#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৪৩
#নন্দিনী_নীলা
জীবনের প্রথম বার স্কুলে কোন পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করল তৃষ্ণা। দুরুদুরু বুক দিয়ে ও ক্লাসে বসে আছে। ভয়, আতংক নিয়ে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। বড়ো বড়ো বেঞ্চের দুই কর্ণার এ দুজন বসা। প্রথম কোন পরীক্ষা অংশগ্রহণ করছে কিন্তু প্রিয় মানুষটার সাপোর্ট পায় নি কাছ থেকে। বুকের ভেতরটা ভার হয়ে উঠল। জায়ান গত দুই আগেই দেশের বাইরে গেছে চিকিৎসার জন্য। পায়ের অবস্থা সিরিয়াস হয়ে গেছে। কোন উন্নতি না পেয়ে দেশের বাইরে ট্রিটমেন্ট এর জন্য গেছে। তার সাথে গেছে জেসমিন বেগম। আপন মা না হলেও ছেলেদের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা সেটা প্রতি মূহুর্তে তিনি প্রমাণ করেছেন। তৃষ্ণার ছলছল চোখে শুধু বিদায় দিয়েছিল।
জায়ানের সাথে ফোনে নিয়মিত কথা হয় কিন্তু মানুষটা কাছে নেই ভাবলেই বুকটা ফেটে যায়। তৃষ্ণা সব চিন্তা সরিয়ে পরিক্ষায় মনোনিবেশ করল। দুজন টিচার হলে ঢুকেই সবাইকে খাতা দিতে লাগল। তৃষ্ণা দিকে খাতা দিয়েই স্যার’টা দাঁত বের করে হেসে কেমন আছি জিজ্ঞেস করল। তৃষ্ণা বিব্রত বোধ করে ভালো আছি বলল। ছাত্র-ছাত্রী টিচার সবার এই আন্তরিকতা ওকে বিব্রত করে তুলে। এটার কারণ আছে এমন হলে সবাই ওর দিকে কেমন হিংসাত্মক চোখে তাকায় যেই চাহনি ওর মোটেও পছন্দ নয়।
পরীক্ষা শেষ হতেই ফাইল হাতে বেরিয়ে এল তৃষ্ণা। বাইরে এসে দেখল জোভান হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে ওকে দেখতেই বলল,,” ভাবি এক্সাম কেমন হলো?”
তৃষ্ণা বলল,,” সব লেখার আগেই সময় শেষ হয়ে গেল।”
” আরে ব্যাপার না।”
” তুমি এখানে এলে যে।”
” ভাইয়া কল দিছিল বলল তার বউকে যেন নিজ দায়িত্বে বাসায় নিয়ে আসি।”
” উনি এখন কেমন আছেন?”
” নিজেই কথা বলে জেনে নাও।”
” আমি তো ফোন আনিনি।”
জোভান নিজের ফোন থেকে জায়ান কে কল করল। আর তৃষ্ণার দিকে ফোন এগিয়ে দিল।
” হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।”
” ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?”
” আলহামদুলিল্লাহ। আপনার শরীর কেমন আছে? দেশে ফিরবেন কবে?”
” খুব তাড়াতাড়িই। পরীক্ষা কেমন দিলে?”
তৃষ্ণার মুখটা চুপসে গেল। জায়ান সেটা বুঝতে পেরে বলল,,” খারাপ হলেও সমস্যা নাই। মাথা ঠান্ডা রেখে পরীক্ষায় মনোনিবেশ করবে। আমায় নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। I’m absolutely fine.”
” আমি ভালো রেজাল্ট না করলে আপনি কি অনেক কষ্ট পাবেন?”
” তা তো একটু পাবো। আমি তো চাই তুমি ফার্স্ট হও।”
” আমি চেষ্টা করব।”
” আচ্ছা বাসায় যাও। ফ্রেশ করে কিছু খেয়ে নিবে।”
বলেই জায়ান কল কেটে দিল।
দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন ও জোভান গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। তৃষ্ণা ওর স্কুলের ফ্রেন্ডদের সাথে বের হয়েছিল।
একজন তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলল,,” এই তৃষ্ণা, ওইটা তোর কি হয় রে?”
জোভান কে দেখিয়ে বলল মেয়েটি। তৃষ্ণা জোভানের দিকে তাকিয়ে বলল,,” আমার ছোট দেবর।”
” বাবাহ তোর দেবর তো তোর খুব খেয়াল রাখে। প্রতিদিন তোকে দিতে আসে। তোর জামাই তো একদিন ও আসলো না।”
তৃষ্ণা বলল,,” উনি কিভাবে আসবে উনি তো অসুস্থ। দেশের বাইরে গেছেন চিকিৎসার জন্য।”
” তোর দেবরটা হ্যান্ডসাম আছে। সিঙ্গেল থাকলে নাম্বারটা দিছ তো মজা করতে পারব।”
তৃষ্ণা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মেয়েটির কথার ইঙ্গিত ও বুঝতে পারেনি। এদিকে জোভান ওকে হাত নাড়িয়ে ডাকছে। তৃষ্ণা কথার উত্তর না দিয়ে চলে এল।
” আজ আবার কেন এসেছ?”
” আজ তোমার সাথেই আমার কিছু কথা ছিল ভাবি।”
তৃষ্ণা কপাল কুঁচকে বলল,” কি কথা?”
জোভান আমতা আমতা করে বলল,,” বকুল তো অনেক দিন হলো গ্রামে গেছে। ওকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসি। তুমি ও এখন একাই আছো। ভাইয়া নাই তোমার নিশ্চয়ই বোরিং লাগে। ও আসলে ভালো লাগতো।”
তৃষ্ণা জোভানের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ জোভান বকুলের আসা নিয়ে ভাবছে কেন?
সন্দেহ হলেও প্রকাশ করল না বলল,,” তা কীভাবে সম্ভব ও আসবে কি করে?”
” আমি আছি তো ভাবি। আমি যেয়ে নিয়ে আসব।”
” আচ্ছা যেও যদি তুমি ফ্রী হয়ে।”
জোভান তরিৎ গতিতে বলল,” আমি এখনি ফ্রী আছি তুমি রাজি থাকলে। আমি ওকে আনতে এখনি যেতে চাই।”
তৃষ্ণার মুখটা বিষ্ময় এ হা হয়ে গেল।
” কি ব্যাপার তুমি আমার বোনকে আনতে এতো পাগল হচ্ছো কেন?”
জোভান নিজের উত্তেজনাকে সামালে বলল,,” ভাবি আমি তো তোমার জন্যেই আনতে চাইছি।”
তৃষ্ণা আরো কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। বকুল কে দেখে না কবে থেকে আর বাসায় ও ভালো লাগে না একা একা। বাসায় এখন তৃষ্ণা একা থাকে। লিয়া ও বাসার নাই। কোথা থেকে লিয়ার আত্নীয় স্বজন এসে উপস্থিত হয়ে জায়ান থাকতে তাকে নিয়ে গেছে। আর বাসায় এখন শুধু তৃষ্ণা আর শেফালী। শেফালীর সাথে তৃষ্ণা ভাব হয়নি। উল্টো আর অসহ্য লাগে তাকে। আর শশুর তো নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে বাইরে। জোভান ও বাসার থাকে না। বকুল এখন বাসায় আসলে ভালোই হবে। নিজের একাকিত্ব কমবে।
তৃষ্ণা একাই বাসায় ফিরে এল ড্রাইভারের সাথে।জোভান নিজের গাড়ি নিয়েই গিয়েছিল স্কুলে সেখানে থেকে ওর পারমিশন পেয়ে আর চলে গেছে। তৃষ্ণা সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পায় শেফালী সোফায় বসে গুনগুনিয়ে গান গাইছে আর হাতে নেলপালিশ পরছে। তৃষ্ণার উপস্থিতি টের পেতেই লাফ দিয়ে সোফা ছেড়ে ফ্লোরে বসে পরে। তৃষ্ণা প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে আছে শেফালীর দিকে। শেফালী ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,” আপনার পরীক্ষা কেমন হয়েছে ম্যাম?”
তৃষ্ণা উত্তর না দিয়ে হনহনিয়ে উপরে চলে এল। কখনো লিয়া কে সোফায় বসতে দেখেনি ও আর এই মেয়ে দুই দিনেই। আজ বাসায় একেবারেই ফাঁকা তৃষ্ণা গোসল করে সেলোয়ার কামিজ পরে নিচে এল খাবার খেতে। শেফালী সেখানে বসেই সাজতে ব্যস্ত ওর দিকে তাকিয়ে শুধু হেসেছে। তৃষ্ণা টেবিলে বসে অল্প কয়টা ভাত ও মাংস নিয়ে খেতে লাগল। তৃষ্ণা ভেজা চুল না মুছেই খোলা রেখে খাবার খাচ্ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করল শেফালী হা করে ওর চুলের দিকে তাকিয়ে আছে। মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেল তৃষ্ণা বলল,” অন্য দিকে তাকাও। আমার দিকে তাকাবে না তুমি।”
শেফালী চোখ সরিয়ে নিল। কিন্তু আড়চোখে শেফালী তৃষ্ণার দিকে ঠিকই তাকিয়ে রইল। তৃষ্ণা সুতি কাপড়ের কালো কামিজ পড়েছে। সদ্য গোসল করে এসেছে। ওর ফর্সা গায়ে কালো রঙটা মারাত্মক সুন্দর লাগছে। কোন মেয়ে ও ওকে এই রুপে দেখলে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য। ঘন কালো রেশমী চুল, ডাগর ডাগর চোখ, সিগ্ধ সরল মায়াবী মুখশ্রী, গোলাপি পাতলা চিকন ঠোঁট। আড়ালে কয়টা পিকচার তুলে কাউকে সেন্ড করে দিল শেফালী।
তৃষ্ণা হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শেফালীর উদ্দেশ্য এ বলল,,” সব কিছু ফ্রীজে রেখে দাও। বাবা আর জোভান রাতে ফিরবে।”
শেফালী নড়ল না তৃষ্ণা শক্ত চোখে তাকিয়ে গটগট করে নিজের রুমে এসে দরজা লক করে শুয়ে পড়ল। জায়ান রাতে কল করবে এখন আর বসে থেকে লাভ কি ঘুমাই যাই। তৃষ্ণা চোখ বুজে ঘুমাই গেল। এদিকে শেফালী যাকে ছবি সেন্ড করেছে সে শেফালী কে কল করে বলল,,” এই ফুলের সুবাস আমি কাছ থেকে পেতে চাই। সামান্য ছবিতে আমার মন ভরবে না। এই ফুলটাও আমার করে চাই সাথে জায়ানের সারে সর্বনাশ ও চাই।”
তৃষ্ণার ঘুম ভাঙল ফোনের রিংটোন এ। বার কয়েক বাজতেই ওর ঘুম ছুটে গেল। ঘুম ঘুম চোখে ফোন রিসিভ করতেই ভিডিও কলে জায়ানের মুখটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল। তৃষ্ণা লাফ দিয়ে উঠে বসল বিছানার উপর।
” হ্যালো মিসেস, ঘুম হলো আপনার?”
তৃষ্ণা মাথা নাড়িয়ে হয়েছে বলল।
” আপনি তো রাতে কল করবেন বলেছিলেন।”
” বাইরে তাকিয়ে দেখো তো এখনো রাত হওয়ার বাকি আছে নাকি।”
তৃষ্ণা জানালা দিয়ে বাইরে নজর বুলিয়ে দেখল অন্ধকার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সারে আটটা বাজে। ও ঘুমিয়েছিল পাঁচটায়।এতো সময় ঘুমালো। সন্ধ্যার আযান হয়ে গেছে ও সারা সন্ধ্যে ঘুমিয়ে কাটাল।
” আমার বাসায় একা একা দম বন্ধ হয়ে আসছে। লিয়া বাসায় থাকলে ভালো লাগত। সেও নাই।”
” লিয়া চলে আসবে বলেছে।”
” কবে আসবে?”
” আগামী কাল না আসলে পরশু আসবেই।”
” আপনি কবে আসবেন?”
” গতকাল থেকে কেবল ট্রিটমেন্ট শুরু হলো। এক সপ্তাহ চলবে।”
তৃষ্ণা মুখটা মলিন করে ফেলল।
জায়ান ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা নিজেও চুপ করে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তৃষ্ণা বলল,,” জানেন কি হয়েছে?”
” না বললে জানব কি করে?”
” আপনার ভাই/ জোভান আমার বোনের জন্য এতো পাগলামি করছে কেন বলেন তো। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
” মানে বুঝলাম না।”
তৃষ্ণা জোভানের সব কথা বলল। সবশুনে জায়ান বলল,,” তুমি আমায় না দেখে কয়দিন থাকতে পারবে?”
” একদিনও পারব না। আপনি জানেন এখন আমার কেমন কষ্ট হচ্ছে। আপনার বুকে মাথা না রাখলে আমার ঘুম হয় না। তিন দিন হলো আপনি চলে গেছেন। সেদিন রাতের পর আপনি আমাকে আর বুকে টেনে নেন নি। আমার খুব কষ্ট হয়েছে। সেদিনের জন্য কি আপনি আমার উপর রেগে আছেন বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছাকৃত এমনটা করিনি।”
জায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,” রাগের জন্যে নয় তৃষ্ণা। আমি নিজেও কতটা সাফার করছি তুমি বুঝবে না। উল্টো নিজেকে কন্ট্রোল করার জন্য তোমার থেকে দূরে থেকেছি। যে বা যারা এটা করেছে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য হলেও আমায় সুস্থ হতে হবে। ভাঙা পা নিয়ে আমি তো অচল হয়ে গেলাম।”
” সব ঠিক হয়ে যাবেন দেখবেন।”
” আচ্ছা শোন তোমায় একটা কথা বলি। জোভান বকুলকে পছন্দ করে। আই মিন ভালবাসে। বকুলের খবর আমি ঠিক জানি না। এজন্য জোভান বকুলের জন্য এতো উতলা।”
তৃষ্ণা মুখে হাত দিয়ে শুনছে।
” সত্যি?”
” আমি তো এমনটাই জানি।”
” বকুল সব কথা আমার সাথে শেয়ার করে কিন্তু এমন কিছু এখনো বলেনি। আমিও এমন কিছু আঁচ করতে পারিনি। কি বোকা আমি।”
” আমার বোকা বউটাকে আমি ভালবাসি।”
তৃষ্ণার মুখশ্রী লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। জায়ান এটা ওটা বলে তৃষ্ণা কে লজ্জা দিচ্ছে। হঠাৎ দরজায় ধুপধাপ শব্দে চমকে উঠল তৃষ্ণা। এমন জোরে জোরে দরজা কে ধাক্কাধাক্কি করছে?
” কে যেন দরজা ধাক্কা দিচ্ছে আপনি লাইনে থাকেন আমি দেখি বকুল আসলো নাকি।”
কাঁচের সাদা দরজা হলেও ভেতরে থেকে বাইরে দেখা যায় না বাইরে থেকে ভেতরে দেখা যায় না। তৃষ্ণা হাতে দরজা লক করেছিল তাই হাতেই খোলে দিল। শেফালী কে আতঙ্কিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল।
” কি হয়েছে শেফালী?”
শেফালী ছুটে এসে তৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। তৃষ্ণা হতভম্ব স্তব্ধ ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ শেফালীর কি হলো এতো ভয় পেয়ে আছে কেন? শেফালী কাঁদতে কাঁদতে তৃষ্ণার কাঁধে একটা ইনজেকশন পুশ করতেই তৃষ্ণা ঠলে পড়ল। এদিকে জায়ান তৃষ্ণাকে ডেকে যাচ্ছে সেটা কানে আসতেই শেফালী ভয়ে চমকে উঠল। আর তাড়াতাড়ি ফোনের স্ক্রিনে দূর থেকে নিজেকে আড়াল করে কল কেটে দিল।
#চলবে……