#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |১০|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
অন্ধিকা কা’টিয়ে ময়ূখমালা উঁকি দিচ্ছে৷ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চারিপাশ। বিশাল অম্বর নীলাভ মেঘের আড়ালে ঢেকে রয়েছে। আকাশে শুভ্র আর নীলচে তুলোর ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে৷ ভোরের পাখিদের কলকাকলি জানান দিচ্ছে প্রভাত নেমেছে মেদিনীর বুকে৷ সুদর্শিনীকে সঙ্গে করে হাঁটতে বের হয়েছে মৃত্তিকা৷ দুজনে মিলে খালি পায়ে শিশির ভেজা দূর্বাঘাসের উপর সমান তালে হাঁটছে৷ নীরবতা কাটিয়ে সুদর্শিনী বলল‚
“ব্যস্ত শহরের কোলাহলের চাইতে গ্রামের এই নীরবতা অসম্ভব সুন্দর। তোর জামাইবাবুকেও নিয়ে আসা উচিত ছিল।”
মৃত্তিকা কোনো প্রত্যুত্তর করার আগেই সুদর্শিনী আবার বলল‚ “আমিও না— কী না কী বলছি! তোর জামাইবাবুকেই বা পাব কোথায়! সে তো কাজে ব্যস্ত৷”
“নেক্সট টাইম আমরা জামাইবাবুকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব।”
“হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছিস।”
“দিদিভাই তুই কী পুষ্করিণী পাড়ে যাবি? অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করবে সেখানে গেলে।”
“তুই এখনো জিজ্ঞেস করছি? নিয়ে চল আমাকে। আমি অবশ্যই যাব।”
সুদর্শিনীকে নিয়ে মৃত্তিকা পুষ্করিণী পাড়ে গেল। তেঁতুল গাছের কাঁচা পাঁকা তেঁতুল দেখে জিভে জল চলে এলো সুদর্শিনীর। কাল বিকেলে পুষ্করিণীর পাড় থেকে যাওয়ার সময় কয়েকটা তেঁতুল সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল৷ বেশ তৃপ্তি নিয়ে লবণ শুকনো মরিচের গুড়ো মিশিয়ে তেঁতুল খেয়েছিল সুদর্শিনী।
“তুই কাল এখান থেকেই আমার জন্য তেঁতুল নিয়ে গিয়েছিলি?”
চোখের পলক ঝাপ্টে মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে মৃত্তিকা বলল‚ “হুম।”
“আমরা কী আরও কিছু তেঁতুল সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারব?”
মৃত্তিকা কিছুটা মজার ছলে বলল‚ “মনে হয় না দেবে বলে।”
মনঃক্ষুণ্ন হলো সুদর্শিনীর। সে কিছুটা ক্ষীণ স্বরে বলল‚ “ওহ!”
❑
ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা বাজে৷ ব্যাগ বইখাতা গুছিয়ে নিয়েছে তৃপ্তি। তার কথানুযায়ী আজই সে গ্রামে ফিরে যাবে৷ আর কখনো শহরে আসার নাম নেবে না আর না পড়াশোনার নাম নেবে৷ আজই সব স্বপ্ন লাটে উঠিয়ে ফিরে যাবে বাবা মায়ের কাছে৷ বাড়িতে মহিলামহল আর প্রলয়কে ছাড়া কেউই নেই। সকালে নাস্তার পাঠ চুকিয়ে অর্পণ আর মেহরাব শিকদার হসপিটালে গিয়েছে৷ মেহরাব শিকদারের একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রয়েছে। অর্পণের কাজ যেন আরও বেড়াছে। আজও একটা ক্রিটিকাল অপারেশন রয়েছে। সকালের নাস্তা করেই বাবা ছেলে মিলে বেরিয়ে পড়েছে৷ অবশ্য অর্পণ আগেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। মোর্শেদ শিকদারও বেরিয়েছেন। তিনি একটু অফিসে গিয়েছেন। ব্যবসায় কী যেন একটা সমস্যা হয়েছে! প্রলয় তার বাবার সঙ্গে যেতে চেয়েছিল কিন্তু মাধুরী কিছুতেই যেতে দিলেন না।
বৈঠকখানায় বসে টিভিতে খবর দেখছিল প্রলয়৷ তখনই তৃপ্তি তার ব্যাগ নিয়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল৷ বাড়ির প্রত্যেকের থেকে আগেই বিদায় নিয়েছিল সে৷ এক্ষুনি বের হবে। দেরি হলে হয়তো ট্রেনের টিকেটও পাবে না৷ সদর দরজার দিকে তৃপ্তি যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই তার বুকের ভেতরটা ছটফট করছে৷ হুট করে প্রলয়ের ডাকে সে থেমে গেল৷ সেই সঙ্গে হৃৎস্পন্দনও যেন একটু একটু করে বাড়তে শুরু করছিল।
“আপনি এখানে থাকতে পারেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
হকচকিয়ে গেল তৃপ্তি। স্তম্ভিত ত্রস্তনয়নে চেয়ে রইল প্রলয়ের দিকে। প্রলয়ের কাছ থেকে এমন কথা কস্মিনকালেও আশা করেনি সে। কী রিয়েকশন দেবে ভেবে পাচ্ছে না! প্রলয় আবারও বলল‚
“তবে আমার ঘরে হুটহাট ঢুকে পড়বেন না৷ আমি পছন্দ করি না।”
কথা বলতে দেরি প্রলয়ের চলে যেতে দেরি হয়নি। পায়ের ব্যথাটা কমলেও ক্ষ’তগুলো এখনো শুকোয়নি। ক্ষ’তগুলো এখনো বেশ তাজা। সময়ের সাথে সাথে ক্ষ’ত শুকিয়ে গেলেও হৃদয়ে জমে থাকা ক্ষ’তগুলো বয়ে বেড়াতে হয় চিরকাল। এদিকে তৃপ্তিও বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেল। প্রলয় হয়তো এতক্ষণে তার ঘরে গিয়ে দোর দিয়েছে৷ ঘটলও তাই। তৃপ্তি দাঁড়িয়ে দেখল বন্ধ দরজাখানা। মাধুরী দোতলায় করিডর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তৃপ্তিকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি অবাক হলেন। তৃপ্তির বাহুতে স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করলেন‚
“এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? তুমি তো বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলে?”
“আমি কোথাও যাব না আন্টি।”
“হঠাৎ সুবুদ্ধি কী করে ফিরল?”
“সুবুদ্ধি মানে?”
“এইযে তুমি যাওয়া ক্যান্সেল করলে।”
“আপনার ছেলের নাকি আমাকে নিয়ে কোনো অসুবিধে নেই। তাই আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
“এই তো বুদ্ধিমতীর পরিচয় দিলে। তুমিই পারবে আমার ছেলের মন জয় করতে। তাইতো তোমাকে আমি এখানে এনেছি।”
তৃপ্তি প্রত্যুত্তর করল না। ব্যাগটা নিয়ে পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে চলে এলো৷ অতিথিশালা পরিষ্কার করানো হয়নি তাই এদের দুই বোনের ঘরেই থাকতে দিয়েছেন মাধুরী। তৃপ্তিকে ফিরে আসতে দেখে‚ দুই বোনের হাসিখুশি মুখটা মিইয়ে গেল। দেখে মনে হচ্ছে তৃপ্তি চলে যাওয়ায় খুব খুশি ছিল দুজনে। কিন্তু তাকে আশায় জল ঢেলেছে তাদের বড়ো ভাইয়া৷ এদিকে তৃপ্তিকে দেখে বেশ খুশি মনে হচ্ছে। খুশির কারণও চট করে ধরে ফেলল দুটোতে। দুজনকে হঠাৎ করে চুপ করে যাওয়ায় তৃপ্তি আহ্লাদে গদগদ সুরে বলল‚
“তোমরা দুই বোন খুব সুইট সেটা কী তোমরা জানো?”
“বোকাসোকা পূর্ণতা বলল‚ “হ্যাঁ সবাই এমনটাই বলে। একচুয়্যালি সবাই আমাদের দুজনকে বারবিডল বলে ডাকে।”
একটিবার তালি বাজিয়ে তৃপ্তি বলল‚ “বাহ্!”
পূর্ণতা পুষ্পিতা একে অপরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তৃপ্তি নিজে থেকেই মেয়ে দুটোর গাল টেনে দিল। পছন্দ হলো না পুষ্পিতার। তার চিত্তচাঞ্চল্য স্বভাব তাকে চুপ থাকতে দিল না। অতিশয় কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল‚
“গাল টেনে দেওয়া আমি মোটেও পছন্দ করি না৷ সো কিপ ডিস্টেন্স।”
মুখের উপর এভাবে বলে ফেলায় ইতস্তত বোধ করল তৃপ্তি৷ কথা কাটাতে পূর্ণতা বলল‚
“তোমাকে খুব খুশি মনে হচ্ছে— কী ব্যাপার আপু?”
“একটু খুশি৷”
একটু থেকে তৃপ্তি আবারও বলল‚
“একচুয়্যালি আমি হোস্টেলে একদম থাকতে পারি না৷ তোমাদের ভাইয়া যেহেতু আমাকে চলে যেতে বলেছিলেন তাই আমি এখান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম৷ কাল রাতে খুব টেনশনে ছিলাম কারণ এক রাতে মধ্যে কী করে থাকার ব্যবস্থা করতাম?
তৃপ্তির অসুবিধেটা বুঝল পূর্ণতা পুষ্পিতা। একটু আগে করা ব্যবহারে অনুশোচনা হলো পুষ্পিতার৷ অজান্তেই খারাপ ব্যবহার করেছে। সে তো এমন নয়৷ তৃপ্তি আবারও বলল‚
“হোস্টেলে খাবার মুখে তোলা যায় না৷ পড়াশোনা লাটে উঠিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। বড়ো দাদুমণি আমাকে ঢাকায় মানে তোমাদের বাড়িতে পাঠালেন। পড়াশোনায় এবার হয়তো মনোযোগী হতে পারব। ভাবতে খুব খুশি খুশি লাগছে আমার৷”
তৃপ্তির কথা শেষ হতেই পুষ্পিতা এসে জড়িয়ে ধরল৷ নিজের করা খারাপ ব্যবহারের জন্য মনে মনে ভীষণ অনুশোচনায় ভুগছে সে৷
“আ’ম স্যরি আপু৷ শুধু শুধু তোমাকে খারাপ মনে করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের ভাবিমণির জায়গা নিতে এসেছ।”
তৃপ্তি এবার বুঝল সবকিছু৷ মেয়ে দুটোর মাঝে এখনো বাচ্চামো স্বভাবটা রয়েই গিয়েছে৷ তৃপ্তি গাল এলিয়ে হেসে বলল‚
“আমি এখানে কারো জায়গা নিতে আসিনি পাখি৷ আসলে আন্টির কথায় আমি সেদিন তোমাদের ভাইয়ার ঘরে ঢুকেছিলাম কিন্তু উনি যে এভাবে রেগে যাবেন সেটা ভাবতে পারিনি৷ বড়ো দাদুমণি আমাকে বলেছিল আমি এ বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে পারব।”
এবার পূর্ণতা বলল‚ “অবশ্যই তুমি আমাদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে পারবে আপু।”
“তোমরা সত্যিই খুব কিউট। একদম গোলুমোলু।”
দুপুর দেড়টা…
সাঁই বেগে ট্রেন ছুটছে। সিটে মাথা হেলান দিয়ে রয়েছে সুদর্শিনী। খুব গা গোলাচ্ছে তার। তনুজা অনেকবার বলেছেন একটু ঘুমিয়ে নিতে। কিন্তু অস্বস্তির কারণে ঘুম আসছে না কিছুতেই৷ মুখোমুখি বসে সবটা খেয়াল করল মৃত্তিকা। সে সুদর্শিনীকে জিজ্ঞেস করল‚
“অ্যাই দিদিভাই তেঁতুল খাবি?”
মাথা তুলে তাকিয়ে সুদর্শিনী জিজ্ঞেস করল‚ “এ সময় তেঁতুল পেলি কোথায়?”
“তুই ভুলে গেলি? কালই তো তুই বললি বেশ কিছু কাঁচা পাঁকা তেঁতুল সঙ্গে করে নিয়ে নিতে।”
“তোর মনে আছে?”
“বাহ্ রে! আমার দিদিভাইয়ের খেতে ইচ্ছে করেছে আর আমি আনব না— তা কী করে হয়?”
“সবদিকেই তোর খেয়াল থাকে৷ কী মিষ্টি রে তুই!”
ব্যাগ থেকে বড়ো দেখে দুটো তেঁতুল বের করে সুদর্শিনীর হাতে দিল৷ সঙ্গে কাগজে মুড়িয়ে রাখা লবণ। অহনা দিয়েছিল৷ বলেছিল পথে প্রয়োজন পড়তে পারে। তার কথাই সত্যি হলো। এই যে এখন কাজে লেগে গেল। ঢাকা ওরা পৌঁছে গিয়েছে৷ আর হয়তো আধঘন্টার রাস্তা পাড়ি দিতে হবে।
চলবে?…..