কৃষ্ণবেণী #পর্ব_৪১ #নন্দিনী_নীলা

0
477

#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৪১
#নন্দিনী_নীলা

গ্রামে এসেছি চারদিন হলো। চারদিন আমার কাছে চার বছরের মতো লাগছে। জায়ানের সাথে রাতে দীর্ঘ সময় কথা হয়‌ অডিও/ ভিডিও কলে। তবুও মানুষটাকে এতো বেশি মনে পড়ে যে নিজেকে সামলাতে পারি না। আলেয়া বেগম স্বামীর এমন কান্ডে নিজেও রাগান্বিত হয়ে আছেন। ছোট মেয়েকে বাড়ি নিয়ে এসেছেন ঠিক আছে কিন্তু বড় মেয়েকে কেন আনবেন? মেয়ে এখন ওই বাড়ির ব‌উ আর তিনি সেই মেয়েকেই নাকি জামাই বাড়ি আর যেতে দিবে না। মেয়ের দিকে তাকানো যায় না। এভাবে এসে যে মেয়েটা ভালো নাই তা স্পষ্ট। আলেয়া তৃষ্ণা কে ডেকে উঠল। তৃষ্ণা তখন রুমে বসে জায়ান কে কল দিচ্ছে। ফোন গতকাল থেকে বন্ধ দেখাচ্ছে।রাতেও কথা হয়নি‌। তৃষ্ণা সারারাত ঘুমাতে পারে নি। আর সকাল থেকে পাগলের মতো কল করে যাচ্ছে।
এতো বেলা হয়ে গেছে তৃষ্ণা এখনো রুম থেকে বের হয়নি খাবার ও খায় নি। বকুল কে ডাকতে পাঠিয়েছে কয়বার তাও বের হয়নি।
আলেয়া স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,,” আপনের জন্য আমার মাইয়াটা না খাইয়া র‌ইছে।”
তাহের বললেন,,” আমার লিগা? কি ক‌ও তুমি এইসব।”
” মাইয়া‌’টারে জোর ক‌ইরা ক্যান নিয়া আসলেন? এহন তারাই ওর সব তাদের রাইখা ওর মন কি এইহানে টিকতাছে?”
” ক্যান টিকব না। আমরা কি ওর কেউ না? ওই সন্ত্রাস পরিবারে আমি আমার মাইয়া আর যাইতে দিমু না।”
” একজনের লিগা সবাইরে খারাপ ক‌ওয়া কি উচিত হ‌ইতাছে? তারে তো পুলিশ ধ‌ইরা নিয়া গেছে শুনলাম। তাইলে আর সমস্যা কি কন তো। আপনি মাইয়ারে শশুর বাড়ি রাইখা আসেন। মাইয়ার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না‌ কিন্তু আপনের লিগা কিচ্ছুটি ক‌ইবার পারতাছে না।”
তাহের চুপ করে উঠে চলে গেলেন‌। আলেয়া স্বামীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলেন।

আলেয়া প্লেটে ভাত ও তরকারি নিয়ে মেয়ের ঘরে এলেন।
” কি করিস কখন থিকা ডাকতাছি বের হস না ক্যান। খাবি না।”
” আম্মা উনার কাল থেকে খোঁজ পাচ্ছি না।”
” কার জামাইয়ের?”
” হ্যা। কি হ‌ইলো আমার ভালো লাগছে না।”
” চিন্তা করছিস কয়ডা খাইয়া নে। জামাই কত ব্যস্ত থাকে।”
” যত‌ই ব্যস্ত থাক আমার সাথে কথা না বলে উনি থাকতে পারেন না।”
” তোর বাপরে আমি রাজি করাইয়া তোরে ঢাকা পাঠাইয়া দিমু তুই‌ এখন কয়ডা খা।”
তৃষ্ণার মন মানছে না‌। টেনশন হচ্ছে। জায়ান ঠিক আছে তো? তার আবার কোন বিপদ হলো না তো?
সেদিন ই তো বলল খুব তাড়াতাড়িই আমাকে ফিরে যেতে।‌ কি জানি দরকারি কাজ আছে। চলে আসতে চাইল আমি বারণ করলাম। কারণ বাবা এখন কিছুতেই যেতে দিবে না।
তখন‌ উনি বলল,,” দুইদিন এর মধ্যে তোমার বাবা কে ম্যানেজ করবে। আমি কিন্তু চলে আসব। শশুর এর সাথে তর্ক করতে চাইছি‌ না তাই আমি আসার আগে সব মিটমাট করবে।”

আলেয়া মেয়েকে নিজ হাতে খাইয়ে দিল। এটা দেখে আবার বকুল ও ভাগ বসাতে বসে পড়ল। তৃষ্ণা বাড়ি এসে আরেকটা খবর জানতে পেরেছে তৃষ্ণার ভাই বাড়িতে এখন ঠিকমতো টাকা দিচ্ছে। জায়ান নাকি তার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। জায়ানের প্রতি তৃষ্ণার ভালবাসা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

তৃষ্ণা ওর বাবার পাশে বসে আছে।
” বাবা।”
” হ্যা বল।”
” তুমি উনা কে শুধু ভুল বুঝেছ বাবা। উনার ভাই খারাপ বলে উনাকে খারাপ ভেবো না। এতো দিন উনাদের বাসায় থাকলাম আমার কি ক্ষতি হয়েছে বলো? উনারা খারাপ থাকলে আমি কি এতো দিন ওখানে থাকতে পারতাম? উনার ভাই খারাপ তার জন্য সবাইকে তার মতো ভাবা কি ঠিক? আমাকে ওই বাসার দিয়ে আসো বাবা। আমি বলছি তোমার জামাই খুব ভালো মানুষ। আমাকে খুব ভালবাসে। আমার কোন ক্ষতি তিনি হতে দিবেন না। বিশ্বাস করো বাবা।”
” তোর মার কথা শোনে আমি নিজের ভুল বুঝতে পারছি। কিন্তু কি করব বল। ওই তোর দেবরের জন্য আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তোরা আমার কলিজার টুকরো মাইয়া তোদের ক্ষতির আশংকা আছে এমন জায়গায় রাখতে ভয় পাই।”
” আমি তোমার মনের ভয় বুঝি বাবা। আমার কিচ্ছু হবে না তুমি এই নিয়ে ভয় পেয়ো না।”
” আজ থাক আগামীকাল আমি নিজে জামাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইয়া তোরে দিয়ে আসমু।”

পরদিন তৃষ্ণা কে নিয়ে তাহের র‌ওনা হয়। এর মধ্যে আর জায়ানের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি।
জায়ান দের বাসায় সব সময় গার্ড দিয়ে ভর্তি থাকে কিন্তু আজ আরো বেশি। তৃষ্ণা গেইট দিয়ে ঢোকার সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।
সদর দরজার এসে আরেকটা ধাক্কা খায় পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন। আবার সোফায় বসে আছে জায়ান। যার গায়ে আঘাতের চিহ্ন। মাথায় ব্যান্ডেজ, পায়ে ব্যান্ডেজ। তৃষ্ণা চোখ কপালে তুলে জায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। সাদিকুর পুলিশের সাথে রাগী গলায় কথা বলছে,,” আমার বাসায় ডাকাত ঢুকেছিল আর আপনারা দুই দিন চলে গেছে এখনো তাদের সন্ধান পাচ্ছেন না? আমার ছেলের কি অবস্থা করেছে দেখেন। ঘুমের মধ্যে ওকে মেরেছে। ডাকাতের উদ্দেশ্য ছিল আমার সন্তান কে মারা আমাদের সবার রুম লক করে এই কাজ করেছে। বাসার সব সিসি ক্যামেরার অফ করে ঢুকেছিল। ছোট খাটো ডাকাত আমার বাসায় ঢোকার সাহস পাবে না। কিন্তু যে ঢুকেছিল সে এই বাসার নাড়ি নক্ষত্র সব জানত।”
সাদিকুর চিৎকার করে অনেক কিছুই বলছে অফিসার সব শুনে মাথা নীচু করে বেরিয়ে যায়। তৃষ্ণা দরজার দিয়ে ঢুকে এক কোনে বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একবার ভয় ভয় চোখে বাবার দিকে তাকালো। এসব দেখে বাবা আবার না ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝামেলা করে।

তৃষ্ণা তাহের এর দিকে তাকিয়ে বলল,,” বাবা আমি উনাকে ছেড়ে যেতে পারব না। তুমি এসবের জন্য আবার আমাকে নিয়ে যাবে বলো না। উনি আমার স্বামী আমি সব পরিস্থিতি উনার সাথে থাকতে চাই। দেখো কত আঘাত পেয়েছে এই জন্য কাল থেকে আমার মনটা শান্তি পাচ্ছিল না।”
তাহের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,,” তোর যেখানে ভালো লাগে সেখানেই থাকবি। আমি আর এসবে কথা বলব না।”
তৃষ্ণা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে। ওরা এখনো কেউ ওদের খেয়াল করেনি‌। গার্ড দিয়ে ভর্তি তাদের সাথে জোভান আর সাদিকুর কথা বলছে। আর জায়ানের পাশে বসে আছেন জেসমিন। জায়ান তার সাথেই কথা বলছে।
শেফালি পাশেই দাঁড়িয়ে হা করে তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে।

জায়ানের বিরক্ত লাগছে এখানে বসে থাকতে। গতকাল থেকে তৃষ্ণার সাথে কথা হয় না। একদিন হসপিটালে থেকে এসেছে ফোনটা বাসায় ছিল। হসপিটালে থেকে আসতেই এখানে বসিয়ে রেখেছে।
” উফ আমায় উপরে নিয়ে চলুন প্লিজ। অসহ্য লাগছে এখানে।”
ভাঙা পা নিয়ে একা যাওয়া সম্ভব নয়। জেসমিন বললেন,,” শেফালী তুই ধর তো আমরা দুজনে নিয়ে যাই।”
শেফালী খুশি হয়ে এগিয়ে এল জায়ান‌ কে ধরতে। জায়ান শেফালীর দিকে তাকিয়ে বলল,,” নো এই মেয়ে আমায় ধরবে কেন? জোভান কে ডাকেন।”
জেসমিন কিছু বলতে যাবে। তখনি তৃষ্ণা এগিয়ে আসে। আচমকা তৃষ্ণা কে দেখে সবাই চমকে উঠে। জায়ান তৃষ্ণার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,,” তুমি কখন এলে? একা কীভাবে এলে?”
তৃষ্ণা উত্তর দিল না জায়ানের পায়ের কাছে ফ্লোরে বসে ব্যান্ডেজ করা পায়ের উপর হাত রাখল।
” এসব কি হয়েছে আপনার?” কান্না আটকে বলল তৃষ্ণা।
জায়ান দেখতে পেল তাহের পেছনে পেছনে আসছে। জায়ান তাকে সালাম দিল পাশের সোফায় বসতে বলল। জেসমিন অসন্তুষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণা দের দিকে।
জায়ান তৃষ্ণার হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে দিল।
” কাঁদছ কেন? আই এ্যাম ওকে।তোমার বাবাকে মানাতে পারলে অবশেষে। আজ কত স্পেশাল একটা দিন জানো সব গোলমাল হয়ে গেছিল। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি হীন থাকতে হবে।”
” আজ কিসের দিন?”
” সারপ্রাইজ।”
” কি অবস্থা করেছেন নিজের। আমি গতকাল থেকে এজন্য শান্তি পাই নাই। আপনি আমাকে কিছুই জানালেন না কিভাবে। আমার বুঝি চিন্তা হয় না? এখন সারপ্রাইজ বলছেন।” কপট রাগ দেখিয়ে বলল।
জায়ান জোভান কে ডেকে বলল,” আমাকে ধরে রুমে নিয়ে চল তো।”
জোভান তৃষ্ণা কে দেখে বলল,,” ওয়াও ভাবি চলে আসছ।”
” হুম আসলাম। তুমি তো জানাতে পারতে তোমার ভাইয়ের খবর। আমি কত টেনশনে ছিলাম জানো?”
” সরি ভাবি এতো কিছু ঘটে গেল যে মাথায় ছিল না। তুমি প্লিজ রাগ করো না।”
তাহের শঙ্কিত মনে বসে আছে। লজ্জা লাগছে তার সেদিন যে বাড়াবাড়ি করেছে। সাদিকুর এসে তার সাথে কথা বললেন। লিয়া হালকা খাবার দিল। কিন্তু তাহের কিছু খেল না। তাকে রেস্ট করার জন্য রুমে নিয়ে গেল তৃষ্ণা। তারপর নিজের বেডরুমে এসে দেখল জায়ান আস্তে ধীরে পা বিছানায় তুলছে। তৃষ্ণা দৌড়ে এসে নিজে সাহায্য করল।
” আপনার এই অবস্থা আমি মানতে পারছি না। নিজেকে সাবধানে রাখতে পারেন না। এসব কিভাবে হলো?”
” তখন আমি ঘুমে ছিলাম তৃষ্ণা। আর আমার সব অস্ত্র ওরা কব্জা করে নিয়েছিল। যারা এসেছিল তারা সব জেনে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে ছিল।”
তৃষ্ণা জায়ানের কপালের সাদা ব্যান্ডেজ এর উপর হাত রেখে তাকিয়ে আছে টলমল চোখে।
জায়ান ওর হাত ধরে চুমু খেয়ে বলল,,” সব যন্ত্রণা কমে গেছে তোমার ছোঁয়া পেয়ে।”
তৃষ্ণা জায়ানের পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। তারপর নিজে জায়ানের বক্ষস্থলে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে র‌ইল।
” আমার যন্ত্রণা যে বেড়ে গেল।”

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here