#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৩৫(১)
#নন্দিনী_নীলা
এতো কিছু ঘটে গেল বাসায় তার কোন খবরই জানে না জোভান। বোনকে বিদায় দিয়ে দরজা আটকে ঘুমিয়ে পড়েছিল সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সবটা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। যাকে পাগলের মতো ভালবাসে সে এখন বড়ো ভাইয়ের বউ ও ভাবতেই পারছে না। পাথরের ন্যায় বসে আছে খাবার টেবিলে। সেই ক্ষনে আয়ান আর বকুল আসে। বকুলের পরণে শাড়ি দেখে জোভান কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। জায়ান তৃষ্ণার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। তৃষ্ণা জায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,,” আপনার ভাইয়ের পাশে আমার বোনকে আমি সহ্য করতে পারছি না।”
” এখানে তোমার বোন সায় দিচ্ছে তাই কিছু করাও সম্ভব নয়।”
“আপনি আমার বাসায় কল করেন আমি বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে চাই।”
” তাদের খবর দেওয়া হয়েছে আজ আসবেন তারা।”
তৃষ্ণা খাবার সামনেই বসে শুধু বকুলের কান্ড কারখানা লক্ষ্য করছে। খাবার ওর গলা দিয়ে নামছে না। আগুন চোখে তাকাচ্ছে আয়ানের দিকে কিন্তু আয়ান ভুল করেও ওর দিকে তাকাল না।
আয়ান বকুলকে খাবারে হাত দিতে দিল না।
বলল,,” আমি খাইয়ে দেই।”
বকুল আড়চোখে জোভানের দিকে তাকিয়ে আছে। জোভান শক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একথা শুনে রাগে ওর কপালের রগ ফুলে উঠল। বকুল কিছু বলছে না দেখে আয়ান সবার আড়ালে বকুলের হাত মুচড়ে ধরে বলল,,” কথা বলছ না কেন বকুল ফুল।”
বকুল ব্যথায় কুঁকড়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। বকুলের সম্মতি দেওয়া দেখে তৃষ্ণা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। নিজের বোনকে ও চিনতেই পারছে না। যেন পুতুল হয়ে গেছে। আয়ান এর সব কথায় সায় দিচ্ছে পুতুলের ন্যায়।
জোভান এসব আর সহ্য করতে পারছে না। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চেয়ে আছে। আয়ান আদ্যিখেতা করে বকুলের মুখে লোকমা তুলে দিবে এটা দেখে ও পানি ভর্তি গ্লাস হাতের মধ্যে চেপে ধরে জোরে চাপ দিল সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের গ্লাস ভেঙে জোভানের হাতে ঢুকে গেল। সবাই খাওয়া ফেলে অবাক চোখে জোভান এর দিকে তাকাল। জায়ান ছাড়া জোভানের রাগের কারণ আর কারো বোধগম্য হলো না।
জেসমিন বেগম দৌড়ে এসে ছেলের হাত ধরল। জোভান তাকে নিজের থেকে সরিয়ে গটগট পায়ে উপরে চলে গেল। আয়ান কপাল কুঁচকে জোভানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
রুমে এসে আয়ান বকুলের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,,” জোভান ওমন রিয়েক্ট করল কেন?”
” আমি জানি না।”
” ইউ লায়ার। জোভানের সাথে কি সম্পর্ক ছিল তোর?”
বকুল কেঁদে উঠে বলল,,” কোন সম্পর্ক ছিল না।”
” মিথ্যা বলবি না। কোন সম্পর্ক না থাকলে জোভান তোর দিকে ওই দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কেন?”
” আমি জানি না।”
আয়ান ঠাস করে বকুলের গালে চর মেরে বলল,,” আমার ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল তোর। তুই আমার জোভান রে ভালবাসিস তাই না। উষসী ও এই ভুল করেছিল। সবার নজর আমার বাকি ভাইদের উপর কেন রে আমি কি সুন্দর না?”
বলেই বকুলের চুলের মুঠি শক্ত করে ধরল আয়ান।
” ছাইড়া দেন আমারে দয়া কইরা।” আর্তনাদ করে বলল বকুল।
” আগে সব সত্য বল তারপর ছাড়ব।”
বকুল কাঁদতে কাঁদতে সব খোলে বলে।
তৃষ্ণার বাবা মা এসে অবশেষে উপস্থিত হলো। তারা বসে আছে ড্রয়িং রুমে। জেসমিন বেগম তো ক্রোধে এসে বলল।
” দুই মেয়েকে আমার দুই ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। আপনারা ভালো লোভী তো এভাবে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করেন।”
লজ্জায় অপমানে তৃষ্ণার মা মাথা নিচু করে আছেন। প্রথম মেয়ের শশুর বাড়ি এল আর এসে চরম অপমানিত হতে হচ্ছে। তৃষ্ণা পাশে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে।
বকুল আয়ানের সাথেই দাঁড়িয়ে আছে। তৃষ্ণার মা উঠে এসে বকুলের গালে শব্দ করে চর মারল।
বকুল মাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলে।
তিনি বললেন,,” একদমই আমার কাছে আসবি না তুই আমাদের মেয়ে না। আজ থেকে আমার এক মেয়ে। তোর মতো মেয়েকে জন্ম দিয়ে আমাদের মেয়ের শশুর বাড়ি মাথা নিচু করে থাকতে হচ্ছে। তোর মতো মেয়ে জন্ম দিয়েই মেরে ফেলা উচিত ছিল। আমার তৃষ্ণার সংসারে আগুন লাগালি তুই। এজন্য খালি এই বাসায় আসতে চাইতি তাই না মুখ পুড়ি।”
বকুলের বাবা এসে বকুলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,” বাড়ি চল এখনি।”
বকুলের হাত ধরতে যাবে আয়ান এসে বকুলের হাত ধরে বলে,,” সরি আঙ্কেল বকুল যাবে না।”
” দয়া করে বাবা আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে দাও।”
” বকুল আপনার মেয়ে হলেও এখন আমার ওয়াইফ তাই আমি চাই না ও আপনাদের সাথে যাক।”
তৃষ্ণার বাবা খুব সহজ সরল মানুষ।
বিয়ের কথা শুনে তিনি আঁতকে উঠেন।
” বকুল রে এইভাবে আমাদের মান ইজ্জত শেষ করলি?”
বকুল ঝরঝরিয়ে চোখের জল ছেড়ে দিল শুধু।
” বাবা আমি কিছু করিনি। আমাকে ভুল বুঝ না।”
” তাইলে আমাদের সাথে চল।”
বকুল ঢোক গিলে বলল,,” আমার বিয়ে হয়ে গেছে বাবা। এখন আমাকে এখানেই থাকতে হবে। বুবু ও তো বিয়ের পর শশুর বাড়ি আছে আমি কেন তাহলে চলে যাব।”
কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে তৃষ্ণার বাবা। তৃষ্ণা রাগান্বিত মুখশ্রী করে তাকিয়ে আছে বকুলের দিকে।
তৃষ্ণা জায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,,” এটা আমার বোন হতেই পারে না। আপনি প্লিজ বাবা মাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। উনারা এখানে থাকলে মরেই যাবে।”
বলেই তৃষ্ণা বাবা মাকে নিজের রুমে নিয়ে এল। তারা ও মেয়ের কাছে হতভম্ব হয়ে গেছে।
সময়ের চাকা খুব দ্রুত গড়াতে থাকে। বকুল এই বাসায় এসেছে তিন মাস হতে চলল এর মাঝে ওর পরিবর্তন দেখে তৃষ্ণা শুধু অবাকই হয়েছে। তৃষ্ণা প্রথম প্রথম ওর জন্য ভাবলেও এখন বকুলের উপর তীব্র রাগ জমে গেছে। তৃষ্ণা ওকে সহ্যই করতে পারে না। নিজে থেকেই দূরত্ব বজায় করে চলে।
এর মাঝে তৃষ্ণা আরেকটা কাজ শুরু করেছে। মৌমিতা জায়ানের পাগল মা। তার দেখাশোনা করছে। খাবার নিয়ে নিজেই খাইয়ে দেয়। জায়ান বিষয়টা এখনো জানে না। তৃষ্ণা এই কাজ করছে লিয়ার সহায়তায়। পাগলটা এখন আর রাগ করে না। ওকে দেখলে আরো শান্ত হয়ে যায়। তৃষ্ণার সাথে খুব ভাল সম্পর্ক হয়ে উঠেছে।
তৃষ্ণা প্রতিদিনের মতো আজকেও লাঞ্চের পর সবাই যখন ঘুমাতে যায় চুপিচুপি খাবার নিয়ে মৌমিতার রুমে যেতে লাগে। জায়ান আজ বলে গেছে সন্ধ্যার পর ফিরবে তৃষ্ণা সে জন্যই আরো নিশ্চিন্ত মনে যাচ্ছে। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়।
লিয়ার হাত থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে তৃষ্ণা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। জায়ান বসে আছে। আর মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তৃষ্ণা ভয়ে আঁতকে উঠে। জায়ান খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
তৃষ্ণা আমতা আমতা করতে লাগে। জায়ান এর জন্য আবার রাগ করবে নাকি।
তৃষ্ণা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে জায়ান বলল,,” যে কাজে আসছ করো। দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
তৃষ্ণা জায়ানের কথা শুনে বিস্মিত নয়নে তাকায়।
” না মানে আসলে…
” এদিকে আসো।”
তৃষ্ণা খাবারের প্লেট নিয়ে কাছে আসে।
” আপনি বাসায় কখন আসলেন? এতো আগে তো আসার কথা ছিল না।”
“অভাবনীয় কিছু করতে পারলে ভালোই লাগে। এই যে এখন আমায় দেখে কেমন চমকে গেছ। ভয় পেলে নাকি।”
তৃষ্ণা শুকনো ঢোক গিলে বলল,,” অনেক।”
” কি মনে হচ্ছে আমি তোমায় এখানে দেখে বকব?”
তৃষ্ণা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল।
জায়ান হেসে উঠল। মৌমিতার দিকে তাকিয়ে বলল,,” আমার বউকে তো হাত করে নিয়েছ। সে তার স্বামীকে না বলে তোমার কাছে ছুটে আসে। এতো ভাব দু’জনের কবে হলো?”
মৌমিতা কথা বুঝল কিনা বুঝা গেল না। শোয়া থেকে উঠে তৃষ্ণাকে ডাকতে লাগল খাবার দেওয়ার জন্য। তৃষ্ণা খাবারের প্লেট সামনে রাখতেই গপাগপ খেতে লাগল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাচ্ছে। জায়ান উঠে তৃষ্ণার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,” ভয় পাবার দরকার নাই আমি কিছু বলব না। আর আমি প্রথম থেকেই জানতাম তুমি এখানে আসো। আমার কথায় ই লিয়া তোমাকে সাহায্য করেছে।”
” তার মানে আপনি চান উনি ভাল থাকুক কেউ উনার যত্ন নিক তাই তো।”
” হুম সবই চাই শুধু চাই না কোনদিন সুস্থ হোক। স্বাভাবিক হোক।”
তৃষ্ণা হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে বলল,,” কেন চান না উনি সুস্থ স্বাভাবিক হোক। কেন উনার ভাল চিকিৎসা করান না বলেন।”
জায়ান বলল,,” মা সুস্থ হলে তিনি আরো কষ্টে থাকবেন।তার থেকে এভাবেই থাকুক। পাগলের তো কোন কষ্ট নাই। তার ও নাই। তিনি তো বেশ আছেন।”
বলেই জায়ান বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। তৃষ্ণা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি জোড়া বিষ্ময় এ ভরা। জায়ানের কথার আগামাথা কিছুই বুঝেনি কি বলে গেল। উনি সুস্থ হলে কিসের কষ্ট পাবেন? বাবা আরেকটা বিয়ে করেছেন সংসার করছে এসবের জন্য কি? এজন্য তাকে সারাজীবন পাগল বানিয়ে রাখবে?
#চলবে….