এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️ #লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️ — পর্বঃ৩০

0
732

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩০

সময়ের স্রোতে ভাসমান প্রকৃতি। মাঝে দিন পেরুলো অনেকগুলো। প্রায় মাসের কাছে ছুঁই ছুঁই। নতুন বছর আসতে খুব বেশি দেরি নেই। হাতে গোনা দু-চারদিন বাকি। ফারিশ এখন আদ্রিতাতে আসক্ত। রোজ রাতে প্রেমআলাপ। আর দু’দিন পর পর রাতের ঘুরাঘুরি। এটা একটা রুটিনে পরিনত হয়ে গেছে। আদ্রিতাকে ছাড়া ফারিশের চলে না এখন। ফারিশ চাইছে শীঘ্রই বিয়ে করতে। কিন্তু কোথাও গিয়ে দোটানায় পড়ছে। সে কি করে? সে সম্পর্কে আদ্রিতা এখনও অবগত নয়। ফারিশের ভিতর কিছুটা হলেও ভয় ঢুকেছে। আদ্রিতা তার সম্পর্কে জানলে মেনে নিবে তো। নাকি ছেড়ে চলে যাবে। ফারিশ জেনেছে কক্সবাজারের সেই পপি গাছে ফলন হয়েছে ভালো। খুব শীঘ্রই গাছে ফল ধরবে। ফারিশ বেশ চিন্তিত। কি করা যায়! যে ভয় তার শুরুতে ছিল সেই ভয় ধীরে ধীরে বাড়ছে। বিষয়টা চেপে যাবে তাতেও শান্তি পাচ্ছে না। আবার বলে দিবে তাও পারছে না। দ্বিধাদ্বন্দে আছে খানিকটা।’

প্রকৃতি তখন দুপুরের দখলে। ক্লান্ত শরীরে গাড়িতে বসে আছে ফারিশ। আকাশ ছুঁয়ে রোদ্দুর উঠেছে তখন। ঢাকার শহরে বেশ জ্যাম আজ। যানযটে আটকা পড়েছে ফারিশ আর আদিব। আদিব ড্রাইভ করছে। তার পাশে ফারিশ। আদিব প্রশ্ন করলো,“ভাই কাশ্মীরের লোকেরা আবার মাল চাচ্ছে দিবো কি? আগেরবার দেরি করেছিলাম বলে ক্ষেপে ছিল। পরে আবার দমেও গেছে। এবার বেশি চাচ্ছে। কি করবো?”

ফারিশ দু’মিনিট ভেবে বললো,
“দিয়ে দেও।”
“আচ্ছা।”
“কারখানায় কাজ কেমন চলছে?”
“রাত একটায় একবার যাবেন ভাই।”
“আজ হবে না। কাল যাবো।”
“ঠিক আছে।”
“এখন কই যাবেন?”
“পুরনো বাড়ি যাবো।”
“আচ্ছা।”

জ্যাম কাটলো আরো দশ মিনিট পর। আদিব গাড়ি স্টার্ট দিলো। ফারিশ চুপচাপ বসে। সে প্রশ্ন করলো,“তুমি এখনও ডাক্তার ম্যাডামের বন্ধুকে প্রপোজ কেন করো নি আদিব?”

আদিব বিষম খায়। হাত অবশ হয়ে আসে। কণ্ঠনালিতে কথায় আঁটকায়। তবুও আদিব নিজেকে সামলে বলে,“আমি বলতে পারি না ভাই। আমার ভয় লাগে।”

ফারিশের গম্ভীর মুখ। চোখে মুখে বিষণ্ণ। সে হাসলো না। বেশ গভীর ভাবনা নিয়ে বললো,“তুমি কি চাচ্ছো তোমার হয়ে আমি ডাক্তার ম্যাডামের বন্ধুকে প্রপোজ করি?”

আদিব কি বলবে বুঝে না। চুপ করে রয়। ফারিশ আবারও বলে,“কালকের মধ্যে এই মামলা সেট করবে আদিব। তুমি না পারলে আমি কিন্তু দেখবো।”

আদিব তাও কিছু বলে না। কি বলবে তাও জানে না। আদিব চেষ্টা করে। বেশ কয়েকবার সে গিয়েও ছিল চাঁদনীর কেভিনে। কিন্তু মেয়েটার সামনে গেলেই আদিব চুপসে যায় এমন ভাব নেয় যেন মেয়েটাকে সে চেনেই না। প্রথম দেখছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে কখনো পরে নি আদিব। তাতেও সমস্যা হচ্ছে। চাঁদনী কি না কি বলে তা নিয়েও সে ডিপ্রেশনে আছে। মেয়েটার কথার যে ধাঁজ। কখন না হাত চালিয়ে বসে গালে। এ ভেবেও আদিব সাহস পায় না।’

পুরো রাস্তায় চুপ থাকলো আদিব। ফারিশও কিছু বললো না। তবে সে মনে মনে ভেবে নিয়েছে কালকেও যদি আদিব কিছু করতে না পারে তাহলে ফারিশই দেখবে বিষয়টা। নির্জন দুপুরে গাড়ি এসে থামলো সেদিনের আদ্রিতাকে নিয়ে আসা পুরনো বাংলো বাড়ির সামনে। ফারিশ বের হলো। আদিবও নামলো। সেদিনের পুড়ে থাকা ডালপালা গুলো সেখানেই লুটিয়ে পড়ে। কালো কুচকুচে রঙেই সজ্জিত তারা। ফারিশ সেদিনের পর আর এদিকে আসে নি। ফারিশ জ্বলে যাওয়া ডালগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে বাড়ির দরজার মুখে দাড়ায়। আশপাশ দেখে। আদিব টবের নিচে লুকিয়ে রাখা চাবিটা উঠিয়ে ঘরের দরজা খুলতে নিলো। হঠাৎই কিছু একটার আচ পেল ফারিশ। সঙ্গে সঙ্গে সে আদিবের হাত ধরে থামিয়ে দিলো দরজা খোলা থেকে। আদিব বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,“কি হলো ভাই?”

ফারিশ নিজ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো,“হুস। চুপ। এখানে কেউ আছে আদিব?”

আদিব বিচলিত হলো। ফিসফিস করে বললো,“এখানে কে থাকবে?”

ফারিশ জবাব দিলো না। আচমকাই পিঠের পিছনে লুকিয়ে রাখা পিস্তলটা হাতে নিলো। আদিব ঠায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ফারিশ আদিবকে মৃদুস্বরে বলে,“একদম নড়বে না এখানেই চুপটি করে বসে থাকবে। কেমন!”

আদিব মাথা নাড়ায়। যার অর্থ, ‘সে বসে থাকবে’। ফারিশ আস্তে আস্তে বাড়ির কর্ণারটা দেখলো কারো পদধ্বনি পাওয়া গেল। ফারিশ আচমকাই দৌড় দিলো। সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের ভিড়ে লুকিয়ে থাকা কেউ আড়াল থেকে বেরিয়ে দৌড় দিলো। ফারিশ তার পিছু নিলু। লোকটি হতভম্ব হয়ে গেল। ফারিশ কাঙ্ক্ষিত লোকটিকে দেখতে পেয়েই পায়ে গুলি করতে নিলো। কিন্তু সামনে গাছ চলে আসায় লাগলো না। লোকটি গায়ে চাঁদর মুড়ি দিয়ে অনবরত দৌড়াচ্ছে। ফারিশও তার পিছনে ছুটছে। কিন্তু লোকটা একসময় পালাতে সক্ষম হলো। ফারিশ গুলি মারলো সেটা লাগলো সোজা লোকটির হাতে। তবুও পিছন ঘুরলো না। হাত চেপে বেরিয়ে আসলো সেখান থেকে। চাঁদর লুটিয়ে পড়লো নিচে।’

ফারিশ আশপাশ দেখে। বিরক্ত নিয়ে বললো,“শীট।”

ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে আদিব। থরথর করে কাঁপছে। গুলির শব্দ কানে আসলেই আদিব প্রচন্ড ঘাবড়ে যায়। তার শরীর দিয়ে ঘাম বের হয়। নিজেকে সামলাতে প্রায় সময় অক্ষম হয়। ফারিশ এসে বসলো তার পাশে। হাতের পিস্তল সরিয়ে বললো,“খুব ভয় পেয়েছো আদিব?”

আদিব ঘাবড়ে গেল। সে বাচ্চাদের মতো করে বললো,“আমি এখানে থাকবো না ভাই, আমি এখানে থাকবো না।”

ফারিশ আদিবের মাথায় হাত বুলালো। শান্ত স্বরে বললো,“ভয় কেন পাচ্ছো। তোমার ফারিশ ভাই আছে না। তোমার কিছু হবে না আদিব। এই ফারিশ তোমার কিছু হতে দিবে না।”

আদিব চুপ করে রয়। কিছু বলে না। ফারিশের মনে পড়লো ছোট বেলার এক ঘটনা। যেই ঘটনার পর আদিব কখনোই তাকে তুই করে বলে না। বলে তুমি করে।”

সে অনেক বছর আগের পুরনো ঘটনা। তখন মাঝরাত। বাহিরে তুমুল বেগের বর্জপাত আর বৃষ্টি হচ্ছিল। মাথায় টিন চাপিয়ে রাস্তার এক কিনারায় বসে ছিল ফারিশ আর আদিব। তখন তাদের বয়স দশ, নয়। ফারিশের দশ আর আদিবের নয়। আদিব ছোট থেকেই অনেক ভীতু টাইপের। সবকিছুতে তার ভয়। দারুণ ভয়। সে রাতের বর্জপাত আর টিনের ঝাঁকড়ানির শব্দে আদিব ভয়ে স্তব্ধ। পুরো রাস্তা নির্জন। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ। ল্যাম্পপোস্টও জ্বলছে নিভছে। তখনই কোথা থেকে যেন একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় ছুঁটে আসে তাদের দিকে। পায়ে আঘাত থাকায় সে লুটিয়ে পড়ে ফারিশদের সামনে। ফারিশ আদিব দুজনেই লোকটার কাছে যায়। লোকটা আর্তনাদ ভরা কণ্ঠে বলে,“আমাকে বাঁচাও তোমরা নয়তো ওরা আমায় মেরে ফেলবে।”

ফারিশ তখন সামনে তাকায়। দুজন লোক এগিয়ে আসে। গুলির শব্দ হয়। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই লুটিয়ে পড়া লোকটাকে অনবরত গুলি মারা হয় তাদেরই চোখের সমানে। লোকটি তখন বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু পারে না মারা যায়। ফারিশ আদিব দুজনেই ছোট তারা কিছুই বোঝে না। আদিব ফারিশের হাত ধরে গুলির শব্দে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। রুহু সমেত তার ভয়ে কাঁপে। কিন্তু ফারিশ থাকে স্থির। তার দৃষ্টি থাকে ওই লোকদুটোর চোখ আর তাদের হাতে থাকা পিস্তলের দিকে। তখনই একটা ছেলে বলে,“এরা দুজন দেখে ফেলেছে এদেরকেও মেরে ফেল।”

আদিব ঘাবড়ে যায়। ফারিশের হাত আরো শক্ত করে খামছে ধরে। আমতা আমতা করে বলে,“আমগো মাইরা ফালাইবো ভাই। আমরা আর বাঁচুম না।”

‘আমরা আর বাঁচুম না’। কথাটা ছোট ফারিশের বুকে গিয়ে বিঁধে। কি করবে ভাবে। ছেলেগুলো ততক্ষণে এগিয়ে আসে। প্রথম আঘাতটা তারা আদিবকে করে। মাথা ফেটে যায়। আদিবের মুখে গুলি ধরে যেই না শুট করবে সেই মুহূর্তেই ফারিশ মরে থাকা সেই লোকটির পকেটের পিস্তলটা উঠিয়ে পর পর কয়েকটা গুলি মারে। আদিব থমকে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে নিচে। আরেকটা ছেলে ফারিশের এহেম কান্ড দেখে রাগ নিয়ে ছুটে আসতেই তার দিকেও গুলি তাক করে ফারিশ। সেও মরে যায়। দূর থেকে এই ঘটনা কেউ লক্ষ করে। তার সাথে করেই নিয়ে আসে ফারিশ আর আদিবকে। আদিব সেদিন রাতেও এমন ভয়ার্ত কণ্ঠে বলেছিল,“আমি এহিনে থাকুম না ভাই, আমি এহিনে থাকুম না।”

সময় গড়ালো। পরিস্থিতি সামলে এলো। বাড়ির ভিতর আর ঢোকা হলো না। ফারিশ দীর্ঘ নিশ্বাস নিলো। মাথায় তখন একটি প্রশ্নই ঘুরছিল,“কে ছিল ওই চাঁদরের আড়ালে?”
—–
নিজের চেম্বারে বসেছিল আদ্রিতা। তখনই হন্তদন্ত হয়ে কে যেন চেম্বারে ঢুকলো। লোকটি আহত। হাত দিয়ে কলকলিয়ে রক্ত পড়ছে। আদ্রিতা বেশ চিন্তিত স্বরে এগিয়ে এসে বললো,
“কি হয়েছে আপনার?”

লোকটি কোনোমতে বললো,“আমার হাতে গুলি লেগেছে প্লিজ আমার চিকিৎসা করুণ।”

আদ্রিতা শুনলো। দ্রুত লোকটিকে নিয়ে ছুটে গেল ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে। আদ্রিতার ফোনে মেসেজ আসে তখন। ফারিশ লেখে,“আমার আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে ডাক্তার ম্যাডাম। শোনানোর জন্য আমার কিছু সময় চাই।”

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here