লুকোচুরি_গল্প #পর্ব_৩২ #ইশরাত_জাহান

0
206

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_৩২
#ইশরাত_জাহান
🦋
পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে।মিস্টার সমুদ্র ও মিস্টার রবিন মিলে মিষ্টি খাইয়ে সবাইকে খুশির আনন্দে বলছে,”আমাদের মেয়ে আজ GPA 5 পেয়েছে। নেও তোমরা মিষ্টি খাও।”

হ্যাঁ,আজকে ইন্টারের রেজাল্ট প্রকাশ পেয়েছে।দেখতে দেখতে কতগুলো মাস পেরিয়ে গেছে। রেজাল্টে নীরা GPA 5 আর কেয়া একটুর জন্য মিস হয়েছে।তবে কেয়ার রেজাল্টও খুব ভালো। আইসিটিতে প্লাস মার্ক না আসাতে কেয়া গোল্ডেন মার্ক উঠাতে পারেনি।রিক ও তার পরিবার এর জন্য কেয়ার উপর খুব খুশি।কেয়া যে পরীক্ষায় পাশ করছে তাও এত ভালো এটা কেউ আশা করেনি।দ্বীপ তো শেষের দিকে কেয়ার জন্য টিউটর দেখেছিলো।পরীক্ষার ভিতর আবার বিয়ের সপ্ন জেগেছিলো কেয়ার।সে মেয়ে যে এ প্লাস পেয়েছে এটা শুনে কেয়ার মা নিজেই মেয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন।দুই বান্ধবীর এত ভালো রেজাল্টের জন্য আজ বাসায় পিকনিক করা হবে। নীরাদের বাসার সামনে ফাঁকা মাঠ আছে।ওখানে সবাই জয়েন্ট হয়ে পিকনিক করবে।

আজ সবার মুখে খুশির ঝলক।কিন্তু নীরা চোখ ছোট ছোট করে তাকাচ্ছে সবার দিকে।খুশি না হয়ে মুখ গোমড়া করে রেখেছে।অভ্র এসে নীরাকে বলে,”কি হয়েছে,মামী?”

নীরা কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,”আজ রেজাল্ট বেড় হয়েছে কার?”

অভ্র উত্তর দেয়,”তোমার।”

“ভালো রেজাল্ট করেছে কে?”

“তুমি আর কেয়া আণ্টি।”

“তাহলে মিষ্টি খাওয়ার কথা কার?”

“তোমাদের।”

“মিষ্টি খাচ্ছে কে?”

“মামু।”

“এটা কেমন বিচার?”

“খুব বাজে।”

“এত কষ্ট করে রাত জেগে পড়াশুনা করলাম আমি,ভোরবেলা উঠে বই খাতা নিয়ে কাপাকাপা হাত পা নিয়ে পড়াশুনা করলাম আমি,শীতের মধ্যে থরথর করে কেঁপে কেঁপে পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর দিলাম আমি,অত অত কঠিন কঠিন অংক ইংরেজি মাথায় রেখে পরীক্ষার সঠিক উত্তর দিলাম আমি।রেজাল্টের উপর গোটা গোটা নাম ভেসে আসছে আমার।কিন্তু এলাকাবাসী এসে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে কাকে?”

“আমার মামুকে।”

“কেনো খাওয়াবে তাকে।রেজাল্ট তো আমার ভালো হয়েছে।লোকজন আমাকে মিষ্টি খাওয়াবে তা না,হুহ।”

“আমি শুনেছি তুমি পড়াচোর।মামু না পড়ালে তুমি ভালো রেজাল্ট করতে না।তাই মামুকে সবাই মিষ্টি খাওয়াচ্ছে।”

নীরা এবার কটমট চোখে তাকালো অভ্রর দিকে।বলে,”আমি পড়াচোর?তোমার মামু আমাকে পড়াতে পারতো না যদি আমি আগ্রহ দিয়ে না পড়তাম।”

অভ্র এবার নীরার মত করে কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,”আমি দেখেছি তুমি পড়াচোর।একদিন জানালা দিয়ে দেখেছিলাম মামু তোমার গালে একটা মার দিয়েছিলো।পড়াশোনা করলে তো মার খেতে না।”

এত ভালো রেজাল্ট করলো তারপরও যেনো আজ পুঁচকে অভ্রর কাছে অপমান হলো নীরা।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,”তোমার মামুর হাত একটু বেশি চলে।আমি পড়া ঠিকভাবে করতাম।তোমার মামু একটু লিমিটের বাইরে পড়াতো।”

দীপান্বিতা এসে নীরাকে মিষ্টি খাইয়ে বলে,”আমার লিটিল ভাবী।এই নেও মিষ্টি খাও।”

“বাসি মিষ্টি আমি খাই না।”

“ও মা বাসি হবে কেনো?বাবা আর ভাই মিলে সেরা দোকানের মিষ্টি এনেছে।আজকেই বানানো।”

“মিষ্টি সেরা দোকানের হলেও মিষ্টির স্বাদ অন্যজন পেয়েছে।আমি এত ভালো রেজাল্ট করলাম কিন্তু দাম পেলাম না।”

বলেই মুখ ফুলিয়ে ওঠে নীরা।দীপান্বিতা হেসে দেয়।বলে,”ওলে আমার লিটিল ভাবীর অভিমান হয়েছে।চিন্তা করো না।ভাই তোমাকে এর থেকেও সেরা মিষ্টি খাওয়াবে।”

নীরা দীপান্বিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমিও দেখছি আমাদের মতো হয়ে গেছো।”

“তোমাদের ছোয়া পেয়ে তো আমরা সবাই পরিবর্তন।”

সন্ধায় পিকনিক এর ব্যাবস্থা করা হচ্ছে।দ্বীপ কলেজে থেকে এসে সবার থেকে মিষ্টি খেয়ে খেয়ে পেট ভরিয়েছিলো তারপর মিস্টার সমুদ্রর রেস্টুরেন্টে গেছে।সন্ধায় ফিরেছে দ্বীপ ও মিস্টার সমুদ্র।সাথে করে পিকনিকের বাজার সামগ্রী নিয়ে।সবাই আস্তে আস্তে মাঠে উপস্থিত হয়।সবাই এক জায়গায় দাড়ানোর পর দ্বীপ খেয়াল করলো নীরা নেই।দ্বীপ দীপান্বিতাকে জিজ্ঞাসা করে,”নীরা কোথায়?”

“লিটিল ভাবী তো ঘরে।”

“কই না তো।আমি ঘর থেকেই এসেছি।”

“আমি তো লাইভ করতেছিলাম।লিটিল ভাবী বলেছিলো তার এখন ভালো লাগছে না কিছু।তাই ঘুমিয়ে ছিলো। কোথায় যাবে তাহলে?”

“ছাদে গেলো না তো?”
বলেই দ্বীপ চলে যায় ছাদে।কিন্তু নাহ কোথাও নেই নীরা।বাইরে মাঠে এসে দ্বীপ হাফাতে হাফাতে বলে,”কোথায় গেলো ও?মা বাবা সবাই তো এখানে।”

সবাই আলাদাভাবে খুঁজতে থাকে নীরাকে।কেউ খুঁজে পায় না।দ্বীপ অস্থির হয়ে গেছে।চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ।গা হাত পা কাপছে তার।ধপ করে বসে পড়ে মাঠের মধ্যে রাখা কাঠের উপর।মিসেস নাজনীন কান্না করছেন মুখে আচল গুঁজে।মিসেস সাবিনা পাশে এসে শান্তনা দিতে থাকেন।রিকের মাও সেখানে দাড়িয়ে।কেয়া ও রিক একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে কিছু কথা বলে বাইক নিয়ে বের হয় রিক।দ্বীপের করুন অবস্থা মিসেস নাজনীন এর কান্নাকাটি।অভ্র নিজেও এবার ভয় পেয়ে কান্না করছে।বাচ্চা মানুষ সবার চিন্তা দেখে ভয় তো পেয়েছে মামীকে পাচ্ছে না দুই ঘন্টা ধরে।কি হতে পারে।না বলে কোথায় যাবে নীরা।কাউকে সাথে নেয়নি।ফোন করেও পাচ্ছে না নীরাকে।কেউ কিছু বলছে না।দীপান্বিতা অভ্রকে সামলাতে ব্যাস্ত।মামু আর নানুকে কান্না করতে দেখে সেও কান্না করছে।নীরব বাইক নিয়ে বেরিয়েছে।বাকিরা এদিক ওদিক ফোন দিয়ে খোজ খবর নিতে থাকে।

থমথমে পরিবেশ। কারো মুখে নেই কোনো কথা।ঠিক সেই সময় সবার কানে ভেসে আসে,”কি হয়েছে?তোমরা এভাবে কান্নাকাটি করছো কেনো?”

দ্বীপ হাতের মুঠোয় মুখ বুঝে ছিলো।নীরার কণ্ঠ পেয়ে তাকায় নীরার দিকে।হাতের চাপ লেগে চোখের কোনায় চশমার চাপ পড়ে গেছে।শ্যামলা মুখে রক্তের জমাট,চোখমুখ লাল হয়ে আছে।চশমার ভিতর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দ্বীপের চিন্তিত লাল চোখ।তারাতারি উঠে এসে লোকসম্মুখে জড়িয়ে ধরে নীরাকে।বলে,”দুই ঘণ্টা ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমাকে।না বলে কোথায় গিয়েছিলে?”

দ্বীপের কণ্ঠে ফোফানির আভাস।নীরা বুঝতে পারলো দ্বীপ খুব চিন্তা করেছে।শুধু দ্বীপ না পুরো পরিবার।নীরা তাকিয়ে দেখলো তার মা কান্না করতে করতে মুখ দিয়ে ফেনা বের করেছে।ছোট অভ্রর চোখ মুখ লাল।মিসেস শিউলি এখনও বুঝতে পারেনি নীরা এসেছে।তিনি ওখানে বসেই তসবি পড়ছেন।বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার দোয়া পরে যাচ্ছেন তিনি।নীরা আস্তে আস্তে হেঁটে এসে মিসেস শিউলির কাছে দাড়িয়ে একটু ঝুঁকে নেয়।তারপর মিসেস শিউলিকে বলে,”নাতবৌ হারিয়ে যায়নি গো দাদীন।নাতির ঘরে পুতিকে আনতে পেরেছে কি না এটা দেখতে গিয়েছিলো।”

নীরার ফিসফিস করে বলা এমন বাক্য শুনে অবাক হয়ে তাকান মিসেস শিউলি।নীরার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কি হলো।নীরার হারিয়ে যাওয়ার জন্য মাথায় চিন্তার মেলা বসেছিলো।তাই নীরার এমন কথার মানে বুঝতে পারছিলো না।মিনিট পাঁচ তাকিয়ে থেকে মিসেস শিউলি জোরে চিল্লিয়ে বলেন,”সত্যি কও নাতবৌ?”

নীরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে দৌড় দিলো বাড়ির দিকে।সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে।মিসেস শিউলি জোরে জোরে বলেন,”এমন সময় দৌড়াইতে নাই নাতবৌ।শরীরের ক্ষতি হইবো।”

কেউ কিছু বুঝলো না।দ্বীপ নিজেও দৌড়ে চলে গেলো নীরার পিছনে।ঘরে এসে দ্বীপ দেখে নীরা জানালার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসছে।নীরার কাছে এসে বলে,”কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

“ডাক্তারের কাছে।”

চিন্তার ভাঁজ কপালে ফুটিয়ে উঠলো দ্বীপের।নীরার অতি নিকটে এসে কপালে হাত দিয়ে হাসফাস করে বলে,”আমাকে তো বলবে।আমি যেতাম তোমার সাথে।কি হয়েছে তোমার?”

নীরা উত্তর না দিয়ে মিটমিট হাসে।দ্বীপ এখনও কাপছে।দুই ঘণ্টা একজন জলজ্যান্ত মানুষ হাওয়া।না বলে কোথাও যাওয়ার দরকার তো এখন তার নেই।তারপরও গেছে নীরা।এখন আবার কি হয়েছে তা বলছে না।অবশ্য যে ক্লু নীরা দিয়েছে তাতে বুঝে যাওয়ার কথা।কিন্তু দ্বীপের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।নীরা বুঝতে পারলো।অতঃপর নীরা দ্বীপের হাত নিজের পেটের উপর রেখে বলে,”নিজের অস্তিত্ত অনুভব করার চেষ্টা করুন ক্যাডার সাহেব।”

দ্বীপ সাথে সাথে ধরে ফেলে নীরার কথা।বুঝতে পারে তাদের ভালোবাসার ফল আসতে চলেছে।দ্বীপ নীরার পেটের দিকে তাকিয়ে আছে।ওখানেই দ্বীপের ডান হাত।কোনো কথা না বলে শুধু অনুভব করছে।নীরা আবার বলে,”আমি কয়েকদিন আগে থেকেই নিজের ভিতর পরিবর্তন অনুভব করি।প্রথমে একটু চিন্তা হয়।কিন্তু আমি গুগলে সার্চ দিয়ে দেখতে পাই আমাদের জুনিয়র আসার লক্ষণ।কনফার্ম হওয়ার জন্য হসপিটালে যাই কেয়ার সাথে লুকিয়ে ফুসকা খাওয়ার নাম করে।আপনি কলেজে তখন।বাসায় ইচ্ছা করেই বলিনি।ভেবেছিলাম সবাইকে সারপ্রাইজ দিবো।আজকে প্রেগনেন্সি টেস্টের রেজাল্ট দিয়েছে।আনতে বেশি সময় লাগতো না।কিন্তু ডাক্তার আসায় দেরি হয়।অপেক্ষা করতে হয় অনেকক্ষণ।এদিকে ফোনেও চার্জ ছিলো না।ব্যাগ থেকে ফোন নিয়ে কেয়াকে এসএমএস করবো দেখি ফোন বন্ধ।অপেক্ষা করতে করতে একটু দেরি হয় আর রাস্তার অতিরিক্ত জ্যাম ছিলো।আমি দুঃখিত ক্যাডার সাহেব।সারপ্রাইজ দিতে যেয়ে আমি আপনাদের টেনশনে ফেলে দিয়েছি।কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আপনাকে আপনার বাবা হওয়ার স্বাদ একটু ভিন্নভাবে দিতে।সবসময় আপনি আমাকে সারপ্রাইজ করে দেন।আমিও চেয়েছি আজ মা বাচ্চা মিলে সারপ্রাইজ দিবো।প্লিজ রাগ করে থাকবেন না।”
কানে হাত দিয়ে রিকোয়েস্ট করে বলতে থাকে নীরা।নীরার চোখেও পানি।সে দ্বীপকে সারপ্রাইজ দিতে পারেনি বরং চিন্তায় ফেলেছে।দ্বীপ নীরার চোখের পানি দেখে হালকা হেসে জড়িয়ে ধরে তার চন্দ্রপাখিকে।বলে,”আজ আমার চন্দ্রপাখি মা হওয়ার অনুভূতি পাচ্ছে।আমি বাবা হওয়ার অনুভূতি।আমার লুকোচুরি ভালোবাসার ব্যাক্তি আমার হয়ে পরিপূর্ণ সংসারী হয়েছে।আমি পূর্ণ হয়েছি আজ।”

দরজায় দাড়িয়ে হাততালি দিতে থাকে সবাই।কেয়া বলে,”আমরা সব শুনেছি।আমি যে কতবার তোকে কল করেছি।তোর কথামত চুপ ছিলাম আমি।আমি তো পারলে এখনই বলে দিবো যে নীরা হসপিটালে।শুধু তোর ইচ্ছা পূরণের জন্য চুপ ছিলাম কিন্তু রিককে পাঠিয়েছি হসপিটালের দিকে।এখনও রাস্তায় সে।বললো জ্যাম পড়েছে খুব রাস্তায়।”

মিসেস নাজনীন এসে নীরার কপালে চুমু দেয়।নীরার হাত দুটো নিজের মুঠে নিয়ে বলেন,”এবার তো একটু বড় হ মা।চিন্তা হয় তো তোকে নিয়ে।তোদের কিছু হলে আমরা বাবা মা যে মরেই যাবো।”

সাথে মায়ের মুখ চেপে ধরলো নীরা।বলে,”আমার মা হওয়ার অনুভূতিতে তুমি এমন কথা বলছো কেনো মা?”

মিসেস নাজনীন জড়িয়ে ধরেন নীরাকে।নীরা বলে,”জানো মা!আমিও এখন মা হবো।”

সবাই হেসে দেয় নীরার কথায়।মিস্টার সমুদ্র নিজের রেস্টুরেন্ট থেকে কেক নিয়ে এসেছে।বাইরে মাঠে সুন্দর করে চেয়ার ও পাটি দিয়ে সাজানো হয়েছে।নীরা ও দ্বীপ মিলে কেক কাটে।একে অপরকে কেক খাইয়ে দিয়ে বাড়ির সবাইকে কেক দেয় নীরা।অভ্র যখন থেকে শুনেছে বাড়িতে নতুন অতিথি আসবে সে ত খুশিতে হাত তালি দিয়ে নাচানাচি করতে থাকে।

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here