শিশির_ভেজা_শিউলি #পর্ব_৩৫ #ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

0
659

#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_৩৫
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)

(প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য এই পর্ব)

জ্যোৎস্নার আলোয় আলোকিত মেদিনী। আজ দূর আকাশের চাঁদ বুঝি খিলখিলিয়ে হাসছে। এতো হাসির পসরা সাজিয়ে বসেছে কেন দূর আকাশের চাঁদ? বোধগম্য হয়না রমনীর। জানালা গলিয়ে জ্যোৎস্না যেন উঁকি দিতে চাইছে তাঁর ঘরে। হ্যাঁ তারই তো ঘর। তার একান্ত ব্যক্তিগত অর্ধাঙ্গের ঘর তো তারও ঘর। ওই প্রেমিক পুরুষের সবকিছুতে আজ থেকে তার অধিকার। উঁহু ভুল। এখন প্রেমিক স্বামী সে। জ্যোৎস্নার আলো ঘরে উঁকি দিলেও কৃত্রিম আলোর কাছে হেরে যাচ্ছে। সূরা বিরক্ত হয়। বিরক্ত চোখে ঘরের লাইটের দিকে তাকালো সে। লাইটটা বন্ধ থাকলে জ্যোৎস্নার আলোয় আলোকিত হতো তার ঘরটা। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সূরা রুমের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়। জমিদার বাড়ির সবচেয়ে বড় ঘরটা মনে হয় এটাই। ঘরের সবকিছুতে আভিজাত্যের ছোঁয়া। বাথরুম দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় সূরার। কই কারো ঘরের সাথে তো বাথরুম নেই। এই লোকের সবকিছু একদম পরিপাটি চাই। কখনো এই ঘরে উঁকি দিয়েও দেখেনি সে। ইচ্ছে যে করেনি তা না। ইচ্ছে করলেও মিসবাহর থেকে দূরে থাকতে চেয়েছে সে। কিন্তু পারলো কই। সেই তো প্রেমিক পুরুষটার অনুভূতির দহনে দগ্ধ হতে হলো তাকে। মিসবাহ নামক অনুভূতির বিষাক্ত বিষ ছড়িয়ে পড়লো সূরার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ঘরটা এখন ফুলের বাগিচা মনে হচ্ছে সূরার কাছে। এক ফুলের বিছানায় বসে আছে সে। পুরো ঘর শিউলি ফুল দিয়ে সাজানো। তাদের বিছানা টাও শিউলি ফুলে সজ্জিত। ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হওয়ার পরেও বাসর রাতের জন্য এতো আয়োজন যে বন্ধুদের কাজ জানে সূরা। কিন্তু এতো ফুল থাকতে শিউলি কেন? তাহলে কি মিসবাহ বলেছে ওদের। লহমায় লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো সূরার কপোলদ্বয়। এই বজ্জাত লোকের কি লজ্জার ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু লোকটা এখনো এলো না কেন? নাকি তাকে অপেক্ষা করানোর শাস্তি দিচ্ছে সে সূরাকে। কিন্তু লোকটা কি জানে এই অপেক্ষা বড্ড মিষ্টি লাগছে তার? লহমায় বাইরে হৈচৈয়ের শব্দে নড়েচড়ে বসল সূরা। বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির গলার স্বর। বিছানার চাদর মুঠোয় পুরে নিল সূরা। দরদর করে ঘাম ঝরছে। সে কি ভয় পাচ্ছে। কিন্তু কেন? না মানুষটাকে ভয় পাচ্ছে না। ভয় পাচ্ছে নতুন এই সম্পর্কে। সূরা শক্ত হয়ে বসে থাকে। বাইরে মিসবাহর কথা শোনা যাচ্ছে। মিসবাহ ভ্রু কুঁচকে বলে

“এই কি শুরু করেছিস তোরা? সর সামনে থেকে।”

রায়হান কৌতুক স্বরে বলে “কেন মামা তর সইছে না।”

“নাউজবিল্লাহ। এসব কি বলিস? লজ্জা শরম কর। এসব শুনতেই আমার লজ্জা করছে।”

সবাই বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকায় মিসবাহর দিকে। তার নাকি লজ্জা করছে। ভাবা যায়। রায়হান কিছু বলার জন্য হা করতেই মিসবাহ ভরাট কন্ঠে বলে

“হা বন্ধ কর। আর সামনে থেকে সর।”

জিহাদ বলে “স্যার আমরা কি সারারাত থাকার জন্য দাঁড়িয়ে আছি বলেন? আমাদের পাওনা মিটিয়ে দিলেই আমরা চলে যাবো।”

মিসবাহ বাঁকা হেসে বলে “তোমরা যাবে নাকি সারারাত আমাদের প্রেমালাপ শুনবে সেটা তোমাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাছাড়া বউ আমার, ঘর আমার, বিয়েও করলাম আমি তোমাদের পাওনা আবার কিসের?”

প্রিয়া বলে “তেমন কোনো পাওনা না ভাইয়া। সামান্য কিছু টাকা। আসলে কি বলুন তো আপনার বউকে এতো সুন্দর করে সাজানো থেকে শুরু করে আপনার ঘর সাজানো পর্যন্ত একটু পারিশ্রমিক আরকি।”

মিসবাহ বুকে দুই হাত গুজে আয়েশ করে দাঁড়ালো। রায়হান চোখ ছোট ছোট করে বলে
“মতলব কি মামা? আমাদের টপকে ভেতরে ঢুকার প্ল্যান করছিস না তো?”

মিসবাহ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে “তোদের মতো জলহস্তীদের টপকে যাওয়া কি এতোই সোজা?”

সিহাব বলল “ভাই অপমান করলে নাকি সুনাম।”

দিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে “গাধার বাচ্চা সিহাব রে তোর বুদ্ধির প্রদর্শন কি এখনই করা লাগবে?”

“এই বেয়াদব মেয়ে নিজের শ্বশুড় কে গাধা বলিস তুই।”

দিয়া জিভ কাটল। রাগের বশে বলে ফেলেছে। সবাই শব্দ করে হেসে উঠে। জিহাদ ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল

“এই হলো আজকালকার মেয়ে। স্বামীকে তো চোখেই দেখে না শ্বশুড় শ্বাশুড়ি কোন চুলোর বা**।”

প্রিয়া মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে “ছিঃ ভাষার কি ছিরি।”

“তুমি চুপ করো মেও মেও। আরো অনেক প্রকারের ভাষা ডাউনলোড আছে। শুনবে?”

“একদম আমাকে এই নামে ডাকবেন না। অসভ্য লোক একটা।”

“বারে আমি কি অসভ্যতামি করলাম শুনি। মেয়ে তুমি দেখছি সর্বনাশিনী। কিছু না করেই অসভ্য উপাধি দিচ্ছো। কিছু করার পরে তো দেখছি মৃত্যুদণ্ড দিবে আমাকে। এটা কিন্তু ঠিক না মেও মেও।”

প্রিয়া কটমট করে তাকালো। সবাই ঠোঁট চেপে হাসে। মিসবাহ বিরক্ত হয়। এই ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চাদের তার এখন অসহ্য লাগছে। মিসবাহ ধমকে উঠে

“এখন এই মুহূর্তে চুপ না করলে সব গুলোর কানের নিচে দিব। পাওনা মিটে যাবে সবার।”

রায়হান বলে “সে তুই যা ইচ্ছা কর। আমরা আমাদের পাওনা না পেলে সরছি না আজ।”

“কি চাই?”

সবার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠল। মেহের গদগদ হয়ে কিছু বলবে তার আগেই রায়হান ধমকে উঠলো তাকে। বলল

“বাচ্চা মানুষ তুই এসবের মধ্যে কেন রে? যা এখান থেকে।”

“একদম বাচ্চা বলবেন না রায়হান ভাই‌। ঠিক সময় বিয়ে হলে আজ আমার কোলে তিনটে বাচ্চা থাকতো।”

রায়হান দাঁতে দাঁত চেপে চোখ পাকিয়ে তাকালো মেহেরের দিকে। মেহেরের ডোন্ট কেয়ার ভাব। জিহাদ আফসোসের সুরে বলে

“তোর কষ্ট আমি বুঝি বোন। তুই আর আমি যে একি কষ্টের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি। আজ ঠিক সময় বিয়ে হলে আমিও বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম ডাউনলোড করতাম। আমার মাথায়-কোলে-ঘাড়ে সব জায়গায় বাচ্চায় গিজগিজ করতো। ও প্রিয়া ও প্রিয়া তুমি কোথায়।”

প্রিয়া জিহাদের দিকে তেড়ে এসে বলে “আপনি আবার শুরু করলেন। বজ্জাত লোক। আজ কিন্তু আমি খুন করে ফেলবো আপনাকে।”

“আহা তুমি চেতে যাচ্ছো কেন? আমি তো আমার বিড়াল ছানা কে ডাকছিলাম। অনেকক্ষন দেখিনা তো তাই।”

“আর একটাও বারতি কথা শুনলে সবগুলোকে গাছে উল্টো করে বেঁধে ইচ্ছা মতো পেটাবো। বউ আমার ঘুমিয়ে পড়লে তোদের ঘুম আজ হারাম করবো।”

মিসবাহর শুকনো হুমকিতে সবাই চুপ করে যায়। রায়হান সাহস করে বলে

“আমাদের পাওনা মি,,,

“কতো?”

রাফি গদগদ হয়ে বলে “বেশি না এই মাত্র ত্রিশ হাজার।”

মিসবাহ গম্ভীর স্বরে বলে “এটা মাত্র। টাকা কি গাছের পাতা। ছিড়বো আর টুপ করে তোদের দিয়ে দিবো। মগের মুল্লুক পেয়েছিস।”

রায়হান বলে “জমিদার বাড়ির ছেলে সামান্য টাকার জন্য তর্ক করছে। মানাচ্ছে না। আমাদের পাওনা মিটিয়ে দে। আমরা চলে যায়।”

“তোদের কি আমাকে দেখে বিলগেটস মনে হয় যে পকেটে করে ত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াবো। সর সামনে থেকে। ঘরে মানিব্যাগ আছে। টাকা কমা।”

জিহাদ চেঁচিয়ে উঠল “নাহ্। দয়া করে এই ক্ষেত্রে বিশ্বাস করতে বলবেন না। আমরা দায়িত্ববান নাগরিক। এসব অনাচার আমরা মেনে নিব না।”

সিহাব বলল “আমরা কি হোলসেলে জিনিস বিক্রি করছি যে দরদাম করছিস ভাই? ত্রিশ হাজার টাকার কম হবে না।”

মিসবাহ শান্ত স্বরে বলে “তোদের টাকার চক্করে আমার বউ ঘুমালে একটাকেও আজ ঘুমানোর অবস্থায় রাখবো না।”

সবাই ঠোঁট উল্টে একে অপরের দিকে তাকালো। রায়হান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। মিসবাহ বাঁকা হেসে ঘরে ঢুকে। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে টাকা বের করে। রায়হান গদগদ হয়ে মিসবাহর থেকে টাকা নেই। মিসবাহ টাকা নেওয়ার সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল। রায়হান টাকা গুনতেই মুখে অমাবস্যা নেমে আসে। রাফি বলে

“কত ভাইয়া?”

রায়হান কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে “তিন হাজার তিনশ এক টাকা।”

সবার মুখ ছোট হয়ে যায়। রায়হান চেঁচিয়ে দরজার এপাশে থেকে বলে “সা**লা এভাবে ঠকালি। বউ কপালে জুটবে না। না বউ তো জুটেছে। বাসর জুটবে না মিলিয়ে নিস। বাথরুমে সারারাত কাটাতে হবে আজ।”

দিয়া বলল “স্যার আমাদের ঠকাবে না। কাল নিশ্চিত দিয়ে দিবে।”

সবাই চোখ ছোট ছোট করে তাকালো দিয়ার দিকে। দিয়া ওদের তাকানো দেখে অন্য দিকে তাকায়। জিহাদ বলে

“কি আর করার । চলো যায়। জীবনটাই বৃথা হয়ে যাচ্ছে। আমার বাসর ঘরের গেট যারা ধরবে তাদের জন্য টাকা জমাচ্ছি কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না আর বাসর তো বিলাসীতা।”

সবাই চলে যায়। মিসবাহ ওদের যাওয়ার আভাস পেয়ে মুচকি হাসে। পেছনে ঘুরে তাকাতেই থমকে যায় সে। চাঁদের জ্যোৎস্নার আলো আজ যেনো ফিকে মনে হচ্ছে মিসবাহর কাছে। মনে হবেই তো। আজ যে তার ব্যক্তিগত চন্দ্রাকান্তা নুর ছড়াচ্ছে তার ঘরে, তার হৃদয় জুড়ে। কৃত্রিম লাইটের আলো যেনো ঢেকে দিতে চাইছে তার চন্দ্রকান্তার নুর। মিসবাহ বিরক্ত হলো। সুইচ অফ করে বন্ধ করে দিলো ঘরের সমস্ত কৃত্রিম আলো। সূরা হকচকিয়ে গেল। হঠাৎ লাইট অফ করার কারন বোধগম্য হলো না তার। তাকালো মিসবাহর দিকে। মিসবাহ তার দিকেই তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে লজ্জা, কুন্ঠায় নুয়ে পড়লো রমনী। জানালা গলিয়ে জ্যোৎস্নার আলোয় আলোকিত হয়ে আছে ঘর। মিসবাহ বুকে হাত দিয়ে বিরবিরালো

“ওহে জ্যোৎস্না তুমি ভুবন আলোকিত করতে পারলেও আমার হৃদয় আলোকিত করেছে আমার ব্যক্তিগত চন্দ্রাকান্তা। তাহলে কি ধরে নেব তোমার না তার নুরে আমি মুগ্ধ।”

শিউলি ফুলের সুবাসে ভরে গেছে ঘরের আনাচে কানাচে। এক শিউলি ফুলের রাজ্যে বসে আছে মিসবাহর শিউলি ফুল।ফুলের বাগানে ফুটে আছে স্নিগ্ধ শিউলি ফুল। তার সুরজান। মিসবাহ এগিয়ে গেল সূরার কাছে। সূরার মুখোমুখি বিছানায় বসে সে। সূরা শক্ত হয়ে বসে আছে দেখে মনে মনে হাসে মিসবাহ। এই রমনী শত প্রহর অপেক্ষার। তার শখের নারী। মিসবাহ একটু কেশে সালাম দিল

“আসসালামুয়ালাইকুম বউজান।”

মিসবাহর মুখে”বউজান” সম্বোধন শুনে একরাশ ভালো লাগে ঘিরে ধরলো সূরাকে। সাথে নিয়ে আসলো লজ্জা। এই লোক আর কতো নামে ডাকবে তাকে? জানা নেই রমনীর। সূরা বড় ঘোমটার আড়ালে রাখা মুখ তুলে তাকালো মিসবাহর দিকে। আবছা আলোয় দেখলো তার প্রেমিক পুরুষকে। ক্ষীন স্বরে আওরালো

“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”

মিসবাহ মুচকি হাসে। আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। আলমারি খুলে কিছু বের করে এসে বসে সূরার মুখোমুখি। সূরার হাত ধরতেই কেঁপে উঠলো সূরা। মিসবাহ থমকায়। এই মেয়ে কি আজ তাকে মেরে ফেলার পায়তারা করছে? মিসবাহ ওষ্ঠধর ভেদ করে তপ্ত শ্বাস ফেলে। সূরার হাতে একটা চেক দিয়ে বলে

“তোমার দেনমোহরানা পরিশোধ করলাম বউজান। আজ থেকে তুমি আমার জন্য হালাল। তোমাকে দেখার এই চোখজোড়া হালাল।”

সূরা ক্ষীন স্বরে বলল “এতো টাকা আমি কি করবো?”

মিসবাহ কিছু বলে না। সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে বড় ঘোমটা দেওয়া রমনীর দিকে। সূরা তাকায় মিসবাহর দিকে। গভীর চোখের চাহনি আজ এতো গভীর কেন? মিসবাহ হাত বাড়িয়ে সূরার ঘোমটা তুলে স্নিগ্ধ মুখোস্রি দেখে। মিসবাহর মনে হলো তার সুরজান অপ্সরা। এতোক্ষণ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ছিল তার চন্দ্রকান্তার নুর। মেঘ সরে গিয়ে তার চন্দ্রকান্তার নুর ছড়িয়ে পড়ছে তার হৃদয়ের আনাচে কানাচে। সূরা মাথা নিচু করে বসে আছে। লজ্জা লাগছে তার। সূরার লজ্জা রাঙ্গা মুখোস্রি মিসবাহর মনে প্রশান্তির শিহরণ জাগায়। মিসবাহ সূরার পায়ে নূপুর পড়িয়ে দেয়। সূরা তাকালো মিসবাহর দিকে। নূপুরের দিকে তাকিয়ে দেখে জ্যোৎস্নার আলোয় চিকচিক করছে নূপুর জোড়া। মিসবাহ মুখে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে বললো

“যার পদচারণ আমার হৃদয়ে তার পদযুগল সাজিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।”

পরক্ষনে কন্ঠে খাদ নামিয়ে বলে “ওযু করে আসো সুরজান। মহান রাব্বুল আলামীনের নামে নতুন জীবনের সূচনা করি।”

সূরা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বাথরুমে ঢুকে ওযু করে বেরিয়ে আসে। সূরা বেরিয়ে আসলে মিসবাহ গিয়ে ওযু করে। দুজনে এক সাথে নামাজ পড়ে নেয়। মিসবাহ নামাজ পড়ে জায়নামাজ ভাজ করে বিছানায় গিয়ে বসে। সূরা এখনো নামাজ পড়ছে। মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে দুই হাত তুলে চোখের অশ্রু ফেলছে এক পবিত্র ফুল। মিসবাহর মনে হলো এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য সে আগে কখনো দেখেনি। তার সুরজান কি কোনো কারনে কষ্ট পেয়ে আল্লাহর কাছে নালিশ জানাচ্ছে? সূরা নামাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। জায়নামাজ ভাজ করে মিসবাহর কাছে এগিয়ে এসে কিছু দোয়া পাঠ করে মিসবাহর মাথায় ফু দেয় সে। মিসবাহ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে তার সুরজানের দিকে। সূরা ছলছল চোখে হাসলো। মিসবাহ সূরাকে পাশে বসিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে

“কি হয়েছে সুরজান। কাঁদলে কেন? কোনো কারনে কষ্ট পেয়েছো?”

সূরা চোখে হেসে সরল স্বীকারোক্তি দেয় “মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে শুকরিয়া জানালাম। আপনাকে পেয়ে আমি আজ পরিপূর্ণ ডাক্তার। আপনি আমার সুখ ডাক্তার। আমার মনের প্রশান্তিময় অনুভূতি। এতো সুখ আমার সইবে তো।”

“আমি তোমার সুখ হলে সে সুখ তোমার সইবেনা বলছো মেয়ে। ভুল বললে। তোমার ডাক্তার নামক সুখ তোমার শিরায় শিরায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে।”

সূরা মুগ্ধ হয়ে দেখে তার ডাক্তার কে।মিসবাহ সূরার অতি নিকটে এসে সূরার ললাটে হালাল স্পর্শ এঁকে দেয়। আবেশে চোখ বুজে নিল সূরা। লহমায় নিজেকে শূন্যে অনুভব করলে হকচকিয়ে যায় সে। মিসবাহ তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। সূরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে মিসবাহর বুকের কাছের পানজাবি আঁকড়ে ধরে। ব্যস্ত কন্ঠে বলে

“কি করছেন?”

“মেয়ে তোমাকে আমার রাজ্যে নিয়ে যাচ্ছি। যাবে?”

সূরা কিছু বলেনা। মাথা রাখে মিসবাহর বুকে। মিসবাহ সম্মতি পেয়ে সামনে পা বাড়ায়। বারান্দায় নিয়ে এসে সূরাকে কোলে নিয়ে বসে চেয়ারে। সূরা এখনো মিসবাহর বুকে মাথা রেখে আছে। মিসবাহ কন্ঠে খাদ নামিয়ে বলে

“শত প্রহরের অপেক্ষার অবসান বুঝি ঘটলো। আমার ব্যক্তিগত শিউলি আজ আমার হৃদয়ে তার সুবাস ছড়াচ্ছে।”

সূরা তাকালো মিসবাহর দিকে। মিসবাহ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। ওই চোখে তাকিয়ে থাকার ক্ষমতা যে নেই এই রমনীর। মাথা নিচু করে সূরা বলে

“ওই ভাবে তাকাবেন না ডাক্তার। আমি যে নিজের সর্বনাশ দেখি আপনার ওই চোখে।”

মিসবাহ ঘোরলাগা কন্ঠে বলল “তোমাকে দেখার জন্য আমার কাতর চোখ তৃষ্ণার্ত। জান্নাতে স্বামি স্ত্রী প্রথম দেখায় ৪০ বছর একেঅপরের দিকে তাকিয়ে থাকবে। জান্নাতেও কি তোমাকে দেখার তৃষ্ণা আমার মিটবে? উহু তখনো আমার চোখ তৃষ্ণার্ত বুঝি থেকে যাবে।”

সূরার মাথা রাখে মিসবাহর বুকে। সুখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চোখ বেয়ে। তাকায় দূর আকাশের চন্দ্রের দিকে। আজ সে বড্ড খুশি। সূরাও তো খুশি। আজ তার শখের পুরুষের বুকে সে পরম শান্তিতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মিসবাহ দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সূরাকে। হয়তো বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা তার। ঘোরলাগা কন্ঠে আওরালো

“আজ আমার বুকে আমার একান্ত ব্যক্তিগত চন্দ্রকান্তা মুখ লুকিয়ে আছে। এই জ্যোৎস্না স্নিগ্ধ রজনী আজ নাহয় সাক্ষী থাকুক আমার প্রনয়ের পরিপূর্ণতার। আমার চন্দ্রাবতীর নুরে আলোকিত হওয়ার অধিকার দেবে কি আমায়?”

সূরা কিছু বলেনা। তার স্বামী এই পুরুষ। তার প্রতি মিসবাহর অধিকার আছে। তবুও মুখ ফুটে কিভাবে বলবে সেও চাই প্রনয়ের পরিপূর্ণতা। মিসবাহ তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে

“তোমার সময় প্রয়োজন? চিন্তা করোনা। আমি অপেক্ষা করবো আমার সুরজানের।”

সূরার ভ্রু কুঁচকে গেল। সে কিছু বলেনি বলে কি, না ধরে নিবে। হ্যাঁ ও তো ধরা যায় নাকি। সূরা বিরক্ত মুখে মিসবাহর কোল থেকে উঠে দাঁড়ালো। মিসবাহ প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালে সূরা কন্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে

“আমি কি একবারও বলেছি আমার সময় প্রয়োজন।”

মিসবাহ বুঝতে পারেনা হঠাৎ রিনা খানের রুপ ধারণ করলো কেন এই মেয়ে। বলে “হ্যাঁ ও তো বলোনি তাই আমি,,,

সূরা কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে “আমি কি হ্যাঁ মুখে বলবো? বুঝে নেওয়া যায় না। আমি আপনার মতো নির্লজ্জ নাকি যে মুখে বলবো ওগো স্বামী আমিও পূর্নতা চাই। অসভ্য লোক। আনরোমান্টিক পুরুষ।”

মিসবাহ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বাঁকা হেসে সূরাকে কোলে তুলে নেয়। বলে “আমার মতো রোমান্টিক পুরুষকে আনরোমান্টিকের তকমা দিলে মেয়ে। এই অপবাদ কি মেনে নেওয়া যায়? উঁহু যায়না। তো চলো রোমান্স করা যাক। কি বলো?”

মিসবাহর চোখে মুখে দুষ্টুমি খেলা করছে। সূরা লজ্জা পায়। মুখ লুকায় স্বামীর বুকে। আজ বুঝি পূর্নতা পায় দুই প্রেমিক যুগলের প্রনয়ের। শত প্রহর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নতুন জীবনের সূচনা ঘটে। দুই কপোত কপোতীর একে অপরকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র থেকে তীব্র হয়। দূর আকাশের চাঁদ বুঝি লজ্জা পায় তাদের দেখে। তাই তো সে মুখ লুকালো মেঘের আড়ালে।

★★★★★★

নতুন দিনের সূচনা। অন্ধকারকে পরাজিত করে বিজয়ী বেশে দিবাকর নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে ধরনী। পাখিরা হয়তো শুভেচ্ছা জানায় দিবাকর কে। এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। যতোই অন্ধকারে তলিয়ে যাও না কেন দিনশেষে জীবন আলোকিত হবেই। আমরা কেউ পরিপূর্ণ না। আমাদের সবার জীবনেই কোথাও না কোথাও অপূর্ণতা, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব আছেই। তাই বলে কি আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস, ভরসা রাখবো না। নতুন দিনের সূচনা বয়ে নিয়ে আসবে সুখ, শান্তি। শুধু অপেক্ষা করতে হবে। দুই কপোত কপোতীর সুখময় মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছিল দূর আকাশের চন্দ্র। লজ্জাও পেয়েছিল বটে। চন্দ্র লজ্জা পেয়ে মুখ লুকিয়ে ছিল মেঘের আড়ালে আর প্রভাতের দিবাকর বুজি দুই কপোত কপোতীর সুখময় সকাল দেখে খিলখিলিয়ে হাসে। একটু হয়তো হিংসাও হলো তার রমনীর এতো সুখ দেখে। তাইতো ঘরের জানালা গলিয়ে রমনীর চোখ মুখে বিচরন করছে সে। বিরক্ত হলো রমনী। রমনীর বিরক্তি মাখা মুখোস্রি দেখে আবার খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে দিবাকর। ভারি মজা পেল সে। তাইতো নিজের তেজ বারিয়ে দিল। সূরা চোখ পিটপিট করে তাকালো। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল তার। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলো দিবাকর অনেক আগেই তার অস্তিত্বের জানান দিয়েছে। সূরা জানালা থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা মানবটির দিকে তাকালো সূরা। চোখ মুখ কুঁচকে ঘুমিয়ে আছে সে। দিবাকর যে তাকেও বিরক্ত করছে বুঝতে পেরে মুচকি হাসে সূরা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বৈধ পুরুষকে। স্নিগ্ধ মুখোস্রি। শুভ্র মুখোস্রিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ওই চোখজোড়া। অতল গহ্বরের মতো গভীর সেই চোখজোড়া। শুভ্র ললাটে গুটি কয়েক চুল খেলা করছে। সূরা হাত বাড়িয়ে মিসবাহর ললাটে পড়ে থাকা চুল আলতো করে সরিয়ে দেয়। হাতটা মিসবাহর মুখে বুলিয়ে দিতে থাকে। মিসবাহর ঠোঁটের কাছে হাত এনে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে স্লাইট করে মিসবাহর ঠোঁটে। আজ কতো শান্ত এই প্রেমিক পুরুষ। অথচ কাল কতো শত উন্মাদনা তার। এতো বছরের অপেক্ষার প্রহর বুঝি ভেঙে চুরমার করতে কার্পণ্য করেনি এই মানব। এই মানবের প্রতিটি ছোঁয়ায় ছিল সূরার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি। অতি আদরে জড়িয়ে রেখেছিল তাকে। সূরা মিসবাহর আরো নিকট যায়। আলতো করে ছুঁয়ে দেয় অর্ধাঙ্গের গোলাপি ওষ্ঠধর। ঠোঁটে কারো স্পর্শে ভ্রু কুঁচকে গেল মিসবাহর। নড়েচড়ে উঠলো। কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ পিটপিট করে তাকালো সে। সূরা মিসবাহর বিরক্তি মাখা মুখোস্রি দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। মিসবাহ তাকালো সূরার দিকে। মুখে বিরক্তির জায়গায় ঠাঁই নিল একরাশ মুগ্ধতা। মিসবাহকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সূরা লজ্জা পায়। ক্ষীন স্বরে সালাম দেয়। মিসবাহর মনে হলো এর চেয়ে মধুর কন্ঠ বুঝি দ্বিতীয় টি পাওয়া দুষ্কর। মিসবাহ মুচকি হেসে সালামের জবাব দিলো। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে সূরা ব্যস্ত কন্ঠে বলে

“কি করছেন? কতো বেলা হয়েছে খেয়াল আছে। উঠতে হবে। ছাড়ুন।”

মিসবাহ ভ্রু কুঁচকে বলে “স্বামীকে সময় দাও মেয়ে। সংসার নিয়ে তোমাকে ভাবা লাগবেনা। তুমি না গেলে কেউ না খেয়ে থাকবেনা এখানে।”

সূরা মিসবাহর বুকে মাথা রেখে বলে “তেমন কিছু না। বিয়ের পরের দিন এতো বেলা করে উঠলে তো আমারই লজ্জা করবে সবার সামনে যেতে।”

মিসবাহ দুষ্টু হেসে বলল “ঘুমন্ত স্বামীর ঠোঁটে চুমু খেতে লজ্জা করলো না আর একটু স্বামীকে সঙ্গ দিতেই লজ্জা পাচ্ছো সুরজান।”

সূরা লজ্জা পায়। এই লোক অসভ্য নির্লজ্জ। তাকে লজ্জায় ফেলার পায়তারা করে সবসময়। সূরা মিসবাহর বুক থেকে মাথা তুলে তাকালো মিসবাহর দিকে। ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে বলে

“ডাক্তার সাহেব সিগারেট খান না কেন? আপনার ঠোঁট একটু বেশিই গোলাপি। রমনী দের অবাধ্য চোখ আটকে যায় এই ঠোঁটে।”

মিসবাহ ফিসফিসিয়ে বললো “তুমি ভুল জানো মেয়ে‌। তুমি কি জানো তোমার এই প্রেমিক পুরুষ নিকোটিনের ধোঁয়া দূর আকাশে উড়িয়ে দিতে পছন্দ করে। কিন্তু আমার বউজান আজ লজ্জাবতীর ভোল পাল্টে কিসের ভোল ধরলো।

“আল্লাদির ভোল ধরেছে আপনার আল্লাদি।”

সূরা আবার মাথা রাখে মিসবাহর বুকে। মিসবাহ মুচকি হেসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার সুরজান কে। সূরা ক্ষীন স্বরে আওরালো

“যে বুকে আমার শান্তি নিহিত, যে বুকের বা পাশে আমার বসবাস, সেই বুকের একটা অংশ নিকোটিনের কালো ধোঁয়া খুবলে খুবলে খাচ্ছে এটা আমি কিভাবে মেনে নিই ডাক্তার? যে হাত আমাকে আমৃত্যু আমরণ আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেই হাত নিকোটিনের কালো ধোঁয়া বেঁধে রাখবে সেটা আমি কিভাবে মেনে নিব ডাক্তার? আমি যে আমার ডাক্তার কে খুব ভালোবাসি। ভালোবাসি ডাক্তার।”

মিসবাহ বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে সূরার দিকে তাকালো। বুকে মুখ গুজে থাকায় দেখতে পেলনা সেই স্নিগ্ধ মুখোস্রি। নগ্ন বুকে ভেজা কিছুর স্পর্শে বুক ধক করে উঠলো মিসবাহর। তার প্রেয়সী কি তাকে হারানোর ভয়ে ভীত? হৃদয়জুড়ে প্রশান্তি শিহরণ অনুভব করলো মিসবাহ। এক জীবনে আর কি চাই তার? তার প্রেয়সী তাকে হারানোর ভয়ে তার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। এখন এই মুহূর্তে মরে গেলেও মিসবাহর বুঝি আফসোস থাকবেনা।

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here