#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৯
দেখতে দেখতে সপ্তাহখানিক কেটে গেলো।আজ আরাবী আর জায়ানের গায়ে হলুদ।আরাবীকে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে।আলিফা খুব সুন্দরভাবে সাজাতে পারে।ওই সাজিয়ে দিয়েছে আরাবীকে।অবশ্য জায়ান আগেই বলে দিয়েছে। কোনোরকম ভারি মেইক-আপ করা যাবে না।সেই হিসেবে আলিফা যথেষ্ট ন্যাচারাল রাখার চেষ্টা করেছে আরাবীকে।হলুদ লেহেঙা গায়ে জড়ানো,হালকা সাজ,চুলগুলো কার্ল করে কাধের দুপাশ দিয়ে সামনে এনে রাখা হয়েছে।সম্পূর্ণ কাচা ফুলের গহনা দিয়ে সাজানো হয়েছে মেয়েটাকে।তাও আবার কাঠগোলাপ ফুল।জায়ান নিজে অর্ডার করে বানিয়ে এনেছে এটা।হাত ভর্তি চুরি।সাথে দুহাতে কাঠগোলাপের ব্রেসলেট।মেয়েটাকে পুরো ফুলের রানি লাগছে।আলিফা গালে হাত দিয়ে বলে,’ ইয়ার,তোকে যা লাগছে না।আমিই ফিদা হয়ে যাচ্ছি।জায়ান ভাইয়া দেখলে তো পাগল হয়ে যাবে।’
আরাবী লজ্জামিশ্রিত হাসি দিলো।বলল,’ তোকেও কি কম সুন্দর লাগছে?ইফতি ভাইয়া তো সবার সামনেই না তোকে জড়িয়ে ধরে দেখ।তখন দেখব নেহ আমি।’
আলিফা আরাবীর কথা শুনে মুখ ফুলিয়ে বলে,’ ওই হাদারাম?তাও আবার সবার সামনে জড়িয়ে ধরবে?আর আমার চাইতেও তার লজ্জা বেশি।আমি ওসব লজ্জা টজ্জা ওতো পাই নাহ।’
আরাবী দু কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,’ এই কথা যদি আমি আমার দেবরকে না বলেছি।ইফতি ভাইয়া লজ্জা পায়?তুই লজ্জা পাস নাহ?তাই নাহ?আজই এটার হাতে নাতে প্রমান হবে।’
আরাবী ফোনটা বিছানা থেকে হাতে নিলো।অমনি আলিফা তেড়ে এসে আরাবীর হাত ধরল।আরাবী ভ্রু-কুচকে ফেলল।বলল,’ হাত ধরলি কেন?ছাড়।ইফতি ভাইয়াকে ফোন করব আমি।’
আলিফা আমতা আমতা করে বলে,’ আহা,ছাড় না মেরি মা।আমার ভুল হয়েছে।এইগুলা সে জানলে।সবার সামনেই আমাকে আস্ত গিলে ফেলবে।’
আরাবী খিলখিল করে হেসে উঠল।আলিফা মুখ ফুলিয়ে রাখল।এর মধ্যেই আরাবীর ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল।ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই আরাবী মুচকি হাসল।তা দেখে আলিফা বলে,’ জায়ান স্যা..থুক্কু ভাইয়া ফোন করেছে?তাই নাহ?’
থেমে আবার বলে,’ উফ,এতোদিন স্যার স্যার বলে এসেছি।এখন ভাইয়া ডাকার সময় কনফিউজড হয়ে যাই।’
আরাবী হেসে ফেলল আলিফার কথায়।এদিকে ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গেলো।আলিফা বলল,’ আহ,ফোনটা ধরলি না কেন?আচ্ছা আমি বাহিরে যাচ্ছি।তুই কথা বল।ফাহিম ভাইয়া কিন্তু এই ডাকল বলে।কমিউনিটি সেন্টারেও তো যেতে হবে তাই নাহ?’
আরাবী মাথা দুলালো।আলিফা চলে যেতেই।আরাবী ফোনটা রিসিভ করে বিছানায় আরাম করে বসল।মিহি স্বরে সালাম জানালো।সালামের জবাব দিলো জায়ান।তারপর জায়ানের ব্যাকুল কণ্ঠের ডাক ভেসে আসল।
‘ কাঠগোলাপ?’
উফ,এতো অনুভূতি জড়ানো কেন ডাকটা?যতোবার জায়াম তাকে এই নামে সম্বোধন করে আরাবী বুক কেঁপে উঠে।শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে যায়।আরাবী জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে ধীর আওয়াজে বলে,
‘ জি বলুন।’
‘ আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি তোমাকে দেখার জন্যে।একবার ভিডিও কল দেই?একটুখানি দেখব।’
আরাবী মাথা নিচু করে মুচঁকি হাসে।
‘ এতোট ড্যাস্পারেট হলে তো হবে না জনাব সাখাওয়াত সাহেব।এইতো আরেকটু ধৈর্য ধরুন।ধৈর্যর ফল মিষ্টি হয়।’
জায়ান বাঁকা হাসল আরাবীর কথায়।
‘ তো এখন যদি আমি ধৈর্য ধরি।তাহলে আমাকে কি স্পেশাল মিষ্টিটা খাওয়াবে?’
আরাবী বুঝল না।জিজ্ঞাসা করল,
‘ স্পেশাল মিষ্টি মানে?’
‘ হ্যা তোমার ওই ঠোঁট জোড়ায় যেই মিষ্টতা আছে।তা পৃথিবীর সব মিষ্টির কাছে ফিকে আরাবী।’
আরাবীর লজ্জায় ওর মুখশ্রী গরম হয়ে গেলো।থেমে থেমে বলে,’ আবারও এসব কথাবার্তা বলছেন।আর তাছাড়া আপনি কিভাবে জানেন যে আমার ঠোট মিষ্টি।’
‘ আমি জানি।আর সেম জিনিসটা তোমার ক্ষেত্রেও হবে।আমার ঠোঁটজোড়াতে চুমু খেলে তোমারও মিষ্টিই মনে হবে।ওয়ান্না ট্রায়?’
আরাবী থতমত খেয়ে বলে,’ জি না আমার লাগবে না।আর আপনি এসব অসভ্য কথাবার্তা বন্ধ করুন।আপনার লজ্জা নেই ঠিক আছে।বাট আমার তো লজ্জা আছে।’
জায়ান শীতল কণ্ঠে বলে,’ এই লজ্জা কতোক্ষণ থাকবে আমিও দেখব।শুধু আজকের রাতটুকু। কাল রাতে তুমি আমার হবে।আমি তোমার খুব কাছে থাকব।এই এতো এতো লজ্জা পেলেও লাভ হবে না।তোমার লজ্জা হরণ করব কাল আমি।তুমি চাইলেও আর কাল পালাতে পারবে না জান।’
আরাবী ঠাস করে ফোনটা কেটে দিলো।শ্বাস আটকে বসে রইলো কতোক্ষণ।এই লোক এমন সব ভয়ংকর কথা বলে।আরাবীর নিজেকে সামলে নিতে সময় লেগে যায় বহুক্ষণ।এ কোন লোকের পাল্লায় পরল ও?
বসে বসে জায়ানের কথাই ভাবতে লাগল আরাবী।তার কিছুক্ষণ পরেই ফাহিমের কণ্ঠ শুনতে পাওয়া গেলো।আরাবীকে ডাকছে।এর মাঝেই আলিফা আসল।এসেই তাড়া দিতে লাগল,’ চল চল।এখনই বেরোতে হবে।ফাহিম ভাই ডাকছে।’
আলিফা আরাবীকে নিয়ে বাহিরে আসল।ফাহিম আরাবীর থেকে যেন চোখ সরাতে পারছে না।ফাহিম আরাবী কাছে এসে ওর কপালে চুমু দিলো।আরাবী মুচকি হাসল।আরাবীর দুগালে হাত রেখে ফাহিম বলে,’ একদম রানির মতো লাগছে।অনেক সুন্দর লাগছে তোকে।’
‘ থ্যাংক ইউ ভাইয়া।’
জিহাদ সাহেব আর লিপি বেগমও প্রশংসা করলেন আরাবীর।তাদের চোখ ভরে আসছিলো বার বার।তাও নিজেদের সামলে নিচ্ছিলেন।কারন ফাহিম বার বার মানা করে দিয়েছে তাদের কাঁদতে।কারন তারা যদি কান্না করে আরাবীও কেঁদে ভাসিয়ে ফেলবে।পরে এই এতো সাজগোজ সব নষ্ট হয়ে যাবে মেয়েটার। আজ আরাবীর জীবনের স্পেশাল একটা দিন।আর মেয়েটা যেন কান্না না করে।এই গায়ে হলুদের দিনই তো শেষবার পরিবারের সাথে একটু আনন্দ করে নেয়।আগামীকাল তো মেয়েটা চলেই যাবে।তখন তো আর কান্না না করে কেউ থাকতে পারবে না।তাই আজকের দিনটাতে কাঁদতে বারণ করে দিয়েছে ফাহিম।তবে তাদের কান্না করতে বারণ করে দিয়ে।নিজেকে ভেতরে ভেতরে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে।শুধু আজকের দিনটাই আছে আরাবী এই বাড়িতে।কাল চলে যাবে পরের বাড়িতে।কাল থেকে সেটাই হবে ওর আসল নীড়।এই সত্যটা যেন কিছুতেই এই মনটা মানতে পারছে না।কিন্তু কিছু কিছু সত্য যে আমাদের না চাইতেও মেনে নিতে হয়।ফাহিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল সবার অগোচরে। তারপর সবাইকে বলল নিচে নামতে।ফাহিম ট্যাক্সি ভাড়া করেছে।গাড়িওয়ালা নিচে অপেক্ষা করছে।তাই সবাইকে নিয়ে নিচে আসল।এরপর এক এক করে সবাইকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো।পেছনে আরাবী,আলিফা আর লিপি বেগম বসেছেন।সামনে ড্রাইভারের সাথে জিহাদ সাহেব বসেছেন।আর ফাহিম ওর বাইকে করে যাবে।গাড়ি স্টার্ট দিতেই।ফাহিম গিয়ে এইবার নিজের বাইকে উঠে বসল।রওনা হলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
——–
কমিউনিটি সেন্টারের সামনে গাড়ি এসে থামলো।একে একে সবাই বের হয়ে আসল গাড়ি থেকে।এর মাঝে জায়ান ড্যাস্পারেট হয়ে শ’খানেক ম্যাসেজ করে ফেলেছে আরাবীকে।আরাবী বলছে তারা আসছে।কিন্তু এই লোকের সেই ধৈর্য কি আছে?
কমিউনিটি সেন্টারে প্রবেশ করল তারা।আরাবী আর আলিফা ভেতরে প্রবেশ করল না শুধু।আরাবী আসতেই ওর কিছু কাজিন’রা এসে ওকে ঘিরে ধরল।একটা দোপাট্টা এনে চারকোণায় চারজন দাঁড়িয়ে আরাবীর মাথার উপর ধরল।আলিফা আরাবীকে ধরে রেখেছে।লেহেঙাটা ভারি হওয়ায় হাটতে বেগ পেতে হচ্ছে মেয়েটাকে।তাই আলিফা ওকে সাহায্য করছে।এদিকে সবাই বলছে কণে এসে পরেছে।সাউন্ড বক্সে গান বাজছে।
তুমকো পায়া হ্যে তো যেছে খোয়া হু।
কেহনা চাহু ভি তো তুমছে ক্যায়া কাহুন।
কিসি জাবান ম্যে ভি, ওহ লাভ্’য হি নেহি।
কি জিনম্যে তুম হো ক্যায়া তুমে বাতা সাকু।
ম্যে আগার কাহু তুমছা হাছি।
কায়ানাত ম্যে নেহি হ্যা কাহি।
তারিফ য়্যে ভি তো।
সাচ হ্যে কুচ ভি নেহিইই।
গানের তালে তালে আরাবী এগিয়ে যাচ্ছে।আর যতোবার এগোচ্ছে ততোবার যেন জায়ানের বুকের বা-পাশটায় মিষ্টি একটা ব্যথা অনুভব করছে।মেয়েটা এতো সুন্দর কেন?জায়ান যেন চোখ সরাতেই পারছে না।কাঠগোলাপ ফুলগুলো বানানোর পর যখন দেখে জায়ান।তখন এই ফুলে গায়ে জড়ানো আরাবীকে কল্পনা করে যতোটা না সুন্দর লাগছিলো।বাস্তবে যেন তার থেকে হাজার গুন বেশি সুন্দর লাগছে। স্টেজের সামনে আসতেই জায়ান মুচঁকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো আরাবীর দিকে।আরাবী লাজুক হেসে জায়ানের হাত আঁকড়ে ধরল।স্টেজে আরাবীকে ধরে সাবধানে উঠালো জায়ান।তারপর ওকে সোফায় নিয়ে বসালো।সুযোগ বুঝে আরাবীর কানের কাছে এসে বলল,
‘ আই ক্যান কোমফোরট্যাবলি স্যে দ্যাট ইয়্যু আর দ্যা লাভলিয়েস্ট ওমেন ওন দিছ আর্থ।ইয়্যু আর দ্যা মোস্ট বিউটিফুল পার্সন আই হ্যেভ এভার সিন।উইথ সাচ অ্যা বিউটি,ইয়্যু ম্যেক দ্যা মুন,দ্যা সান এন্ড স্টার্স মাইনোর টু মি বিকয ইয়্যুর স্পার্ক্যাল ইজ দ্যা ব্রাইটেস্ট।’
জায়ান মুখে নিজের এমন প্রশংসা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে মুচঁকি হাসল আরাবী।এদিকে আলিফা চিল্লিয়ে বলল,
‘ আরে জায়ান ভাইয়া।কি এমন ফিসফিস করে বলছেন আরাবীর কানে কানে।যে ও এমন লজ্জা পাচ্ছে?’
জায়ান হেসে সরে দাঁড়ালো।তারপর গিয়ে আরাবীর পাশে বসল।আরাবী আঁড়চোখে জায়ানের দিকে তাকাচ্ছে।জায়ান পরেছে সবুজ রঙের একটা সেরওয়ানি,সাদা পাজামা সাথে।চুলগুলো আজ বোধহয় জেল দিয়ে স্যাট করেছে।দাঁড়িগুলোও আজ সুন্দরভাবে ট্রিম করা।লোকটাকে মারাত্মক সুদর্শন লাগছে।আরাবী জায়ানের দিকে একবার তাকালে যেন আর নজর সরাতেই পারে না।
এতো নজরকারা সুদর্শন পুরুষটা আজ বাদে তার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ হয়ে যাবে।এটা যেন এখনও বিশ্বাস হয় না আরাবীর।সত্যিই কি জায়ানের মতো একটা মানুষকে এমন ভাগ্য করে পেয়ে গেলো আরাবী?এতোটা সহজে তাকে আপন করে পেতে যাচ্ছে?আরাবী এক দৃষ্টিতে জায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো।কিন্তু ওকে চমকে দিয়ে জায়ান বলে উঠল,’ আমি জানি আমি অনেক সুর্দশন।তবে এভাবে তাকিয়ে থাকলে নজর লেগে যাবে নাহ?’
আরাবী থতমত খেয়ে গেলো।তবে এইবার খানিকটা রেগে গিয়ে বলে,’ আমি তাকালেই নজর লেগে যাবে তাই নাহ?আর আপনি যখন তাকিয়ে থাকেন তখন?আর অন্য মেয়েরা যে আপনার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে সে বেলা?সে বেলা অনেক ভালো লাগে তাই নাহ?’
আরাবী মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো।জায়ান মুচঁকি হাসল।এবার সবার অগোচরে একটা হাত দিয়ে আরাবীর কোমড় চেপে ধরল।চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো আরাবী জায়ানের দিকে।জায়ান বলে,
‘ আমি তো মজা করছিলাম।আমি তো চাই তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকো।আমরা দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা একে-অপরকে মন ভড়ে দেখব।কি ব্যাপারটা দারুণ হয় নাহ?’
আরাবী জায়ানের হাতটা সরানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,’ একদম নাহ।’
‘ আনরোমান্টিক একটা মেয়ে।কাল আসোই না আমার কাছে।রোমান্সের এ টু যেট সব হাতে কলমে শিখিয়ে দেব।’
আরাবী ক্লান্ত হয়ে বসে রইলো।এই লোকের সাথে জীবনেও পারবে না ও।আর জায়ান সে তো ব্যস্ত হয়ে রইলো তার প্রিয়তমাকে জ্বালাতন করতে।তবে আরাবীর ভালোই লাগে জায়ানের এমন দুষ্টুমি।উপরে উপরে যতোই রাগ দেখাক না কেন?আরাবী আরও বেশি করে চায় জায়ান আরাবীর সাথে এমন করেই থাকুক।এইভাবেই ওকে উত্তক্ত করুক।জায়ানের এই খুনশুটিগুলো আরাবী ভীষণ উপভোগ করে।
এভাবে খুনশুটির মধ্যে দিয়েই জায়ান আরাবীর হলুদ সন্ধ্যা শেষ হলো।
জায়ান আরাবীর ফটোশেসন চলল।সবাই হলুদ ছোঁয়ালো দুজনকে।নাঁচ গান চলল।আরাবীর হাতে মেহেদীও পরানো হলো।বেশ সুন্দরভাবেই সবটা শেষ হলো।
#চলবে______________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।