স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ #সাদিয়া_জাহান_উম্মি #পর্বঃ২৮

0
608

#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৮
আজ বিয়ের শপিংয়ে যাবে সবাই। আরাবী, ওর বাবা,মা,ফাহিম সবাইকেই আসতে বলেছে সাখাওয়াত পরিবার।জিহাদ সাহেব আর লিপি বেগম আসবেন না জানিয়ে দিয়েছেন।এটা কি হয়?মেয়ের বিয়ের শপিংয়ে তারা কিভাবে যাবে?ফাহিমও যাবে না বলেছিলো।কিন্তু আরাবী ফাহিমকে সাথে নিবেই নিবে।সাখাওয়াত পরিবারের সাথে এখনও আরাবী মানিয়ে নিতে পারেনি।সম্পূর্ণ অচেনাই ধরতে গেলে তারা।ওখানে একা গেলে অস্বস্তি লাগবে ওর।তাই ফাহিমকেও জোড়াজুড়ি করে রাজি করিয়েছে।এখন তৈরি হয়ে বসে আছে আরাবী।জায়ান নিতে আসতে চেয়েছিলো।আরাবী নিজেই মানা করে দিয়েছে।ফাহিমের সাথে এসে পরবে ও।জায়ান রাজি হচ্ছিলো না।আরাবী অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে।
এদিকে ফাহিম কলেজ থেকে আসতেই ঝটপট গোসল নিয়ে তৈরি হয়ে নিলো।ফাহিম আসতেই ওরা বেড়িয়ে পরল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

বসুন্ধরা শপিং মলের সামনে বাইক থামালো ফাহিম।ফাহিমের একটু অস্বস্তি লাগছে।ওরা কখনই এতো বড়ো শপিং মলে শপিং করতে আসেনি।ওদের ইনকাম যেটুকু সেটুকু অনুযায়ী বড়ো জোড় নিউ মার্কেট যায়।বসুন্ধরায় জিনিসপত্রের যেই দাম। তা ওদের ধরাছোঁয়ার বাহিরে।ফাহিম আরাবীর দিকে তাকালো।বোনটার তার রাজ কপাল।তবে ফাহিম কখনই আশা করেনি আরাবীকে বড়োলোক বাড়িতে বিয়ে দিবে। ও চাইতো সামান্য তিনবেলা দুটো ভাত আর নিজের সম্মান আর ইজ্জত রক্ষার ক্ষেত্রে পরিধানের দুটো কাপড় পেয়েও যেন তার বোন সুখে থাকে।একটা দায়িত্ববান,ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার আশা করেছিলো ফাহিম।সেই সাথে একটা ভালো পরিবার। আরাবী তো ওর কাছে আর ওর বাবা মায়ের কাছে হুরপরি।কিন্তু সমাজের লোক কি তা মানে?আরাবীর গায়ের রঙের কারনে ফাহিম এই আশা কোনোদিন করেনি।ওর বোন তো ওর কাছে অনেক সুন্দর।কিন্তু বাকিরা তো এই সৌন্দর্য বুঝবে না।
কিন্তু উপর ওয়ালা ওদের উপর মনে হয় অনেক সন্তুষ্ট। তাই তো এতো ভালো পরিবার আর এতো ভালো ছেলের কাছে বোনকে বিয়ে দিতে পারছে। সেই সাথে টাকা পয়সারও অভাব নেই।বোনটা তার রাজরানি হয়ে থাকবে।
ফাহিম আরাবীর হাস্যজ্জ্বল ওই মুখের দিকে যতোবার তাকায়।ততোবারই বুঝতে পারে এখানে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো ভুল করেনি ফাহিম।আরাবীর মুখ থেকে যেই উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়াচ্ছে এতেই বোঝা যায় বোন তার ভীষণ খুশি এই সম্বন্ধে।এসব ভেবেই মুচঁকি হাসল ফাহিম।
ফাহিম ঘুরে দাঁড়ালো।এখন ভেতরে যেতে হবে।কিন্তু তার আগেই দূর থেকে ছুটে আসতে থাকা নূরকে দেখেই হকচকিয়ে যায়। এই মেয়ে এমন ম্যারাথন রেসের প্রতিযোগিদের মতো দৌড়াচ্ছে কেন?পরে গেলে তখন কি হবে?আর এতোগুলো মানুষ এখানে।যদি কারো সাথে ধাক্কা লেগে যায়?যদি কোনো ছেলের সাথে ধাক্কা লাগে?তখন কি হবে?এসব ভেবেই ভ্রু-কুচকে আসে ফাহিমের।এদিকে ফাহিমের কাছে এসেই পায়ের গতিতে ব্রেক কষে নূর।থামতেই দু হাটুতে ভড় দিয়ে হাপাতে লাগে।ফাহিম তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
‘ যেভাবে দৌড়াচ্ছিলেন।মনে হচ্ছে পাগলা কুকুর তাড়া করছিলো।’

নূর সোজা হয়ে দাঁড়ালো এইবার।ফাহিমের দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো।বলল,
‘ বেয়াই সাহেব আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন?’

ফাহিম বুকের মধ্যে দুহাত ভাজ করে বেধে বলে,
‘ তাই নাকি?তা আমি ঠিক কিভাবে আপনার অপমান করলাম?’

ফাহিম তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো নূরের দিকে।নূর হকচকিয়ে গেলো ওমন দৃষ্টিতে।হাজারও সাহস রাখুক মনে। ফাহিম এমন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালে ওর সবকিছু গুলিয়ে যায়।
তাও নূর সেটা বুঝতে দিলো না ফাহিমকে।উলটো বুক ভেংচি কেটে বলল,
‘ আমি ভাবিকে দেখে দৌড়ে এসেছি।আপনি এক ডিগ্রি বেশি বুঝেন বেয়াই সাহেব।’

নূর গিয়ে এইবার আরাবীকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।
‘ আহ,ভাবিইইই আমি তোমাকে ভীষণ মিস করেছি।’

আরাবী এতোক্ষণ ফাহিম আর নূরের ঝগড়া দেখছিলো।বেশ মজাই লাগছিলো দেখতে।ওর ভাই যে এভাবে কোনো মেয়ের সাথে তর্কে জড়াতে পারে তা এই প্রথম দেখল আরাবী।তাই তো এতোটা এক্সাইটেড হয়ে দেখছিলো।
তারপর হঠাৎ করে নূর এসে এভাবে ধরায় মেয়েটা চমকে উঠে।পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে নূরকেও জড়িয়ে ধরল।মুচঁকি হেসে বলে,
‘ আমিও মিস করেছি।’

নূর এইবার আরাবীকে ছেড়ে দিলো।তারপর গাল ফুলিয়ে বলে,’ মিথ্যে কথা বলছ তুমি।’

আরাবী ভড়কে যায়।আমতা আমতা করে বলে, ‘ মিথ্যে কথা কখন বললাম নূর?’
‘ এইযে তুমি বললে তুমিও আমায় মিস করেছ।যদি মিস করেই থাকতে তাহলে আমাকে একটাবার ফোন দিতে,তাই নাহ?’

আরাবীর ঠোঁটের হাসি নিভে আসল।মুখ ভাড় করে বলে,
‘ তোমার ফোন নাম্বার তো আমার কাছে নেই।তাই তো ফোন দিতে পারিনি।তবে তোমার ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করো আসলে।আমি তোমাদের সবার কথা তার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করি।’

নূর হেসে ফেলল এইবার।বলল,
‘ আরে ভাবি চিল।মন খারাপ করছ কেন?আমি তো জাস্ট মজা করলাম।তবে দোষ তোমার বরের বুঝলে? জায়ান ভাইয়া একদিন কথা বলছিলো তোমার সাথে।আমি এতো করে চাইলাম কথা বলার জন্যে তোমার সাথে।কিন্তু সে দিলোই না।এর বিচার তুমি করবে।বুঝলে?বকা দিবে ভাইয়াকে।’

‘ কে কাকে বকা দিবে?’ গম্ভীর স্বরের আওয়াজে চমকে উঠে আরাবী।পাশে তাকিয়ে দেখে জায়ান দাঁড়ানো ওর সাথে।জায়ান নূরের দিকে ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে আছে।কিন্তু সুযোগ বুঝে আরাবীর হাত ধরতে দেরি করল না।জায়ান এমনটা করায় চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো আরবী।কি? কি করছে কি লোকটা।নূর,ইফতি, আর ওর ভাই সবাই এখানে।আর এই লোক সবার সামনে এভাবে ওর হাত ধরে নিলো।ইশ,সবাই দেখলে কি ভাববে?লজ্জা পাবে না ও?

জায়ান নূরকে আবারও প্রশ্ন করে,’ কিরে বললি না।কে কাকে বকা দিবে?’

নূর দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,’ এখন একদম ভয় পাই না আমি তোমায়।বুঝলে?আমার সাইড এখন ভারি হয়েছে।ভাবি আমার পক্ষে।আমাকে কিছু বললে। ভাবি তোমাকে বকা দিবে।তাই নাহ ভাবি?’

শেষের বাক্যটা বলে উত্তরের আশায় তাকালো নূর।আরাবী থতমত খেলো।পর পর মৃদু মাথা দোলালো।জায়ান এইবার আরাবীর হাতে চাপ দিলো।আরাবী তাকালো জায়ানের দিকে।জায়ান বাকা হেসে বলে,’ তুমি আমাকে বকা দিবে?’

আরাবী দ্রুত মাথা দুলিয়ে জায়ানকে না বোঝালো।জায়ান মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে হেসে ফেলল। এই মেয়েটা এতো কিউট কেন?ওর এমন বোকা বোকা চাহনী দেখলেই তো জায়ান পাগল হয়ে যায়।বড্ড ড্যাস্পারেট হয়ে পরে ও।তখন খুব করে কাছে পেতে ইচ্ছে করে মেয়েটাকে।তবে এতোটা ড্যাস্পারেট হলে তো হবে না।আর মাত্র কয়েকটা দিন।এই কয়েকটা দিন তো ধৈর্য ধরে থাকতেই হবে।
ভাবমার মাঝেই ফোন বেজে উঠে জায়ানের।জায়ান রিসিভ করল।ওপাশ থেকে কথাগুলো শুনে বলে,
‘ ইয়াহ মম।উই আর কামিং।হ্যিয়ার উই আর ইন দ্যা পার্কিং এরিয়া।হ্যা আরাবী আর ফাহিমকে এখানেই পেয়েছি।হ্যা নূর ও এখানেই আছে।’

ফোন কাটতেই জায়ান এইবার সবার উদ্দেশ্যে বলে,
‘ চলো এইবার ভেতরে যাওয়া যাক।সবাই অপেক্ষা করছে।’

সবাই সম্মতি দিলো।
______________
একের পর এক শাড়ি,লেহেঙা দোকানদার বের করেই যাচ্ছে।ঠিক কোনোটাই ভালো লাগছে না জায়ানের।

জায়ানের মেজাজ খিটখিটে হয়ে গিয়েছে একদম।তারপরেই নিজেকে শান্ত রেখে বলে,
‘ শ্যো মি সামথিং বিউটিফুল এ্যাণ্ড ইউনিক।এইগুলো একটাও ভালো না।’
‘ ওকে স্যার।জাস্ট ওয়ান মিনিট।এইবার এমন দুটো লেহেঙা দেখাবো যে।আপনি পছন্দ না করে থাকতেই পারবেন না।’

জায়ান মাথা দোলালো।দোকানদার দুটো ড্রেস আনলেন।তারপর সেটা খুলে দেখালেন জায়ানকে। একটা সিঁদূর লাল রঙের লেহেঙা।যেটার কারুকাজ জায়ানের পছন্দ হলো না।তারপর অপর ড্রেসটা জায়ান খুলতে বলল।সেটা খুলতেই জায়ানের যেন নজর কেরে নিলো সাথে।
একটা পাকিস্তানি র‍্যোয়াল ব্রাইডাল গাউন এটা।কালো খয়েরী রঙের মধ্যে গোল্ডেন জারি সুতোর কাজ করা।তার মাঝে হ্যাবি স্টোনের কাজ।এটার দোপাট্টাটাও ভীষণ সুন্দর।জায়ানের এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেলো।
জায়ান হাসি হাসি মুখ করে বলে,
‘ এটাই ফাইনাল। এটাই নিবো আমরা।আরাবী।’

আরাবী ডাক শুনে বলে,’ জি বলুন।’
‘ যাও এটা নিয়ে ট্রায়াল রুমে গিয়ে একটু পরে দেখে আস।’

জায়ান গাউনটা নিয়ে আরাবীকে ট্রায়াল রুমে নিয়ে গেলো। কারন গাউনটা বেশ ভারি।জায়ান সেটা জায়গা মতো রাখল।আরাবী ভেতরে আসলে জায়ান বলল,
‘ একা একা পরতে পারবে?নাকি আমি হ্যাল্প করব?’

আরাবী জায়ানকে ঠেলে বাহির করতে করতে বলে,
‘ ইশ, শখ কতো। দেখি বাহির হন এখন।’

জায়ান ট্রায়াল রুমের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ এখন তো এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছ।কিন্তু শীঘ্রই এমন একটা সময় আসবে।তখন তুমি চাইলেও আমাকে এভাবে সরাতে পারবে না।’

আরাবী লজ্জা পেলে। বলল,
‘ উফ যান তো আপনি।শুধু অসভ্য কথাবার্তা বলে।খারাপ লোক একটা।’

জায়ান হাসতে হাসতে সরে আসল।আরাবী দরজা আটকে এইবার ড্রেসটা পরল।তাও বহু কষ্টে।অনেক যুদ্ধ করার পর অবশেষে পরতে সক্ষম হলো আরাবী।আরাবী দেখল ড্রেসটা পুরো ঠিক আছে। না জানি ওকে কেমন লাগছে দেখতে।একটা আয়না হলে ভালো হতো।তবে আর আয়না দেখতে চাইলো না আরাবী।ড্রেসটা যেহেতু জায়ানের পছন্দ হয়েছে। তো এইটাই পরবে আরাবী।জামাটা ঠিকই আছে ওর সাইজ অনুযায়ী।আবারও যুদ্ধ করে খুলল জামাটা।নিজেকে ঠিক ঠাক করে দরজা খুলল।আরাবী দেখেই জায়ান প্রশ্ন করল,
‘ ড্রেসটা ঠিক আছে?’
‘ হুম।’
‘ বেশি হ্যাবি?তুমি চাইলে আরও কিছু দেখতে পারি আমরা।’

আরাবী হালকা হেসে বলে,
‘ কতো কিছুই তো দেখলাম।এইটাই সবচেয়ে সুন্দর।এইটাই ঠিক আছে।’

জায়ান আবারও ড্রেসটা নিয়ে আসল।তারপর দোকানদারকে বলল এইটা প্যাক করে দিতে।
এইবার হলুদ আর বউভাতের ড্রেস সিলেক্ট করল।সেটা করতে বেশি সময় লাগল না।হলুদের লেহেঙা হলুদ রঙের মাঝে জারি সুতোর কাজ করা।আর মিরর ওয়ার্ক করা সেই সাথে স্টোন ওয়ার্ক তো আছেই।বউভাতের লেহেঙাটা নিলো ফুল ব্লাক।জারি সুতোর কারুকাজের মধ্যে গোল্ডেন স্টোন বসানো।সবগুলো ড্রেসই নজর কারা।জায়ানও ম্যাচিং সব শেরওয়ানি নিলো আরাবীর ড্রেসের সাথে মিলিয়ে।এরপর জুয়েলারি শপে গেলো তারা।সবগুলো অকেশনের জন্যে সিলেক্ট করা ড্রেসের সাথে মিলিয়ে জুয়েলারি কেনা হলো।মূলত আরাবীর এ টু জেট যা যা কেনা হয়েছে।সব জায়ান নিজে পছন্দ করে কিনেছে।আরাবীর খুব ভালো লাগছে।এইভাবে জায়ানের সাথে সময় কাটাতে।লোকটা কি পাগলামিই না করছে।
এই তো বিয়ের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি।এরপরেই দুজন সারাজীবনের জন্যে এক হয়ে যাবে ওরা।এসব ভাবলেই আরাবীর ধুকপুকানি যেন বেরে যায় দ্বিগুনভাবে।

#চলবে________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here