#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৩৩(২)
#নন্দিনী_নীলা
তৃষ্ণা ভেতরে গিয়ে গাল থেকে হলুদ মুছে নিল। রাগ হচ্ছে ওর কিন্তু দেখাতে পারছে না। আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখল মেকাপ উঠে গেছে। ও অপর গাল থেকে ও মুছে নিল। তারপর বেরিয়ে এলো রুম থেকে। বাসা এখন ফাঁকা মোটামুটি। হইচই হচ্ছে বাগানে। এদিকে ছোট বাচ্চারা খেলাধুলা করছে।
তৃষ্ণা সিঁড়ি দিয়ে নামছে হঠাৎ পেছন থেকে দৌড় আর চিৎকার এর আওয়াজ শুনে তৃষ্ণা ঘাবড়ে যায়।
চমকে পেছনে তাকাতে যাবে কেউ ঝড়ের গতিতে দৌড়ে আসে। এলোমেলো পা ফেলে সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে যায়। তার শরীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে তৃষ্ণা মেঝেতে পরে যায়। তৃষ্ণা মেঝেতে বসে হতবিহ্বল চোখে তাকায় সামনে।
বিস্মিত স্বরে বিড়বিড় করে,” হায় আল্লাহ,এই পাগলটা বাইরে আসলো কি করে?”
তৃষ্ণা সিঁড়ির হান্ডেল ধরে উঠে দাঁড়ায়। বাচ্চা গুলো ও ভয়ার্ত তাকিয়ে আছে।
উনার পরনে একটা ম্যাক্সি আর গায়ে কোন ওরনা নাই। চুল গুলো জট হয়ে এলো মেলো হয়ে মুখ অর্ধেক ডেকে আছে। এই চুল কত বছর ধরে আঁচড়ানো হয় না কে জানে। তৃষ্ণা পাগলকে থামাতে যাবে এদিকে পাগল চিল্লাচিল্লি করে বাসার বাইরে চলে গেল গার্ড আটকাতে গেলে কামড় খামচে দেয়। তাই তারা ও এগিয়ে আসতে পারছে না। কারণ তারা আঘাত করতে পারবে না। এদিকে পাগলের কামড়, খামচি খেতেও কেউ চায় না।
তৃষ্ণা লেহেঙ্গার ওরনা ঠিক করে কাঁধে হাত চেপে বাইরে আসে। ধাক্কা খেয়ে পরে কাঁধে ব্যথা পেয়েছে। তাই হাত দিয়ে আলতো চাপ দিয়ে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করছে।
এদিকে বাইরে এসে আরো বিচ্ছিরি অবস্থা। পাগলটা সবাইকেই নাজেহাল করে ছাড়ছে। জায়ান আশেপাশে নাই। সব আত্নীয় স্বজন তামাশা দেখছে। গার্ডরা তাকে ভেতরে নেওয়া জন্য টানাটানি করছে। কাজের মহিলারা এগিয়ে এসে ধরলেই তাদের চুল টেনে দিচ্ছে। ভয়ে তারা দূরে সরে যাচ্ছে।
তৃষ্ণা উর্মির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। উর্মি ভয়ে তৃষ্ণার হাত চেপে ধরে বলল,” ভাবি ভাইয়া কোথায়?”
” জানি না।”
” ভাইয়াকে খোঁজ প্লিজ না হলে অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে।”
” হুম তুমি ভয় পেয়ো না আমি দেখছি।”
তৃষ্ণা নেমে আসে এদিকে পাগলটা দৌড়ে স্টেজে উঠে যায়। উর্মি ভয়ে ছুটে নেমে আসে। পাগলটা মিষ্টি খেতে লাগে টপটপ করে। খুব মজা করে খাচ্ছে। মনে হচ্ছে কত দিনের খাওয়ার শখ আজ মিটল।
জায়ান কোথাও নাই লোকটা হঠাৎ কোথায় হাওয়া হয়ে গেল?
কোমরে হাত রেখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে! তখনি একটা হাত টেনে তৃষ্ণা কে বাগানের একটা স্টোর রুমে নিয়ে আসে আর পেছনে থেকে কোমর জড়িয়ে ধরে।
” কি মিসেস আমাকে খুঁজচ্ছ?” কানের কাছে জায়ানের ফিসফিসানি জড়ানো কন্ঠ আসে।
” এখানে কি করছেন আপনি? ওইদিকে কি হচ্ছে জানেন?”
” শুধু জানি নাকি লাইভ ও দেখছি।”
” মানে?”
“তুমি ও দেখ।”
জায়ান তৃষ্ণাকে জানালা দিয়ে দেখায় পাগলটা হলুদের বাটি নিয়ে সবার গায়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে সবাই দৌড়ে পালাচ্ছে।
” সব দেখেও আপনি এখানে শান্ত হয়ে আছেন? তাকে থামাবেন না?”
” নাহ।”
” আজ উর্মির গায়ে হলুদ সব নষ্ট করে দিচ্ছে সবাই ভয় পাচ্ছে।”
” তো আমার কি?”
তৃষ্ণা জায়ানের হাত পেট থেকে সরিয়ে ওর দিকে ঘুরে বলল,,” পাগলটা শুধু আপনার কথা শুনে কেন?”
” তাকেই জিজ্ঞেস কর।”
” পাগলটা আপনার কি হয়? না মানে আমার কি হয় জানি না তো তাই জানতে ইচ্ছে করছে।”
” তোমার হাজব্যান্ডের গর্ভধারণী মা।”
তৃষ্ণা হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। ও স্তব্ধ হয়ে গেছে। এই পাগলটা জায়ানের মা হতে পারে ও কল্পনাতেও ভাবেনি। জায়ানের দৃষ্টি স্বাভাবিক। ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিল। এদিকে তৃষ্ণার অবস্থা করুন। ও নির্বাক হয়ে গেছে কথা বলতে পারছে না। পাগল বলে সম্বোধন করতো সব সময় আর সেই ব্যক্তি কিনা ওর স্বামীর মা ওর শাশুড়ি ও লজ্জা মাথা নিচু করে ফেলল। মাথার মধ্যে এখন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন গুলো করতে পারছে না। করলেও উত্তর ও পাবে না। কিন্তু খুব যে জানতে ইচ্ছে করছে। জায়ানের মা পাগলটা হলে জেসমিন মা কে?
সেতো জায়ান কে পাগলের মতো ভালবাসে মা ডাক শুনতে ছটফট করে। সৎ মা এতো ভাল হয়? ভুলেও তাকে আমার সৎ মা মনে হয় নি। এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
এই পাগলটা মা হলে সে তো সৎ মাই হয়।
সব ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
জায়ান হঠাৎ তৃষ্ণা কে পাঁজকোলে তুলে নিল। তৃষ্ণার সমস্ত চিন্তায় ভাটা পরল। ও চমকে জায়ানের গলা জড়িয়ে ধরল। জায়ান তৃষ্ণাকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে উপরে নিজেদের রুমে চলে এলো।
” কি করছেন? এখানে এলেন কেন? উনাকে থামাবেন চলেন।”
জায়ান তৃষ্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,” সম্বোধন চেঞ্জ করে ফেললে। পাগল কে পাগল বলেছ এতে দোষের কি আমি নিজেও তো পাগলই বলি।”
” না মানে আমি কল্পনা ও করিনি উনি আপনার মা হতে পারে। আসলে আমি ভাবতেই পারিনি জেসমিন মা আপনার আসল মা না!”
” ওদিকটা তোমার শশুর আর শাশুড়ি আছে উনারাই সব সামলে নিবে। আমাকে প্রয়োজন নাই। আর আয়ান আছেই তো।আমরা বরঞ্চ একটু প্রেম করি।”
” মানে…”
” জায়ান তৃষ্ণাকে বিছানায় বসিয়ে দরজা লক করে লাইট নিভিয়ে দেয়। অন্ধকারে বিছানায় গিয়ে বসে। তৃষ্ণা জায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,,” এই অবস্থায় ঘুমাবেন? পোশাক পরিবর্তন করে আসি। এই ভারি লেহেঙ্গা পরে ঘুমানো যাবে না।”
জায়ান তৃষ্ণার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে,,” হুশশ, চুপ করো।”
তৃষ্ণা থমকে চুপ করে যায়।
জায়ান মোমবাতি জ্বালিয়ে তৃষ্ণার সামনে ধরে বলল,,” তোমার রুপের বাহার মোমবাতির আলোয় দেখব বলে এতো কাহিনী করলাম। আর তুমি বোকা বউটা আমার বোকাই রয়ে গেলে।”
তৃষ্ণা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। জায়ান মোমবাতি ট্রি টেবিলের উপর রেখে এক হাত বাড়িয়ে তৃষ্ণার গালে ছুঁইয়ে দিল। তৃষ্ণা লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু ফট করেই চোখ তুলে তাকালো জায়ানের চোখের দিকে।
” কি লাগালেন ভেজা লাগছে!”
জায়ান অপর গালেও লাগিয়ে দিয়ে বলল,,” হলুদ লাগিয়ে দিলাম আমার বউকে। অন্য কেউ কেন লাগাবে? এই গাল, চোখ, ঠোঁট, নাক, কপাল, সম্পূর্ণ মানুষটাই আমার তার সব জায়গায় সব কিছু লাগবো ছুবো শুধু আমি।”
তৃষ্ণা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ভাবছে জায়ান দেখে ফেলেছিল নাকি ওই ছেলের হলুদ দেওয়াটা।
তৃষ্ণা কিছু বলতে যাবে জায়ান আবার বলে,,” আমাকে ও লাগিয়ে দাও।”
” কিভাবে আমি তো হলুদ আনি নাই।”
” তোমার গাল থেকে লাগিয়ে দাও।”
” কিভাবে?” অবাক গলায় বলল।
জায়ান তৃষ্ণার দিকে নিজের গাল এগিয়ে নিয়ে বলল,,” দাও নিজের গাল থেকে হলুদ লাগিয়ে।”
তৃষ্ণা বুঝতে পারছে না জায়ানের ইঙ্গিত। ও চুপ করে তাকিয়ে আছে জায়ানের গালের দিকে।
জায়ান তৃষ্ণার গালে নিজেই গাল ঘষে হলুদ লাগিয়ে দেয়। তৃষ্ণা এতোক্ষণ ইঙ্গিত বুঝে ও লজ্জা পেয়ে লাজুক হাসতে লাগল।
_______________________________
জেসমিন বেগম সবার সামনে লিলির গালে ঠাস করে চর মারলেন। লিলি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। উর্মি ভয়ে রুমে চলে গেছে। জোভান ফোন কানে ধরে আয়ানের নাম্বারে ট্রাই করছে। অদ্ভুত ভাবে তিনি গতকাল বিকালে থেকে মিসিং। আজ সারাদিন বাসায় আসে নাই।তাই তাকে খোঁজার দায়িত্ব পরেছে জোভানের উপর। কারণ আয়ানের কোন ব্যাপারে জায়ান থাকতে চায় না। তাই তাকে এই ব্যাপারে জানানো হয়নি।
পাগলটা কে রুমে আবার বন্দি করা হয়েছে। এই কাজ করেছে অনেক কষ্টে সবাই মিলে শেষে আয়ানের বদলে জোভান ঘুমের ইনজেকশন দেয়। তারপর তাকে রুমে নেওয়া হয়। গায়ে হলুদের মজাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। সবাই যার যার রুমে চলে গেছে। আনন্দ উল্লাস করার শখ সবার মিটে গেছে পাগলের পাগলামী দেখে।
” তোর জন্য আজ ওই পাগল বাইরে আসার সাহস পেয়েছে। আর আমার মেয়ের হলুদে ঝামেলা করার সুযোগ পেয়েছে আজ তোর….”
জোভান মায়ের কাছে এসে বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,,” উফফ মা ছাড়ো তো। আয়ান ভাইয়ার ফোন অফ দেখাচ্ছে। আমাকে দয়া করে মাফ করো আমি তার খোঁজ নিতে পারব না।”
বলেই জোভান চলে গেল।
সাদিকুর রহমান কপালে হাত রেখে বসে আছে সোফায়।
জেসমিন বেগম তার পাশে বসে বললেন,,” আয়ান কোথায়?”
” জানি না!”
” সত্যি?”
” তোমাকে মিথ্যে বলে আমার লাভ কি?”
” আচ্ছা। ওর খোঁজ করো। হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয় কেন?”
” আমাকে জিজ্ঞেস না করে ওকেই জিজ্ঞেস করিও।”
” তুমি কপালে হাত রেখে ওর কথা ভাবছ?”
সাদিকুর রহমান উঠে গম্ভীর মুখশ্রী করে চলে গেলেন।
#চলবে……