স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ #সাদিয়া_জাহান_উম্মি #পর্বঃ৩৬

0
689

#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৬
মৃদু খুটখাট শব্দ কর্ণে এসে প্রবেশ করতেই ঘুম ছুটে যায় আরাবীর।তবে চোখ না খুলেই বুঝতে পারে আজ আর শক্তপোক্ত নিরাপদ বুকটায় নেই ও।ভ্রু-কুচকে আসে আরাবীর।এমনিতে তো নিজেকে সর্বদা লোকটার প্রশস্ত বক্ষে আবিষ্কার করে।তাহলে আজ ব্যতিক্রম কেন?আরাবী চোখ বন্ধ করে পাশ হাতরে জায়ানকে খোঁজার প্রয়াস চালালো।কিন্তু ব্যর্থ হলো।তাই হতাশ হলো আরাবী।আলস্যতা আঁকড়ে ধরেছে ওকে যেন।তাই তো চোখটাই খুলতে ইচ্ছে করছে না।আবার জায়ান কোথায় গিয়েছে সেটাও জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।হঠাৎ করেই সেই চেনা পরিচিত অতি প্রিয় মানুষটাএ পুরুষালি স্বরটা শুনতে পেলো আরাবী,
‘ মিসেস সাখাওয়াত।আমাকে খুঁজে পাচ্ছেন না বুঝি?’

জায়ানের কণ্ঠস্বর শুনেই আরাবীর মুখে হাসি ফুটে উঠল।ও এইবার চোখ মেলে তাকালো।তাকাতেই মুখের সামনে নিজের সুদর্শন স্বামীর মুখশ্রীটা দেখতে পেয়ে ঠোঁটের হাসিটা যেন আরও চওড়া হলো।জায়ান যেন পাগল হয়ে উঠল আরাবীর এই সদ্য ঘুম ভাঙা মায়াবীর মুখের হাসি দেখে।ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল,’ সকাল সকাল এভাবে হেসে আমাকে মে’রে ফেলার পায়তারা করছেন নাকি?প্রেমে পরে যাই তো বার বার।’

আরাবী হাত বাড়িয়ে দুহাতে জায়ানের গলা জড়িয়ে ধরল।ঘুমজড়ানো গলায় বলল,’ আর সকাল সকাল এরকম হ্যান্ডসাম,ড্যাশিং সেজে বসে আছেন তার বেলায়?তার বেলায় বুঝি আমার কিছু হয় নাহ?’

জায়ান ঠোঁট কামড়ে হাসল।বলল,’ তোমার কিছু হয় বুঝি?’
‘ হয়তো অনেএএক কিছু হয়।’

আরাবীর নাকে নাক ঘষলো জায়ান।আদুরে কণ্ঠে বলে,
‘ তা কি হয় শুনি?’

আরাবী মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে হাসল।একটা কথা আছে না?মেয়েরা তার অতি প্রিয় মানুষটার কাছেই বড্ড আহ্লাদী হয়ে থাকে।আরাবীর ক্ষেত্রও যেন কোনো ব্যক্তিক্রম হলো না।আরাবী ফিসফিস করে বলল,’ এইযে এভাবে সেজেগুজে আমার সামনে এসেছেন। আপনাকে দেখে আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে।আপনার দিকে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে।কেমন যেন একটা পাগল করা অনুভূতি হয়।’

আরাবীর কথা শুনে জায়ান প্রাপ্তির হাসি দিলো।বলল,
‘ কংগ্রাচুলেশনস মিসেস সাখাওয়াত। আপনি মি. সাখাওয়াতের প্রেমে পরে গিয়েছেন।এখন এখান থেকে আর নিস্তার নেই আপনার।’

আরাবী জায়ানের চোখে চোখ রাখল।বলল,’ নিস্তার পেতে চায় কে?আমি?সেটা তো দুঃস্বপ্নেও না।’

জায়ান হেসে ফেলল।তারপর আরাবীকে ফট করে কোলে তুলে নিলো।আরাবী জায়ানকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল।জায়ান হাসি হাসি মুখ করে বলে,’ আজ ম্যাডামের এই অধমের প্রতি এতো ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে যে?’
‘ সবসময় তো আপনিই ভালোবাসেন।দু একদিন আমি ভালোবাসা দেখালে কি বড্ড ক্ষতি হবে?’
‘ উহু! একদমই না।বরংচ আপনার এই ভালোবাসা তো আমি দিনরাত চব্বিশঘন্টাই পেতে চাই।’

আরাবী ভেংচি কেটে বলে,’ ইশ,শখ কতো।’

জায়াম সুযোগ বুঝে আরাবীর ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।সরে এসে বলে,’ অনেক।’

আরাবী জায়ান হঠাৎ চুমু খাওয়ায় একটু লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলো।পরক্ষণে জায়ানের কথা বলার ভঙি দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।আর জায়ান তার কাঠগোলাপের শুভ্রময়ী হাসিতে মত্ত হয়ে রইলো।
জায়ান দুষ্টু হাসল।মেয়েটা আজ অনেক বোল্ডন্যাস দেখাচ্ছে।এইবার নাহয় একটু লজ্জা দেওয়া যাক।জায়ান আরাবীর কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,’ ভালোবাসাটা যেভাবে আজ দেখাচ্ছেন।সেভাবে যদি রাতে আমাদের একান্ত সময় এইভাবে একটু আদর করতেন এই অধমকে।তাহলে সে বড্ড খুশি হতো।সবসময় তো আমাকেই এগিয়ে আসতে হয়।খুব করে আদর করতে হয়।’

এইবার আর পারল না আরাবী নিজের লজ্জা ধরে রাখতে।এই লোকের সাথে সে কখনই পারবে না।সবসময় এমন একটা কথা বলবে।যেটা শুনে আরাবী লজ্জা না পেয়ে থাকতেই পারে না।আরাবী লজ্জা পেয়ে জায়ানের কাধে মুখ লুকিয়ে ফেলল।ওভাবে থেকেই জায়ানের পিঠে মৃদু আঘাত করে বলে,’ আপনার শুধু অসভ্য কথাবার্তা।ধ্যাৎ ভাল্লাগে না।’

জায়ান গা ছেড়ে হাসল আরাবীর কান্ডে।পর পর গানের সুরে সুরে গাইলো,’ অসভ্য হ‌য়ে‌ছি আমি তো‌মা‌রি প্রে‌মে। তাই কা‌ছে আসো না আরো কা‌ছে আসো না। ‘
‘ ছি! অশ্লীল গান! আর ওটা অভদ্র হবে অসভ্য না।’
‘ আমি তো তোমার জন্যে অসভ্য,অভদ্র আরও যা যা তুমি বলবে সব হয়ে যাবো ডার্লিং।’
‘ ধুর! কি শুরু করলেন?থামেন তো।এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছে।নামাজ পরার পর ঘুমাতে যাওয়ার সময় কি বলেছিলাম আপনাকে?সকাল সাতটায় আমায় ডেকে দিতে।এখন কয়টা বাজে?আটটা বেজে আটত্রিশ মিনিট।আপনার কারনে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়।সবাই কি ভাববে বলুন তো?’

মুখ ভোঁতা করে বলল আরাবী।জায়ান আরাবী ফুলো গালে চুমু খেলো।আরাবী বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলল।জায়ান চট করে আরাবীর ঠোঁটেও চুমু খেয়ে নিলো।
আরাবী চটে গিয়ে বলে,’ উফ,কি শুরু করলেন?এখনও ব্রাশ করেনি।মুখ ধুইনি আমি।’
‘ তো কি হয়েছে?’
‘ আমার মুখে জীবানু আছে না?’
‘ ওহ কিছু হবে না।’
‘ বেশি জানেন আপনি?’
‘ বড়ো কে এখানে?আমি না তুমি?’
‘ আপনি।’
‘ তাহলে বেশি জানবে কে?অবশ্যই আমি।’
‘ আসছে আমার সব জানতা।এখন আমাকে নামান।আমি ফ্রেশ হবো।’

জায়ান আরাবীকে ওয়াশরুমে নামিয়ে দিলো।আরাবী জায়ানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বোলালো।ব্লাক স্যুট কোটে মারাত্মক সুন্দর লাগছে জায়ানকে।আরাবী যেন চোখ ফেরাতে পারছে না।পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে ভ্রু-কুচকে আসে আরাবীর।যেখানে ও নিজেই চোখ সরাতে পারছে না এই লোকটার থেকে।তো এই অবস্থায় বাহিরে যাওয়া মানেই মেয়েদের নজর জায়ানের উপর পরা।একদম চোখ দিয়ে গিলে খাবে।আরাবীর রাগ হলো।ভীষণ রাগ।কঠিন রাগ।এই লোক এমনিতেই এতো সুন্দর।তার উপর আবার এতো রঙঢঙ করার কি আছে?আরাবী রাগে ঠাস করে ওয়াশরুমের দরজা আটকে দিলো।এদিকে অকস্মাৎ আরাবীর এহেন কান্ডে জায়ান থতমত খেয়ে গেলো।এইতো কি সুন্দর একটা মুডে ছিলো।এখন আবার কি হলো মেয়েটার?হঠাৎ এভাবে চটে গেলো কেন?জায়ান আপনমনে এসব ভাবতে ভাবতে অফিসের ব্যাগ গোছাতে চলে গেলো।গিয়ে দেখে সেটা আগেই গুছিয়ে রাখা।নিশ্চয়ই মেয়েটা নামাজ পরতে উঠেছিলো।তখন গুছিয়ে রেখেছে।জায়ান গিয়ে চুপচাপ বসে পরল ডিভানে। অপেক্ষা করতে লাগল আরাবীর।কিছুক্ষণ বাদে আরাবী বেড়িয়ে আসল।সোজা চলে গেলো বারান্দায়।সেখানে তোয়ালে নেড়ে দিয়ে এইবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।তাকালো না অব্দি জায়ানের দিকে।জায়ান আর সহ্য করতে পারল না আর।এইবার উঠে এলো আরাবীর কাছে।আরাবী চুল আঁচড়াচ্ছিলো। জায়ান পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল আরাবীকে।আরাবী হাত থেমে গেলো।পর পর মাথা নিচু করে নিলো।জায়ান আরাবীকে ঘুরিয়ে ওর দিকে দাঁড় করালো।জায়ান আরাবীর চিবুকে হাত রেখে আরাবীর মুখটা উপরে তুলল।পর পর আরাবী চোখে ঠলমলে অশ্রু দেখে থমকে গেলো জায়ান।এইতো কিছুক্ষণ আগেই এই পূর্ণিমার চাঁদের নক হাসি হাসি মুখটায় হঠাৎ অমাবস্যার মতো আঁধার নামল কেন? জায়ান বিচলিত কণ্ঠে বলে,’ কাঁদছ কেন?কি হয়েছে?খারাপ লাগছে?’

আরাবী মাথা দুলালো।জায়ান আবারও কারন জানতে চাইলো।আরাবী ভেজা কণ্ঠে বলে,’ আমার ভয় হয় জায়ান।’

জায়ানের চিন্তিত কণ্ঠস্বর,’ কিসের ভয় আরাবী?আমি তো আছি।’
‘ আপনাকে নিয়েই যে আমার ভয় হয়।আপনাকে আমার জীবনে আমি পেয়ে ধন্য।আমার তো সাত কপালের ভাগ্য আমি আপনাকে পেয়েছি।নাহলে যেখানে মানুষ আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো প্রতিনিয়ত।ইনফেক্ট এখনও করে।আমার এই গায়ের রঙ নিয়ে। সেখানে আপনি আমার এই গায়ের রঙ দেখেই নাকি আমাকে ভালোবেসেছেন।অনেক ভাগ্য করে আপনাকে পেয়েছি।আপনাকে আমি হারাতে পারবো না।তবুও ভবিষ্যতের কথা তো কেউ বলতে পারে না।আপনি তো অনেক সুন্দর।আপনাকে তো আমার থেকেও কতো সুন্দর সুন্দর মেয়েরা বিয়ে করতে চেয়েছিলো।এমনকি এখনও চাইছে।আমার ভয় করে তারা যদি আপনাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। আমি সহ্য করতে পারবো না জায়ান।’

আরাবীর কথাটা শেষ করতে দেরি।জায়ানের রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হতে দেরি নেই।অনেক সহ্য করেছে।মেয়েটা প্রতিনিয়ত এসব ভেবে চলে৷ এতো বার মানা করে তবুও মেয়েটা এসবই ভাবে।কিন্তু নাহ,আরাবীকে তো আর জায়ান কিছু বলতে পারবে না।জায়ান চোখ বন্ধ করে আরাবীর দিকে তাকালো।আরাবীর গাল ভিজিয়ে গড়িয়ে পরা চোখের জলটুকু মুছে দিলো।তারপর অত্যন্ত শীতল কণ্ঠে বলল,’ একটা কথা জানো কি আরাবী?আমি যে তোমায় ঠিক কতোটা ভালোবাসি।এটা তুমি এখনও অনুভব করতে পারোনি।তুমি আমার ভালোবাসায় বিশ্বাস করোনি।যদি বিশ্বাস করতে তাহলে এই কথাগুলো আজ এভাবে বলতে না।আমাকে বিশ্বাস করলে এটা বিশ্বাস করতে যে তোমার জায়ান শুধু তোমারই থাকবে।আর কারো না।এইবার পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী মেয়েটাও যদি আমার সামনে থাকতো তাও আমি তার দিকে তাকাবো না।কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি।কিন্তু আফসোস আমার এই ভালোবাসার গভীরতা তোমায় আমি বোঝাতে পারলাম না আরাবী।এতে তোমার কোনো দোষ নেই।এটা আমার ব্যর্থতা।আমি আমার ভালোবাসা তোমাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি।আ`ম সরি।’

জায়ান আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না।দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল এখান থেকে।সে অনেক রেগে আছে।আর এই রাগ সে আরাবীর সামনে প্রকাশ কর‍তে চায় না।মেয়েটা কোমল হৃদয়ের অধিকারি।ভয় পেয়ে যাবে।এদিকে জায়ানের কথাগুলো ঝংকার তুলে আরাবীর কানে বাজতে লাগল।ভুল করেছে ফেলেছে।বড্ড বড়ো ভুল।মানুষটা অনেক কষ্ট পেয়েছে।এইবার কি করবে আরাবী?অনুশোচনা দগ্ধ হতে লাগল আরাবীর হৃদয়।মানুষটাকে এভাবে কষ্ট দিতে পারল ও?

#চলবে___________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here