কৃষ্ণবেণী #পর্ব_২৭(১) #নন্দিনী_নীলা

0
561

#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_২৭(১)
#নন্দিনী_নীলা

অবশেষে আয়ানের পরিকল্পনা সফল হলো। উষসী কে মারতে সফল হয়েছে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেও অনেক যুদ্ধ করেছে উষসী। বাঁচার যুদ্ধ। নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারে নি। আয়ান পারতে দেয়নি। যে নার্স ওর দেখাশোনা করতো সেই ছিল আয়ানের টাকা খাওয়া। সেই আয়ানের সাথে হাত মিলিয়ে উষসীর প্রান কেড়ে নিলো। জায়ান কে কল সেই নার্সই দিয়েছিল।
জায়ান আর তৃষ্ণা আধা ঘন্টার মধ্যে হসপিটালে গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে গিয়ে উষসীর নিথর দেহটা পায়। জায়ান নিজেও স্তব্ধ। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উষসীর সাথে ওর একটা ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক ছিল। সব কিছু উষসী ওকে শেয়ার করতো। ওর সব সমস্যায় হেল্প করতো। এভাবে চলে যাবে ও বিশ্বাস করতে পারছে না।
এদিকে আয়ান তখন সেই নার্সের সাহায্যে উষসীর কাছে এসে নাটকীয় কান্না শুরু করে দেয়। যেন উষসীর মৃত্যু তে সব চেয়ে বেশি দুঃখ সেই পেয়েছে।

তৃষ্ণা তো বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। জায়ান এই খবর উষসীর পরিবারের সবাইকে কিভাবে দেবে সেই টেনশনে আছে। দুইদিন হসপিটালে ছিল ওরা সবাই আশা করেছিল উষসী সুস্থ হয়ে যাবে। উষসীর বাবা
খুব রাগী মানুষ তার মেয়ের এই পরিনতি জানলে তিনি কি করবেন সেটা ভাবতে পারছে না জায়ান।

জায়ান নার্সের দিকে তাকিয়ে বলল,” ডক্টর কোথায়?”

নার্স শুকিয়ে আসা গলায় চমকে বলল,” ডক্টর কে কল করা হয়েছে তিনি দ্রুত আসছেন।”

” বিকেলেও তো ডক্টর বলল উষসীর অবস্থা ভালো। তাহলে এসব কিভাবে হলো? আর এমন সিরিয়াস পেশেন্ট রেখে ডক্টর বাসায় গেল কিভাবে? এ্যানসার মি।”

নার্স কথা বলতে পারছে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
” কোন সন্দেহ জনক কিছু হয়ে থাকলে কেউ পার পাবেন না। ভুলে যাবেন না আমরা কোন ফ্যামিলির।”

আয়ান তখন বলে উঠল,” নার্স আমাকে আমার রুমে দিয়ে আসেন। আমার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে।”

নার্স তাড়াতাড়ি আয়ান কে ধরে তার রুমে নিয়ে আসলো। একে একে অনেক নার্স এসে ভীড় করলো রুমটাতে। জায়ান তৃষ্ণাকে নিয়ে রুমের বাইরে এসে দাঁড়ালো। তৃষ্ণা কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।
জায়ান বাড়িতে কল করে সবাইকে জানিয়ে দিলো।
তৃষ্ণা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কয়দিনে কি সুন্দর দুজনে মিলে গেছিল। বড় বোনের মতো ওকে উপদেশ দিতো কত গল্প করেছে কয়দিনে। কি ভালো ছিল। তৃষ্ণা পুরোনো কথা গুলো মনে করছে শুধু।

এদিকে অনেকক্ষণ চলে গেল উষসীর নার্স আসলো না আর। আয়ানকে রেখে আসতে এতো সময় লাগছে কেন? জায়ান ভ্রু কুঁচকে সন্দেহ চোখে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে।
তৃষ্ণা দরজায় দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে। জায়ান আয়ানের রুমে ঢুকে দেখে আয়ান অক্সিজেন মাস্ক মুখে দিয়ে কাঁদছে। জায়ান কেবিনের চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,” নার্স কোথায়?”

আয়ান চমকে চোখ মেলে তাকালো। আর আমতা আমতা করে বলল,” সে তো আমাকে রেখেই চলে গেছে! কেন কি হয়েছে?”

জায়ান আয়ানের কাছে এসে বলল,” তুই কিছু করিস নি তো এসবে তোর কোন হাত নেই তো?”

আয়ান শুকিয়ে আসা ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলল,” কি বলছো এসব। আমি এসব করব কেন? আমি কি জানি না ওর বাপ কেমন। আমাকে ছিঁড়ে খাবে ওর কিছু করলে। আমি জেনে বুঝে কেন কিছু করতে যাব।”

জায়ান কি যেন ভেবে বলল,” নার্স টাকে সন্দেহ হচ্ছে। এখন নিখোঁজ তার মধ্যে ঝামেলা আছে।”

আয়ান বলল,” নার্স কেন উষসী ক্ষতি করবে ভাবো। তার কি লাভ এতে?”

” তার লাভ না থাকলেও তোর লাভ আছে। যদি এর পেছনে তোর হাত থাকে। আমি ভুলে যাব তুই আমার ভাই একবার ক্ষমা করেছি। বলে ভাবিস না এবার আর ক্ষমা পাবি।”

বলেই জায়ান হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো কেবিনে থেকে। আয়ান অক্সিজেন মাস্ক খুলে উঠে বসে রাগে ফুঁসতে লাগল। এতো দিন তোকে ভা‌ই বলে ছেড়ে দিয়েছি জায়ান। অনেক তোর ধমক অবজ্ঞা শুনেছি আর না এবার তোর জায়গা হবে আমার। আর আমি মাথা নিচু করে থাকব না।

আয়ান ভাবছে নার্সকে তো পালিয়ে যেতে বললাম কিন্তু ওই মেয়ে বাই এনি চান্স ধরা পরে গেলে আমার নাম বলে দিবে। ওকে শুধু পালাতে দিলে হবে না। ওর মুখ চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিতে হবে। জায়ানের পক্ষে ওকে খোঁজে পাওয়া ব্যাপার না কিন্তু ও যদি বেঁচে ই না থাকে তখন আর ওকে খোঁজে পেয়ে লাভ কি হবে?

আয়ান প্রতিশোধ আর স্বার্থের লোভে আস্তে আস্তে কতটা নিচে নেমে যাচ্ছে নিজেও বুঝতে পারছে না। ও বুঝতে চাইছে ও না। ও শুধু চাচ্ছে জায়ান কে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। জায়ানের সব ক্ষমতা নিজের দখলে নিতে।

তৃষ্ণা জায়ানকে ছটফট করে এদিকে ওদিকে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে যায়।
” কি হয়েছে এমন করে কাকে খোঁজেন?”

” প্রথমে যে নার্স টা এখানে ছিল তাকে দেখছি না যে। দেখছো তাকে?”

তৃষ্ণা কাঁদছিল কোন দিকে এতোটা নজর দিয়ে রাখছিল না। তাই মনে করতে পারছে না।

” কি দেখেছো কি?”

” আমি খেয়াল করিনি।”

জায়ান ফোন কানে ধরে লিফটের কাছে চলে গেল তৃষ্ণা উষসীর কাছেই রইলো। তখনি কাঁদতে কাঁদতে একজন অপরিচিত মহিলা এগিয়ে এলো এদিকেই তার পেছনে আসছে চারজন পুরুষ ও দুইজন মহিলা‌। তৃষ্ণা তাদের দেখে দরজার পাশে থেকে সরে দাঁড়ালো। উনারা কি উষসী ভাবির বাড়ির লোক তৃষ্ণা ভাবছে। তখনি জেসমিন বেগম, জোভান, জায়ানের বাবা সবাই এসে উপস্থিত হলো। সবাই এলোমেলো হয়েই এসেছে। এদিকে ফজরের আজান কানে ভেসে এলো তৃষ্ণার। রাত দুইটার পর এখানে এসে পৌঁছেছিল ও আর জায়ান। আর এখন সারে চারটা বাজে। বাড়ির একজন সদস্য ও নাই। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। আজকের সকালটা তার জন্য ছিল না। ছিল না এই সুন্দর ভূবন দেখা। তৃষ্ণা ডুকরে কেঁদে উঠল।

তৃষ্ণা কান্না থেমে গেল‌ হঠাৎ একটা লোক‌ হঠাৎ জায়ানের বাবার কলার চেপে ধরে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করলো। তৃষ্ণা ভয়ে ভীত হয়ে পরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে।
আরেকজন লোক তিনি আয়ানের কেবিনে গিয়ে আয়ানকে ঘুসি মেরে কেবিনের বাইরে ফ্লোরে ফেলে দিলো।
এসব কি হচ্ছে কিছুই তৃষ্ণার ছোট মাথায় ঢুকছে না।
জোভানের থেকে জানতো পারল একজন উষসীর বাবা আর দুজন উষসীর ভাই।
তারা তাদের মেয়ের মৃত্যুর পেছনে ওদেরকে দোষারোপ করছে।

তৃষ্ণা ভাবছে মেয়ের মৃত্যু তে কোথায় কষ্ট পাবে তা না কে কি করেছে সেসব ভেবে মারামারি করছে এরা কেমন ভাই বাবা? মেয়ের প্রতি তাদের এ কেমন ভালোবাসা?

জায়ান এখানে নাই থাকলে হয়তো তার উপর ও আক্রমণ হতো। ডক্টর এসেছে এবার ডক্টর কে মারতে চাইছে। সবাই দুঃখী মুখ করে আসলেও উষসীর বাবা আর ভাইয়ের কাজে সবাই অসন্তুষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জোভান আর উষসীর ছোট ভাই ও কয়েকজন ওয়ার্ড বয় মিলে তাদের রেষারেষি থামিয়ে দূরে সরিয়ে আনে। আর বুঝায় এটা একটা হসপিটাল এখানে হাজারো পেশেন্ট আছে। যা করার বাইরে গিয়ে করতে এখানে এসব করলে অন্য পেশেন্ট এর সমস্যা হবে।
জায়ান আসে অনেকটা সময় পর। সবাই জায়ানের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। জায়ান সবাইকে ইগনোর করে ডক্টরের কেবিনে গিয়ে উপস্থিত হয় আর সেই নার্সের সন্ধান দিতে বলে।

” আপনাদের নার্স টা হঠাৎ উধাও হলো কেন?”

ডক্টর বলল,” কি বলছেন উধাও হবে কেন? হসপিটালেই কোথায় আছে হয়তো।”

” আমি সি সি টিভি চেক করে আসলাম। আজ রাতের কোন ফুটেজ নাই। ক্যামেরা অফ করা আছে। এমনটা কেন বলেন তো আমাদের পেশেন্ট ভালো থেকে হঠাৎ মৃত্যু হলো। সব কিছুই কিন্তু ধোঁয়াশা লাগছে।”

ডক্টরের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। তিনি একজন কে কল করে তার কেবিনে ডাকলো। জায়ান রাগে ফুঁসছে অনবরত।

” আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না। এসব কি হচ্ছে আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। আর পেশেন্ট দেখে বুঝলাম তিনি শ্বাস রুদ্ধ হয়ে মারা গেছে। কিন্তু এমনটা কিভাবে হলো! অক্সিজেন তো তার কেবিনে ছিল সেটা আজ রাতে শেষ ও হয়নি। হবার কথাও না। সিলিন্ডার ভর্তি অক্সিজেন তাহলে তার শ্বাস রুদ্ধ হলো কীভাবে!”

” ওই নার্স এর পেছনে আছে আমি সিউর। আর কে আছে আমি জানি না। কিন্তু আমার সন্দেহের তালিকায় আপনিও আছেন ডক্টর। আপনারা যদি কারো সাথে হাত মিলিয়ে এই কাজ করে থাকেন তো এর ফল ভালো হবে না। এই হসপিটালে বন্ধ করা কিন্তু আমার বা হাতের কাজ মাইন্ড ইট।”

ডাক্তার ও ভয়ে ঘামতে লাগলো। তিনি ও উষসীর পার্সোনাল নার্সকে খোঁজ করতেন লোক লাগালো।
ভোরে উষসী কে রিলিজ করিয়ে গাড়ি নিয়ে উঠে। এখন এই লাশ নেওয়া নিয়ে আরেক দফা ঝগড়া। উষসীর পরিবার কোনভাবেই লাশ জায়ান দের নিতে দিবে না। এই নিয়ে আবার তর্ক লেগে গেল।
জায়ান রেগে বলল,” উষসী আমাদের বাড়ির ব‌উ। সো আমাদের বাসায় ই যাবে।”

জায়ান কথা শেষ করতে পারল না উষসীর বড় ভাই ক্রোধে এসে জায়ানের নাক বরাবর ঘুসি মেরে বসলো। সবাই জায়ান বলে চিৎকার করে উঠল।

জায়ান রাগে রক্ত বর্ণ চোখে তাকালো উষসীর ভাই এর দিকে। সে রেগে আবার আঘাত করতে আসলে জায়ান শুধু একটা কথাই বলল,” মারামারি করতে লাগলে তুমি আমার সাথে পারবে না। তাই আমার সাথে লাগতে এসো না। উষসীর জন্য তোমাদের মন মেজাজ ভালো নেই তাই ক্ষমা করে দিলাম। আমার গায়ে হাত দেওয়ার ভুল করো না।”

তিনি ক্রোধের সাথে বলল,” তোরা সবাই মিলে আমার বোনকে মারছিস। তোদের সবকটা কে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।”

” আসল দোষীকে খোঁজে বের করো। রাগের মাথায় ভুল জায়গায় দোষারোপ করো না। সময় লস এতে তোমার ই হবে। এখন দুঃখের সময় ঝামেলা রাগারাগী না করে যে চলে গেছে তার জন্য কিছু করো। এসব পরেও করতে পারবে।”

জায়ান গাড়িতে উঠে বসলো সবাই জায়ান দের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। তৃষ্ণা জায়ানের ঠোঁটের কোনে থাকা রক্ত মুছে দিয়ে বলল,” ওনারা সবাই আপনাদের দোষারোপ কেন করছে?”

#চলবে…..

( আসসালামু আলাইকুম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here