#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_২২
#নন্দিনী_নীলা
জায়ান কোন সারা শব্দ করলো না। তৃষ্ণা বিছানার কোনা ঘেঁষে বসে আছে। ওর চোখ বেয়ে গলগলিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। জায়ান আচমকা চোখ মেলে তাকালো। আর সরাসরি দৃষ্টি নিয়ে ফেলল তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা জায়ান কে তাকাতে দেখে আরো জোরে কেঁদে উঠলো। জায়ান হাত বারিয়ে তৃষ্ণা হাত ধরলো। তৃষ্ণা চমকে উঠে হাতের দিকে তাকালো। জায়ান তৃষ্ণার হাত ধরে এক টানে নিজের কাছে নিয়ে এলো। তৃষ্ণা আচমকা টানে চমকে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। আর মুখ থুবড়ে পরেছে জায়ানের বক্ষ স্থলে।
তৃষ্ণার ঘন কালো চুল জায়ানের মুখের উপর আছড়ে পরেছে। জায়ান চোখ বন্ধ করে তৃষ্ণার চুলের ঘ্রান নিতে মগ্ন হয়ে যায়। তৃষ্ণা জায়ানের শার্ট হাতের মুঠোয় নিয়ে মাথা উঁচু করতে যায়। এদিকে চুল লম্বা হওয়ায় চুল গিয়ে আটকেছে জায়ানের ঘড়িতে। তৃষ্ণা জায়ানের বুকের উপর থেকে উঠতে গিয়ে চুলের টান পেয়ে আহ করে উঠে।
জায়ানের সেদিকে খেয়াল নেই। ও আছে তৃষ্ণার ঘন কালো কেশের মিষ্টি সুবাসে। তৃষ্ণার আর্তনাদ শুনে ওর ঘোর কাটে। চোখের পলক মেলে তাকায়। তৃষ্ণা চুল টেনে জায়ানের মুখের উপর থেকে সরিয়ে উঠে বসে। সব চুল গেলেও কয়েকটা চুল আনতে পারে না। ঘড়িতে কঠিন ভাবে আটকেছে। তৃষ্ণা কাঁপা হাতে জায়ানের হাত ধরতে যাবে। এদিকে জায়ান সবটা বুঝতে পেরে বিরক্তিকর চোখে একবার তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে নিজেই হাত এগিয়ে আনে চুলের টান কমিয়ে। জায়ান ঘুমঘুম ক্লান্তি মাখা চোখ মুখ নিয়েই উঠে বসে হাত থেকে ঘড়ি খুলে নেয়। তারপর নিজেই চুল ছাড়াতে চেষ্টা করে। এমন ভাবে আটকেছে যে ছাড়ানো যাচ্ছে না। আবার জোরে চেষ্টা করলে ছিঁড়ে যাবে কিন্তু জায়ান কোন ভাবেই ছিঁড়তে দিবে না একটা চুল ও। এজন্য খুব আলতো ভাবে আস্তে ট্রাই করছে।
এদিকে তৃষ্ণা এতো সময় লাগছে দেখে বিরক্ত হয়ে এক টান দিয়ে চুল ছিঁড়ে ছাড়িয়ে নেয়।
আর বলে উঠে,” দুইটা চুল ছিঁড়লেই তো হয়। এতো সময় কেন নিচ্ছেন। আমার মাথায় কি চুলের অভাব আপনি দুইটা চুল নিয়ে এতো কষ্ট করলেন।”
তৃষ্ণা জায়ানের থেকে সরে আবার চুল বাঁধতে শুরু করে। জায়ান ছেঁড়া চুল হাতে নিয়ে আছে ওর চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে যেটা এখনো তৃষ্ণা লক্ষ্য করেনি। ও চুল বেঁধে জায়ানের কাছে এগিয়ে আসে।
জায়ানের হাতে এখনো ছেঁড়া চুল দেখে নিচু হয়ে চুল নিয়ে ফেলে দিতে চায়। যেইনা চুল নেওয়ার জন্য হাত বাড়াবে তখনি জায়ান অগ্নি চক্ষু মেলে তৃষ্ণা দিকে তাকায়। তৃষ্ণা জায়ানের রক্ত বর্ণ চোখ দেখে কেঁপে উঠে । মনে মনে শুকনো ঢোক গিলে।
জায়ান চুল দুটো তৃষ্ণার চোখের সামনে তুলে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,” তোমার সাহস কি করে হলো চুল ছেঁড়ার? কে অধিকার দিছে বলো কেন ছিঁড়লে। এ্যান্সার মি।”
তৃষ্ণা জায়ানের ধমক খেয়ে ভয়ে ভীত হয়ে যায়। কথা বলতে পারছে না তবুও জায়ানের থেকে ধমক খেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলে,” আমি তো আপনার ঝামেলা হচ্ছে দেখেই ছিঁড়লাম। সামান্য দুইটা চুল ছিঁড়লে কি হবে এতো রেগে যাচ্ছেন কেন?”
জায়ান তৃষ্ণার গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলে,” তোমার কাছে সামান্য হতে পারে কিন্তু আমার কাছে নয়। তুমি আমার বউ হয়েছ এই চুলের জন্য। আমি প্রথম এই চুল দেখেই তোমার মায়ায় পরেছিলাম। এই চুল আমার দূর্বলতা। এই চুল ধরার ছোঁয়ার কাটার অধিকার শুধু মাত্র আমার। আমার জিনিস ছেঁড়ার বা নষ্ট করার চেষ্টা করলে সেটা ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
“সব কিছু এই চুল তাহলে আমি কি আপনার কিছুই না? কাল যদি চুল না থাকে। তাহলে কি আপনি আর আমাকে ভালোবাসবেন না?” কাঁদো কাঁদো গলায় বলল তৃষ্ণা।
জায়ান তৃষ্ণার চুলের খোঁপায় হাত দিয়ে চুল খোলে দেয়। তৃষ্ণা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে।
জায়ান তৃষ্ণার চুলের ভেতর হাত দিয়ে মাথা এগিয়ে এনে তৃষ্ণার নরম ওষ্ঠে স্পর্শ করে তৃষ্ণা চোখ খিচে বন্ধ করে নেয়।
জায়ান ফিসফিস করে বলে,” তুমি আমার মিষ্টি বউ। আর আমার বউ আস্ত একটা ভালোবাসা আমার কাছে।”
” আপনি ওই খারাপ লোকটার জন্য আমাকে কেন ভুল বুঝলেন?”
” কে বলেছে ভুল বুঝেছি?”
” কারো বলতে হবে কেন? আপনি তো সত্যি আমায় খারাপ ভাবছেন। কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি…
” তোমার কিছু জানাতে হবে না আমি সবটাই জানি।”
” আপনি ভুল জানেন। আপনার ভাই আপনাকে ভুল জানিয়েছে। আমাকে আপনার চোখ খারাপ বানিয়েছে।”
” কেউ বললেই তুমি আমার চোখে খারাপ হয়ে যাবে না। তোমাকে আমার থেকে বেশি অন্যকেউ জানে না। তাই অন্যকারো থেকে তোমাকে চেনার, জানার প্রয়োজন নেই।”
” আপনি সবটা জানলেন কি করে বলেন না।”
” তুমি যে রুমে থাকতে ওই রুমে সিসি ক্যামেরা ছিল। যেটা চেক করে আমি সবটা জানতে পেরেছি।”
” সিসি ক্যামেরা সেটা আবার কি?”
” ওটা দিয়ে সব ভিডিও হয়। তুমি রুমে কি করেছ না করেছ সব ওইটার মাধ্যমে খবর রেখেছি কাছে না গিয়েও।”
” ওখানে কি ওই সব ও ছিল। আপনার ভাই যে আমার সাথে নোংরা কাজ করছিল। আমাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করেছিল।” বলতে বলতে তৃষ্ণার চোখে জল চলে এলো।
” এখানে দোষ তোমার নয়। দোষ আমার এই চেহারায়। যেই সুযোগ ও নিয়েছিল। এর শাস্তি তো পাবেই সামান্য মার দিয়ে ওকে ছেড়ে আমি দেব না।”
জায়ান তৃষ্ণার চোখের পাতায় চুমু খেয়ে ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।
তৃষ্ণা ফুঁপিয়ে উঠে বলল,” সেদিন আমার অনেক খারাপ লেগেছিল। আমি ওই লোকটাকে আপনি ভেবেছিলাম কিন্তু ওটা আপনি ছিলেন না। আমি যদি উর্মি আপুর থেকে আপনাকে চেনার উপায় না জানতাম তাহলে খারাপ কিছু হয়ে যেত। তখন আমি কি করতাম বলেন।”
জায়ান তৃষ্ণার মুখশ্রী দুহাতের মুঠোয় তুলে কপালে চুমু খেয়ে বলে,” সরি জান আমি ও সেদিন তোমায় ধমক দিয়েছিলাম। আমার জানটা উপর দিয়ে এতো বড়ো ঝড় গিয়েছে আমি জানতামই না। অকৃতজ্ঞ স্বামী আমি।”
তৃষ্ণা জায়ানের আদর পেয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো জায়ানের বুকের সাথে মিশে রইলো।
হঠাৎ জায়ান তৃষ্ণার বাহু ধরে টেনে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো। তৃষ্ণা হকচকিয়ে উঠলো।
জায়ান গম্ভীর গলায় ধমক স্বরে বলে উঠে” তুমি আমার থেকে কথা গোপন করেছিলে কেন?কোন সাহসে?”
তৃষ্ণা কেঁপে উঠে বলে,” আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস না করেন। আর আমার কাছে মুখের কথা ছাড়া আর কোন প্রমাণ ছিল না তাই চুপ ছিলাম।”
” নিজেই মন গড়া কথা ভেবে এতো কিছু নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখা তোমার উচিত হয়নি। সবটা আমাকে জানানো উচিত ছিল।”
তৃষ্ণা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল,” আমার ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করে দিন।”
জায়ান বলল,” নো, ভুল করেছ এর শাস্তি তোমার পেতেই হবে। শাস্তি বিহীন জায়ান কাউকে ক্ষমা করে না।”
তৃষ্ণা ভয়ার্ত চোখে জায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,” কি শাস্তি দেবেন। এবারের মতো ক্ষমা করে দিন। আর কোনদিন কিছু লুকাবো না।”
জায়ান তৃষ্ণার দিকে শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,” “আমি এখন ঘুমাবো আর তুমি পড়তে বসবে। যতক্ষণ আমি ঘুমাবো ততক্ষণ তুমি পড়া রেখে উঠতে পারবে না। মনোযোগ দিয়ে পড়বে উঠে আমি চেক করবো নাও স্টার্ট।”
বলেই জায়ান বিছানায় শুয়ে পরলো।
” আপনি একটু তাড়াতাড়ি উঠবেন।”
তৃষ্ণা বইয়ের দিকে তাকিয়ে বসে আছে পড়ছে না। জায়ান চোখ বন্ধ রেখেই বলে,” ফাঁকি দিয়ে লাভ নাই পড়া না পারলে শাস্তি চেঞ্জ হবে। আর জোরে জোরে পড়ো।”
_______________________
বকুল কলপাড়ে থেকে পানি উঠাচ্ছিল জামাকাপড় ধুয়ার জন্য। এদিকে বাড়ির ভেতর থেকে তখনি ওর মায়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে ভেজা শরীরেই মায়ের চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে যায় বকুল। উঠানে এসে দেখতে পায় বকুলের ভাই রক্তাক্ত অবস্থায় চেয়ারে বসে আছে। দৌড়ে আসে বকুল ভেজা শরীরেই। ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে মা ভাবি দুজনেই জোরে জোরে কাঁদছে। বকুল এগিয়ে এসে তার ভাইয়ের করুণ পরিণতি দেখে চমকায়।
বকুলের ভাই হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,” মরি নাই এহনো। তোরা মরা কান্না কাঁন্দস ক্যান? বকুল রে বোন আমার যা ত হাসেম চাচা রে নিয়া আয়।”
” ভাই তোমার এই অবস্থা কি কইরা হইলো? এতো মারামারি কার লগে করলা। আবার কি তুমি টাকার লোভে চুরি করতে গেছিলা?”
” এই তুই যাবি? না এইহানে দাড়িয়ে থাইকা আমার মরা পর্যন্ত অপেক্ষা করবি।”
বকুল ভেজা শরীরে শুকনো ওরনা পেঁচিয়ে দৌড়ে লাগালো হাসেম চাচাকে ডাকতে।
তিনি এসে ব্যান্ডেজ করিয়ে দিয়ে যায়। আর সেই তখন থেকে বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়েছে রাত দশটা পর্যন্ত তা চলতে থাকলো।
বকুল পাটি বিছিয়ে একা বসে আছে বারান্দায়। ওর মনটা খুব খারাপ অজান্তেই জোভান এর কথা মনে পরছে। অনেক দিন হয়ে গেছে জোভানের খবর নাই। বুবুর কথাও ওর মনে পড়ে অনেক কিন্তু তার সাথেও যোগাযোগ করার রাস্তা নাই। দুলাভাইয়ের নাম্বার আছে ওদের কাছে ফোন দিতে হলে দোকানে যেতে হবে। যাওয়ার সময় পাচ্ছে না তাই কথা ও হচ্ছে না। বকুলের আজকে জোভান কে মনে পরার একটা কারণ আছে। ওর সই সাথী একটা ছেলের সাথে প্রেম করে। ছেলে নাকি ওরে অনেক ভালোবাসে। আজ সাথীর সাথে গল্প করে ও ওর প্রেমকাহিনী শুনেছে তার পর থেকেই জোভান কে মনে পরছে।
___________________________
সকাল সকাল একটা ঝটকা খেল বকুল। ঘুম ভাঙলো ওর অদ্ভুত কথা শুনে। বাইরে কে জানি বলছে,
” সুজন এর বউ গতকাল রাইতে বিষ খাইছে। হাসপাতালে ও নিতে পারে নাই বউটা মইরা গেছে। কি ভালো ছিল বউটা গেলে কত খাতির করতো। কি হইলো বউটা বিষ খাইয়া মইরা গেল। বউয়ের বাড়ির লোকজন নাকি পুলিশ নিয়া আইতাছে। সেটা শুইনা সুজন ত পালাইছে।”
রাত জাগার ফলে আজ বেলা করেই ঘুমাইছে বকুল। আর ঘুম ভাঙবে এমন আশ্চর্য জনক কথা শুনে ও কল্পনাও করতে পারে নাই। মরার কথা শুনে ওর বুক কেঁপে উঠেছে। বুকে হাত দিয়ে ও জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে উঠে দৌড় লাগায় সুজন দের বাড়ির দিকে পেছনে থেকে বকুলের মায় চেঁচিয়ে বকুলকে থামতে বলছে ডাকছে বকুল শুনেনি। ওর ভেতরটা যন্ত্রনায় ছটফট করছে। প্রথম দিন আলাপ করেই মালতির সাথে বকুলের ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছিল তারপর থেকে সময় পেলেই বকুল গিয়ে তার সাথে গল্প করতো। নিজের বুবুর মতো ভালোবাসে মালতিকে ও। সেই মানুষটা মরে গেছে ও ঠিক থাকবে কি করে?
কয়দিন মাত্র তিন দিন ধরে ওই বাসায় যাওয়া হয় না। তার মধ্যে এমন ঘটনা ঘটলো।
বকুল সুজন দের বাড়ির সামনে এসে থামলো। বাড়িতে এলাকার মানুষ গিজগিজ করছে। বকুল ঢোক গিলে ভেতরে এলো। লাশ রুমে আছে বকুল দূর থেকেই জানালা দিয়ে মালতির দিকে তাকালো। তাকিয়ে কেঁদে উঠলো।
#চলবে?