#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
রজনী নেমেছে মেদিনীর বুকে। আকাশে চাঁদ নেই— গভীর অমাবস্যা। বাতাবরণ এখন স্বচ্ছ ও শীতল। শয়নকক্ষজুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজমান। ফোনের ফ্ল্যাশলাইটের সাহায্য বই খুলে পড়ছে মৃত্তিকা৷ উপন্যাস পড়তে তার ভারী আনন্দ লাগে। আগে এই অভ্যেসটা ছিল না— ইদানীং নতুন করে যুক্ত হয়েছে। ওই তো অদূরে ল্যাম্পপোস্টের হরিদ্রাভ বাতির কাছটায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝাক বসেছে। ছোট্টো অলিন্দ থেকে একটু আধটু দেখা যাচ্ছে বৈকি৷ একটু উঁকি দিয়ে আরও আঁটসাঁট হয়ে মেঝেতে বসল৷ মেঝে এখন শীতল। মৃত্তিকা একবার জানালা দিয়ে শয়নকক্ষে উঁকি দিল। নিষুপ্তিতে আচ্ছাদিত তনুজা৷ স্বস্তির নিশ্বাসে অন্তঃকরণ উচ্ছ্বসিত হলো৷ সেই সাথে অধরোষ্ঠ যুগল প্রসারিত হলো তার৷
ঘুমের ঘোরে বিছানা হাতড়ে কাউকে পেলেন না তনুজা৷ গাঢ় ঘুমটা তখনই ভেঙে গেল। শয়নকক্ষে আবছা নীলচে আলোয় কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ কিছুটা সময় নিয়ে তিনি শোয়া থেকে উঠলেন। বয়স হয়েছে— হুটহাট কোনো কাজ করে ফেলতে পারেন না। সময় নিয়ে করতে হয়। তিনি দেখলেন ছোট্টো বারান্দা থেকে হরিদ্রাভ আলো আসছে৷ তিনি ভেবে নিলেন মৃত্তিকা সেখানেই রয়েছে। হলোও তাই। কিছুটা সময় নিয়ে ধীর পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। বারান্দায় এসে দেখলেন‚ মৃত্তিকা একটা মোটা উপন্যাসের বই নিয়ে বসে আছে৷ খুব নিভৃতে মেয়ের পাশে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলেন তিনি৷ মনোনিবেশ ভগ্ন হলো মৃত্তিকার৷ পাশে তাকিয়ে যখন তার মামনিকে দেখল‚ তখন একটা হাসির রেখা মিলল অধর কোণে। তনুজা প্রাণ ভরে দেখলেন। মেয়ের এই হাসিটাই তো বাঁচতে শেখায়। তিনি বললেন‚
“রাত জাগলে তো শরীর খারাপ করবে।”
“ঘুম আসছিল না মামনি। তুমি কেন উঠতে গেলে? আমাকে ডাক দিলেই তো আমি ছুটে যেতাম।”
“মা গো তোকে একটা কথা বলি?”
তনুজার মুখপানে তাকাল মৃত্তিকা। মায়াময়ী মানবীর সুশ্রী পানে গভীর আকুলতা। মৃত্তিকা আশ্বাস দিয়ে বলল‚
“অবশ্যই বলবে।”
সাহস পেয়ে মনের কথাটা বলেই ফেললেন তনুজা। “আর কতদিন একা থাকবি? আমি কী আর চিরকাল বেঁচে থাকব রে মা?”
“মামনি তুমি এভাবে কথা বললে আমার কষ্ট হয়। কেন বোঝ না?”
“আমি শুধু তোর সুখ চাই। তোর একটা ছোট্টো সংসার হোক— সেটাই আমি চাই।”
“আমি যে কখনো সুখী হব না মামনি। এটাই আমার ভবিতব্য।”
“ভগবান আমাদের ভাগ্য কী রেখেছে সেটা আগে থেকে জানার সাধ্যি কার আছে?”
“তোমার ভগবানকে বলে দিয়ো— বিষাদে মোড়ানো জীবন নিয়েই আমি সুখে আছি। আর আমি তো একা নই‚ তুমি আছ আমার সঙ্গে।”
তপ্ত নিশ্বাস ফেললেন তনুজা। মেয়ের কথার মর্মার্থ ধরতে খুব বেশি সময় লাগল না উনার৷ মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।
❑
সূর্যের তেজস্বী কিরন এসে পড়ছে কারুকাজে বেষ্টিত বিছানার উপর। গ্রীষ্মকালীন সূর্যের কঠোরতা সকাল থেকেই শুরু হয়। সোনালি রোদের ঝলকানিতে সমগ্র ঘরময় খাঁ খাঁ উত্তপ্ত হচ্ছে৷ বিশাল বিছানার উপর উদোম গায়ে উবুড় হয়ে শুয়ে আছে প্রলয়। রোদটা তার পিঠে এসে ঠেকছে। তবুও ঘুম ভাঙছে না তার৷ রাতে বারকয়েক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল৷ অতিরিক্ত গরম সহ্য হয় না তার। ঘামছিলও প্রচুর— তাই তো গায়ে জড়িয়ে রাখা ধূসর রঙা টিশার্টটা খুলে রেখে দিয়েছিল বিছানার অপর পাশে। ভেজা তোয়ালেটা চেয়ারের উপর ঠিক সেভাবেই পড়ে রয়েছে৷ সবসময়কার অভ্যেস কী আর অত সহজে ছাড়ানো যায়? অকস্মাৎ কেউ এসে কড়া নাড়ল।
“বড়ো ভাইয়া তুমি কী এখনো ঘুমচ্ছ?”
তবুও ঘুম ভাঙল না প্রলয়ের৷ একই ভঙ্গিতে উবুড় হয়ে গভীর নিদে আচ্ছাদিত। বেলা প্রায় অনেক হয়েছে৷ ছোটো বেলা থেকেই প্রলয় বড্ড ঘুমকাতুরে। পুষ্পিতা আবারও তার ভাইকে ডাকল৷ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না ঘরের ভেতর থেকে। ব্যর্থ কিশোরী চলে যেতে নিল। অর্পণ এদিকেই আসছে৷
“ভাই ওঠেনি এখনো?”
পুষ্পিতা দুদিকে মাথা ঝাকিয়ে বলল‚ “উঁহু!”
“তুই যা— আমি ভাইকে ডাকছি।”
পুষ্পিতা চলে যেতেই অর্পণ দরজা ধাক্কাতে শুরু করল। সেই সঙ্গে কয়েকবার ডাকলও৷ প্রলয়ের হয়তো ঘুম ভেঙেছে। দরজায় খট করে শব্দ শুনতে পেল অর্পণ। এতক্ষণ নিচের দিকে মুখ করে ছিল। আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে মুখ তুলল। হ্যাঁ— ঠিকই ধরেছে। প্রলয়ের ঘুম ভেঙেছে৷ দরজাটা খুলে দিয়ে আবারও বিছানায় গিয়ে উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল প্রলয়। অর্পণ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। মেঝেতে লুটোপুটি খাওয়া কোলবালিশটা বিছানার উপর রেখে বলল‚
“ভাই মাত্রই খবর এলো পার্টি অফিসে বিরোধী দলের ছেলেরা গ্যাঞ্জাম করছে।”
চিত হয়ে বালিশে কনুই ঠেকাল প্রলয়। ফোলা আধবোজা চোখে অর্পণকে একবার দেখল৷ ঘুমু ঘুমু ভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল‚
“কী নিয়ে?”
“রবিন আর শিহাবের সঙ্গে কী নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি হয়েছিল। ঝামেলা এতটাই বেড়েছিল যে‚ ওরা মা’রামা’রি পর্যন্ত করেছে।”
ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে প্রলয় বলল‚ “তো আমি কী করতে পারি?”
বোকা বনে গেল অর্পণ। ভাবতেও পারেনি এই গুরুতর বিষয়ে প্রলয় এমন প্রত্যুত্তর করবে। ফ্যালফ্যাল করে বেশ অনেকটা সময় চেয়ে রইল অর্পণ। উঠে বসল প্রলয়। আধ ভেজা তোয়ালে ঘাড়ে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল৷ যাওয়ার আগে অর্পণকে বলল‚
“তুই আমার ফোনটা খোঁজ— আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি৷”
অর্পণ বিছানায় বসে হাফ ছাড়ল। কিয়ৎকাল বসে থেকে শুধুমাত্রই প্রলয়ের কথাই ভাবল। এই ছেলের মাঝে কী কখনো সিরিয়াসনেস আসবে না? মজায় মজায় সবকিছু উড়িয়ে দিতে নেই৷ তাই তো তার জীবনটা আজ এলোমেলো। তমসায় মরীচিকা হাতড়ে বেড়াচ্ছে— ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অর্পণের।
খটখট শব্দ তুলে মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে৷ জানালার উপর ঝুলে থাকা পর্দাগুলো উড়ছে৷ রোদের আলো ঘরে প্রবেশ করতে না পারলেও বারান্দায় কিছুটা লুটোপুটি খাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দ্বারা চুল ঠিক করছে প্রলয়৷ গায়ে তার সাদা শার্ট জড়ানো৷ মেদহীন আঁটসাঁট দীর্ঘ দেহ৷ ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে পারফিউম নিয়ে নিজের গায়ে স্প্রে করল৷ এরপর আলমারির ভেতরে চাবি ঝুলিয়ে রাখা ছোটো ড্রয়ার খুলে রিভলবার বের করল প্রলয়। এটার লাইসেন্স আছে। শত্রুপক্ষের হাত থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে— এটা সবসময় পাশেই থাকে৷ জুতোর ফিতা ঠিক করে লাগিয়ে শয়নকক্ষ থেকে বের হয়ে গেল সে৷ যাবার আগে নিজের ঘরে তালা আটকে নিল৷ গত একবছর যাবৎ এমনটাই করে আসছে সে৷ এই ঘরে অর্পণ‚ পূর্ণতা আর পুষ্পিতা ছাড়া আর কারো আসার অনুমতি নেই৷ এমনকি— মাধুরীরও না।
বৈঠকখানায় তখন সবাই বসে ছিলেন। রান্নার ঘর থেকে মাধুরী পানের বাটা নিয়ে এসে বসলেন। উনার স্বামী মোর্শেদ শিকদার‚ দেবর মেহরাব শিকদার আর তার স্ত্রী ফিরোজাও এখানে বসে আছে। উনাদের চারজনের জন্য বেশ ভালো করে পান বানালেন মাধুরী। কথায় কথায় মনে পড়ল কতদিন ছেলের সঙ্গে শান্তিতে দুদণ্ড কথা হয় না। ছেলের বিস্তর পরিবর্তন অবাক করল উনাকে৷ এই এক বছরে একটু একটু করে মা ছেলের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। মাধুরী হাহুতাশ করতে লাগলেন।
এরই মাঝে প্রলয় আর অর্পণ একেবারে তৈরি হয়ে বেরিয়েছে। ওদের দুজনের পেছন পেছন পূর্ণর আর পুষ্পিতাও এসেছে। মাধুরী উঠে গেলেন ছেলের কাছে৷ কালকের সেই কথাটা তিনি আবারও পুনরাবৃত্তি করলেন। বিতৃষ্ণা আর ক্রোধে শরীর কাঁপছে প্রলয়ের৷ অর্পণ খেয়াল করছে সবটা। না জানি এখন কোন প্রলয় আসে। পুরুষালি উদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বর বৈঠকখানার চার দেয়ালের মাঝে প্রতিধ্বনি তুলছে।
“বিয়ে নিয়ে জোর করলে আমি এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব৷ এণ্ড আই মিন ইট!”
প্রলয়ের শান্ত স্বরের হু’মকি শুনে মাধুরীর মুখ থমথমে হয়ে গেল। ছেলের কাছ থেকে এমন কথা কিঞ্চিৎ পরিমাণও আশা করেননি তিনি। যেখানে তিনি সবার উপর ছুরি ঘুরান। পূর্ণতা পুষ্পিতা ঠোঁট টিপে হাসছে৷ মায়ের থমথমে মুখখানা দেখে বড্ড হাসি পাচ্ছে তাদের৷ অর্পণ ইশারায় দুটোকে হাসি থামাতে বলল। মাধুরী কথা কা’টাতেই জিজ্ঞেস করলেন‚
“কোথাও কী যাবি তোরা?”
উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করল না প্রলয়। মুঠোফোন হাতে কিছু একটা দেখতে লাগল। কিছুই বুঝলেন না মাধুরী। অর্পণ এগিয়ে এসে বলল‚
“বড়ো মা— আমি আর ভাই একটু বের হব।”
“কোথায়?”
“ওই একটু…”
পুরো কথাটা বলতে পারল না অর্পণ। তার আগেই প্রলয় ফোড়ন কে’টে বলল‚
“এখানে দাঁড়িয়ে এত কথা বলার কোনো মানেই হয় না৷ দেরি হচ্ছে— অর্পণ আয়।”
“এই সমস্ত রাজনীতির পেছনে না ছুটে তোর চাচা আর অর্পণের মতো ডাক্তার তো হতে পারতি।”
“এসব আমার কাছে ঝামেলা মনে হয়। আর ডাক্তারি আমার দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়। আমার স্বপ্ন রাজনীতি।”
শেষোক্ত হতেই প্রলয় উপস্থিত সকলের দিকে তাকাল। ছেলের এহেন কথায় বোকা বনে গেলেন মাধুরী। উনার কত ইচ্ছে ছিল— ছেলে মস্ত বড়ো ডাক্তার হবে৷ এই ছেলে তো উনার সকল আশা জল ঢেলে দেয়৷
“এই ছেলেকে বুঝিয়ে কাজ নেই৷”
প্রলয় একবার মেহরাব শিকদারের দিকে তাকাল। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হলো। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন মেহরাব শিকদার। প্রলয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল‚
“তোমাদের কথা আমি বুঝতেও চাইছি না চাচ্চু।”
এদিকে ছেলের এমন খামখেয়ালিপনায় বেজায় বিরক্ত মোর্শেদ শিকদার। ছেলের ব্যবহারে দিনকে দিন আরো ক্রূরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফিরোজা বললেন‚
“দেখলেন ভাইজান— প্রলয় কীভাবে কথা বলছে!”
মোর্শেদ শিকদার বললেন‚ “চাচার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তা ভুলে গেছ তাইনা?”
“ফর ইয়্যর কাইন্ড ইনফরমেশন— আমি এমনই।”
বড়ো বড়ো পা ফেলে বেরিয়ে এলো প্রলয়৷ তার পেছন পেছন ছুটে এলো অর্পণ। ডাক্তারি ছাড়াও তার আরেকটা কাজ হলো প্রলয়ের প্রত্যেকটা কাজে সঙ্গ দেওয়া। যাকে এক কথায় পারসোনাল সেক্রেটারি বলা যায়।
মালঞ্চ নীড় পেছনে ফেলে গাড়ি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। ড্রাইভ করছে প্রলয়। পাশের সিটে বসেছে অর্পণ। খুব দ্রুত এবং বাজে ভাবে ড্রাইভ করছে প্রলয়৷ নিয়ন্ত্রণে না এলে খারাপ কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। প্রলয়কে থামাতে অর্পণ বলল‚
“ভাই সমস্ত রাগ কী গাড়ির উপর ঢালবে?”
“তুই তো জানিস রাজনীতি আমার স্বপ্ন। দীর্ঘ বছরের তপস্যা।”
চলবে?…..