়ার মতো হয়েছে। বিগত দিনের ঘটনাগুলো মাহতিম আনসারী নামক শক্ত-তেজী পুরুষকে চরম ভাবে পালটে দিয়েছে! মোটকথা, আজ তার আচরণ হিংস্র আগ্রাসী। তাকে দেখলে বুকটা আতঙ্কে কেঁপে উঠে, রীতিমতো প্রচণ্ড ভয় লাগে। মনেহয় যেকোনো মূহুর্তে পৈশাচিক রাগটা দেখিয়ে ফেলবে। ওমন রাগ, ওমন তেজ সহজে দেখা যেতো না। অথচ, এখন আগ্নেয়গিরির টগবগে লাভার মতো রাগ পুষে থাকে সে। সৌভিক জানে আজও নিরবতার দেয়ালটা ওপাশ থেকে ভাঙবেনা, বাধ্য হয়ে নিজেই তখন প্রশ্ন করে বললো,
– কেমন আছিস দোস্ত?
প্রশ্নটা বুঝি ঠিক হলো না, ওপাশের ব্যক্তিটা এখন প্রাণঘাতীর চেয়ে কম কিছু না। কিছুক্ষণ আমতা-আমতা করলেও শেষমেশ মোদ্দাকথায় ফিরলো সে,
– ওর শরীরের অবস্থা খারাপ মাহতিম। বাধ্য হয়ে ডাক্তাররা এখন রক্ত দিচ্ছে। একটাবার বুঝ্ ওর কেমন অবস্থা হয়ে গেছে। তুই যে শয়তানের মতো আচরণ করছিস এটা কি ঠিক? তুই কেন বুঝতে চাস না, ও তোর প্রতি পুরোপুরি উইক হয়ে গেছে। ও ম-রে যাচ্ছে মাহতিম, মেয়েটা ম-রে যাচ্ছে! প্লিজ কল হার।
এক দমে কথাগুলো বলে ফেললো সৌভিক। কথা বলতে-বলতে তার গলাটা কখন যে উঁচু হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি সে। মাহতিম এখনো চুপ করে আছে। উত্তর না পেয়ে চোখদুটো বন্ধ করলো সৌভিক, জানালার ডানদিকের পর্দাটা বাতাসে নড়েচড়ে তার মুখে বরাবর মৃদ্যু স্পর্শ করলো। বাতাস কমে যেতেই পুর্বের মতো থেমে গেলো পর্দাটা। মাহদির মৃত্যুর তৃতীয় সপ্তাহেও সুস্থ হয়নি মেহনূর, নিউমোনিয়ার মতো শীতলঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়েছে সে। মাঝে-মাঝে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিলে অক্সিজেন নেওয়া লাগে। মাহদি যখন সমুদ্রের উত্থাল জোয়ারে ভেসে যাচ্ছিলো, তখন সবাইকে উপেক্ষা করে পানিতে ঝাঁপ দেয় মেহনূর। সমুদ্রের নোনাপানিতে সাঁতারের দক্ষতা না থাকায় ব্যর্থ হয়ে পরে, তার নিজের শরীরটাও যে সুস্থ না সেদিকে লক্ষ করেনি সে। আদরের মাহদিকে ওমন অবস্থায় বাঁচানো দূর, নিজেই পানিতে নেতিয়ে পরে। ওইসময় ব্যর্থ সৌভিকরা তীরের কাছে নীতির চিৎকার শুনতে পায়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি মেহনূরকে উদ্ধার করতে ছুটে। ভাগ্য ভালো মেহনূর বেশি দূর তলাতে পারেনি, তীরের অনেকটা কাছাকাছি ছিলো বলে দ্রুত উদ্ধার করেছে ওরা। সেই থেকেই মানসিক অবস্থা চুরমার মেহনূরের, শরীরটাও সেটার তালে-তালে খারাপের দিকে যাচ্ছে। মাহতিম সিভিল ড্রেসে অফিশিয়াল গাড়িতে উঠার সময় সৌভিকের কাছে পাষাণের মতো দায়িত্ব বুঝিয়ে যায়, মেহনূরকে যে করেই হোক বাপের বাড়িতে পাঠানো চাই। মাহতিম কেনো আহাম্মকের মতো এমন কাজটা করছে, সেটার কিছুই জানে না সৌভিক। অনেকবার জিজ্ঞেস করেও মাহতিমের কাছে উত্তর মিলেনি।
– ওকে গ্রামে পাঠাচ্ছিস কবে?
অনেকক্ষণ পর উত্তর এলে ভাবনার দুয়ার থেকে ছুটে এলো সৌভিক, ভ্রুঁ কুঁচকে আশ্চর্য হয়ে বললো,
– তুই কি এখন লাত্থি মে-রে বের করতে চাচ্ছিস? তোর বউ যে অসুস্থ তুই বুঝতে পারছিস না?
আবারও ওপাশ থেকে নিরবতা আঁকড়ে ধরলো। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে দৃঢ়তার সাথে বললো,
– গলা নামা। আমার সাথে গলা উঁচাবি না। ওকে পরদিনই বিদায় করার ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম। তুই আমার কথাটা শুনিসনি। তার উপর আমার সাথে গলাবাজি করছিস, যেটা আমি একদম সহ্য করতে পারছিনা।
অবিশ্বাস্য চোখে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো সৌভিক! মুখ খুলে কিছু বলতে গিয়েও যুগোপযোগী শব্দ খুঁজে পেলো না। আজ পযর্ন্ত এমন টোনে কখনো কথা বলেনি মাহতিম, তার সত্যিই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে মাহতিম এসব বলছে! সৌভিক বহুকষ্টে আবারও গলা দিয়ে শব্দ বের করলো, কথা বলতে গিয়ে আড়ষ্টে বিহ্বল হয়ে বললো,
– বিয়েটা সেদিন নিজের ইচ্ছায় করেছিলি দোস্ত। মেহনূর কিন্তু টু আওয়াজও করেনি। তুই যে ওকে চলে যেতে বলেছিস ও সেটাও মেনে নিয়েছে। মারজা আন্টিকে ট্রিটমেন্টের জন্য ফ্লাইটে চড়িয়ে ও সোজা গ্রামে চলে যাবে।
গলাটা ক্রমশ নিচে নেমে গেলো, নিজের অসহায়ত্ব লুকানোর জন্য চুপ রইলো সৌভিক। ওপাশ থেকে সব শোনার পরও মাহতিম আজ আশ্চর্যভাবে চুপ। সৌভিকের তরফ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে নিরুত্তেজ ভঙ্গিতে ‘ রাখি ‘ বলতে নিচ্ছিলো, তখনই সৌভিক ম্লান কন্ঠে বললো,
– তোর বউ ঘুমের ঘোরেও কাঁদে রে মাহতিম। বিশ্বাস কর্, ও যদি আমার বোন হতো তোকে আমি খু-ন করে ফেলতাম। তুই আসলেই নি”ষ্ঠুর!
টুট টুট করে কেটে গেলো কলটা। এবার কলটা মাহতিমের জায়গায় সৌভিকই কেটে দিয়েছে। কান থেকে ফোন সরিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে মাহতিম, নিচের দিকে ঠিক ডানকোণার গ্লাসটা চৌচির হয়ে আছে। চৌচির অংশটার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে চোখের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে এলো, অজান্তেই ডেষ্কের উপর থাকা সাদা ডকুমেন্টটা বড়-বড় ফোঁটায় ভিজতে লাগলো। সিওসি খেলতে গিয়ে মাহদি ভুলবশত হাত থেকে ফোনটা ফেলে দেয়, ফ্লোরের সাথে জোরে বারি খাওয়াতে ফোনের ডানকোণার গ্লাসটা ভেঙ্গে যায়। সেদিন মাহদিকে ইচ্ছামতো বকেছে মাহতিম, কানটাও মোচড় মেরে লাল টকটকে করে দিয়েছিলো। নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে চট করে চোখদুটো বন্ধ করলো মাহতিম, ফোনটা ডেষ্কের উপর ছেড়ে ফ্লোরের সাথে পা ঠুকে দিলো, মৃদ্যু একটা শব্দ তুলে রকিং চেয়ারটা কম্পিউটারের সামনে থেকে উলটো ঘুরে গেলে সোজা দাঁড়িয়ে পরলো মাহতিম। দ্রুত দুই চোখে বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনী চেপে একটা টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো, গভীর রাত হলেও ঠান্ডা পানির শাওয়ারটা ফুল স্পিডে ছেড়ে দিলো সে। তীব্র বর্ষণের নিচে দাঁড়াতেই দুহাতে টিশার্ট খুলে ফেললো, দূরে নিক্ষেপ করতেই ঝপাস করে দেয়ালে বারি খেয়ে মেঝেতে পরলো ওটা। রাগে-ক্ষোভে-লজ্জায় নিজের প্রতি ঘেন্না কাজ করছে, ধিক্কারে বুক চিড়ে আসছে! তার ঠান্ডা মস্তিষ্ক, দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণ, সুকৌশল দক্ষতা সবকিছু কিভাবে গুলিয়ে ফেলেছে? চোয়াল শক্ত করে দুহাত দেয়ালের উপর রাখলো, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই হঠাৎ সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দেয়ালে ঘুষাতে লাগলো মাহতিম। একের-পর-একের শক্ত হাতের মুঠিগুলো সাদা চকচকে টাইলসের দেয়ালে কঠিন আক্রোশে পরছে! ধিম-ধিম করে ভূতুড়ে শব্দগুলো ওয়াশরুমে ছড়িয়ে পরছে! এতো রাতে এমন শব্দ শুনলে যে কারোর রক্ত হিম হতো, ভাগ্যিস এটা এ্যাপার্টমেন্টের মতো ভবন। এখান থেকে কোনো শব্দই চার দেয়ালকে ভেদ করতে পারে না, একটুও না।
.
ব্যালকনির ঝুলন্ত দোলনায় বসে আছে অনামিকা। পাদুটো তুলে আসন করে বসেছে, তার দুহাতের ভেতর সিরামিকের কালো মগ। সেই মগ থেকে উত্তপ্ত ধোয়ার কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছে। সোডিয়ামের হলুদ বাতির জন্য রাস্তার দু’ধার হলদেটে হয়ে আছে, জনশূন্য রাস্তা দিয়ে একটা-দুইটা মানুষ হুটহাট যাতায়াত করছে। নিরবতার মধ্যে তলিয়ে আছে জায়গাটা, একা-একা চমৎকার লাগছে। দোলনার বুননশৈলীর দেয়ালে পিঠটা হেলে দিলো অনামিকা, মগে দুঠোঁট চেপে ছোট্ট চুমুক দিলো। জিভে তেতো স্বাদ ঠেকতেই আরামে চোখ বন্ধ করলো, চেষ্টা করলো স্মৃতির পাতাগুলো হাতড়ে দেখার। মা নেই, মা দেখতে কেমন জানা নেই, মায়ের স্নেহটা কতো মধুর মতো তাও জানে না। খুব ছোট্ট থেকে আদরহীন জীবনে বড় হয়েছে, বাবা তো মস্ত বড় পলিটিশিয়ান। দেশের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সাথে উঠা-বসা, চলাফেরা, ঘোরাফেরা সব করেন। এমনও হতো বাবা অনেক দিন পযর্ন্ত বাসায় আসতো না। ফুপিও তার বাবার মতোই খুব পাওয়ার নিয়ে দাপট দেখায়, মহিলা হলেও সে যেনো একাই একশো। আনসারী নিবাসে রজনীর সঙ্গে-সঙ্গে সেও থাকতে শুরু করে। স্কুল-কলেজের সঙ্গদোষের কারণে অশ্লীল ব্যাপারগুলো তার কাছে রুচিশীল লাগে। আজ পযর্ন্ত কোনো ছেলে অনার প্রতি মুখ ফিরিয়ে চলেনি, তার আর্কষর্ণীয় ফিগার-রূপ-সম্মোহন দেহভঙ্গিমা ছেলেদের টনক নড়িয়ে দিতো। যাকে টার্গেট করতো সেই ছেলেই ওর দিকে অদ্ভুত ডোরে চলে আসতো। অদ্ভুত ও বিচিত্র জগতের মধ্যে ধীরে-ধীরে এভাবেই প্রবেশ করে অনামিকা, পরিবারের অযত্নশীল ব্যবহারের কুফল পরিণতি ধরা পরে। ঠিক মদের নেশার মতোই জঘন্য এক নেশায় লিপ্ত ছিলো। সেই নেশার শেষ পরিণতি বিছানা পযর্ন্ত ফূর্তি করা, এরপর নতুন কাউকে খোঁজা। Nympho-mania নামক ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত ছিলো সে, যেখানে ছেলেদের সাথে সঙ্গ উদযাপন করাটাই মূখ্য থাকে। মাহতিমের প্রতি আকৃষ্ট হলেও নিজেকে সামলে রাখতো সে, মাহতিম যে অন্য দশটা যুবকের মতো নয় ভালোভাবেই বুঝতো অনা। মাহতিম তার প্রতি চোখই তুলে দেখতো না। মাঝে-মাঝে লন সাইডে জগিং শেষে ঘার্মাক্ত বডিটা দেখে বিচলিত হতো অনা। এক চুম্বকার্ষণের জন্যই সে আস্তে-আস্তে মাহতিমকে চোখে-চোখে রাখতে শুরু করে। অনেকভাবে মাহতিমকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করেছে, প্রতিবারই মুখ থুবড়ে ব্যর্থ হয়েছে অনামিকা। তার এমন ডিসঅর্ডারের কথা রজনী যখন জানলো তখন বেশ হয়ে গেছে। বারবার মাহতিমের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়ে হিংস্র হয়ে উঠেছিলো অনামিকা। অপেক্ষায় থাকে সুযোগের জন্য।
মারজা আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরলে সবাই তড়িঘড়ি করে হাসপাতালের রাস্তা ধরলো। এদিকে পুরো বাড়িতে মানুষ নেই। অনামিকা এসব ঝন্ঞ্জাট থেকে নিস্তারের জন্য মিছেমিছি মাথাব্যথার নাটক করেছিলো, অনামিকা অবশ্য জানতো না সেদিন সন্ধ্যাটা তার জন্য কেমন হতে চলেছে। ঠিক এভাবেই ব্যালকনিতে বসে-বসে কফি খাচ্ছিলো সে, হঠাৎ অনা মেইন গেইট দিয়ে একটি গাড়ি ঢুকতে দেখে বেশ আশ্চর্য হয়। তখনই স্পষ্ট চোখে কিছু দেখতে পেয়ে তার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠে। কফিটা আধা মতোন খেয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে চলে যায় অনামিকা, আজ রাতটা লীলাখেলা না হলেও প্রণয়লীলা হবে। মাহতিম বাড়িতে ফিরলেও মায়ের অসুস্থতার কথা সিরাজ কাকার জন্য জানতে পারেনি, ক্লান্ত মাহতিমকে দেখে তিনি ভাবেন একটু পরেই জানিয়ে দিবেন। তিনি মাহতিমকে বিশ্রামের জন্য পাঠিয়ে দিলেন রুমে, নিজে অন্য কাজ দেখতে চলে গেলেন। ওত পেতে থাকা অনামিকা চুপ করে দরজা ঠেলে ঢুকে, জানালায় সব পর্দা দিয়ে পুরো অন্ধকার করে রেখেছে। মুচকি হাসলো অনা, মাহতিম যে ঘুমের সময় চারপাশ অন্ধকার করে শোয় সেটা সে জানে। ব্যস, চোখ সয়ে আসা অন্ধকারে পা টিপে-টিপে এগিয়ে যায়, পুরো রুমটা পারফিউমের গন্ধে মৌ-মৌ করছে, নিঃশব্দে গভীর করে নিশ্বাস নিলো অনা। প্রাণচাঞ্চল্যকর একটা গন্ধ, গন্ধটা শিরশির করে দেহের উপর হিম বইয়ে দিচ্ছিলো। আরো উন্মাদের মতো অস্থির হলো সে, বিছানার দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টি তাকিয়ে রইলো।
বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মাহতিম। বিছানার একপাশে তার সদ্য খুলে রাখা শার্ট, শার্টের পাশে হ্যান্ড ওয়াচ্, সাদা রঙের রুমাল পরে আছে। কয়েক মাসের দীর্ঘ ট্রেনিং, লম্বা জার্নিতে ক্লান্ত ছিলো মাহতিম, কোনোরকমে ফ্রেশ হলেও কেবল শার্ট খুলে বিছানায় ঢলে পরে। তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হলেও হঠাৎ পিঠের উপর উষ্ণ জাতীয় অনুভব করলো, তন্দ্রার ঘোর ভেবে আমলে নিলো না সে। হঠাৎ পুরো পিঠের উপর পাঁচ আঙ্গুলের গাঢ় স্পর্শ চোখ খুললো মাহতিম। অন্ধকার রুম, নির্ঘাত এই অন্ধকার রুমে কেউ ঢুকেছে! ‘ কে ঢুকলো? ‘ তন্দ্রা বিঘ্ন মাথাটা তৎক্ষণাৎ কিছু ঠাহল করতে পারলো না, এমন পরিস্থিতিতে মাথাটা ঠান্ডা রাখলো মাহতিম! কোনোপ্রকার রিয়েক্ট বা সেল্ফ ডিফেন্স না দেখিয়ে চুপচাপ বিষয়টা ধরার চেষ্টা করলো। এটা একটা মেয়েলি ঘটনা, তার প্রতি এ্যাট্রেকশান থেকে গায়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে, বাড়িতে বহিরাগত মেয়ে মানুষ ঢুকার সাহস নেই, তার রুম অবধি আসলেও তাকে এভাবে ছোঁয়ার মতো বিরাট কলিজা এখন পযর্ন্ত কারো হয়নি। অন্ধকারে খুব চালাকির সাথে হাত নাড়ালো মাহতিম, চোখের নিমিষে বিছানার উপর ‘ ধিরিম ‘ করে আওয়াজ হতেই মেয়েলি কন্ঠটা আর্তনাদ করে উঠলো! এক মূহুর্ত্তের বেতর বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালায় মাহতিম, পুরো অন্ধকার উবে গিয়ে আলোয় পূরণ হয়ে উঠলো। কৌতুহলী চোখদুটো এবার রাগে ভষ্ম হলো, তীব্র হুঙ্কারে চেঁচিয়ে উঠলো মাহতিম, সোজাসাপ্টা ‘ তুই ‘ সম্বোধন করে বললো সে,
– তুই আমার রুমে কিভাবে ঢুকলি?
অনামিকা ডানহাতের কবজিটা বুলাতে-বুলাতে চোখ খুলে তাকালো, ব্যথায় আর্তনাদ করতে-করতে বললো,
– তুমি আমাকে তুই-তোকারি করছো?
রাগে মাহতিমের নাক-বুক ক্রমশ ফুলে-ফুলে উঠছে, মুখটা রক্তিম হয়ে কপালের দুই পাশে নীল রগ ফুটে উঠেছে। রাগটা কোনোরকম সংবরণ করে তেজালো কন্ঠে বললো,
– তুই ফটাফট আমার রুম থেকে বের হ। আমার সামনে পরে থাকলে তোর মান-সম্মান কিচ্ছু টিকবে না। এক্ষুনি বেরিয়ে যা।
ফুসতে থাকা মাহতিম মাথাটা নিচু করে তর্জনী দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ইশারা করলো। মাহতিমের নত মাথা দেখে অন্য কিছু ভেবে মুচকি হাসলো অনামিকা। শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াতেই সম্মোহনী ভঙ্গিতে কর্মকাণ্ড শুরু করলো,পড়নে সিল্কের সাদা নাইট ড্রেস, কোমরের বাঁদিকে ফিতা ঝুলছে, ড্রেসটা কেবল হাঁটু পযর্ন্ত এবং দৃষ্টিকটু! দুহাত দিয়ে এলোচুল গুলো আস্তে-আস্তে খোপা করলো অনা, বক্ষদেশ ফুলিয়ে অশ্লীল দেহভঙ্গি প্রকাশ করে চুপচাপ দরজার কাছে আসলো। মাহতিম দরজার ডানদিকে নতচোখে দাঁড়িয়ে ছিলো, হঠাৎ কানে ঠাস করে দরজা লাগানোর আওয়াজে ভ্রুঁ কুঁচকে সেদিকে তাকালো। অনামিকা বন্ধ দরজায় পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে রহস্যময়ী দৃষ্টি, ঠোঁটে বাঁকা ও ন্যাকান্যাকা হাসি দিয়ে চেয়ে আছে। মাহতিমের চোখে-চোখ রাখতেই কোমরের বাঁদিকের ফিতায় হাত রাখলো অনা, ছোট্ট গিটটা তর্জনীতে পেচিয়ে খুলতে নিচ্ছিলো। মাহতিমের সজাগ চোখে ওটা ধরা পরতেই সেও চামড়ার বেল্ট খুলতে লাগলো। অনামিকা তার বেল্ট খোলার দৃশ্য দেখে গাঢ় ঠোঁটে হেসে দেয়, নাইটড্রেসের বেশ চওড়া ফিতাটার একটা জায়গা থেকে ছোট্ট একটা জিনিস বের করে। মাহতিম সেটাও স্থির চোখে একপলক দেখে নিয়ে ফের অনার দিকে তাকালো। তার চামড়ার বেল্টটা একটানে কোমর থেকে খুলতেই অনামিকা ছোট্ট জিনিসটা ডানহাতে বাড়িয়ে দিলো। এমন দৃশ্য দেখে মাহতিম দাঁতে-দাঁত পিষে ওমনেই শুরু করলো পৈ’শাচিক আচরণ! প্রত্যেকটা পৈ:শাচিকতা রুমের ভেতর কাঁপিয়ে দিচ্ছে, দূর-দূরান্তে ছুটে যাচ্ছে চিৎকার, রুমের চারটা দেয়ালে তীব্র আঘাতে শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত্ব হচ্ছিলো! ফ্লোরে বিব’শ হয়ে ধপ করে পরে যায়, ঠোঁট ফেটে ফুলে উঠে তার, নাকের ডান ফুটো দিয়ে তরল র’ক্ত দেখা যায়, দেহের ২০৬টা হাড়ে যেনো যন্ত্রণার ইন্ধন ঢুকিয়ে দেয়! সাবু খালার ‘ ও মোর আল্লাহ্ গো ‘ চিৎকার শুনে সিলাজ দৌড়ে ছুটে আসে। এসেই হতভম্বের মতো একবার রক্তাক্ত অনার দিকে তাকায়, আরেকবার হাঁপাতে থাকা মাহতিমের তাকায়। মাহতিমের অবস্থা ও বেল্টটা র-ক্তাক্ত বেল্ট দেখে সিরাজ কাকা আসল র’ক্তমাখা ব্যাপারটা আঁচ করলেও সাবু খালা উলটো ব্যাপার বুঝলো। র-ক্তাক্ত অনামিকাকে দেখে সাবু খালা লো’লুপ কর্মটা ভেবে ‘ হায়, হায় খোদা গো ‘ করতে লাগলো।
.
চোখ খুললো মাহতিম। সেদিনের বীভৎস চিত্রটা সেও শাওয়ার নিচে স্মরণ করলো। কখনো মেয়ের প্রতি এতোটা ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলবে বুঝতে পারেনি মাহতিম। রাগটা সম্ভবত কুরুচিপূর্ণ আচরণের জন্য তুঙ্গে চড়ে গিয়েছিলো, আর সেটাই ছিলো এক নিশ্বাসে পি’টানোর কারণ। শাওয়ারের সিলভার নবটা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে বন্ধ করতেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে-মুছতে চিন্তামগ্ন মাহতিম মেহনূরের জন্য বিষণ্ণ হয়ে গেলো। টাওয়ালটা বিছানায় রেখে রকিং চেয়ারে বসলো সে। সেদিন নক্ষত্রবাড়ি রেসোর্টে অসুস্থ মেহনূরকে নিয়ে পাগলের মতোই হয়েছিলো। জ্বর নামাতে গিয়ে শেষ রাতের দিকে সফল হয় মাহতিম। মেহনূরের মাথাটা তার কোলেই ছিলো সেদিন। আজও মেহনূর অসুস্থ, কিন্তু সে পাষাণের মতো দূরে বসে আছে। হঠাৎ একটা ইনকামিং টেক্সে বিপ হলো ফোনটা। দূর থেকে চোখ বুলাতেই অদ্ভুত স্টাইলে লেখা টেক্সটটা বুকের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেলো!
How’re you feeling my boy? You should talk to your beloved wife. Take care.
– Rajani Ibnat.
‘তোর বউ ঘুমের ঘোরেও কাঁদে রে মাহতিম। ‘ … হঠাৎ কথাটা মনে পরতেই অজানা এক উত্তেজনায় ডেষ্ক থেকে ফোন তুললো। চটপট কল করে রিসিভের জন্য অপেক্ষা করলো, ফোন ধরছেনা! ফোন ধরছেনা কেনো? লাগাতার কলের-পর-কল দিয়েই গেলৌ মাহতিম, কোনো ফুরসত না দিয়ে যেই আট নাম্বার কল দিয়ে বসলো, তৎক্ষণাৎ ওপাশ থেকে রিসিভ হলো সেটা। মাহতিম অস্থির হয়ে বললো,
– হ্যালো? হ্যালো মেহনূর? মেহনূর তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
কোনো উত্তর নেই। কোনো সাড়া না পেয়ে মাহতিম আরো উৎকন্ঠায় ঢলে পরলো,
– মেহনূর প্লিজ রিসপন্স মি! মেহনূর কথা বলো, মেহনূর তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? মেহনূর, মেহনূর কথা বলো।
– চলমান .
#FABIYAH_MOMO