#মায়ারণ্যে
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#পর্ব-২৪
★দেখতে দেখতে হাসি আনন্দ আর খুনসুটির মাঝে কেটে গেছে দুই সপ্তাহ। মায়ার জীবন যেন সুখের স্বর্গ হয়ে উঠেছে। অরণ্যের মতো এতো এতো কেয়ার করা হাসব্যান্ড, আর এতো সুন্দর একটা পরিবার পেয়ে মায়া নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে ভাগ্যবতী মনে করছে। ওর কপালে যে এত সুখ জমা ছিল তার কল্পনাও করেনি মায়া। ওর নিয়তির ওপর আর কোন অভিযোগ নেই। শুধু একটাই চাওয়া ওর খুশিতে যেন কোন নজর না লাগে।
সাহিল আর সারার খুনসুটি ভরা প্রেমও ভালোই চলছে। যদিও সারার কান্ড কারখানা মাঝে মাঝে সাহিলকে চরম পেরেশানির মাঝে ফেলে দেয়। তবুও সাহিল সব সয়ে নেয়। ওর পিচ্চি পরিটার সবকিছুই যে ওর ভালো লাগে। ওর অবুঝ কথা আর কাজকর্ম গুলো যেমন রাগিয়ে দেয়। আবার সারার মাছুম মুখের মন মাতানো হাসিটা মুহূর্তেই সাহিলকে গলিয়ে ফালুদা করে দেয়। সাহিলের মন চায় ওর পরিটাকে সারাক্ষণ কোলে নিয়ে বসে থাকতে।
ইহান আর ইরিনের ব্যাপার টায় খুব একটা উন্নতি না হয়েও আবার হয়েছে। ইহান আর ইরিনকে তেমন জ্বালায় না। বাসায় আসলেও তেমন একটা ইরিনের সাথে কথা বলে না। শুধু স্বাভাবিক হায় হ্যালো বলে যথাযথ দূরত্ব বজায় রেখে চলে। আর বিষয় টাই ইরিনকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। এতোদিন ইহানকে দূরে সরাতে চাইলেও, এখন যখন ইহান দূরে দূরে থাকছে তখন ইরিনের বুকে কেমন ব্যাথার অনুভব করছে। এই উপেক্ষা ওর ভালো লাগছে না। ইরিন বুঝতে পারছে ওর ভেতর কিছু বদলাতে শুরু করেছে। ইহানের প্রতি ওর দৃষ্টিকোনও পাল্টে গেছে। এখন আর ইহানকে অরণ্য আর সাহিলের মতো মনে হয় না। মনের মাঝে ওর জন্য অন্য রকম দৃষ্টিকোণ সৃষ্টি হচ্ছে। তবে কি আমি ইহানের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়লাম? না না এটা ঠিক না। এটা একদমই ঠিক না। আমি আবারও ভুল করতে পারি না। ইহান নাহয় না বুঝে পাগলামি করছে তাই বলে আমিও একই ভুল করতে পারি না।
ইরিন ড্রয়িং রুমে মটরশুঁটি ছিলছে আর এসব ভাবছে। তখনই বাসায় ইহানের মা এলো। তাকে দেখে তনিমা বেগম হাসিমুখে বলে উঠলেন।
–আরে ভাবি আপনি?কেমন আছেন? কতদিন পর এলেন। আসুন আসুন বসুন না।
ইহানের মা সোফায় বসে মুচকি হেসে বললেন।
–আমি ভালোই আছি। আসলে অরণ্যের বউ দেখতে এলাম। এতদিন ব্যাস্ততার কারণে আসতে পারিনি। তাই আজ একটু সময় বের করে চলে এলাম।
–ও আচ্ছা। ভালো করেছেন। আমি এখুনি বৌমা কে ডেকে পাঠাচ্ছি। এই সারা যাতো তোর ভাবিকে ডেকে নিয়ে আয়।
সারা মাথা দুলিয়ে এক দৌড়ে চলে গেল মায়াকে ডাকতে।ইরিন ইহানের মাকে সালাম করে কুশলাদি বিনিময় করলো। একটু পরেই সারা মায়াকে সাথে করে নিচে নিয়ে এলো।তনিমা বেগম মায়াকে ইহানের মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মায়া মাথার ঘোমটা টেনে ইহানের মাকে সালাম দিল। ইহানের মাও মুচকি হেসে সালামের উত্তর নিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তা শেষে মায়া ইহানের মায়ের জন্য চা নাস্তা আনতে গেল। ইহানের মা তনিমা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন।
–বাহ্ ভাবি ছেলের বউ অনেক ভালো পেয়েছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা অনেক পবিত্র মনের।
–হ্যাঁ ভাবি ঠিকই বলেছেন। মেয়েটা অনেক ভালো। ওর মতো বউ পেয়ে আমরা সত্যিই লাকি।
ইহানের মা তখন আপসোসের সুরে বলে উঠলেন।
–আপনি তো লাকি হলেন ভাবি। কিন্তু আমি কবে লাকি হবো? আমার ঘরেও কবে টুকটুকে একটা বউ আসবে? ছেলেটা যে বিয়ের কথা শুনতেই পারে না।বয়স তো আর কম হলো না। যখনি বিয়ের কথা বলি তখনই রেগে যায়। বলে সে নাকি বিয়ে করবে না। বলেন ভাবি এমন করলে কি হয়? আমি কতবার বুঝিয়েছি কিন্তু কিছুতেই রাজি হয় না। কালতো ওর বাবার সাথে তুমুল রাগারাগি হয়ে গেছে এটা নিয়ে । ওর বাবাতো শেষে এটা পর্যন্ত বলে দিয়েছে যে,বিয়ে না করলে ওকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিবে। আর ইহানও রেগেমেগে না খেয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে এসেছে। এখন পর্যন্ত বাসায় ফেরেনি। ফোনও ধরছে না। ভাবলাম হয়তো এখানে এসেছে। তাই আসলাম। আমার তো চিন্তায় চিন্তায় বিপি লো হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটাকে কিভাবে বোঝাবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাদের একটাই মাত্র ছেলে। সেই যদি এভাবে ছন্নছাড় হয়ে যায়। তাহলে আমাদের বংশের নতুন প্রজন্ম আসবে কিভাবে?
ইহানের মায়ের কথা শুনে ইরিনের প্রচুর অপরাধ বোধ হচ্ছে। ইহানের পরিবারের এই দুশ্চিন্তার কারণ যে সে নিজেই। ইহান ওর জন্যই ওর পরিবারের এতো দ্বন্দ্ব করছে যা ইরিনের মোটেও কাম্য নয়। তনিমা বেগম বলে উঠলেন।
–আচ্ছা ইহানের কোন পছন্দ নেই তো? আপনারা এই বিষয়ে ওর কাছে কিছু জিজ্ঞেস করেছেন?
তনিমা বেগমের কথায় ইরিনের বুকটা কেঁপে উঠল। ইহান আবার ওর কথা কাউকে বলেনি তো?
ইহানের মা বললো।
–হ্যাঁ ভাবি। সেটাও অনেক বার জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু সে ব্যাপারেও কিছু বলে না ও। সবসময় এরিয়ে যায়। তাই আমি এবার একটা ডিসিশন নিয়েছি।
–কি ডিসিশন?
–আমার ননদের একটা মেয়ে আছে। মেয়েটা খুবই সুন্দর। আমারও খুব পছন্দ। তাই ভাবছি ওর সাথেই ইহানের বিয়ে ঠিক করবো। হয়তো মানতে চাইবে না। তবে আমিও ছাড়ার পাত্রী না। দরকার হলে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে, নিজের কসম দিয়ে হলেও রাজি করাবো। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে তখন ঠিকই মেনে নিবে।
ইহানের মায়ের কথায় হঠাৎ কিছু একটা হয়ে গেল ইরিনের। মটরশুঁটি ছিলতে থাকা হাতটা থমকে গেল। হাত থেকে মটরশুঁটি পড়ে গেল নিচে। বুকের ব্যাথা টা হঠাৎ করে বেড়ে যেতে লাগলো। কেন জানি এখানে আর বসে থাকতে পারছে না ইরিন। কোন কাজের বাহানা দিয়ে কোনরকমে ওখান থেকে উঠে গেল ইরিন। নিজেকে যে এখন ওর নিজেই সামলাতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না।
__
সারা হেলেদুলে এসে সাহিলের রুমের দরজা খুলে সরাসরি ভেতরে ঢুকে পড়লো। আজকাল এটা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। হুটহাট যখন খুশী তখন সাহিলের রুমে কোন না বাহানায় চলে আসবে। যেন সাহিলের চেয়ে বেশি ওরই অধিকার এই ঘরে। আর এসেই কোন না কোন আবদার নিয়ে বসে পরবে। আর সেটা সাহিলকে পুরন করতেই হবে। নাহলে তার নিস্তার নেই। আর সাহিলও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সারার সব আবদার পুরন করে। তার পিচ্চি পরির বায়না মেটাতে যে সে নিজেও পরম আনন্দ পায়। বায়না পুরন করলে সারার মুখে মাছুম হাসিটা দেখতে পায় সেটা যে সাহিলের জন্য নোবেল পুরষ্কারের চেয়েও বেশি। ওই হাসিটার জন্য তো হাসিমুখে নিজের জানটাও দিয়ে দিতে পারে সাহিল।
সারা ভেতরে ঢুকতেই মুখটা ফুটবলের মতো হা হয়ে গেল। সাহিল শুধু একটা টাওয়াল পেঁচিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়ছে। হয়তো মাত্রই শাওয়ার নিয়েছে। ফর্সা সুঠাম সুন্দর বডি দেখে সারা বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। যেন সে পৃথিবীর অষ্টম কোন আশ্চর্য দেখছে। সাহিলকে দেখে সারার কেমন কেমন যেন লাগছে। কেমন যেন শুরশুরি লাগছে। সারা হা করে একধ্যানে তাকিয়েই আছে। এভাবে একটা ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকা যে লজ্জার বিষয় সে ব্যাপারে কোন ধারনাই নেই সারার।
সাহিল হঠাৎ পাশে ফিরে তাকাতেই সারাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে গেল। সারা কেমন চোখ পিটপিট করে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। সাহিল ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কিরে এভাবে কি দেখছিস? কখনো ছেলেমানুষ দেখিস নি নাকি?
সারার মাঝে তেমন ভাবান্তর হলো না। সারা একই ভাবে থেকে সাহিলের কাছে এগিয়ে এসে বলে উঠলো।
–দেখেছি তো। কিন্তু আপনাকে না আজ অন্যরকম লাগছে।
সাহিল বাঁকা হেসে বললো।
–কেমন লাগছে শুনি?
সারা বোকার মতো বলে উঠলো।
–একদম চকলেটের মতো লাগছে। ইয়াম্মি ইয়াম্মি টাইপস।
সারার এমন আজব কথায় সাহিল হালকা বিষম খেল। সারার দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে দুষ্টু হেসে বললো।
–তো কি এখন খেয়ে ফেলবি আমাকে?
তারপর কানের কাছে ঝুঁকে লো ভয়েসে বললো।
–তা কিভাবে খাবি শুনি? লিক করে খাবি,নাকি কামড়িয়ে?
এবার কেন জানি সারার ভীষণ লজ্জা লাগলো। সারা একটু সরে এসে বললো।
–কোনভাবেই না। আমি কি রাক্ষস নাকি?
সাহিল হালকা হেঁসে বললো।
–তা এখানে কি চাই শুনি?
–আপনার ফোন চাই। স্কুলের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ চেক করবো।আমার ফোনে এমবি নাই। আর বাসার ওয়াইফাই এ নেট নাই।
সাহিল মুচকি হেসে বললো।
–বেডের ওপর আছে। নে ওখান থেকে।
সারা হেলেদুলে গিয়ে বেডের ওপর থেকে সাহিলের ফোন টা নিয়ে কাজ করতে লাগলো। সাহিল ততক্ষণে কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো চেঞ্জ করার জন্য। কতক্ষণ পর চেঞ্জ করে বের হয়ে দেখলো সারা বেডের ওপর উবুড় হয়ে শুয়ে থেকে মনের সুখে ফোন টিপছে আর পা দুলাচ্ছে।প্লাজুটা হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে। সেদিকে কোন খেয়ালই নেই তার। সারার কান্ডে সাহিল খুব একটা অবাক হলো না। ও জানে ওর পাগলীটা এমনই। হাতে পায়ে বড়ো হলেও মাথার ভেতর কিছুই বৃদ্ধি পায় নি। সাহিল ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে চুল আঁচড়াচ্ছে আর আয়নায় ওর পরিটাকে দেখছে। সাহিল কখনো কাউকে নিজের জিনিসে হাতও দিতে দেয়না। কিন্তু কথা যখন সারার আসে তখন সাত খুন মাফ। যার কাছে ওর জানটাই বন্দি সেখানে এই সামান্য জিনিসের কি মূল্য। সাহিলের সবকিছুতেই শুধু সারার অধিকার।
হঠাৎ পেছন থেকে সারার একটা কথায় সাহিলের সব ভালোলাগা ফুট্টুস করে উড়ে গেল। সাহিল ভ্রু কুঁচকে সারার দিকে ফিরে দেখলো, সারা হেঁসে হেঁসে কারোর সাথে ফোনে কথা বলছে।
–হায় জানু। কেমন আছিস? আই মিস ইউ জানু। স্কুল কবে খুলবে আর আমি আমার জানুটার সাথে একটু আড্ডা দিতে পারবো। লাভ ইউ জানু। অনেক গুলো কিস্সি উম্মাহ,,
ব্যাস এতটুকুই যথেষ্ট ছিল সাহিলের চান্দিতে আগুন জ্বালিয়ে দিতে। রাগে শরীর রি রি করছে সাহিলের। সাহিল দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সারার হাত ধরে ওকে একটানে উঠে বসিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–কার সাথে কথা বলছিলি হ্যাঁ? স্কুলে এসব করতে যাস তুই? আজ থেকে তোর স্কুল যাওয়া বন্ধ। তোর বাসা থেকে বের হওয়াও বন্ধ।
সারা বেচারি সাহিলের আচমকা অ্যাটাকে তাজ্জব বনে গেল। হঠাৎ রাগের কারণ টা কি সেটাই মাথায় ঢুকছে না ওর। সারা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো।
–কি কিন্তু হয়েছে টা কি? আপনি এভাবে রাগছেন কেন?
–তুই আগে বল ছেলেটা কে?
–কোন ছেলেটা কে?
–যার সাথে এসব করে বেড়াচ্ছিস। এতো আদর করে যাকে জানু জানু করছিস সেই ইডিয়ট টা কে?
সারা কপট রাগ দেখিয়ে বললো।
–এই এই আমার জানুকে একদম ইডিয়ট বলবেন না। আমার জানু ইজ ভেরি ইনটেলিজেন্ট।
সারার কথায় সাহিলের রাগের অগ্নিশিখায় আরও ঘি ঢেলে দিল। সাহিল সারাকে নিজের সাথে আরও শক্ত করে চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–তুই শুধু একবার ওর নাম বল, তারপর দেখ ওর ইনটেলিজেন্সের চৌদ্দ টা কিভাবে বাজাই আমি। কি হলো বল নাম।
–জুই,,
সাহিল ভ্রু কুঁচকে বললো।
–হোয়াট??
–হ্যাঁ জুই। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড জুই।
সাহিল বেচারা তব্দা খেয়ে গেল। ও জাকে নিয়ে এতো পরিকল্পনা করছে সে কিনা একটা মেয়ে? ভাবতেই নিজের ওপরই হাসি পাচ্ছে সাহিলের। সাহিল হাতের বাঁধন একটু ঢিলা করে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–তো বেস্ট ফ্রেন্ড কে এভাবে জানু জানু বলার কি আছে?
–কেন এতে কি সমস্যা? আমরা তো দুজন দুজনকে জানু বলেই ডাকি। কারন আমরা জানের জান দোস্ত।
–সমস্যা আছে। অনেক সমস্যা। আজ থেকে আর এসব বলবি না। নাহলে কিন্তু তোর স্কুল পাল্টে দিবো বলে দিলাম।
–না না প্লিজ এমন করবেন না।
–তাহলে এসব ফালতু নামে আর ডাকা চলবে না।
–ওকে।
সাহিল সারাকে ছেড়ে দিয়ে আবারও আয়নার সামনে এসে রেডি হতে লাগলো। সারা তখন আবার ওর বেস্ট ফ্রেন্ড কে ফোন করে বললো।
–শোন জুই আজ থেকে আমরা আর জানু জানু বলবো না কেমন? ওটা পুরাণ ট্রেন্ড হয়ে গেছে।
ওপাশ থেকে জুই বলে উঠলো।
–তাহলে কি বলবো?
–আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে। ফ্রেন্ড+জানু= ফানু। আজ থেকে আমরা একজন আরেকজন কে ফানু বলে ডাকবো। ভালো না আইডিয়া?
–আরে হ্যাঁ ইয়ার। সুপার্ব আইডিয়া। ফানু।
–ওকে বাই ফানু।
সারার এমন অদ্ভুত কথায় সাহিল পেট ফেটে হাসি পাচ্ছে। ওর পরিটা সত্যিই একটা পাগলী।
___
মায়া বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ফ্রেশ হাওয়া নেওয়ার চেষ্টা করছে। শরীর টা কেমন ভালো লাগছে না ওর। বিকাল থেকেই কেমন তলা পেট টা ব্যাথা করছে। পিরিয়ড হওয়ার আগে এমন হয় ওর। তবে লজ্জার কারণে কখনো কাওকে বলেনি ও। আর বললেই বা কি হতো? ওর ভালো মন্দ দেখার কি কেউ ছিল আগে? তাইতো নিজের ব্যাথা নিজেই সয়ে যেতে যেতে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে ওর।
হঠাৎ কোমড়ে কারোর ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল মায়া। তবে চমকালো না। কারণ সে জানে এটা যে তার স্বামী ছাড়া আর কেউ না। অরণ্য মায়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে ঘাড়ের মাঝে নাক ডুবিয়ে দিয়ে নেশালো কন্ঠে বললো।
–আমার মায়াপরী টা এখানে একা একা কি করছে? জানো কখন থেকে খুঁজছি তোমাকে?
মায়া মুচকি হেসে বললো।
–কখন থেকে শুনি?
–এইতো পাঁচ সেকেন্ড ধরে। পুরো পাঁচটা সেকেন্ড ধরে পাইনা আমার বউটাকে। ভাবতে পারো কি অবস্থা হয়েছে আমার? আই মিসড ইউ সো মাচ।
–আহারে, কি দুঃখজনক কথা। আই ফিল ভেরি স্যাড ফর ইউ।
–মজা নেওয়া হচ্ছে তাইনা? এখুনি মজা দেখাচ্ছি।
কথাটা বলে অরণ্য মায়াকে পাঁজা কোলে তুলে নিল। রুমে এসে মায়াকে বেডে শুইয়ে দিয়ে মায়ার গলায় মুখ ডুবিয়ে অরণ্য তার দুষ্টুমিতে মেতে উঠলো।
পেটের ওপর চাপ লাগায় মায়ার ব্যাথা আরও বেড়ে গেল। মায়া ঠোঁট চেপে ধরে ব্যাথাটাকে হজম করার যথাযথ চেষ্টা করছে। সে নিজের কারণে অরণ্যের সুখের মুহূর্ত টাকে নষ্ট করতে চায়না। তবে ব্যাথার যন্ত্রণার অশ্রু চোখ থেকে বের হওয়া ঠেকাতে পারছেনা মায়া। অরণ্য মায়ার গলায় চুমু খেতে খেতে হঠাৎ নোনতা পানির স্বাদ পেল। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে মাথা তুলে মায়ার মুখের দিকে তাকাতেই চমকে গেল। মায়ার মুখে যন্ত্রণার ছাপ আর চোখের পানি দেখে অরণ্য ঘাবড়ে গিয়ে উঠে বসলো। দুই হাতে মায়ার মুখটা ধরে চিন্তিত সুরে বললো।
–এই মায়াপরী কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন সোনা? কি হয়েছে বলো? আমি কি তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?
মায়া জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো।
–কি কিছু হয়নি তো আমার। আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন।
–কি কিছু হয়নি? আমাকে কি তোমার বোকা মনে হয়? সত্যি সত্যি বলো কি হয়েছে?
–বললাম তো কিছু হয়নি। আপনি অযথাই টেনশন করছেন।
অরণ্য এবার একটু রাগী কন্ঠে বললো।
–মায়া রাগ জ্বালিও না আমার। তাড়াতাড়ি বলো কি হয়েছে?
মায়া আর উপায় না পেয়ে আস্তে করে বললো।
–তে তেমন কিছুই না। ওই হালকা একটু পেট ব্যাথা করছিল।
–কখন থেকে?
–বি বিকাল থেকে?
অরণ্য এবার দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–আর সেটা তুমি আমাকে না বলে চুপচাপ মুখ বুজে সহ্য করছো?
মায়া ভীতু স্বরে বললো।
–এ এটা তেমন কিছুই না। পিরিয়ড হওয়ার আগে এমন একটু আধটু হয়।
অরণ্য রাগী সুরে বললো।
–আমাকে বোঝাতে এসোনা কোনটা কেমন ব্যাথা। কতটুকু ব্যাথায় যে তোমার চোখে পানি আসতে পারে এতটা ধারণা অন্তত আমার আছে। আর এক মিনিট,পিরিয়ড হওয়ার আগে হয় মানে এই ব্যাথা তোমার প্রতিবারই হয়?
মায়া ভীতু ভাবে মাথা ঝাকালো। মানে হ্যাঁ। অরণ্য চোয়াল শক্ত করে বললো।
–ওয়াও গ্রেট। লাইক রিয়েলি রিয়েলি গ্রেট। মানে আমার বউ তার মাঝে রোগ পুষে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ এই আমাকে একবারও বলার প্রয়োজনও মনে করে না সে। না না দোষ তোমার না। আমারই হয়তো কোথাও কমতি আছে। তাইতো আমাকে কিছু বলতে চাওনা তুমি। এটা আমারই অপারগতা।
কথাটা বলে অরণ্য রাগ করে অন্য দিকে ঘুরে বসে রইলো। মায়ার বুক ফেটে যাচ্ছে। মায়া উঠে বসে অরণ্যকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বললো।
–প্লিজ এমন করে বলবেন না। আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দিন আমাকে। আসলে আমার সুবিধা অসুবিধা বলার মতো কেউই ছিল না এতদিন। তাইতো নিজের যেকোনো সমস্যা কাউকে না জানানোর একটা অভ্যাস হয়ে গেছে আমার। আর আপনাকে এই সামান্য কারণে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাচ্ছিলাম না। তাই বলিনি। প্লিজ রাগ করে থাকবেন না। আপনার রাগ আমি সহ্য করতে পারি না। শরীরের এই সামান্য ব্যাথার চেয়েও বেশি কষ্ট দেয় আমাকে।
অরণ্য এক ঝটকায় পেছনে ঘুরে মায়াকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে আবেগী কন্ঠে বললো।
–আমি রাগ করে নেই সোনা। তবে আমার ভয় হয়। তোমার হারানোর ভয় হয়। তাইতো তোমার সামান্য থেকে সামান্যতম কিছু হলেও আমি ভয়ে কুঁকড়ে যাই। তোমার আগের জীবনটাকে আমি বদলাতে পারব না। তবে তুমি এখন আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রমিজ করো আমাকে তোমার যাই হোক না কেন, সাথে সাথে আমাকে বলবে। নাহয় পরিবারের অন্য কাওকে বলবে বুঝেছ?
মায়া মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। অরণ্য মায়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো।
–এখন চলো তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেও। আমরা এখুনি ডাক্তারের কাছে যাবো।
–কিন্তু এখন তো অনেক রাত। আমরা নাহয় কাল সকালে যাবো।
–না না সকাল পর্যন্ত তোমাকে এই ব্যাথা নিয়ে থাকতে দেব না আমি।
–দেখুন আপাতত একটা নাপা খেয়ে নিলে ব্যাথা কমে যাবে। তারপর সকালে আমরা যাবো। প্লিজ একটু বুঝুন।
–আচ্ছা ঠিক আছে। তবে সকালে কিন্তু কোন কথা শুনবো না আমি।
–ঠিক আছে।
–তুমি এখন শুয়ে থাক। আমি তোমার জন্য গরম দুধ আর ঔষধ নিয়ে আসছি।
মায়া বেচারি চেয়েও মানা করতে পারছে না। এমনিতেই জনাব যে রেগে আছে। এখন যদি দুধ খাওয়ার কথা মানা করে তাহলে নিশ্চয় তুলে আছাড় মারবে। তারচেয়ে ভালো চুপচাপ যা বলে তাই শুনে নেওয়াই ভালো। অরণ্য মায়াকে দুধ আর মেডিসিন খাইয়ে দিয়ে, মায়াকে বুকের মাঝে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। পরদিন সকালে অরণ্য মায়াকে হসপিটালে নিয়ে যায়। ডক্টর মায়াকে কিছু টেস্ট দেয়। টেস্টের রিপোর্ট দুদিন পর দিবে তাই ওরা বাসায় চলে আসে।
____
সন্ধ্যার দিকে অরণ্যের কাছে কোন একটা কাজে আসে ইহান। ড্রয়িং রুমে ঢুকে সেখানকার পরিবেশ টা কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। ইহান ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল সোফায় ইরিন শাড়ী পড়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। কোন এক ভয়ের পূর্বাভাসে বুকটা দুরদুর করছে ইহানের। আরেকটু এগিয়ে যেতেই সামনের সোফায় পাশের বাড়ির সেই আন্টিটাকে দেখতে পেল ইহান।( যে সেদিন দুই বাচ্চার বাপের সাথে ইরিনের বিয়ের কথা বলেছিল) আর তার পাশে মধ্য বয়স্ক মাথায় টাক পড়া একটা লোক বসে আছে। তার পাশে আরও দুজন মানুষ আছে। এবার ইহানের বুকটা কেঁপে উঠল। ও যা ভাবছে তা সত্যি হতে পারে না। কিছুতেই না।
ইহানকে দেখে সাহিল ওর দিকে এগিয়ে এলো। ইহান সাহিলকে জিজ্ঞেস করলো।
–কি হচ্ছে এখানে? আর ওই মহিলা এখানে কি করছে?
–আরে এরা আপুকে বিয়ের জন্য দেখতে এসেছে। বিয়ে প্রায় পাকা হয়ে গেছে। এখন শুধু দিন তারিখ ঠিক করবে।
ইহানের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। হৃদস্পন্দন থমকে গেল ওর। ইহান কম্পিত কণ্ঠে বললো।
–কি কি বলছিস এসব? হঠাৎ করে এই বিয়ের কথা কোথাথেকে আসলো। আর এমন একটা বিয়ের প্রস্তাবে তোরা রাজি হলি কিভাবে?
সাহিল বলে উঠলো।
–আরে এই বিয়ের ব্যাপারে আমাদের কারোরই তেমন মত ছিল না। কিন্তু আপুর নাজানি কি হয়ে গেছে? আপু নিজে থেকেই এই বিয়ের কথা বলেছে।তাইতো আমরা চেয়েও মানা করতে পারছি না।
সাহিলের কথায় ইহানের বুঝতে বাকি রইলো না ইরিন কেন এসব করছে। ইরিন যে ওকে দূরে সরানোর জন্যই এসব করছে তা ভালোই বুঝতে পারছে ইহান। এসব ভাবতেই তড়তড় করে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল ইহানের। ইরিনের দিকে অগ্নি চোখ তাকালো। অন্য একটা আধবুড়ো লোকের জন্য এভাবে শাড়ী পড়ে সেজেগুজে বসে থাকতে দেখে কপালের রগ ফুলে ফেপে যাচ্ছে ওর। হাতের মুঠো শক্ত করে সবার সামনে এগিয়ে গেল ইহান।
ইহানকে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠল ইরিন। ও যে এইসময় চলে আসবে তা ভাবতেই পারেনি ও। এখন সবার সামনে কোন সিন ক্রিয়েট না করলে হয়। ইহান সবার সামনে এসে ওই মহিলাটির উদ্দেশ্যে চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো।
–আপনি? আপনি আবারও এবাড়িতে এসেছেন? আপনাকে না সেদিন মানা করে দেওয়া হয়েছিল তারপরও কোন লজ্জায় এসেছেন?
ইহানের কথায় সবাই একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আর মহিলাটি তেজী সুরে বললো।
–এই ছেলে ভদ্রভাবে কথা বলো। আমি এখানে এমনি এমনি আসিনি। আমাকে এখানে আসতে বলেছে তাই এসেছি। আর তুমি কে হ্যাঁ? তোমাকে কেন কৈফিয়ত দিতে যাবো?
অবস্থা বেগতিক দেখে তনিমা বেগম এগিয়ে এসে বললো।
–ইহান বাবা শান্ত হও। উনি ঠিকই বলেছেন। আমরাই উনাকে আসতে বলেছি। উনি ইরিনের জন্য পাত্র নিয়ে এসেছেন।
ইহান বলে উঠলো।
–এখানে কোন বিয়ে হচ্ছে না আন্টি।
তারপর ছেলেপক্ষের দিকে তাকিয়ে আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বললো।
–হেই ইউ গেট আপ এন্ড গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার।মাত্র দুই মিনিট সময় দিচ্ছি। নিজের পরিবার কে নিয়ে ফুটুন এখান থেকে। নাহলে এম্বুলেন্সে করে যেতে হবে।
ইহানের কথায় সবাই এবার প্রচুর অবাক হয়ে গেল। তবে অরণ্য আর সাহিলের মাঝে কোন ভাবান্তর হলো না। ওদের দেখে মনে হচ্ছে ওরা জানতো এমনটাই কিছু হবে।
পাশের বাড়ির আন্টি টা রেগে গিয়ে বললো।
–এসব কি ধরনের ব্যবহার ভাবি? আমাদের কি এখানে অপমান করার জন্য ডেকে এনেছেন?
ইহান আরও রাগী কন্ঠে বলে উঠলো।
–অপমান তাদের করা যায় যাদের কোন মান আছে। এখন তিন গোনার মধ্যেই যদি এখান থেকে না ফুটেছেন তাহলে আই সোয়্যার। নিজের পায়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন না।
বেচারা আন্টি আর ছেলেপক্ষ এক বলার আগেই সবগুলো লেজগুটিয়ে পালিয়ে গেল। ওরা যেতেই এবার ইরিনের বাবা বলে উঠলো।
–এসব কি ধরনের ব্যবহার ইহান? এসব কেন করলে তুমি?
ইহান এবার বিনম্র সুরে বললো।
–অ্যাম সরি আঙ্কেল। তবে আমি আপনাদের কিছু কথা বলতে চাই। আমি কথাটা এভাবে বলতে চাইছিলাম না। তবে এখন না বলে আর কোন উপায় নেই।
–কি বলবে বলো?
–আমি ইরাবতী কে বিয়ে করতে চাই। আপনাদের অন্য কোথাও ছেলে খুঁজতে হবে না। আমি কালই আমার বাবা মাকে নিয়ে আসবো বিয়ের কথা বলতে।
ইহানের কথায় সবাই প্রায় থমকে গেল। ইরিন তো পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল। ইহান যে সবার সামনে এমন কথা বলবে তা ভাবতেই পারেনি ও।
ইরিনের বাবা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ ভেবে বললো।
–কিন্তু তুমি কেন বিয়ে করতে চাও ইরিন কে?
ইহানের সহজ স্বিকারক্তি
–কারণ আমি ইরাবতী কে ভালোবাসি। আর আজ থেকে না অনেক আগে থেকেই।
–কিন্তু তোমার মা বাবা কি এই বিয়েতে রাজি হবেন?
–সেটা নিয়ে ভাববেন না আঙ্কেল। আমি আমার মা বাবাকে চিনি। আমার খুশীর জন্য তারা কখনোই মানা করবেন না। আমি উনাদের রাজি করিয়ে কালই নিয়ে আসবো।
–ঠিক আছে। তোমার মা বাবাকে আগে নিয়ে আসো। তারা যদি রাজি থাকে তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই।
তখনই ইরিন মাঝখান থেকে উঠে বললো।
–কিন্তু আমি এই বিয়েতে রাজি না।
ইহান এবার ইরিনের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইরিনের বাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–আঙ্কেল আপনি ওর কথায় কান দিয়েন না। ওকে কিভাবে রাজি করাতে হয় সেটা আমি ভালো করেই জানি। আপনি অনুমতি দিলে আমি ইরাবতীর সাথে একটু কথা বলতে পারি?
ইরিনের বাবা মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। কিন্তু ইরিন কথা বলতে মানা করে দিল। ইহান এবার রেগে গিয়ে ইরিনের হাত ধরে টানতে টানতে ওপরের দিকে নিয়ে গেল। বাকিরা কেউ কিছু বলতে চাইলে। অরণ্য বাঁধা দিয়ে বললো।
–থাক যেতে দাও ওদের। সবকিছু ঠিক হবে চিন্তা করোনা।
অরণ্যের কথায় আর কেউ কিছু বললো না। অরণ্য মনে মনে চাইছে এবার যেন ওর বোনটার জীবনে সুখ আসে।
চলবে…..
(রিচেক করিনি। ভুল ত্রুটি থাকলে মাফ করবেন।)
গল্প নিয়ে যেকোনো আলোচনা আড্ডা দিতে। আর আমার গল্পের লেটেস্ট আপডেট পেতে আমার গ্রুপে জয়েন হওয়ার আমন্ত্রণ রইল।
গ্রুপ
https://facebook.com/groups/170529085281953/