#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_২৩(২)
#নন্দিনী_নীলা
” হাই মিস কি করছেন?”
দরজার পাশে থেকে অচেনা পুরুষ কন্ঠস্বর শোনে চমকে উঠে উর্মি। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছিল ট্যুরে যাওয়ার জন্য। তখনি কেউ দরজায় হেলান দিয়ে কথা বলে উঠে। ও চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে দেখে আরিফ হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আরিফের হাসি দেখেই ওর রাগে গা জ্বলে উঠে। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে,’ বেয়াদব’
আরিফ কপাল কুঁচকে বলেন,” আমাকে গালি দিলেন?”
উর্মি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে,” আপনি এখানে কি করছেন এই অসময়ে?”
” হবু শশুর বাড়ি আসতে আবার সময় অসময় লাগে বুঝি? যখন আসবো তখনি পারফেক্ট টাইম।”
উর্মি জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলে,” রং জায়গায় এসেছেন।এটা আপনার হবু শশুর বাড়ি নয়। বিদায় হোন। এখন আমরা সবাই ফ্যামিলি ট্যুরে যাব।”
” সরি হবু বউ। আমি আপনাদের সাথে যাচ্ছি ট্যুর দিতে।”
উর্মি চেঁচিয়ে বলল,” হোয়াট? আপনি কেন যাবেন? আপনি কি আমাদের ফ্যামিলির কেউ? পরিবারের সবার মধ্যে বাইরের মানুষ নট এলাও।”
“বাইরের কেউ এলাও না জানি। আর আমি কোন বাইরের কেউ নয়। আমি এই বাড়ির হবু জামাই। সো আমার যাওয়া হচ্ছে।”
” হ–বু জামাই। কথার মধ্যে হবু আছে তাই আপনি এখনো পরিবারের কেউ হোন নাই। বিদায় হোন।”
আরিফ কথাটা শুনেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একদম উর্মির কাছে চলে এলো কিন্তু কোন স্পর্শ করল না। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,” চলেন এখনি কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে হবু শব্দটা বাদ করে দেই।”
” এতো বিয়ে করার শখ তো এখানে আসছেন কেন? অন্য জায়গায় যান। আপনাকে আমি ভালো ভাবছিলাম। আপনি তো দেখছি একটা ছ্যাচড়া।”
” অবুঝ ভেবে ক্ষমা করে দিলাম যান।”
উর্মি রাগে বলল,” আপনি যাবেন এখানে থেকে।”
” এখনো আপনার রুমে থাকার মতো অনুমতি পাই নি। যেতে তো হবেই। আচ্ছা আসেন। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।”
আরিফ বেরিয়ে এলো। উর্মি ব্যাগ থেকে সব পোশাক বের করে ফেলল। যাবেই না ও।
” ভাইয়া ওই ছ্যাচড়া লোকটাকে ও নিয়ে যাচ্ছে। ধুর আমিই যাব না।”
বাড়ির সবাই আয়ান কে জিজ্ঞেস করেছে কোথায় ছিল এতো দিন। আয়ান কোন উত্তর দেয় নি শুধু রাগী চোখে তাকাচ্ছিলো জায়ানের দিকে। সবাই গাড়িতে উঠে বসেছে। বাকি শুধু উর্মি। তৃষ্ণা উর্মি কে নিতে এসে দেখল সব কিছু খোলে বসে আছে। যাবে না। সে কারণে জিজ্ঞেস করলেও বলছে না। তৃষ্ণা তোষামোদ করে ব্যর্থ হয়ে জায়ান কে বলল সব। জায়ান উর্মির না যাওয়ার কারণ ধরে ফেলল নিমিষেই।
” উর্মি এসব কি রেডি হও নি কেন যাবে না?” জায়ান রাগী গলায় বলল।
” ভাইয়া আমি যাব না।”
” প্রবলেম কি?”
” কোন সমস্যা নাই। তোমরা চলে যাও আমাকে জোর করো না।”
” তুমি কিন্তু এখন বেশি বাড়াবাড়ি করছো। কার জন্য এমন নাটক করছো বুঝতে পারছি না ভাবছো। কান খুলে শুনে রাখো তোমার বিয়ে আরিফের সাথেই হবে আর সেটা ট্যুরে থেকে ফিরেই। তাই ওর সাথে কোন রকম খারাপ বিহেভ না করে ভালো আচরণ করো। ওকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করো। দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নিচে আসবে। এক সেকেন্ড লেট যেন না হয়।”
বলেই জায়ান হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
________________________
গোমড়া মুখে উর্মি বাইরে আসতেই গাড়ি ছেড়ে দিলো।
সবাই নিজেদের গাড়িতে উঠে বসেছে। উর্মি এসে নিজের গাড়িতে আরিফ কে দেখে রাগে দুঃখে কান্না করতে চায়। কিন্তু পারে না। সামনে জোভান বসেছে ও পেছনে গিয়েই বসলো।
আরিফ দূরত্ব রেখেই বসে আছে। ওর দিকে তাকায় নি। ফোন টিপছে আর এক দুইবার সামনে তাকিয়েছে। এদিকে উর্মি রাগী চোখে কয়েকবার তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ করে বসে রইল।
তৃষ্ণা শাড়ির আঁচলে আঙুল পেছাচ্ছে আবার খুলছে। কিছু জিজ্ঞেস করতে উশখুশ করছে খুব। কিন্তু জায়ানের শক্ত চোখ মুখ দেখে সাহস পাচ্ছে না। একবার নিজের আঙুলের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার জায়ানের দিকে তাকাচ্ছে।
” কি বলতে চাও বলো। ”
তৃষ্ণা চোখ কপালে তুলে তাকালো জায়ানের দিকে। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল,” আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি কিছু বলতে চাইচ্ছি?”
জায়ান তৃষ্ণার গাল টেনে দিয়ে বলে,” ম্যাজিক।”
” আমিও এই ম্যাজিক শিখতে চাই!” অবুঝ গলায় বলল তৃষ্ণা।
জায়ান বললেন,” এটা শিখতে হলে ভালোবাসার রোগে আক্রান্ত হতে হবে।”
তৃষ্ণা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে। জায়ান তৃষ্ণার হাত ধরে কাছে টেনে হাতের উল্টো পিঠে চুমু দিয়ে বললেন,” বলো।”
” আমার মনে হয় উর্মি আপু আরিফ ভাইয়া কে পছন্দ করে না। উনি তো মিহির ভাইকে পছন্দ করতো তাই বলছিলাম কি যদি…..
বলতে বলতে তৃষ্ণা থেমে গেল জায়ানের চোখ মুখ লাল হয়ে আসছে দেখে ভয়ে। তৃষ্ণা আবার কথা চেঞ্জ করে বলল,” আপনি যা করছেন আপুর ভালোর জন্য। আমি একটু বেশিই কথা বলি। আমি আর কোন বাড়তি কথা বলব না আপনি রাগ করবেন না প্লিজ।”
জায়ান তৃষ্ণার কথা শুনে আচমকাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে তৃষ্ণা কে ছেড়ে দিয়েছে।
তৃষ্ণা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে হাসলে কত সিগ্ধ লাগে। তৃষ্ণা গালে হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। জায়ান হাসি থামিয়ে সিটে হেলান দিয়ে আছে। হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে গেছে।
ওভাবেই তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলল,” এতো ভয় পাও?”
ঘোর থেকে বেড়িয়ে এসে বলল,
” আপনি মানুষটা খুব রাগী। রেগে গেলে ভয়ংকর হয়ে যান। আমার খুব ভয় লাগে তখন।”
” আমার রাগ তুমি বুঝতে পারো?” অবাক গলায় বলল।
” হুম পারি তো। রাগলেই আপনার মুখটা ভয়ংকর হয়ে যায়।”
“ভালোবাসা হচ্ছে তাহলে!” বিরবির করে বলল।
তৃষ্ণা শুনতে কাছে এগিয়ে এসে বলল,” কি বললেন শুনতে পাইনি।”
জায়ান তৃষ্ণার বাহু ধরে টেনে নিজের বুকের উপর তৃষ্ণার মাথা চেপে ধরে বলল,” হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে গেছি। একটু রেস্ট করি আসো।”
” আপনাকে হাসলে অনেক সুন্দর লাগে।”
লজ্জা মাখা গলায় বলল তৃষ্ণা। তৃষ্ণার কথা শুনে জায়ানের ঠোঁটের কোনে আবার ও হাসি ফুটলো।
____________________________
এদিকে আয়ান খুব ভালো বিহেভ করছে উষসীর সাথে। উষসী এই শয়তান টার এতো ভালো আচরণ হজম করতে পারছে না। কিছু তো শয়তানি বুদ্ধি আঁকছেই কিন্তু ধরতে পারছে না ও। গায়ে গা লাগিয়ে বসতে চাইছে। উষসী দূরত্ব করলেও সে যেন কাছেই থাকতে চাচ্ছে।
” তোমার মনে কি শয়তানি প্লান ঘুরছে বলো তো? আমার সাথে কেন ভালোবাসার অভিনয় করছো?”
আয়ান নরম সুরে বলল,” বিলিভ কর। আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি। আমি শুধরে গেছি।”
” তোমার মতো মানুষ কে বিলিভ করবো তাও আমি কখনোই না।”
” দেখ কত অত্যাচার করেছে জায়ান আমাকে। না খাইয়ে রেখেছে। পানির তৃষ্ণায় আমি ছটফট করেছি আর ও আমাকে এক ফোঁটা পানিও দেয় নি। যে তোমার স্বামীকে এতো ভয়ঙ্কর শাস্তি দিয়েছে তার জন্য তুমি আমাকে অবহেলা করবে?”
” তুমি নিজের পাপের শাস্তি পাইছো। এখানে আমি কি করব। আমি যে এখনো তোমার সাথে আছি এটাই তোমার ভাগ্য। একদম আমার সাথে ভালোবাসা বাসি দেখাতে আসবে না। তুমি যে এক নারীতে সন্তুষ্ট নয় সেটা আমার থেকে কেউ ভালো জানে না। শত নারীর দিকে খারাপ দৃষ্টি দেওয়া তোমার জন্মগত দোষ।”
আয়ান চোখ মুখ শক্ত করে উষসীর কথা হজম করছে। মন তো চাচ্ছে এখানেই এইটা কে কিছু করে দিতে। কিন্তু এখন ওর সব কিছুই সহ্য করতে হবে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করে আবার কিছু বলতে লাগলো। উষসী অবাক হয়ে গেছে এতো কথা বলল ও তাও আয়ান ওকে কিছু বলল না। উল্টো হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে।
ওর অবাক করা মুখের দিকে তাকিয়ে আয়ান বলল,” আমি এসব শোনার যোগ্য। তুমি বলে নিজের মনকে শান্ত করো।”
উষসীর মাথার ঘুরে উঠবে এমন লাগছে। এতো ভালো আয়ান হতেই পারে না। এতো ভালো অভিনয় করছে কি করে?
_________________________
দীর্ঘ জার্নির পর সবাই গন্তব্যে এসে পৌঁছেছে। সাইরু হিল রিসোর্ট বান্দরবান। অপরুপ সৌন্দর্যের মধ্যে অন্যতম একটি রিসোর্ট। জায়ান এই রিসোর্ট ঠিক করেছে সবার জন্য। ক্লান্ত শরীর নিয়েই সবাই রিসোর্ট এ প্রবেশ করল। এতো জার্নি তৃষ্ণা খুব কমই করেছে। এজন্য ক্লান্তে নেতিয়ে গেছে।
জায়ান তৃষ্ণাকে এক হাতে নিজের সাথে মিশিয়ে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করল।
আরিফ সারা রাস্তায় একটা কথাও বলেনি উর্মি কে এমনকি তাকায় ও নি উর্মির দিকে।
উর্মি আরিফ এর বিহেভিয়ার এ হতভম্ব হয়ে গেছে। এখনো গাড়ি থেকে নেমেই হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেল। জোভান আর আরিফ এর জন্য এক রুম ঠিক করা হয়েছে। আরিফ সেই রুমেই চলে গেছে। পেছনে থেকে উর্মি আরিফের ভাব দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেছে।
ও আনমনেই বলে উঠলো,” নির্লজ্জ লোকটার হঠাৎ এতো ভাব কোথা থেকে উদয় হলো!!”
জোভান পেছনে থেকে উর্মি কে ধাক্কা দিয়ে বলল,” কি হয়েছে?”
” আরিফ লোকটা ছ্যাচড়ামি ছেড়ে ভাব দেখাচ্ছে!”
” তোর কি তাতে? তুই তো তাকে পছন্দ করিস না। তাকে নিয়ে এতো কিসের ভাবনা?”
” ভাবছি না অবাক হচ্ছি। যাইহোক ভালোই হয়েছে তার জন্য আসতে চাইছিলাম না। তিনি আমার পেছনে না থাকলে আমি শান্তিতে একটু আনন্দ করতে পারবো।”
” শোন তোর সাথে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার আছে। রেস্ট করে নে তারপর বলব। সাথে একটা সারপ্রাইজ পাবি।”
উর্মি অবাক স্বরে বলল,” তুই আমাকে সারপ্রাইজ দিবি? স্বপ্ন দেখছি না তো?”
” এখন রুমে যা ফ্রেশ হ। সময়মতো পেয়ে যাবি।”
_________________________
ডিনারের পর জোভান উর্মি কে নিয়ে রিসোর্ট এর বাইরে আসলো। উর্মি জোভানের পকেট ও এদিক ওদিকে তাকিয়ে বলল,” আমার সারপ্রাইজ কই? এই তুই মিথ্যে বলেছিলে?”
জোভান উত্তর না দিয়ে ফোনে কারো নাম্বার উঠিয়ে কল দিলো।
উর্মির রাগ বাড়ছে কথার উত্তর দিচ্ছে না আবার কাউকে কল করছে। রাগে ও ফোন ছিনিয়ে নিয়ে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু ফোন নিতে পারল না। জোভান সরিয়ে কল দিয়ে ফেলল।
” এ্যাই তুই কাকে ফোন দিচ্ছিস?”
” মিহির কে ”
চঞ্চল উর্মি থমকে দাঁড়িয়ে পরলো। অবিশ্বাস্য চোখে বলল,” মিথ্যা বলছিস?”
” নো সত্যি মিহির কে কল দিছি।”
” তুই তার নাম্বার কোথায় পেলি?”
” যোগাড় করেছি!”
” কেন?”
” তোর খুশির জন্য?”
” এসব ভাইয়া জানলে কি হবে ভাবতে পারছিস?”
” নিজের চিন্তা কর। কি হবে না ভেবে।”
ফোন রিসিভ হতেই জোভান ফোন এগিয়ে দিলো উর্মি কে,” নে কথা বল।”
উর্মি ফোন নিলো কিন্তু কথা বলল না কল কেটে দিলো।
” এটা কি করলি?”
” মিহির আমাকে পছন্দ করে না। তার সাথে আমি কথা বলে আর তাকে ডিস্টার্ব করতে চাই না। আমার জন্য তাকে আর কখনো কল করবি না।”
” তাহলে কি ভাইয়ার পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করতে রাজি তুই?”
” আমি কোন কিছু তেই রাজি নয়। কিছুতেই না।”
বলেই কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। মিহির ওকে ভালোবাসলে ওর এই কষ্ট ভোগ করতে হতো না কেন ওই পাষাণ হৃদয়ের মানুষটাকে ভালোবেসেছিল!!
#চলবে?
( আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন পাঠকমহল?)