#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৩৪(১)
#নন্দিনী_নীলা
সময়টা রাত দুইটার দিকে।
তৃষ্ণা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মাঝেই বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ও যেহেতু বিছানায় একা এজন্য একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাচ্ছে এভাবে গড়াগড়ি করে ঠাস করে বিছানা থেকে ফ্লোরে পরে গেল। তৃষ্ণা ফ্লোরে পরতেই ওর নিদ্রা ছুটে যায়।
জায়ান বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। থপ করে কিছু পরে যাওয়ার শব্দ পেয়ে ও চমকে উঠে আর দ্রুত ভেতরে আসে। ড্রিম লাইটের আলোয় দেখল তৃষ্ণা ফ্লোরে বসে আছে স্তব্ধ হয়ে। ব্যথা পেয়েছে কিনা ওর মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে না।
জায়ান রুমের লাইট অন করে দ্রুত তৃষ্ণার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,,” পরলে কীভাবে? দেখি উঠো বেশি ব্যথা পেয়েছ?”
তৃষ্ণা হতবিহ্বল চোখে তাকাল জায়ানের দিকে। ও নিচে বসে আছে স্তম্ভিত হয়ে। ওর বুঝতে পারছে না ও এতো বড়ো খাট থেকে পরে গেল কিভাবে? তাও জায়ান পাশে থাকা সত্ত্বেও। পরার সময় ওর মনে হলো না ওর পাশে কেউ ছিল। তাহলে কি ও একা ছিল বিছানায়? তৃষ্ণা প্রশ্নতুক চোখে তাকাল জায়ানের দিকে আর জিজ্ঞেস করল,,”আপনি কোথায় ছিলেন? আমি পরে গেলাম কীভাবে?”
” বেলকনিতে ছিলাম। তুমি ঘুমের মধ্যে এতো নড়াচড়া করলে যে মাঝখানে থেকে ফ্লোরে চলে এলে।”
” সকাল কি হয়ে গেছে?”
বলতে বলতে তৃষ্ণা জায়ানের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ চিনচিন ব্যথা করছে। হাত পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে বলল,,” আপনি বেলকনিতে কি করছিলেন এতো রাতে? আড়াইটা বাজে। এখনো তো সকাল তো হয়নি।”
জায়ান তৃষ্ণার ঘুমঘুম ফোলা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,” ঘুম আসছে না। এজন্য আঁধার রাত্রি উপভোগ করছিলাম।”
” আপনি ওসব উপভোগ করতে না গেলে আমি পরে যেতাম না। নিশ্চয়ই ঘুমের মধ্যে আপনায় খুঁজে নিতে ছটফট করেছি আর নিরাশ হয়ে পরে গেছি।”
জায়ান বলল,,” তুমি ঘুমাও।”
” আপনি কি ঘুমাবেন না আজ?”
” আমি একটু একাকি থাকতে চাইছি।”
” আমি আবার পরে যাব আপনি না থাকলে।”
” এর আগে মনে হয় একা থাকো নাই!”
” থেকেছি তখন পরতাম না। আজ পরে গেছি তাই আপনাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।”
বলেই তৃষ্ণা ওয়াশরুমে থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো।
” আপনাকে খুব বিষন্ন লাগছে। আপনার কি কোন কারণে মন খারাপ?”
” মাথাটা যন্ত্রণা করছে।” জায়ান কপালে হাত দিয়ে বলল।
তৃষ্ণা লাইট অফ করে বিছানায় বসে বলল,,” আসুন আপনার মাথা টিপে দেই। ভাল লাগবে।”
জায়ান দ্বিমত করল না। বাধ্য ছেলের মতো বিছানায় উঠে বসল। আর তৃষ্ণা কোলের উপর মাথা রেখে পা ভাঁজ করে শুয়ে পরল। তৃষ্ণা চমকে উঠে ও নিজেকে সামলে নিল।
তৃষ্ণা জায়ানের মাথার চুল টেনে ধরে বলল,,” মায়ের কথা মনে পরছে তাই না? উনার জন্য আপনি কষ্ট পাচ্ছেন।”
জায়ান সত্যি ডুকরে কেঁদে উঠল। জায়ানকে সব সময় শক্তপোক্ত, গম্ভীর, কঠিন পুরুষ বলেই মনে হয়েছে। সে তেমনটাই। ওকে ভালবাসে অনেক কিন্তু নরম, বা কাঁদতে পারে, এমনটা কখনো মনে হয়নি। সব সময় যে মানুষটাকে শক্ত বলে মনে হয়েছে আজ তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে ওর বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। মায়ের প্রতি তার যে অসীম ভালবাসা তা এই কান্নায় প্রকাশ পাচ্ছে অথচ একটু আগেও ও ভেবেছিল জায়ান তার মাকে ভালবাসা তো দূরে থাক পাগল বলে হয়তো অবজ্ঞা করে। তখন কেন জানি ওর জায়ানের উপর রাগ হচ্ছিল নিজের মাকে এভাবে অবজ্ঞা করার জন্য। কিন্তু এই মুহূর্তে জায়ানের এই হাহাকার, কান্না ওর ভাবনা ভুল বলে প্রমাণ করছে।
মাকে উনি একটু নয় অনেক বেশিই ভালবাসে কিন্তু তাহলে কেন নিজেকে তার থেকে দূরে রাখে। চাইলেই তো তিনি মায়ের চিকিৎসা করাতে পারে তা না করিয়ে কেন বন্দি করে রেখেছে।
তৃষ্ণা হঠাৎ বলে উঠল,, ” যান মায়ের সাথে দেখা করে আসেন।”
জায়ানের কান্নার শব্দ অনেক আগেই থেমে গেছে। আবেগের বশে একটু কেঁদে উঠলেও দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। কিন্তু তার চোখ দিয়ে গলগলিয়ে এখনো অশ্রু ঝরছে। আর সেই জলে তৃষ্ণা শাড়ি ভিজে যাচ্ছে।
জায়ান তৃষ্ণার কথার পিঠে কিছু বলল ও না নড়ল ও না। তৃষ্ণা জায়ানের মুখটা সোজা করে বলল,,” কথা বলছেন না কেন?”
“শুয়ে পরো। একটু ঘুমাতে চাই। সকালে আর রেস্ট নেওয়ার টাইম পাওয়া যাবে না।”
” কথা এরিয়ে যাচ্ছেন?”
” যা মনে করো।”
তৃষ্ণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জায়ানের পাশেই শুয়ে পরল।
“আমি ঠিক আছি। এতো চিন্তা করতে হবে। ঘুমাও।”
জায়ান তৃষ্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল।
তৃষ্ণা জায়ানের বক্ষস্থলে অধর স্পর্শ করে বলল,,” আপনি ঠিক নেই।”
জায়ান বিষন্ন মুখ এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল,,”বউয়ের আদর স্পর্শ পেলে সব কষ্ট কোথায় যেন মিইয়ে যায়। একটু বেশি করে আদর করে দাও। আমি একদম ফিট হয়ে যাব।”
তৃষ্ণা মাথা উঁচু করে বলল,,” তাই? এই অবস্থায় ও মজা করছেন?”
“মজা নয় রিয়েলি।”
” তখন এতো ভালবাসার কথা বলে তো আমায় ঘুম পাড়িয়ে দুঃখ বিলাস করতে গেছিলেন। আর আমি সেই দুঃখে বিছানা থেকেই পরে গেলাম।”
” আমি কিন্তু সত্যি বুঝি নি তুমি পরে যাবে।”
“যান আজ আপনার বিষন্নতা কাটাতে আমি সব মেনে নিলাম।”
” বউ স্বেচ্ছায় আমন্ত্রণ করলে আমি কি মানা করতে পারি।”
” কি! কি বললেন? আমি আমন্ত্রণ করলাম কখন?”
” এই এখনি তো করলে!”
” মোটেও না আপনি আবদার করছেন বিদায়।”
” তাহলে একটু আদর করো দাও না।”
তৃষ্ণা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। জায়ান কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়েই যেন ঘায়েল করে দিবে। ওকে সম্মোহিত করে ফেলবে। ড্রিম লাইট আজ এতো আলো দিচ্ছে কেন?
জায়ানের ঠোট টিপে হাসা ও স্পর্শ দেখতে পাচ্ছে আর এতে ও আরো লজ্জায় কাঁচুমাচু করতে লাগে।
জায়ান ঠোঁট উঁচু করে বলল,,” তারাতাড়ি করো মাথা ব্যথা করছে। ঘুমাব তো।”
তৃষ্ণা কিছুই করতে পারছে না ও মুখ লুকাতে আরো জায়ানের বুকের সাথে মিশে যাচ্ছে। তা দেখে জায়ান তৃষ্ণার থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে বলল,,” প্লিজ।”
তৃষ্ণা চোখ খিচে বন্ধ করে লাজুক গলাতেই বলল,,” আমি পারছি না।”
জায়ান তৃষ্ণার থুতনি ছেড়ে দিল।
” আচ্ছা ঘুমাও।”
জায়ান চোখ বন্ধ করে নিল। তৃষ্ণা চুপ করে জায়ানের বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। কথা রাখতে না পেরে ওর খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু ওর যে লজ্জা লাগে ও কীভাবে.. উনার মনটা এমনিতেই খারাপ ও আরো বাড়িয়ে দিল।
জায়ান তৃষ্ণার মাথাটা টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,,” ঘুমাও তো।”
” আপনার কষ্ট কমানো বদলে বাড়িয়ে দিলাম। আমি আসলেই আপনার যোগ্য নয়।”
” বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করলে এই এক জ্বালা। সব কিছুতেই উল্টো বুঝে।”
বলেই জায়ান নিজেই গভীর ভাবে তৃষ্ণা কে স্পর্শ করল। তৃষ্ণা জায়ানের আদর স্পর্শ সাদরে গ্রহণ করল।
____________________________
হলুদে ঝামেলা হওয়ার জন্য। বিয়ের দিন জেসমিন বেগম নিজে বারবার করে পাগলটার ঘর পাহারা দিচ্ছেন। বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। আজ সবাইকে এ রুমে আসতে মানা করেছেন। আদ্যিখেতা করতে গিয়ে দরজাটা বন্ধ না করেই চলে আসে সবাই। বিপদ সেই ওর ঘাড়েই পরে। মেয়ে বিয়েতে এসব ঝামেলা দেখতে চান না তিনি।
তৃষ্ণা সকাল থেকে পাগলটার ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে কিন্তু চাবির অভাবে ভেতরে যেতে পারছে না। লিলির থেকে খবর পেয়ছে অনেক মার দিয়ে রুমে নেওয়া হয়েছিল। তৃষ্ণা মার দেওয়ার কথা শুনেই যেতে চেয়েছিল। জায়ান কে এসব বলে কষ্ট দিতে চায় না এজন্য তাকেও বলতে পারছে না। জায়ান ওর মাকে খুব ভালবাসে মায়ের জন্য আপসেট ও থাকে। গতকাল রাতেই সেটার প্রমাণ পেয়েছে ও। লোকটাকে এসব বলে আর কষ্ট দিতে চায় না।
সকালের দিকেই তৃষ্ণা ভাই ভাবি এসে উপস্থিত হলো। তারা হলুদে আসবে বলে আসেনি এ
জন্য তৃষ্ণা ভেবেছিল আজ ও আসবে না কিন্তু আজকে এসে ওকে চমকে দিয়েছে।
বরপক্ষ চলে এলো যথাসময়ে। যেহেতু ও বাড়ির একমাত্র বউ তাই গেইট থেকে শুরু করে সব কিছুতেই ওকে নিয়ে আনন্দ উল্লাস করছে সবাই। আরিফ আর ওর সব ফ্রেন্ডরা ওর পাশেই বসা স্টেজে। তৃষ্ণার হাতে দেওয়া হয়েছে বর এর খাবার। এতো বড়ো প্লেট নিয়ে ও হাঁটতে পারছে না ওর সাথে আরো দুজন জায়ানের মামাতো বোন গেল। তৃষ্ণা প্লেট রেখে আসতে যাবে তখন নজর গেল রহিতের দিকে। রহিতের হাত ব্যান্ডেজ করা।তাও ডান হাত ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,,” আরে আপনি গতকাল এসেছিলেন সেই না?”
রহিত ফ্যাকাশে মুখে মাথা নাড়াল।
” আপনার হাতে কি হয়েছে। গতকাল ও না ঠিক ছিল।”
রহিত বলল,,” ভুল জায়গায় হাত দেওয়ার জন্য শাস্তি হিসেবে হাত ভেঙে দিয়েছে।”
” মানে?” অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল তৃষ্ণা।
” আপনি দয়া করে এখানে থেকে যান। নয়তো কথা বলার জন্য না আবার আমার জিভটাই কেটে নেয়। আমি বউয়ের সাথে প্রেম বাক্য না আউরিয়ে বোবা হতে চাই না।”
তৃষ্ণার দৃষ্টি বিষ্ময়ে ভরা। বোকা চোখে তাকিয়ে ভ্রু কুটি করে নিচে নেমে এলো।
___________________________
উর্মির বিদায়ের সময় খুব দ্রুত ঘনিয়ে এলো। তৃষ্ণা এমনিতেই খুব নরম মনের আর তৃষ্ণা কে উর্মি খুব আপন করে নিয়েছিল এজন্য তৃষ্ণা বিদায় এ খুব কাঁদল। আত্নীয় স্বজন সবাই কেঁদে পরিবেশটা মুহূর্তের মধ্যে কান্না বাড়ি বানিয়ে দিল।
তৃষ্ণা জায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু মানুষটা কাঁদে নাকি। কিন্তু জায়ান একটুও কাঁদল না। কিন্তু মুখটা যথেষ্ট গম্ভীর ছিল। জোভান সেকি কান্না। এই ছেলে মেয়েদের থেকেও বেশি কাঁদে। সে কেঁদে কেঁদে উর্মি কে তো গাড়িতেই উঠতে দিচ্ছিল না পরে জেসমিন বেগম তাকে জোর করে টেনে সরিয়ে আনে আর উর্মি কে গাড়িতে তুলে দেয়।
তৃষ্ণা জায়ানের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,,” আপনার যমজ ভাইকে বিয়ে বাড়ি দেখলাম না। তিনি কোথায়?”
জায়ান ভ্রু কুঁচকে বলল,,” বলো কি সিরিয়াসলি? বাট আই ডোন্ট নো।”
” বলেন কি আপনি কিছুই জানেন না? আপনি কি বাড়ি থাকেন না?”
” থাকব না কেন? কিন্তু আমি সত্যি জানতাম না ও বাসায় নাই। আমি তো ভেবেছি আমার সামনে আসছে না হয়তো। আরো এতো টেনশনের মাঝে ওর কথা মনেই ছিল না।”
” সকালেই শুনলাম জেসমিন মা আপনার বাবাকে তাঁর খোঁজ করতে বলছে।”
জায়ান তৃষ্ণার দিকে থেকে চোখ সরিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে উর্মি কে বিদায় দিয়ে এলো। তৃষ্ণা ভীড় ঠেলে আর কাছে যায় নি।
#চলবে……
( নেক্সট পর্বে বকুলের খবর জানতে পারবে। ওর কি পরিনতি হয়েছে। আর ধৈর্য হারা না হয়ে পড়ার অনুরোধ রইল। সাজিয়ে লিখতে সময় লাগছে। আপনার আমাকে সুন্দর করে সাজাতে সময় দিবেন আশাকরি। তাড়াহুড়ো করে গল্পের সৌন্দর্য নষ্ট করতে চাইছি না। আপনারা পাশে থাকলে সব রহস্য সুন্দর করে উন্মোচন করে দিব। ইনশাআল্লাহ।)