#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩০
‘ আহানা এখনও সময় আছে।তুই চাইলে আমরা আরাবীকে সরিয়ে ফেলব।তোর আর জায়ানের বিয়ে হবে কাল।একবার রাজি হয়ে যা।’ সুহানা সাখাওয়াত আহানাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
আহানা অবিশ্বাস্য নজরে তাকালো সুহানার দিকে।বলল,
‘ এসব তুমি কি বলছ খালামুনি।এসব কিভাবে হয়?আমি জায়ান ভাইয়াকে ছোটো বেলা থেকে নিজের বড়ো ভাই মানি।ইনফ্যাক্ট সে আমার বড়ো ভাই।তাকে আমি কিভাবে বিয়ে করব?এসব তো ভাবাও পাপ।’
সুহানা সাখাওয়াত ভেতরে ভেতরে বেজায় রাগে ফুসছেন।মন তো তার চাচ্ছে মেয়েটা ঠা’টিয়ে দুটো চ’ড় মেরে দিতে।তারপরেও কণ্ঠস্বর যথেষ্ট নরম করে বলেন,
‘ ভাই ঠিক আছে।কিন্তু আপন তো আর নাহ। তাই নাহ?তাহলে?কাজিনদের মধ্যে বিয়ে হয়।এটা পাপ না।’
আহানা এইবার দাঁড়িয়ে গেলো।রাগান্বিত স্বরে বলে,
‘ এসব কথা বন্ধ করো খালামুনি।আমার আর জায়ান ভাইয়ার মাঝে এসব কোনো সম্পর্ক হওয়া কোনোদিন সম্ভব না।আর জায়ান ভাইয়া ভাবিকে প্রচণ্ড ভালোবাসে।এসব জানতে পারলে ভাইয়া অনেক রাগ করবে তোমার উপর।এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলো খালামুনি।নাহলে ভবিষ্যতে ভালো হবে না।আর আমি বিয়েটা এঞ্জয় করতে এসেছি।আমাকে এঞ্জয় করতে দেও।প্লিজ এসব ফালতু কথা বলে আমার মন মেজাজ খারাপ করবে না।নাহলে আমি আজই চলে যাবো এখান থেকে।’
কথাগুলো শেষ করে হনহন করে বেরিয়ে গেলো আহানা।সুহানা সাখাওয়াত দাঁতেদাঁত চেপে বসে রইলেন।তারপর ফোন করলেন আহানার বাবাকে।
ফোন রিসিভ হতেই বলেন,
‘ আপনার মেয়ে তো আমার কোনো কথাই শুনলো না শামিম ভাই।উলটো আমাকে কতোগুলো জ্ঞান বিতরন করে করে চলে গেলো।’
শামিম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে বলেন,
‘ সুহানা আমাদের উচিত এখানে থেমে যাওয়া।আমার মেয়ে যেহেতু রাজি না।আমি আহানাকে আর জোড় করব না।আমার মেয়ের মতের বিরুদ্ধে আর কিছুই করবো না।তাছাড়া আমাদের উচিত এসব পা’প ছেড়ে দেওয়া।আর কতোদিন এভাবে চলবে সুহানা।আমার কেমন যেন ভয় কর ইদানীং। মনে হয় খুব শীঘ্রই আমাদের এইসব ঘৃনিত কাজ সবার সামনে এসে পরবে।তাও খুব বাজেভাবে।তুমি সাথিকে…’
শামিমকে আর বলতে দিলো না সুহানা।চেচিয়ে উঠল,
‘ চুপ! আর একটা কথাও আমি শুনতে চাই না।এতো সাধু সন্নাসী হলে এক আনাও কপালে জুটবে না।’
‘ আমার চাইনা টাকা পয়সা সুহানা।তুমিই সব দখল করে নেও পারলে।কিন্তু আমাকে আর এসবে জড়াবে না।আমি চাইনা আমার মেয়ে আমাকে ঘৃণার নজরে দেখুক।শুধু তোমায় এটুকু বলব সময় আছে ভালো হয়ে যাও।এসব বন্ধ করে দেও।’
‘ আই ডোন্ট নিড এনি সাজেশন ফ্রম ইয়্যু।’
এই বলে সুহানা ফোন কেটে দিলো।দাঁতেদাঁত চিপে বসে পরল বিছানায়।কিছুই হচ্ছে না ওর প্লান মোতাবেক।শেষমেষ কি ওই মেয়েটাই জায়ানের বউ হবে?
হুংকার করে উঠল সুহানা,
‘ নাহ,এটা হবে না।আমি ওই কালি মেয়েটাকে কিছুতেই মানতে পারবে না।ওই মেয়ের কোনো যোগ্যতাই নেই জায়ানের বউ হবার।আমার স্বপ্ন এভাবে ভেঙেচুরে যেতে পারে না।আমার এতো বছরের কষ্ট এভাবে বিসর্জন হতে পারে না।’
রাগে ফোস ফোস করতে লাগল সুহানা।সে নিজের মন মতো চিল্লাচ্ছে।কারন রাত তিনটে বাজে।এখন নিশ্চয়ই কেউ জেগে নেই।আহানাও ঘুমোতে যাচ্ছিলো।ঘন্টাখানিক আগে কমিউনিটি সেন্টার থেকে ফিরেছে তারা।আহানা ঘুমোতে যাবে তখন সুহানা আহাকাকে ডেকে এনে বোঝানোর চেষ্টা করে।তিনি তো মনে করছিলেন সবাই ঘুমিয়ে পরেছে।কিন্তু না এমনটা না।
নূর ফ্রেস হয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলো। পানি আনার জন্যে।তখন ও খেয়াল করে আহানাকে ডেকে সুহানা নিজের সাথে নিয়ে যাচ্ছে।তাই নূর ওদের পিছু পিছু যায়।আর সম্পূর্ণ ঘটনা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শোনে।দরজা অবশ্য আটকানো ছিলো।তাই আবছা শুনেছে নূর।তবে আহানা যখন দরজা খুলে চলে যায়।তখন আর সুহানা দরজা আটকায়নি।এতে সুবিধা হয় নূরের।দরজা খোলা পেয়েই ঝটপট ভিডিও করে নেয় সুহানা আর শামিমের কথাবার্তা। তারপর দ্রুত নিজের রুমে চলে আসে।যথেষ্ট প্রমান এখন হাতে পেয়ে গিয়েছে নূর।এখন অপেক্ষা সঠিক সময়ের।জায়ানের বিয়েটা ভালোভাবে সম্পূর্ণ হলেই জায়ানকে এসব ব্যাপারে সব জানাবে নূর।আর দেরি করবে না।আর আরাবীর খেয়াল রাখতে হবে।মেয়েটার না ক্ষতি করে দেয়।তাই ভাবল কিছু গার্ড আগামীকাল আরাবীকে দেখে রাখার জন্যে পাঠিয়ে দিবে।মনে মনে এসব প্লান করে ঘুমোতে যায় নূর।তার আগে ভিডিওটা ওর ল্যাপটপ,ওর এক্সট্রা একটা ফোন আছে সেখানেও সেন্ড করে রেখে দিলো।
———-
এতো এতো অপেক্ষার পর অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সময়টা এসেই পরল।আজ জায়ান আর আরাবীর জীবনের সবচেয়ে খুশির আর গুরুত্বপূর্ণ দিন।আর ওরা সারাজীবনের জন্যে একে-অপরের হয়ে যাবে।বাধা পরবে পবিত্র বন্ধনে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরাবী।আজ পার্লারেই এসেছে।আরাবী বলেছিলো আলিফাকেই সাজিয়ে দিতে।কিন্তু আলিফা মানা করে দিয়েছে।বিয়ের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন।যদি কোনো কিছু গড়বড় হয়ে যায়?তাই আলিফা আরাবীকে পার্লারে নিয়ে এসেছে।সাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। আরাবী আয়নায় নিজেকে দেখছে।আচ্ছা বঁধু সাজলে কি সবাইকেই এতো সুন্দর লাগে।আজ যেন নিজেকে নিজেই চিনতে পারছে আরাবী।জায়ানের দেওয়া রোয়্যাল ব্রাইডাল পাকিস্তানি গাউনটা এতো সুন্দর।আলিফার সাজ সম্পূর্ণ হয়েছে।ও আরাবীর সামনে এসেই হা করে তাকিয়ে রইলো।আরাবী হেসে আলিফার হা করা মুখটা বন্ধ করে দিলো।আলিফা ঢোক গিলে বলে,
‘ ইয়ার,কি সুন্দর লাগছে তোকে।নজর না লাগুক তোর গায়ে।মাশা-আল্লাহ। ‘
আলিফা চোখের কোন থেকে একটুখানি কাজল নিয়ে আরাবীর কানের পেছনে লাগিয়ে দিলো।আরাবী মুচঁকি হাসল।তারপর নিজের চোখের কোণ থেকে কাজল নিয়ে আলিফাকেও লাগিয়ে দিলো। বলল,
‘ তোকেও ভীষণ সুন্দর লাগছে আমার দেবরানি জি।’
আলিফা হেসে দিলো আরাবীর দেবরানি সম্বোধনে।তারপর হাত ঘড়িটা দেখে বলে,’ চল এখন যাওয়া যাক।জায়ান ভাইয়াদেরও আসার সময় হয়ে যাচ্ছে।তারা পৌছানোর আগে আমাদের কমিউনিটি সেন্টারে পৌছাতে হবে।তোর বিয়ের গেট ধরতে হবে নাহ?’
আরাবী সম্মতি দিলো।তারপর ওরা বেরিয়ে আসল পার্লার থেকে।বাহিরে আসতেই আরাবী চারজন দেহরক্ষী দেখে চিন্তিত স্বরে বলে,’ নূর হঠাৎ করে এই গার্ডদের আমাদের সাথে পাঠালো কেন বুঝলাম না।আমাকে শুধু সকালে ফোন করে জানালো ও বাড়িতে চারজন গার্ড পাঠাচ্ছে।কিন্তু কেন পাঠাচ্ছে সেটা বলেনি।আমার চিন্তা হচ্ছে।ভয় লাগছে কেমন যেন।’
আলিফা আরাবীর কাধে হাত দিয়ে ভড়সা দিলো।বলল,’ চিন্তা করিস না।হয়তো ভাইয়া বলেছে গার্ড পাঠাতে।তার এতো সুন্দরী একটা বউ।যদি কেউ তুলে নিয়ে যায়।এই ভয়েই হয়তো।আর বিয়ের দিন একটা নার্ভাসন্যাস ফিল হয়।এটা স্বাভাবিক।ভয় পাস না এতো। জাস্ট টেইক অ্যা ডিপ ব্রেথ আরাবী এন্ড রিল্যাক্স।’
আরাবী জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলো।আলিফা তা দেখে বলে,’ নাউ ফিলিং বেট্যার?’
‘ ইয়াহ।’
‘ তাহলে চল।’
আরাবী আর আলিফা এইবার গাড়িতে উঠে বসল।আরাবী আলিফার হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে।ভীষণ নার্ভাস লাগছে।দুরু দুরু করে কাঁপছে বুক।হাত পা গুলোর কম্পন অনুভব হচ্ছে।এ যেন অন্যরকম এক অনুভূতি। সাথে কান্নাও পাচ্ছে ভীষণ।তাও নিজের কান্নাটুকু দমিয়ে রেখেছে বহু কষ্টে।
ভালোভাবে কমিউনিটি সেন্টারে পৌছাতেই আরাবীকে নিয়ে একটা রুমে চলে আসল আলিফা।তার কিছুক্ষণ পর লিপি বেগম আসলেন।হাতে খাবারের প্লেট।এসেই মেয়ের পাশে বসলেন। লিপি বেগমের চোখ মুখ ফুলে আছে।বোঝাই যাচ্ছে তিনি অনেক কেঁদেছেন।আরাবী ঠোঁট চেপে বসে রইলো।লিপি বেগম নিজ হাতে খাবার মাখিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলেন আরাবীকে।খাইয়ে দেওয়া শেষ হতেই লিপি বেগম উঠে যাবেন।তার আগেই আরাবী তার হাত ধরে ফেলল।করুণ স্বরে ডেকে উঠল,’ আম্মু!’
লিপি বেগম আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না।একটা মাত্র মেয়ে তার।আজ পরের বাড়ি দিয়ে দিবেন।লিপি বেগম জড়িয়ে ধরলেন আরাবীকে।আরাবীও ধুকড়ে কেঁদে উঠল।কেঁদে কেঁদে বলছে,’ আম্মু।আমি তোমাদের ছাড়া কিভাবে থাকব।আমি থাকতে পারবো না আম্মু।আমার ভেতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে।এতো কষ্ট কেন লাগছে আম্মু।আমি তোমাদের ছেড়ে যাবো না।’
লিপি বেগমের কান্নার মাত্রা যেন আরও বাড়ল মেয়ের এই কথা শুনে।আলিফা হতভম্ব। ওর নিজেরও খারাপ লাগছে।কিন্তু এটা কি কান্নার সময়?এই মেয়ে করছেটা কি?আলিফা দ্রুত গিয়ে আরাবী আর লিপি বেগমকে সামলো।ওদের দুজনের কান্না থামালো অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে।লিপি বেগমও নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েকে বোঝালেন।তারপর চলে গেলেন বাহিরে।কারন এখানে থাকলে মেয়ে তার আরও কাঁদবে।আলিফা আরাবীকে স্বান্তনা দিচ্ছে।আরাবী একটু শান্ত হতেই আলিফা আরাবীর মেইক-আপ ঠিক করে দিলো।ভাজ্ঞিস ওয়াটার প্রুফ মেইক-আপ ছিলো।শুধু কাজলটা একটুখানি বিগড়ে গিয়েছে।
এর মাঝে শোনা গেলো বর এসেছে।তা শুনে আলিফা বলে,
‘ তুই সাবধানে থাক একটু হ্যা?আমি ওখানে গিয়ে গেইট ধরি?ঠিক আছে?’
আরাবী হ্যা বলতেই আলিফা সেখানে গেলো।আলিফা গেইটের কাছে আসতেই ইফতি হা করে তাকিয়ে রইলো আলিফার দিকে।তা দেখে আলিফা মুখ টিপে হাসল।এরপর চোখ মেরে দিলো আলিফা ইফতিকে।থতমত খেয়ে যায় ইফতি।গলা খাকারি দিয়ে নিজেকে শান্ত করে।তারপর চোখ রাঙ্গানি দেয় আলিফাকে। আলিফা হেসে উঠে।
আলিফা এইবার জায়ানের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ ভাইয়া আমাদের দাবি মেনে নেন।তারপর চুপচাপ ঝামেলা ছাড়া বউয়ের কাছে চলে যান।’
ইফতি তর্ক করতে নিবে।তার আগেই জায়ান এক ব্যান্ডিল টাকা আলিফার হাতে ধরিয়ে দিলো।অধৈর্য কণ্ঠে বলে,
‘ যা চেয়েছ তার থেকেও এক্সট্রা দিয়েছি।এইবার আমাকে ভেতরে যেতে দেও।আর দ্রুত আমার বউকে আমার সামনে আনো।বুঝেছ?সালিসাহেবা।’
আলিফা হেসে উঠল খিলখিলিয়ে।আলিফার সেই হাসি মুগ্ধ হয়ে দেখল ইফতি।মেয়েটা হাসলে কি সুন্দর লাগে।অথচ সবসময় এভাবে হাসে না কেন ও?নাকের ঢগায় রাগ নিয়ে ঘুরে সদা।
আলিফা জায়ানের হাতে কাচি দিলো।জায়ান কাচি দিয়ে ফিতা কেটে ভেতরে প্রবেশ করল।এদিকে নূর,ইফতি আর আহানা জায়ানকে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করছে।কোথায় একটু ঝগড়া করবে কনেপক্ষের সাথে।তা আর হতে দিলো না।টাকা চাওয়ার আগেই একদম হাতে ধরিয়ে দিলো।তার ভাই যে এমন বউ পাগল হবে।এটা কি কেউ কল্পনাও করেছিলো কোনোদিন?হাহ্!
স্টেজে এসে জায়ানকে বসানো হলো।জায়ান ছটফট করছে।সময় যেন যাচ্ছে না।আজ কি দিনটা একটু বেশিই বড়ো?নাহলে সময় যাচ্ছে না কেন?জায়ান পাগল হয়ে যাচ্ছে আরাবীকে দেখার জন্যে।মেয়েটাকে বিয়ের সাজে কেমন লাগবে?গতকাল গায়ে হলুদের সাজেই মেয়েটাকে দেখে ওর দম আটকে যাচ্ছিলো।সেখানে আজ তো একদম বঁধু বেশে আসবে ওর কাছে।তখন কি করবে জায়ান?কিভাবে সামলাবে এই মেয়ের এমন রূপ?
সময়টা জায়ান ছটফট করে কাটালো।কাঙ্খিত সময় আসল।আরাবী বঁধু বেশে আসছে।ওর কাজিনরা মাথায় ওড়না ধরা।আলিফা আরাবীকে ধরে নিয়ে আসছে।আরাবী ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসির বাহার।বিয়ের গাউন,স্বর্ণের অলংকার দিয়ে সাজিয়েছে সবার্ঙ্গ।সেই সাথে ব্রাইডাল মেইক-ওভার।জায়ানের মনে হলো এ যেন সাক্ষাত কোনো হুরপরি এগিয়ে আসছে।জায়ান স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। ঠিক কি রিয়েকশন দিবে বা কি বলবে।মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না।এই দিনটার জন্যে কতো কি ভেবে রেখেছে জায়ান।কতোভাবে কল্পনা করেছে আরাবীকে।কিন্তু আজ সরাসরি মেয়েটাকে বঁধুর সাজে দেখে যেন জায়ানের হুশ জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছে।হার্ডবিট মনে হয় মিস হয়েছে কয়েকটা।
আরাবী স্টেজের কাছে আসতেই ইফতি জায়ানের কাধে হাত রেখে মৃদু ঝাকি দিলো।বলল,
‘ ভাই,ভাবিকে স্টেজে উঠতে হ্যাল্প করো।’
জায়ানের যেন হুশ ফিরল।শুকনো ঢোক গিলে ধীর পায়ে হেটে এগিয়ে গেলো আরাবীর কাছে।জায়ানের পুরো শরীর কাঁপছে।জায়ান কাঁপা হাতে আরাবীর হাত স্পর্শ করল।দুজন অনুভব করল দুজনের শরীরের অবস্থা।দুজনেই উত্তেজনায় কাঁপছে।জায়ান আরাবীকে হ্যাল্প করল স্টেজে উঠতে।আরাবীকে সাবধানে বসিয়ে দিলো।তবে কিছুই বলল না।আসলে জায়ান কি বলবে?আজ মুখে বলে আরাবীর প্রশংসা করলেও তা কম মনে হবে।আজ মেয়েটা যেন নিজের এই রূপ দেখিয়ে জায়ানকে যেন মে’রে ফেলার পায়তারা করেছে।এই মেয়ে নাকি বলে সে সুন্দর না।একবার নিজেকে জায়ানের জায়গায় দাঁড় করিয়ে যদি দেখতে পারতো।তাহলে বুঝত।যে ঠিক এই মুহূর্তে কেমন অনুভব করছে জায়ান।কতোটা অনুভূতি কাজ করছে ওর মাঝে।
_________
এদিকে জায়ানের দিকে একবার আঁড়চোখে তাকিয়েই যেন আরাবী বুক ধ্বকধ্বক করতে লাগল। কালো শেরওয়ানিতে জায়ানকে মারাত্মক সুদর্শন লাগছে।কালো রঙটা জায়ানের গায়ে এতো মানায়।আরাবী গলা শুকিয়ে আসছে বার বার।এইতো আর মাত্র কয়েক পলক যেতেই লোকটা ওর স্বামি হবে।আচ্ছা মানুষটা যে এতো সুন্দর।তাকে এতো মেয়েরা পেতে চায়।আরাবী ঠিক কোথায় লুকাবে তাকে?যাতে জায়ানের দিকে কেউ তাকাতে না পারে।আরাবী জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল।পরিহিত গাউনটা খামছে ধরে বসে রইলো।ভীষণ নার্ভাস ও।
এদিকে কিছুক্ষণ পর কাজি আর মৌলভী সাহেব আসল।বিয়ে পড়ানো শুরু হলো।আরাবীর মাথার কাছে ফাহিম দাঁড়ানো আর ওর দুপাশে জিহাদ সাহেব আর লিপি বেগম বসা।লিপি বেগম আসতে চাননি।কিন্তু আরাবী বার বার তাকে এখানে আসতে বলার কারনে তার বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে।
এক পর্যায়ে জায়ানকে কবুল বলতে বলা হলো।জায়ান সাথে সাথেই তিন কবুল বলল।আর কাবিননামাতেও স্বাক্ষর করে দিলো।আরাবীকে কবুল বলতে বললে আরাবী বাবার বুকে মুখ গুজে কাঁদতে লাগল।ফাহিম আর লিপি বেগম তাদের বোঝানোর অনেকটা সময় পর কান্নাভেজা কণ্ঠে কবুল বলল।তারপর কাঁপা হাতে কাবিননামায় সই করে দিলো।
বিয়ে সম্পন্ন হলো।আরাবী আর জায়ান চিরজীবনের জন্যে একে-অপরের হয়ে গেলো আজ।আর কোনো বাধা নেই।পবিত্র সম্পর্কে বাধা পরল দুজন।স্বামি স্ত্রী হলো আজ থেকে তারা।
বিয়ে শেষ হওয়ার পর জায়ান আর আরাবীকে টুকাটুকি নিয়ম পালন করা হলো।এর মাঝে ফটোশ্যুটও হয়েছে বেশ।আয়না দেখার সময় হলো।আরাবীর দিকে আয়না ধরে জায়ানকে প্রশ্ন করল আলিফা,
‘ জায়ান ভাইয়া আয়নায় কাকে দেখছেন?’
জায়ান নেশাময় চোখে আরাবীর দিকে তাকিয়ে আছে।ধীর আওয়াজে বলে উঠল,
‘ আমার অবষন্ন জীবনে একগুচ্ছ কাঠগোলাপের মতো শুভ্রতা আর স্নিগ্ধতা নিয়ে আমার জীবনে প্রবেশ করেছে।সেই মেয়েটিকে দেখছি।যাকে ভালোবেসে আমি নাম দিয়েছি আমার কাঠগোলাপ।আর আজ সে আমার বউ,আমার অর্ধাঙ্গিনী,আমার চিরজীবনের সঙ্গী,আমার ভালোবাসা আমার সব।’
সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। আরাবী লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো।জায়ানের এক একটা ভালোবাসা মাখানো বাক্যে যেন আরাবীর হৃদস্পন্দন বেরে গিয়েছে হু হু করে।
সব নিয়ম কানুন মানা হলে।এইবার বিদায়ের ঘন্টা বাজল।আরাবী ফাহিম,লিপি বেগম আর জিহাদ সাহেবকে আঁকড়ে ধরে অনেক কাঁদল। শেষমেষ ক্লান্ত হয়ে পরে যেত্র নিলে জায়ান সামলালো।জিহাদ সাহেব কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
‘ আমার একটা মাত্র মেয়ে।আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো বাবা।ও আমার কলিজা।আজ আমার প্রাণটাকে তোমার হাতে সপে দিলাম।আগলে রেখো ওকে। ‘
জিহাদ সাহেবকে ভড়সা দিলো জায়ান।
‘ চিন্তা করবেন না বাবা।আমি আরাবীকে নিজের জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করব।কোনোদিন ওকে কষ্ট পেতে দিবো না।আমি জায়ান বেঁচে থাকতে।ওর গায়ে ফুলের টোকাও পরতে দিবো না।’
ফাহিম এগিয়ে আসল।বোনের মাথায় চুমু খেলো।আরাবী কান্নারত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে।ভাইকে যে আঁকড়ে ধরবে সেই শক্তিটুকুও নেই ওর মাঝে।ফাহিমের চোখজোড়া লাল হয়ে আছে।ও ধরা গলায় বলে,
‘ আমার বোনটার খেয়াল রেখো।ওকে কখনও কষ্ট পেতে দিও না।যদি ও কোনো ভুল করে।বা তোমাদের কাছে যদি বেশি হয়ে যায়।আমার বোনকে আমার কাছে দিয়ে যেও।আমি আজীবন ওকে আমার কাছে রাখতে পারব।তবুও ওকে আঘাত পেতে দিও না।বোনটা আমার অনেক সহজ সরল। অল্পতে ভেঙে পরে।ওর পাশে থেকো।’
জায়ান বলল,’ এসব কি বলছ ফাহিম।এমনটা কোনোদিন হবে না। আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস অব্দি আরাবীকে যত্ন করে রাখব ফুলের মতো।ওকে নিয়ে কোনোরকম চিন্তা করবে না।তোমার বোনকে রাজরানি করে রাখব।ইনশাআল্লাহ।’
সবার থেকে বিদায় নিয়ে এইবার জায়ান আরাবীকে সাবধানে গাড়িতে উঠিয়ে বসালো।আরাবীর চোখ দিয়ে অঝোড়ে পানি পরছে।কিন্তু কিছু যে বলছে তা বলারও শক্তিটুকু নেই। মাথাটা ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে।ভীষণ ক্লান্ত ও।
এদিকে ফাহিমের ভঙ্গুর অবস্থা দেখে নূর এলো ফাহিমের কাছে।ধীর আওয়াজে বলল,’ ভাবিকে নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না।ভাইয়া অনুপস্থিতিতে আমি ভাবির খেয়াল রাখব।আমার কোনো বোন নেই।আমার ভাবি আমার বোন হয়ে আজ আমার বাড়িতে যাচ্ছে।আমি আমার ভাবিকে প্রটেক্ট করব।আপনি চিন্তা করবেন না।আপনার যখন মন চাইবে আপনি আমাদের বাড়িতে এসে পরবেন ভাবিকে দেখতে।আর ভাবির যখন মন চাইবে তার বাবার বাড়ি আসবে।কোনো বাধা দেওয়া হবে না।ভাইয়া না থাকলে আমি নিজ দায়িত্বে ভাবিকে নিয়ে আসব।ভাবিকে কখনও কোনো কষ্ট পেতে দিবো না। আসি তবে।’
এইটুকু বলেই নূর চলে গেলো। এদিকে ফাহিম নূরের যাওয়ার পাণে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার কথাগুলো বড্ড ভালো লাগল ফাহিমের।এমনিতে নূরকে সবসময় চুপচাপ স্বভাবের মনে হয়েছে।মনে হয়েছে বোকা।কিছু বুঝে না।কিন্তু এখনকার কথাবার্তা শুনে মনে হলো মেয়েটা খুবই ম্যাচিউরড।ফাহিমের ভালো লাগল নূরের এই স্বভাবটা।মেয়েটা দেখতেও যেমন সুন্দর,কথাবার্তাতেও তেমন স্মার্টন্যাস আছে।এই প্রথমবার ফাহিম নূরকে নিয়ে অন্যকিছু অনুভব করল।একেবারে অদ্ভুত কিছু।
#চলবে__________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।