স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ #সাদিয়া_জাহান_উম্মি #পর্বঃ২৫

0
641

#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৫
সূর্যের প্রখরতায় আজ যেন ঝল’সে যাচ্ছে চারপাশ।কয়েকদিন যাবত এসবই হচ্ছে।দিনের আলোতে সূর্য তার দাপট দেখাচ্ছে।ঠিক তেমনই রাত হলেই শীত শীত অনুভব হয়।কি একটা আশ্চর্য মৌসুম এলো।
রিকশায় বসে এসবই ভাবছে আরাবী।আজ একাই এসেছে।ফাহিম আগেই কলেজে চলে গিয়েছে।ওর নাকি দরকারি কাজ আছে।তাই আরাবী আজ একাই যাচ্ছে।আরাবী ভেবে পায় না।ও যখন একা কোথায় যাওয়ার জন্যে বের হয়।তখনই জ্যামে পরতে হয় ওকে?
গরমে মেয়েটা ঘেমেনেয়ে উঠেছে।ওড়নার এক অংশ দিয়ে কপালের আর মুখশ্রীর ঘামটুকু মুছে নিলো।অনেকক্ষণ যাবত রোদে বসায় মাথাটাও ব্যথা করছে প্রচুর।আরও পনেরো মিনিট আরাবী অপেক্ষা করল।এইবার বিরক্ত হয়ে ভাবল আর অফিসে যাবেই না।জায়ানকে ফোন করে বারণ করে দিবে।যেই ভাবা সেই কাজ।আরাবী ফোন করল জায়ানকে।প্রথমবার রিং হয়ে কেটে গেলো।আরাবী আবারও ট্রায় করল।এইবারও ধরল না।আরাবী এইবার অবাক হলো।এমন তো কোনো সময় হয় না।আরাবী কল দিলে একটা রিং কোনোরকম হলেই জায়ান ওর কল কেটে।সাথে সাথে কল ব্যাক করে।সেখানে আজ আরাবী এতোগুলো ফোন করল।একটাও ধরল না।তবে কি লোকটার কোনো বিপদ-আপদ হলো?অফিসে না যাওয়ার চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল আরাবী।এক নাগাঢ়ে জায়ানকে ফোন দিতে লাগল।নাহ,ধরছে না।জ্যাম ছাড়ল তার কিছুক্ষণ পরেই।আরাবী রিকশাওয়ালাকে দ্রুত চালাতে বলল।অফিসে সামনে রিকশা থামতেই।ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করল।লিফটের সামনে এসে দেখে সেটা আসতে অনেক দেরি।আরাবী অপেক্ষা না করে সিড়ি দিয়েই উপরে উঠতে লাগল। একে একে সিড়ি দিয়ে উঠে তিনতলার সিড়িতে পা রাখতেই দু একজন মেয়ের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কথা কানে আসে আরাবীর।সাথে সাথে পা জোড়া থেমে যায় ওর।সেখানেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।কথাগুলো ঠিক এমন।
‘ আরে শুনেছিস আহানা ম্যাম আজ জায়ান স্যারের সাথেই অফিসে এসেছে।দুজনকে একসাথে অনেক সুন্দর লাগে।ম্যাম নাকি কালই দেশে ফিরেছে।আর আজকেই স্যার তাকে অফিসে নিয়ে এসেছেন।আমরা যা ভেবেছি তাই ঠিক।স্যার আর আহানা ম্যাম জিএফ,বিএফ।দুজন সেইযে অফিসরুমে ঢুকেছে এখনও বের হয়নি।একটা মেয়েকে কি খামোখা স্যার তার আশেপাশে এইভাবে ঘেষতে দিবে?কই আমাদের দিকে তো কোনোদিন তাকিয়েও দেখেনি স্যার।’

আরেকজন বলছে,
‘ আরে হ্যা সে যাই বলছিস তুই।আহানা ম্যাম এতো সুন্দরী। তাকে রেখে ওই কি যেন নাম আরাবী।ওই মেয়েকে স্যার বিয়ে করবে এটা মানা যায়?আমরাও তো ওই মেয়ের থেকে বহুগুন সুন্দর।আর ওই মেয়ে তো কালো। স্যার কি সুন্দর।ওই মেয়েই কিছু একটা করেছে স্যারের উপর।নাহলে স্যার এই মেয়েকে কেন বিয়ে কর‍তে রাজি হবে?ওই মেয়ে তো বড়লোকও না।মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির থেকে বিলং করে।বামুন হয়ে আকাশের চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়েছে।মুখ ধুব’ড়ে পরলেই উচিত শিক্ষা পাবে।’

মেয়েগুলো আরও নানান কথা বলতে বলতে চলে গেলো।আর তাদের বলা কথাগুলো তীরের মতো এসে বিধল আরাবীর বুকে।মনে হলো কে যেন ধারা’লো ছু’ড়ি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করছে ওর হৃৎপিণ্ডে।শ্বাস নিতে পারছে না আরাবী।চোখজোড়া জলে টইটম্বুর। পলক ঝাপ্টাতেই যা গড়িয়ে পরল ওর গাল বেয়ে।এই অপমান,এই তিরিস্কার।এইসবেরই তো ভয় পাচ্ছিলো আরাবী।আর আজ সেটাই হলো।আরাবী জায়ানকে অবিশ্বাস করে না।লোকটা এমন কোনো কাজ করবে না ও জনে।বিশ্বাস করে জায়ানকে মনেপ্রাণে। তবে মেয়েগুলোর কটুক্তিগুলো তীক্ষ্ণ ধনুকের ন্যায় আ’ঘাত করছে ওকে।কানে শুধু ওই কথাগুলোই বাজছে।আরাবীর আগে থেকেই সোশ্যাল ফোবিয়ার সমস্যা আছে।ওই কারনেই এখন আরাবীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে যাচ্ছে।এমনিতেই মাথা ব্যথা ছিলো।সেটা যেন এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে।আরাবীর পুরো শরীর কাঁপছে ভয়ানকভাবে।কাঁপা হাতজোড়া তুলে চোখের জলগুলো মুছে নিলো।নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করতে লাগল আরাবী।বহু কষ্টে টালমাটাল পায়ে কাঙ্ক্ষিত স্থানে এসে পৌছালো আরাবী।এক দু কদমে এখন জায়ানের অফিসরুমের দিকে যাচ্ছে।আর আশেপাশে সবাই ওকে কেমন একটা নজরে দেখছে।ভয়ে,লজ্জায়,অস্বস্তিতে আরাবী আরও কুকড়ে গেলো।পা-জোড়া যেন চলছে না।অফিসরুমটার সামনে আসতেই আরাবী নক না করেই দরজাটা খুলে ফেলল খুব ধীর আওয়াজে।কারন জায়ানই ওকে বারণ করেছে ওর এখানে আসতে নক করার প্রয়োজন নেই।আরাবী ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখে জায়ান আর তার পাশে অতি সুন্দরী একটা মেয়ে দাঁড়ানো।মেয়েটার পরনে সাদা লেডিস টি-শার্ট আর কালো লেগিংস।ফর্সা গায়ে মানিয়েছে বেশ মেয়েটাকে।চুলগুলো সোনালী রঙের হেয়ার কালার করা।মেয়েটা এতোটাই ফর্সা আর যেরকম বেশ-ভূষা করেছে।দেখতে একদম বিদেশি পুতুলের মতোই লাগছে।জায়ানের সাথে আসলেই মেয়েটাকে অনেক মানাবে।এই মেয়ের সৌন্দর্যের কাছে আরাবী কিছুই না। ‘ ও জায়ানের যোগ্য না। ‘ এই কথাটা বার বার মস্তিষ্কে হানা দিতে লাগল।পুরনো সেই ফোবিয়ার কারনে আরাবী মূর্ছা যেতে লাগল।সোশ্যাল ফোবিয়াটা মেয়েটা পুরোপুনি কাটিয়ে উঠতে পারিনি যে।তাই আবারও যেই ফোবিয়ার কারনে প্যানিক এট্যাক শুরু হলো আরাবীর।এইবার যেন মাত্রা ছাড়া শরীর কাঁপছে মেয়েটার।নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছে না আর।
_____
গতকাল বিকেলে জায়ানের খালামুনি, খালু আর ওর খালাতো বোন বিডিতে এসেছে।ওর মা আহানার সাথে ওর বিয়ে দিতে চাইলেও।জায়ান আর আহানার মাঝে এমন সম্পর্ক কোনোদিনই ছিলো না।আহানা জায়ানকে বড়ো ভাই মানে। সম্মান করে বড়ো ভাইয়ের মতো।জায়ানও আহানাকে ঠিক নূরের মতো আদর আর স্নেহ করে। ওদের মাঝে ভাই-বোনেরই সম্পর্ক। মেয়েটা এসেই গতকাল বায়না ধরেছে আরাবীর সাথে দেখা করবে।তার ভাবির সাথে দেখা করবে।জায়ান বলেছে রাতে কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে দেখা করাবে।কিন্তু মেয়েটা যেন ধৈর্যহারা।সে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তার ভাবির সাথে দেখা করবে।তাই জায়ান ওকে অফিসে নিয়ে এসেছে।আরাবী আসলেই ওর সাথে দেখা করবে।এখানে এসে জায়ান,আহানা আর ইফতি কথা বলছিলো।আহানা তো দু ভাইকে পেয়ে রাজ্যের কথা শুরু করে দিয়েছে।ও বিদেশে কি কি করত,ওখানে ওর স্টাডি কেমন চলছে।তারপর জায়ানের বিয়েতে অনেক এঞ্জয় করবে ও।কি কি প্লানিং করে রেখেছে তা শোনাচ্ছে দু ভাইকে।জায়ান সেসবে পাত্তা না দিয়ে কাজ করতে যেতে নিলে জায়ানের ল্যাপটপ,ফোন সব নিয়ে একটা ড্রয়ারে তালা মেরে চাবি নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয়।সে আজ তার ভাইদের সাথে গল্প করবে।আসলে আহানা বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে।তাই ভীষণ আদুরে।আর জায়ান আর ইফতিও ওকে নূরের মতোই স্নেহ করে।মেয়েটার যে আর কোনো ভাই বা বোন নেই।তাই তো জায়ান,ইফতি আর নূরকে আপন ভাই বোনের চোখে দেখে।
এদিকে জায়ান যেন আহানার বকবক শুনে বিরক্ত হলো।আবার বেশি বিরক্ত হচ্ছে আরাবী আসছে না দেখে।আধাঘন্টা লেইট হয়ে গিয়েছে।অথচ এখনও মেয়েটা আসছে না।এদিকে এই ইফতিটাও ওয়াশরুমে ঢুকে বসে আছে।ইফতির কাছে আহানাকে ধরিয়ে দিয়ে।সে এখান থেকে সরে পরবে।
জায়ান যখন নিজের ভাবনায় ব্যস্ত।হঠাৎ আরাবীর অস্তিত্ব অনুভব হতেই সজাগ হয় ও।আরাবীকে নিজের রন্দ্রে রন্দ্রে অনুভব করে জায়ান।আরাবীর শরীরের মেয়েলী ঘ্রাণ যেন ওর রক্তে মিশে গিয়েছে।তাই মেয়েটা আশেপাশে থাকলেই জায়ান না দেখেই বলে দিতে পারে।জায়ান চট করে দরজার দিকে তাকালো।ওর ধারণাই সঠিক হলো।ওই তো মেয়েটা দাঁড়িয়ে।জায়ান উঠে দাঁড়ালো।দ্রুত কদমে এগিয়ে যেতে লাগল আরাবীর দিকে।কিন্তু যতো কাছে এগোচ্ছে আরাবীর শোচনীয় অবস্থা দেখে বুকটা ধ্বক করে উঠে জায়ানের।তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে যায় আরাবীর দিকে।কাছে আসতেই আরাবীর দুগালে হাত রাখে জায়ান।সাথে সাথে অনুভব হয় আরাবীর দেহের কম্পন।জহুরি নজরে আরাবীকে দেখল জায়ান।আরাবী ফ্যাকাশে মুখশ্রী,জলে ভড়া দূর্বল চোখ জোড়া।চোখ দুটো যেন নিস্প্রাণ হয়ে আছে।ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে খরখরে হয়ে গিয়েছে। থরথর করে কাঁপছে শরীর মেয়েটার।কেমন হাপানি রোগীর মতো শ্বাস নিচ্ছে। যেন মেয়েটার শ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।জায়ান দ্রুত আরাবীর বাহু আঁকড়ে ধরল।উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠল,
‘ আরাবী?কি হলো?তোমায় এমন দেখাচ্ছে….’

কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলো না জায়ান।তার আগেই আরাবী চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলে।অন্ধকার ছাড়া মেয়েটা আর কিছুই দেখতে পেলো না।লুটিয়ে পরল জায়ানের বুকে।নিজেকে ধরে রাখতে আর সক্ষম হতে পারেনি ও।প্যানিক এট্যাকের কারনে একদম নেতিয়ে গিয়েছে মেয়েটা।জায়ান অবাক হয়ে আছে।আরাবীর কোমল দেহটা অতি যত্নসহকারে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরল।এর মাঝে ইফতি বেড়িয়ে আসল ওয়াশরুম থেকে।জায়ানের বুকে আরাবীকে দেখে ছেলেটা ভড়কে যায়।বলে উঠে,
‘ ভাই?ভাবির কি হয়েছে?’

বলতে বলতে দ্রুত এগিয়ে আসে।জায়ান শান্ত চোখে তাকালো ইফতির দিকে।ঠাণ্ডা স্বরে বলে উঠল,
‘ কল দ্যা ডক্টর, ইফতি।’

ইফতি দ্রুত ডক্টরের নাম্বারে কল করল।জায়ান আরাবীকে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসালো।তারপর নিজে ওর পাশে বসে আরাবীকে আবারও নিজের বুকের মাঝে আগলে নিলো। এদিকে আহানা অবাক হয়ে শুধু সব দেখছে।বেচারি মাঝে থেকে কিছুই বুঝতে পারছে না।আপাততো চুপচাপ সবকিছু অবলোকন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই ওর কাছে।এখন চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করল মেয়েটা।

#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here