কৃষ্ণবেণী #পর্ব_৪০ #নন্দিনী_নীলা

0
519

#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৪০
#নন্দিনী_নীলা

তৃষ্ণার বাবা আয়ানের খবর শুনেই মেয়ের শশুর বাড়ি ছুটে এসেছেন। এসেই তিনি দুই মেয়ে নিয়ে গ্রামে ফিরে যাবেন বলছেন। এই বাসায় আর এক মুহূর্তও থাকতে দেবে না মেয়েদের। মরতে মরতে আয়ানের হাত থেকে বকুল রক্ষা পেয়েছে। তৃষ্ণাকে কিভাবে এমন পরিবারে রাখবে? এক ছেলের এমন স্বভাব বাকি সবাই যে ভাল তার গ্যারান্টি কি? তিনি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তার জায়ান কেও সন্দেহ হচ্ছে।
তাহের এর এমন কথা শুনে জায়ানের মাথা গরম হয়ে গেছে। শশুর বলে ও এখনো মাথা ঠান্ডা করে আছে। কিন্তু কতক্ষন রাখতে পারবে তা জানা নাই।
তাহের তৃষ্ণার হাত ধরে বললেন,,” তারাতাড়ি এই বাড়ি থেকে চল মা। আর এক মুহূর্তও তোদের এই বাসায় রেখে আমি বিপদে ফেলতে চাই না। আল্লাহর অশেষ রহমত এমন বিপদ স্থানে তোরা ঠিক আছিস।”
তৃষ্ণা ঢোক গিলে একনজর জায়ানের দিকে তাকাল। জায়ান রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।
বকুল তাহের এর হাত ধরে বলল,,” এসব কি বলছ বাবা? আপু তার শশুর বাড়ি ফেলে কোথায় যাবে। চলো আমরা দুজন ফিরে যাই।”
তাহের বকুলের দিকে তাকিয়ে ধমকে বললেন,,” কিসের শশুর বাড়ি। না না আমি আমার মেয়েকে এমন ভয়ঙ্কর মানুষদের কাছে রেখে যেতে পারব না। জোঁকের মাথায় খবর না নিয়ে সুখের আশায় মেয়ে বিয়ে দিয়েছিলাম। তারা যে এমন সন্ত্রাসী হবে কল্পনাও করি নাই। এমন জায়গায় ফেলে যাব মেয়েটাকে মরার জন্য?”
তৃষ্ণা বাবার হাত শক্ত করে ধরে বলল,,” বাবা আমার একটা কথা শোন। তুমি ভুল বুঝছো। মাথা ঠান্ডা করো।”
” কোন কথা না। তুই এখনি আমার সাথে যাবি।”
এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না জায়ান রেগে এগিয়ে এসে বলল,,” দেখুন আপনি আমার গুরুজন। আমি আপনার সাথে খারাপ আচরণ করতে চাইছি না। তাই আমার ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করবেন না।”
” আমি আমার মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছি। আমাকে আটকাতে আসবে না জামাই বাবা।”
” আমি আমার ব‌উকে কোথাও যেতে দেব না‌। আপনি এভাবে জোর করে নিয়ে যেতে পারবেন না।”
” আমি বাপ। আমার সন্তান কে আমি নিতে পারব না?” রাগী গলায় বলল তাহের।
” না পারবেন না।কারণ আমি ওর স্বামী।” ক্রোধে ফেটে পড়ে বলল জায়ান।
তৃষ্ণা ঢোক গিলে একবার নিজের বাপের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার জায়ানের দিকে। দুজনেই তর্ক করে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে জায়ান রেগে উঠছে।‌
তৃষ্ণা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে দেখে চিৎকার করে উঠে,,” থামুন দয়া করে আপনারা।”
তৃষ্ণা চিৎকার শুনে দুজনেই থেমে ওর দিকে তাকায়।
তাহের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,,” মা চল তো কথা না বারিয়ে।”
তৃষ্ণা বুঝে গেছে বাবার সাথে না গেলে বাবা থামবে না। আজ না নিয়ে তিনি স্বস্তি পাবেন না।
জায়ান সঙ্গে সঙ্গে বলল,,” তৃষ্ণা তুমি তোমার বাবাকে বলে দাও কোথাও যাবে না।”
তৃষ্ণা ঢোক গিলে বলল,,” জায়ান আমি বাবার সাথে বাড়ি যাব। আপনি প্লিজ আটকাবেন না।”
জায়ান তৃষ্ণার দিকে স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,,” বাবা তুমি বসো একটু আমি রেডি হয়ে আসছি।”

জায়ান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার পানে। তৃষ্ণা দ্রুত পায়ে উপরে চলে এল। জায়ান নিজেও পেছনে পেছনে এল।
রুমে এসেই দেখল তৃষ্ণা ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। জায়ান তৃষ্ণার হাত ধরে এক টানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,,” এসব কি সার্কাস চলছে?”
তৃষ্ণা চমকে উঠে বলল,,” ভয় পেয়ে গেলাম তো।‌এভাবে কেউ টান দেয়।”
” তুমি রাজি কেন হলে? দেখ তোমার বাবার পাগলামী’তে যদি তুমি সায় দাও আমি কিন্তু নিজেও জানি না কি করব। তুমি আমার ওয়াইফ। আমাকে ছেড়ে তুমি কোথাও যেতে পারবে না।” দাঁতে দাঁত চেপে বলল জায়ান।
তৃষ্ণা জায়ানের বুকে নাক ঘষে বলল,,” আপনাকে ছেড়ে কোথায় যাব আমি? আমি তো একেবারে যাচ্ছি না। এখন বাবার মাথা গরম আছেন। তিনি ভয় পাচ্ছেন এখানে আমাকে রেখে যেতে। এখানে বাবার দোষ নেই তার ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। আয়ান যা করেছে তাদের সাথে তার পর কেউ নিজের সন্তানকে এমন জায়গায় রেখে যেতে চাইবে না। জানি আয়ান এখন এখানে নাই তবুও বাবার মনের ভয় দূর করতে হবে। আমি চলে আসব আপনি চিন্তা করবেন না। আপনাকে ছাড়া আমিও থাকতে পারব না। বাবাকে বুঝানোর জন্য হলেও আমাকে তার সাথে এখন যেতে হবে। দয়া করে রাগ করবেন না। রাজি হয়ে যান।”
জায়ান আঁজলা করে তৃষ্ণার মুখমন্ডল ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলল,,” আমার তো এক মুহূর্ত তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।”
” আমি আপনাকে কল করব। মালদ্বীপ যাওয়ার সময় ফোন দিয়েছিলেন ওটা নিয়ে যাই?”
” ওটা তো তোমার ফোন যেখানে যাবে সাথেই রাখবে।”
” আচ্ছা রাখব। এবার ছাড়েন বাবা অপেক্ষা করছে।”
জায়ান তৃষ্ণার খোঁপা খুলে দিল। তৃষ্ণা কে উল্টো করে চুল মুখ গুঁজে বলল,,” এই সুবাস ছাড়া আমার ঘুম আসবে না।”
” তাহলে কয়টা রাত না হয় নির্ঘুম থাকেন।”
জায়ান কথা বলে না। নিশ্চুপ চুলের ঘ্রাণ নিতে থাকে। আর হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল ছাপিয়ে পেটে বিচরণ করতে থাকে আঙ্গুল।
নিচ থেকে তৃষ্ণার বাবা ডেকে উঠতেই তৃষ্ণা জোর করেই ঠেলে জায়ান কে সরিয়ে দিতে লাগে। কিন্তু জায়ানের পেশিবহুল সুঠাম দেহের সাথে পারলে তো। এক চুল ও নড়াতে পারে না।
” বাবা ডাকছে ছাড়ুন প্লিজ।”
জায়ান নিজের তৃপ্তি মিটিয়েই ছাড়ে। তৃষ্ণা রাগে গজগজ করে ব্যাগের চেইন আটকায়।
” শশুর এমন ভিলেন গিরি শুরু করবে আমার বউ নিয়ে ভাবতেই পারি নি। শেষে নিজের শশুরের সাথে যুদ্ধ করতে হবে।”
তৃষ্ণা বিরক্তিকর গলায় বলল,,” কিসের যুদ্ধ কি বলছেন।”
” বুঝ না তুমি।”
” না বরমশাই বুঝি না।
থেমে আবার বলল,,” আপনি নিজের খেয়াল রাখবেন।”
” তুমি স্বামী সেবা না করে চলে যাচ্ছ। আবা‌র বলছ খেয়াল রাখতে? পারব না।”
” না পারলে আমি এসে যত্ন নেব।”
জায়ান আচমকাই তৃষ্ণা কে টেনে কোমর জড়িয়ে ধরে খুব গভীর ভাবে ছুঁইয়ে দেয় অধর। তৃষ্ণা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। ওদিক দরজা খোলা তৃষ্ণা সেদিকে তাকাতেই চমকে উঠে নতুন কাজের মেয়ে শেফালী দাঁড়িয়ে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণা জায়ানের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে না পেরে ঠোঁটে কামড়ে দেয়। জায়ান আহ করে দূরে সরে দাঁড়ায়। তৃষ্ণা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা দৌড়ে চলে গেছে। তৃষ্ণা রাগী চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা এমন বেয়াদব কেন নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে ছিল কেন?
” এটা কি করলে?” রাগী গলায় বলল জায়ান। ওর হাত ঠোঁটে। ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে গেছে। তৃষ্ণা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এতো জোরেই দিয়েছে নাকি রক্ত বেরিয়ে গেছে।
” ছাড়ছিলেন না কেন? দরজা খোলা ছিল।”
জায়ান বলল,,” এতে প্রবলেম কি? কারো সাহস আছে আমার ঘরে উঁকি মারার?”
তৃষ্ণা বলতে গিয়ে ও বলতে পারল না। মেয়েটা হয়ত ভুলে এমনটা করেছে। জায়ান কে বললে তার বিপদ হবে‌। এসব ভেবে জায়ানের থেকে আড়াল করল। কিন্তু ও নিজেই রেগে আছে শেফালীর প্রতি। বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে ছিল কেন প্রথমেই তো চলে যেতে পারত।
” তুমি এটা করতে পারলে? এতো সাহস তোমার?”
” হ্যা আমি মিসেস জায়ান আহনাফ ভুলে যাবেন না। আমার সাহস অনেক বেশি।”
জায়ান তৃষ্ণার বড়ো বড়ো চোখের থাকে চেয়ে বলল,,” তাই নাকি মিসেস।”
” ইয়েস মিস্টার।”
” এবার তোমাকে ভর্তি করতে হবে।”
” আচ্ছা ফিরে এসে ভর্তি হবো। আপনার যোগ্য ব‌উ হবো।”
” যেদিন তোমার প্রথম দেখেছি সেইদিন‌ই তোমায় যোগ্য বলে মেনেছি। আমার জন্য যোগ্যতার প্রয়োজন নাই। তোমার এই যোগ্যতা নিজের জন্য।”
তৃষ্ণা জায়ানের বুকে মাথা রেখে চুপ করে র‌ইল।
জায়ান নিজের গাড়িতে ওদের পাঠানোর কথা বলল। তাহের যাবে না বলল জায়ানের গাড়িতে। তৃষ্ণা তখন বাবাকে সামলে নিল। এতো বাড়াবাড়ি জায়ান মানবে না। এমনিতেই অনেক কষ্টে থাকে রাজি করিয়েছে।
জায়ান রাগী চোখে শুধু তাকিয়ে ছিল তাহেরের দিকে। তৃষ্ণার বাবা না হলে এতোক্ষণ উনার কি হাল করত ও নিজেও জানে না। তৃষ্ণা ছলছল চোখে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে বাবা বোন কে নিয়ে। বিয়ের পর প্রথম স্বামী ছাড়া কোথাও যাচ্ছে। নিজের আপন নীড়ে তবুও বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। মানুষ এতোটা আপন হয়ে উঠেছে তাকে বিহীন নিজের বাড়িতে যেতেও বুকে জ্বালা করে।
#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here