#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৯|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
নীরদ অম্বর রং পাল্টেছে। দিবসপতি হেলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। মেদিনী তমসাবৃত হচ্ছে ভীষণ ভাবে। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মৃত্তিকা৷ বাড়িতে ফিরে এসেছে আরও অনেকটা সময় আগেই৷ এসেই গৌরীর কবলে পড়তে হয়েছে দুজনকে৷ কথাও শুনতে হয়েছে বেশ কয়েকটা। তার একটা কারণ হচ্ছে— বারবার বারন করা স্বত্তেও কেন এদিকসেদিক টইটই করছে৷ মৃত্তিকা সারাটা সময় চুপ করে থাকলেও চুপ থাকেনি অহনা আর অর্জুন। ভাইবোন দুটোতে একই ধাঁচের বলা যায়। রাগ যেন নাকের ডগায় গিয়ে ঘোরে। রাগটা নিশ্চয়ই মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে৷ ছড়িয়ে রাখা আঁচলটা কাঁধে তুলে নিল মৃত্তিকা। তাকে দেখেই সুদর্শিনী গম্ভীর স্বরে বলল‚
“গ্রামে এসে তো দেখছি তুই আমাকে ভুলেই গিয়েছিস!”
মৃত্তিকার কোনো উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না। এমনিতেই মনটা তার ভালো নেই৷ হুটহাট মনখারাপেরা এসে জড়িয়ে ধরেছে তাকে৷ সেই দুপুর থেকেই কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে৷ তবে পুষ্করিণী পাড়ে বসে থাকতে ভালোই লাগছিল। বাড়িতে ফিরে আবারও সেই আগের অবস্থা৷ আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে সুদর্শিনী আবারও বলল‚
“একা একাই দেখছি পুরো পাড়া টো টো করে ঘুরে এসেছিস। আমাকে সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করিসনি।”
“তোকে নিয়ে হুটহাট কোথাও বের হওয়া বারণ৷ আর অনা আমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। মেয়েটাকে শত বারণ করেও কোনো কাজ হয়নি।”
তবুও মন ভরল না সুদর্শিনীর। মুখটা আঁধার করেই রাখল৷ মৃত্তিকা গিয়ে গা ঘেঁষে বসল৷ সুদর্শিনীর গলা জড়িয়ে আহ্লাদে গলায় বলল‚
“আমার সোনা দিদি— রাগ করে না। কাল সকালে তোকে নিয়ে হাঁটতে বের হব।”
অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সুদর্শিনী বলল‚ “গলব না আমি। কাল ঢাকা ফিরে যাব আর এই মেয়ে আমাকে বলছে কাল সকালে হাঁটতে বের হবে। এখন বুঝতে পারছি— এখানে এসে আমার লাভ কিছুই হলো না।”
সুদর্শিনীর পেটের কাছে মুখ এনে মৃত্তিকা ফিসফিসিয়ে বলল‚ “তোর মাকে একটু বোঝা না‚ মিম্মির সঙ্গে যেন রেগে না থাকে।”
“উঠে বোস— আমার সুড়সুড়ি লাগছে।”
উঠে বসল মৃত্তিকা। সুদর্শিনী আবারও বলল‚
“ট্রেনের টিকিট কে’টেছিস?”
“হ্যাঁ। কাল সকাল দশটার দিকে রওনা দেব।”
“আচ্ছা৷”
“কিছু খাবি দিদিভাই?”আ
“কী খাব?”
“তুই পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কর। আমি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
রাতে…
হসপিটাল থেকে ফিরেছে অর্পণ। আজ সারাদিন ভীষণ কাজের প্রেসার ছিল। আজ দুটো অপারেশন ছিল। দুটোই সাকসেসফুল হয়েছে৷ একটা অপারেশন সকালে ছিল আর আরেকটা শেষ বিকেলে। সকালে অল্প কিছু খেয়েই হসপিটালে ছুটেছিল। বাড়ি ফিরেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরের দরজা আটকে দিল অর্পণ। একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। পড়নে কালো চেক শার্টটা না খুলেই বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল৷ ফুল স্পিডে সিলিং ফ্যান ঘুরছে। সারাদিনের ব্যস্ততায় ইরার সঙ্গেও কথা হয়নি। মেয়েটা হয়তো অভিমানে গাল ফুলিয়েছে। প্যান্টের পকেট থেকে মুঠোফোন হাতে নিয়েই ইরাবতীর নাম্বারে ডায়াল করল৷ রিং হবার সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ হলো। হয়তো তার কলেরই অপেক্ষা করছিল মেয়েটা। ফোনটা কানের কাছে ধরতেই কিছু অভিযোগের বুলি রিনরিনে ধ্বনির মতো বেজে উঠল। চোখ বন্ধ রেখেই অর্পণ গাল এলিয়ে হাসল।
ইরার সঙ্গে কথা বলা শেষ হতেই অর্পণ উঠে বসল। ফোনটা চার্জে বসিয়ে‚ বিছানার অপরপাশে গেল৷ ওয়ারড্রবের তৃতীয় ড্রয়ার খুলে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল অর্পণ। গোসল করলে হয়তো শরীরটা ঝরঝরে লাগবে। এদিকে প্রলয় তাকে কল করছে। পায়ে চোট পাওয়ার ফলে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার। আর অন্য কাউকে দিয়েও অর্পণ ডাকিয়ে নিতে পারবে না সে। দুজনের ঘর পাশাপাশি হওয়া স্বত্তেও প্রলয় কল করে অর্পণকে ডাকছে সে। একটা জরুরি কাজেই ক্রমাগত কল করছে।
প্রায় আধঘণ্টা পর অর্পণ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো মুছে নিল সে। অসময়ে গোসল করেছে— চুল না শুকালে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। বিছানার উপর ট্রাউজার আর টিশার্ট পড়ে রয়েছে৷ ওয়াশরুমে ঢোকার আগে এগুলো বের করে রেখে গিয়েছিল সে৷ ঝটপট টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়ে ফোনটা হাতে দিল। প্রলয় বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে তাকে। হয়তো জরুরি কোনো তলবে ডাকছে৷ অর্পণ তার ঘর থেকে বের হয়ে প্রলয়ের ঘরে গেল। দরজায় নক করে বলল‚
“আসব?”
ভেতর থেকে প্রলয়ের শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। “এসো!”
ভেতরে প্রবেশ করল অর্পণ। প্রলয় বিছানায় বসে রয়েছে। তাকে দেখা মাত্রই প্রলয় বলল‚
“তোকে কিছু বলার আছে অর্পণ।”
“কী বলবে ভাই?”
“দরজা আটকে এখানে এসে বোস।”
প্রলয়ের কথা শুনল অর্পণ। দরজা আটকে বিছানায় গিয়ে বসল। প্রলয় বলল‚
“এ কদিনের ঝামেলায় তোকে একটা কথা আমার বলাই হয়নি।”
অর্পণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “কী কথা?”
“হুবহু ভূমির মতো একটা মেয়েকে দেখেছি আমি।”
প্রলয়ের কথা বিশ্বাস হলো না অর্পণের। ভূমি তো একবছর আগেই মা’রা গেছে। সঙ্গে সেই নিষ্পাপ বাচ্চাটাও৷ তারউপর ওই লা’শ! অর্পণ আর কিছুই ভাবতে পারল না। কম্পিত কণ্ঠস্বরকে খাদে নামিয়ে বলল‚
“তোমার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে ভাই৷”
“আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। তুই প্রমাণ চাস তো?”
“কীসের প্রমাণ?”
“ডিএনএ রিপোর্ট।”
“ডিএনএ!”
“হুম ডিএনএ। ল্যাবে টেস্ট করতে দিয়েছিলাম৷ মন বলছে ও আমার ভূমি। কিন্তু মন বললেই তো হবে না তার জন্য পোক্ত প্রমাণ প্রয়োজন।”
“এসব তুমি কবে করলে?”
“সেদিন তোকে হসপিটালের সামনে নামিয়ে দিয়ে একফাঁকে ল্যাবে গিয়েছিলাম।”
দুদিন আগে…
অর্পণকে হসপিটালের সামনে নামিয়ে দিয়ে প্রলয় গাড়ি নিয়ে সোজা একটা ল্যাবের সামনে এসে থামে। এখানে তার একজন বন্ধু চাকরি করে৷ অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করে প্রলয় গাড়ি থেকে নামল৷ একবার এদিকসেদিক তাকিয়ে এরপর ল্যাবের ভেতরে চলে গেল। তাকে দেখা মাত্রই এগিয়ে আসে সোহেল। দুজনের মাঝে ভালো মন্দ অনেক কথাই হয়। কথা বলার এক পর্যায়ে প্রলয় তার প্যান্টের পকেট থেকে দুটো ছোটো প্যাকেট বের করে। সোহেলের হাতে প্যাকেট দুটো দিয়ে সবকিছু বলে। প্রথমেই নাকচ করে দেয় সোহেল।
“প্লিজ না করিস না৷ আমার জানাটা খুব দরকার।”
“স্যার জানতে পারলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে।”
“কিছু হবে না৷ যা হবে আমি সামলে নেব। প্লিজ তুই না করিস না।”
“ঠিক আছে। তবে তোকে একদিন অপেক্ষা করতে হবে।”
“কাজটা একটু তাড়াতাড়ি করে দেওয়ার চেষ্টা করিস ভাই।”
“ইনশাআল্লাহ।”
তপ্ত নিশ্বাস ফেলে ল্যাব থেকে বের হয়ে এলো প্রলয়৷ সবকিছু ঠিকঠাক হলে কালই সব সত্যির উদঘাটন হবে। মৃত্তিকার সত্যিটা সামনে আসবে। প্রলয় এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল৷ এরপর আবারও গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
এখন…
প্রলয়ের কথা এতক্ষণ চুপটি করে শুনছিল অর্পণ। অনেকটা সময় চুপ থেকে আবারও জিজ্ঞেস করল‚
“রিপোর্ট পেয়েছ?”
“সেদিনই তো এক্সিডেন্ট হলো। ভেবেছিলাম— পার্টি অফিসের কিছু কাজ শেষ করে‚ ল্যাবে যাব রিপোর্ট আনতে। তার আগেই যা ঘটার ঘটে গেল।”
“তাহলে সোহেলকে বল পার্সেল পাঠাতে।”
“না! একদম না।”
অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “কেন?”
“রিপোর্টটা তুই নিজে গিয়ে নিয়ে আসবি৷”
“সে নাহয় আমি নিয়ে এলাম। তার আগে এটা বল— মেয়েটার বাড়ি কোথায়?”
“খোঁজ লাগিয়ে জানতে পেরেছিলাম মেয়েটা নাকি এডভোকেট মাহেন্দ্র রায়চৌধুরীর মেয়ে।”
“তাহলে তো মেয়েটা সনাতন ধর্মের৷ আমাদের ভূমি কী করে হতে পারে?” হয়তো তোমারই ভুল হচ্ছে৷”
“আমি কিছু জানি না। আমার মন যে মানতে চায় না৷ মন বলে ভূমি আছে। সে আমার কাছে পাশেই আছে৷ মনের শান্তির জন্যই নাহয় রিপোর্ট এনে দিস৷”
“ভাই তোমাকে আরেকটা খবর দেওয়ার আছে।”
প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚ “কী?”
“ওই জা’নোয়ার দুটোকে গোডাউনে আটকে রাখা হয়েছে।”
“আটকেই থাকুক। কোনো খাবার দিবি না৷ একটু খাবারের জন্য ওরা এক এক লহমা তরপাবে। ওরাও তো জানুক— সেহরিশ আরশান প্রলয় আতিথেয়তার কোনো কমতি রাখে না। সংসদ নির্বাচনের আগে আমি কোনো র’ক্তার’ক্তি চাই না।”
“আচ্ছা৷ রাত হয়েছে। তুমি এখন শুয়ে পড়৷ আমি আসছি।”
“হুম আয়!”
চলবে?…..